গার্লফ্রেন্ড -পর্ব:৩

সেই মারুফেরও কিনা একদিন গার্লফ্রেন্ড হয়ে গেলো। তার মত নিরুৎসাহিত মানুষ কিভাবে একটা মেয়ের প্রতি হঠাৎ উৎসাহী হয়ে উঠলো সেটাও এক চমকপ্রদ গল্প।

টি.এস.সি'র চত্ত্বরে এক ঝালমুড়ি ওয়ালার কাছে মেয়েটি প্রতিদিন ঝালমুড়ি খায়। মেয়েটার কথা বার্তা আচরণে কোনো আড়ষ্টতা নেই।

অনেক দূর থেকেও তার রিনরিনে গলা শোনা যায়, " মাম্মা ঝাল আরেকটু বাড়ায়ে দেন না!  আরো দশ টাকার দেন,  বোম্বাই মরিচ গুলি  দিয়ে দিন  পুরোটা।"

মারুফ প্রতিদিন এখানে এসে তার দিকে অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা হাসলে সেও হাসে, মেয়েটা রাগ হলে সেও ঠোঁট দুটি জড়ো করে রাগ হয়।

সত্যি সত্যি রাগ অবশ্য হতে পারে না। ফিক করে হেসে দেয়।

মেয়েটার সাথে কথা বলার কথা চিন্তা করলেই অবশ্য তার হাত পা বুক থরথর করে কাঁপতে থাকে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।

অসহ্যকর সৌন্দর্য বলে যে একটা কথা প্রচলিত আছে তা এই মেয়েটার ক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে খাটে, মারুফ কেমন যেনো আনমনে হয়ে যায় মেয়েটাকে দেখলেই। এমনি কাউকে দেখে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, বাজিলো বুকে সুখের মত ব্যাথা! 

পাতলা অভিমানি ঠোঁট তার। কি জানি কি কারণে মারুফের মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয়, হঠাৎ করে দৌড় দিয়ে কিছু না বলেই মেয়েটার ঠোঁটে চাকাম করে একটা কিস করে দেয়।

অবশ্য এরকম কিছু চিন্তা মনে আসলেই সে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, কন্ট্রোল মারুফ! কন্ট্রোল! এগুলি আনরিয়েল চিন্তা ভাবনা।  ফ্যান্টাসির ব্যাপার! প্রত্যেকেরই একটা ডার্ক ফ্যান্টাসির জগত থাকে। শুধু ডার্কনেসের মাত্রাটা ভিন্ন।

মেয়েটি এদিক উদিক তাকিয়ে দেখছে, ঝালমুড়ি ওয়ালা আজ আসেনি। কালও আসেনি। কি আশ্চর্য। 

মারুফের বুক হাতুড়ির মত ঢাকাস ঢাকাস বাড়ি খাচ্ছে। তার হৃদপিন্ড বুঝি লাফিয়ে বের হয়ে যাবে। কারণ এই মাত্র সে মেয়েটির সাথে কথা বলার ডিসিশন নিয়েছে।

কিন্তু হৃদপিন্ডের লাফালাফি তো থামছেনা। এ তো চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে, কি মুশকিল!

মেয়েটা ঘুরে চলে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনই
_ "এই যে শুনুন? ইয়ে... ঝালমুড়ি ওয়ালা তো..... দুদিন যাবৎ অসুস্থ।"

মেয়েটা মাথা ঘুরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো।  তার চোখে মুখে বিস্ময়। নিজেকে সামলে নিয়ে একটু গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
_"আপনি কিভাবে জানেন আমি ঝালমুড়ি ওয়ালাকে খুঁজছি?"
_"মানে..আপনি তো প্রতিদিন ওনার কাছ থেকেই ঝালমুড়ি খান, তাই বলছিলাম।"
_" উনি অসুস্থ সে কথা আপনি কি করে জানেন? আপনি কি ওনার কিছু হন?"
_"জী না,আপনি কাল ঝালমুড়ি না পেয়ে ফিরে গিয়েছেন, তাই আমি ওনার খোঁজ করতে বাড়ি গিয়েছিলাম। দেখি উনি অনেক অসুস্থ। তাই হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছি।"

_"আমি ঝালমুড়ি খেতে পারিনি দেখে আপনি ঝালমুড়ি ওয়ালার বাড়িতে চলে গেলেন? অদ্ভুত ব্যাপার তো।"
কথাটা বলেই মেয়েটি ঘুরে চলে যেতে লাগলো।

মারুফ অবাক, কথার মাঝখানে উলটা হাটা দিলো কেন? মারুফও মেয়েটার পাশে পাশে হাটতে লাগলো।

_" কি আশ্চর্য!  আপনি আমাকে ফলো করছেন কেনো?"

_" আপনাকে একটা কথা বলি? "

মেয়েটি চোখ ছোটো ছোটো করে সন্দেহের চোখে তাকালো
_ " কি কথা? "

_ "দেখুন আপনি অটোমান সম্রাজ্যের আর্কিটেক্ট সিনান নন, আর আমিও মিথোসোল শহরের লেখক আত্রিকন দস্তুর নই, সুতরাং আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হতেই পারে।
চলুন না একটু হাটি? সামনে দোকানে গিয়ে চা চাবাই?"

মেয়েটি ভ্যাবাচেকা খেয়ে থেমে গেলো, তারপর এক মুহুর্ত পর আবার মারুফকে অনুসরণ করতে লাগলো। ছেলেটি তাকে বন্ধুত্বের অফার দিলো, কিন্তু তার কাছে অনুমতি চাইলো না? আসলে এরকম একটা প্রস্তাবের উত্তর কিভাবে মুখের উপর 'না' বলে দেয়া যায়, তার মাথায় এলো না।

ছেলেটি তাকে অনুসরণ করছিলো, এখন সে ছেলেটিকে অনুসরণ করে হাটছে? কি আশ্চর্য!

_"আচ্ছা আপনি সত্যিই ঝালমুড়ি ওয়ালার বাসায় গিয়েছিলেন?"

মারুফ হাসলো, কিছু বললো না। ব্যাগ এর চেইন খুলে একটা প্যাকেট বের করে দিলো।
_ "এই নিন! আপনার ঝালমুড়ি!"
মেয়েটি চোখ বড় বড় করে প্যাকেটের তাকিয়ে হাত বাড়ালো...

_"আপনি তো ওনার ঝালমুড়ি ছাড়া খান না! এটা খেয়ে দেখুন, ওনার কাছ থেকেই বানিয়ে এনেছি! আর এই হচ্ছে হাসপাতালের কাগজ, তাকে যে কেবিনে ভর্তি করিয়ে এসেছি!"

_"এই যে দেখুন, আপনি মানুষটা হয়তো ভালোই। কিন্তু.. আমি কিন্তু এখনো বন্ধুত্বের অফার গ্রহণ করেছি কিনা বলিনি।"

মারুফ হো হো হেসে বললো,
_" আগে ঝালমুড়িটা খান, তারপর  হ্যাঁ না কিছু একটা বলে দেবেন। সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বানিয়ে এনেছি আপনার জন্য। মামাকে বলেছি,  মামা বোম্বাই মরিচ দিয়ে ঝাল দিয়ে ফাটায়ে দেন।"

_" 'ফাটায়ে দেন' মানে??

_ " মানে ফাটায়ে ঝাল দেন, সবুজ সবুজ বোম্বায় মরিচ দিয়ে এমনে কঁচলায়ে দেন যাতে, খাওয়ার সাথে মাথা ঝালের চোটে ভোটাস করে বাস্ট হয়ে যায়"

মেয়েটি আৎকে উঠলো। তারপর খিল খিল করে হাসতে শুরু করে দিলো।
হাসি থেমে আসতেই জিজ্ঞাসা করলো সে..
"কেনো করছেন, এত্তোসব?"

মারুফ একটি ধীর্ঘশ্বাস ফেলে, মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
_" আমার এ বারিবাহে রুধির নির্যাস,
ইরাবানে বাঁধিবো বলে ভানুর অবয়ব!"

মেয়েটি ভ্রু কোঁচকালো,
_"এর মানে কি?
এ মা! আপনি কবি টবি নাকি? কবি টবি আমি দুই চক্ষে দেখতে পারি না। বিশেষ করে আধুনিক কবি, ছন্দ ছাড়া কবিতা আমার অসহ্য। ছন্দহীন কবিতা আমার কাছে গন্ধহীন বডি স্প্রের মত লাগে!"

_"জী না! আমি মোটেই কবি টবি না! তবে প্রচন্ড ভালোলাগার কিছু মানুষকে দেখে আকাশ থেকে বাজ পড়ার মত মাথার উপর কতগুলি লাইন পটাশ পটাশ করে পড়ে। সেগুলিকে আওড়াই, আর ভাবতে থাকি, এই লাইনগুলি কেনো এলো মাথায়, এর অর্থ কি? "

_"কি! ঐ লাইন দুটির অর্থ?"

_"মানে টা বললে অর্থটা বোঝা যাবে তবে সাহিত্যটা ভেঙে যাবে। তবু বলছি, অর্থ হচ্ছে, "আমার এ মেঘো মালায় রক্তের দোলা, সাগরে বাঁধবো বলে সূর্যের আকার"

মেয়েটি খুব আস্তে করে উত্তর দিলো।
_"ইন্টারেস্টিং"
তারপর একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর হয়ে গেলো।

_"আচ্ছা, আপনার নামটা তো জানা হলো না, আমি মারুফ, আপনি? "

মেয়েটি মারুফের একেবারে চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো, "অর্নিশা, আমি অর্নিশা!"

মারুফ বললো, "অর্নিশা ঐ লোকের ঝালমুড়ি বেশি খাবেন না!"

_" কেন বলুন তো? "
_"  ঐ লোকের পাছায় বিষফোঁড়া হইছে। "

অর্নিশা থতমত খেয়ে গেলো,
"মানে? কি বলছেন এসব?"

মারুফ দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো, " ধরেন,  সে এক একটা কাস্টমার কে ঝালমুড়ি খাওয়ায়, আর একটু ফাঁকা হওয়ায় অবসর পাইলেই পাছায় হাত দিয়ে ফোঁড়া টিপা টিপি করে! তাহলে সেই হাতে বানানো ঝাল মুড়ি খাওয়া কি ঠিক হবে????"

অর্নিশার হাত থেকে মুড়ির প্যাকেট পড়ে গেলো। গলা দিয়ে যা পেটে গিয়েছে, তার সবটাই একই পথে ফিরে আসার জন্য পেটের ভিতরে দলা পাকাচ্ছে। অবশ্য মারুফ আর না দাঁড়িয়ে আগেই হাটা দিয়েছে।

নাহ! ভালোবাসার মানুষের সাথেও বিটলামি করার সুযোগ টাও সে ছাড়ে নাই।  এমনকি তাকে নিয়ে লিখতে বসে রাইটারও হতাশ হয়ে এদিক ওদিক মাথা দোলায়! এরে দিয়ে কি হবে?

কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই মেয়েটার সাথেই তার খুব শক্তিশালী একটা ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হয়েছিল। আর এই মেয়েটা তাকে পাগলের মত ভালোবেসেছিলো একদিন। তাকে পাবার জন্য অর্নিশার বাবার সাথে মুখোমুখি হলো একদিন, সেও এক কঠিন যুদ্ধ....

Next page>>>>>

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top