পাঠ -৭ মেহমান
মেঝের দিকে তাকিয়ে হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেলো মারুফের। সারা মেঝে জুড়ে জায়গায় জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধা।
সোফার এককোণে বুড়ো মতন একটা লোক চোখ মুখ খিঁচে পড়ে আছে। এ কি সর্বনাশ!! কি হয়েছে লোকটার, রক্তবমি করেছে নাকি!
নড়াচড়া তো একদমই নেই। এখনো বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে? কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না! ঠোঁটের কোণে এখনো রক্ত লেগে আছে। সোফার আনাচে কানাচেও রক্তে লাল হয়ে আছে। এতো রক্ত ক্ষরণে এরকম ঘাটের মরা তো বাঁচার কথা না।
মারুফ পুরো টেনশনে পড়ে গেলো..
মার্ডার কেস টেস খেয়ে ফেলবে কি না কে জানে! এখন কি করা উচিত? ডাক্তার ডাকবে? ডাক্তার যদি বলে, এইটা পুলিশ কেইস, পুলিশ না আসলে চিকিৎসা শুরু করা যাবে না। পুলিশ যদি বলে আপনি থানায় চলুন, নাভির দুই ইঞ্চি নীচে রোলারের গুঁতা না খেলে আসল কথা পেট থেকে বের হবে না! তখন কি হবে?
এলা কি মুসিবত। মরে গিয়ে থাকলে তো ফেলে দেওয়া উচিত। ফেলবে কোথায়?
ঘরে ইঁদুর টিদুর মরলে ডাস্টবিনে ফেলা দেয়া যায়। এই বুড়ো তো আর ইঁদুর না, মানুষ! একে তো ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া যায় না!
টেনশনে সব উল্টাপাল্টা লাগছে।
মানুষ মরলে কি করতে হয় তা মারুফের আর মাথায় আসছে না, লজিক এলোমেলো হয়ে গেছে। মৃত সৎকার হিসেবে একটা ম্যাচ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলে হয় না? পট পট করে ফুটতে ফুটতে জ্বলুক!
নাকি মাটিতে খাড়া করে গাছের মত পুতে দেয়? দৃশ্যটা মনে মনে চিন্তা করছে, ছোটো একটা গর্তে একজনকে পোঁতা হচ্ছে। গর্ত বেশ ছোট হয়েছে। মুরগী ঢোকার মত ছোট জায়গা!
লোকটার অর্ধেক শরীর ঢুকে আর ঢুকছেনা। আহা! কি অবস্থা... দুজন দুই পাশ থেকে ঘাড়ে পাড়া দিয়ে নীচে নামাচ্ছে, সহজ কথায়, কেউ একজন বলছে, "এতো সময় লাগছে কেন, জাস্ট গুজে দে!"
কথামত, বাকিরা মাটিতে দলামোচড়া করে ঠেং দিয়ে গুজে দিচ্ছে।
তবু মাথা তো কিছুতে ঢুকছেনা। এখন? মাথাটা কি বাদ দিয়ে দেয়া উচিত? মাথাটা কি বটি দিয়ে ছেঁটে দিয়ে পাশে পুঁতে দেয়া যায় না? নাকি ঘাড়ে একটা গর্ত করে টিপে ভিতরে ঢুকিয়ে দেবে......
ছি ছি! এসব কি ভাবছে সে। মৃত্যু নিয়ে এসব আজে বাজে জিনিস ভাবা ঠিকনা। মাথার নাই ঠিক!
কি করা যায় তাহলে...
"এই যে- ভাই? এই যে! বাঁইচ্চা থাকলে জবাব দেন। এই যে....
এই, বাই সাব?? ঐত্তো ... এই যে, বুড়া লোক, আব্বে ঐ মোরব্বা!!"
ঠিক তখনই লোকটা ধরমর করে উঠলো,
"এ.. ক্যাঁ!... কি!"
মুরব্বির চোখে মুখে আতংক!
"ওহ! বেঁচে আছেন তালে, আমি তো ভাবছি ফিউজ হয়ে গেছেন। লুঙ্গি ঠিক করে গুজে বসেন.. আপনার ভিসুভিয়াস দেখা যায়!".
লোকটা তখনও স্বাভাবিক হতে পারে নাই পুরোপুরি, ঘুমের ঠেলায় এলোমেলো হয়ে আছে মাথা!
"এইগুলি কি চাচা পানের পিক? তাইতো বলি... শালার..!!! তো.. গ্রাম থেকে আসছেন? আপনাকে তো আগে দেখিনি?"
লোকটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে,
" ও তুই মারুইফফা!!! এত্তোরো বড় হইছোস, তোরে তো চিনতেই পারি নাই। ডরায় গেছিলাম, ব্যাডা লোকের মত হইছোস তুই। "
মারুফ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে,
"আরেহহ! তুই তোকারি করতেছেন কেন? হালায়, দেখছোস কান্ড! এখনো তার পরিচয় জানি না, হালার মোরব্বায় কয় আমারে- 'মারুইফফ্যা'?"
লোকটা অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে হো হো করে হেসে উঠলেন, " তুই তো আগের মতই রইছোস রে মারুইফ্যা! হা হা হা! আমি তোর বড় চাচা ফরিদুল! সেই ছোট্ট বেলায় তোর বাপে আমাদের বাড়ি নিয়ে গেছিলো তোরে। কি যে বিয়াদপ ছিলি তুই।"
মারুফ চোখ ছোটো ছোট করে তাকিয়ে থাকলো।
" তোরে আমি কোলে নিয়ে বিছানায় বসায়া কইলাম, আব্বা টিবি দেখপা?
তুই কিছুক্ষণ চুপ কইরা রইলি। তারপর বিছানাত্তে নাইমা আচমকা আমার দিক চাইয়া কইলই- 'তুই টিবি দেখ'। বইলাই, জোড়ে হাঁটা দিলি। আমি তো অবাক, এই পিচ্চি কি কইলো এইডা?
তারপর বাড়ির বাইরে গিয়া তোর
সে কি কান্না! কেন যে তুই এমুন কইরা কানছিলি আমি এহনো জানি না বাজান!
কিন্তু তোর ঐ কান্নার সিন দেইখ্যা কইলজা আমার পুইড়া গেলো তেজপাতা হইয়া গেলো। তোর সেই মায়াভরা চউক্ষের দিক একবার চাইলে পাষাণের বুকও ফাইটা ছাড় খার হইয়া যাইতো বাজান!"
মারুফ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ফরিদুল চাচা লুঙ্গির মধ্যে চোখ মুছছেন। কি আশ্চর্য! গ্রামের মানুষ কি আসলেই এতো ভালো হয়? তার সম্বন্ধে কেউ এতো দরদ দিয়ে কথা বলছে!
" ফকিরুল চাচা! আপনি বসেন, আমি আপনার জন্য নাস্তা নিয়ে আসি। আমার কথায় কিছু মনে নেবেন না চাচা!"
" বাবা! আমার নাম ফরিদুল!"
" চাচা! আপনি যেই গরীবুলই হন না কেন, আপনি আমার মুরব্বি! আপনার মত দরদ দিয়া আমার বন্ধু শরীফুলও কোনোদিন আমার নামে ভালো কথা কয় নাই। আপনি বসেন!"
মারুফের মনটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেছে। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে পিছনে ফিরে তাকালো আরেকবার, চাচা লুঙ্গির মধ্যে আবারো চোখ মুছছেন।
চাচার ভিসুভিয়াস দেখার আগেই সে চোখ ফিরিয়ে নিলো, "আহা! বুড়ো মানুষ টা! "
next page>>>>
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top