মারুফ স্টাইল ফাইট- পর্ব-৫

মারুফ মতিঝিলের রাস্তা ধরে হাঁটছে..
হঠাৎ তার সামনে এক রিক্সাওয়ালা রাস্তার মোড় ঘুরতেই এক মোটর সাইকেলের সাথে একটা মাইনর সংঘর্ষ।

মোটর সাইকেল ওয়ালা মোটর সাইকেল মাটিতে ফেলে দিয়ে ঝড়ের বেগে তেড়ে এসে রিক্সাওয়ালাকে কষিয়ে এক থাপ্পর লাগলো।

রিকশা ওয়ালার দোষ একেবারে ছিলো না এখানে! মোটর সাইকেলটা রং পথে এসে মোড় নিয়েছে বলেই এই সংঘর্ষ। যেহেতু এই সব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম করে রিকশাওয়ালারাই তাই মোটর সাইকেল ওয়ালার পক্ষেই আরো কয়েকজন এগিয়ে এলো মারতে...

মারুফ সহ্য করতে পারলো না ব্যাপারটা। সেও ক্ষেপে গিয়ে দৌড়ে এলো। বলতে গেলে প্রায় উড়ে এসে শূণ্যে ঝুলে  মোটর সাইকেল ওয়ালার গালে লাগালো এক ঠাডায়ে থাপ্পর। বজ্রপাতের মত একটা ফাটাস করে একটা শব্দ হলো।
"শালা!  রাস্তায় চিপা দেখলেই গাড়ি ঢুকাইতে ইচ্ছা করে?"

মোটর সাইকেল ওয়ালা রাস্তার মাঝেই চিৎপটাং।তার এক থাপ্পরেই ঐ বেটা কুপোকাত। কিন্তু আশে পাশের রিকশাচালকেরা যারা তাকিয়ে দেখছিলো এতক্ষণ, তারা ভরসা পেয়ে চরম ক্ষেপে উঠলো। কিছু ভদ্রলোক যারা শুরু থেকে দেখছে তারা রিকশাওয়ালাদেরই সাপোর্ট করলো।

এক পর্যায়ে কলার ধরে হাতাহাতি থেকে সিরিয়াস মারামারি শুরু হয়ে গেলো।

মারুফ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। " এ কি অবস্থা! জার্সি নাই জার্সি? কে কোন দল বুঝুম কেমনে? কারে পিডামু?"

শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে, " হুর ফালা! সবডিই বিরক্তিকর! সবডিরেই সমানে থাবড়াইয়া আসি।"
চোখ মুখ বন্ধ করে মারুফ দুই হাত ঘোরাতে ঘোরাতে নেমে পড়লো।

মারুফের আন্ধামুন্ধা থাপড়ানি দেখে কয়েকজন তো মারামারি থামিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকায় আছে, "এ ভাই আপনি কার পক্ষে?"

কোনো উত্তর নাই। কে কার কথা শুনে! শুধুই ফটাশ ফটাশ শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। যে মারুফকে প্রশ্ন করতে গিয়েছিলো সে দূরে দাঁড়িয়ে গালে হাত বোলাচ্ছে।
তার ডান গালে এমন থাপ্পর খেয়েছে যে বাম গাল অবশ হয়ে গিয়েছে।

এভাবে কতক্ষন চলেছে কে জানে। মারুফের যখন জ্ঞান ফিরেছে তখন প্রায় রাত। সে আইডিয়াল স্কুলের বেঞ্চে শোয়া। আন্ধামুন্ধা ঘুরতে ঘুরতে নাকের মধ্যে কার যেন  কনুইয়ের গুঁতা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।

মারুফ নাকে হাত বোলাচ্ছে। নাকের অর্ধেক তো মনে হয় ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তবে তার মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। অন্তত ৪০/৫০ টাকে তো সে একাই থাপড়িয়েছে। নিজেকে তার এই মুহূর্তে লেজেন্ড মনে হচ্ছে। ঐতিহাসিক মাইরপিট যাকে বলে। আহহ!!!

কমলাপুরের ফুটওভার ব্রিজ হয়ে বাড়ির পথে ফিরছে। খাওয়া দাওয়া একদমই হয় নি।  ক্ষিদে যে পেয়েছে সেটা ব্যাথার কারণে বুঝতে পারছে না।

ব্রিজের উপরে সারি সারি অনেক মানুষ ঘুমাচ্ছে। এর মধ্যে কেবল একটি টোকাই টাইপের ছেলে পেপারের উপরে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে...

এইসব বাচ্চাদের সাথে কিভাবে জানি মারুফের সখ্যতা হয়ে যায়। মারুফ তার পাশে বসার জন্য পেপারটা টান দিতেই পেপার ছিঁড়ে হাতে চলে এলো!

অবশ্য তার মধ্যেই আরাম করে বসে গেলো।
-" কিরে বেটা এরিস্টটল পোজ দিয়া বইসা কি ভাবোস? দেশের অর্থনীতি আর বাণিজ্য নিয়া ব্যাপক চিন্তায় আছোস মনে হয়? খবরের কাগজেই দেখি শুইয়া পড়ছোস!!"

ছেলেটা একবার  সন্দেহের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আরেকবার ছিঁড়া পত্রিকার কাগজের দিকে তাকালো।

_"খবরের কাগজ তো ছিঁড়া ফেলছেন। শুমু কেমনে? পাছার তল থেকে কাগজ তো আর নাই।"

_"ওরে আমার পাছা রে! আচ্ছা যা, আমি কোনোদিন আমেরিকা গেলে তোর এই মহা মূল্যবান পাছার জন্য টাইমস ম্যাগাজিনের কাগজ নিয়া আসবো। তখন তুই খালি দেশের ক্যান, আন্তর্জাতিক ব্যাবসা বাণিজ্য আর অর্থনীতির উপর পাছা রেখে ঘুমাবি"

_"আপনের নাকডি ফাটায়া আলু বানাইছে কে? মনে হইতেছে কাইট্যা খাইয়া ঘুম যাই!"

_"ক্যান। আজ খানা পিনা হয় নাই?"
প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতেই বিরক্ত হয়ে ছেলেটা উত্তর দিলো..
_ "নাহ!.... হোটেলের মুরগী ধইরা দিতে কইছে জবাইয়ের জন্য। একটাও ধরতে ফারি নাই আইজ। তাই খাবার ও দেয় নাই।"

_"তোর আব্বা-আম্মা, ভাই-বোন কই?"

ছেলেটা মাথার পিছনে হাত দিয়ে উদাস হয়ে উত্তর দিলো
_"জানি নাহ!"

মারুফ কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ছেলেটির দিকে।
"তোর নাম কি?"

-"ফরিদ"

মারুফ পকেট থেকে ১৪০ টাকা বের করে দিয়ে বললো...
"যা দুই টোবলা তেহারী নিয়ে আয়। দুইভাই মিল্লা খাই। আমারো আজ খাওয়া হয় নাই। শোন!!! তোর এই ভাই থাকতে তোর না খাইয়া ঘুম যাইতে হইবো না! প্রতিদিন এই পথে আসার সময় তোর আর আমার জন্য প্রতিদিন দুই টোবলা তেহারী নিয়া আসবো। আর তোর পাছার জন্য থাকবো ডেইলি স্টার!"

দুজনই খেতে বসেছে...
মারুফ তার প্যাকেট থেকে কিছু খাবার ছেলেটির প্যাকেটে ঢেলে দিচ্ছে। ছেলেটি আরাম করে খাচ্ছে। মারুফ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, আর রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। বার বার চোখ ভিজে উঠছে কেনো?

এভাবে টোকাই বাচ্চাদের সাথে বসে খাওয়া তো তার জন্যে প্রথম নয়। আগেও অনেকবার খেয়েছে। ইনফেক্ট তার মতে এটা কোনো বড় ব্যাপার তো নয়। এই ধরণের কাজ যারা করে তারা কি মহৎ ধরণের কিছু? মোটেও না! এটা তো যে কেউ করতে পারে!! ইভেন তার মত অতি সাধারণ একজন ও তো করছে... তবে অন্যেরা কেনো করবে না?

পৃথিবীতে মমতাটা আসলে কাকে দেখাতে হবে,  আর কার জন্য সেটা দেখাবার আরো অনেকেই আছে, তা মানুষ যেদিন বুঝবে সেদিন এই কমলাপুরের মত এই ফুটপাত গুলিও আনন্দ অশ্রু ঝড়ানো ডাইনিং টেবিলে পরিণত হবে।

ভদ্র সমাজ জিনিসটা কি মারুফ কোনোদিন বুঝে উঠতে পারে নি! ভালো ভালো জামা কাপড় আর স্যুট-টাই পড়া মানুষ গুলি এইসব বাচ্চাদের সাথে গা লাগতেই যখন, গা  ঘিনঘিন করে ওঠে, অকথ্য ভাষায় হুংকার দিয়ে ওঠে, ইফতারি কিনতে গিয়ে গরীব বাচ্চাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়, অথচ তারা নাকি না খেয়ে রোজা রাখবে, ক্ষুধার্ত মানুষের দুঃখ বুঝবে, তখন সার্কাস্টিক মারুফ সেইসব ভদ্র মানুষদের সাথে কিছুটা অভদ্র হওয়াতে মোটেও দোষের কিছু দেখে না!

...next page>>>> c:

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top