১২


আমি ঠিক বুঝলাম না, সজীবের সাথে ওর এত কি? সজীবের সাথে এতক্ষণ কথা বলার কি আছে? ও কি ইচ্ছা করে এমন করতেছে? নিশ্চয়ই ইচ্ছা করে করতেছে। কিন্তু এসব করতে গিয়ে সজীব যে ওকে ঝামেলায় ফেলবে, এটা কি ও বুঝে? আমাকে এভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে বারবার কণার দিকে তাকাতে দেখে ইমরান দাঁত খিঁচে বলল,
❝বেকুবের মত তাকায় না থেকে ওরে টাইনা আন!❞
❝সজীব যদি ঝামেলা করে তখন?❞
❝তুই কি সজীবকে ভয় পাস?❞
❝ভয় না। আসলে কণা পরে আমার সাথে ঝগড়া করবে। এমনিতেই ঝগড়া লেগে আছে। সজীব শালার কলার ধরে মারতে ইচ্ছা করতেছে!❞
জাহিদ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ালো।
❝মাথা গরম করিস কেন? ও ইচ্ছা করে তোকে জেলাস বানাচ্ছে। আবার আইসা পড়ব এখানে❞

সত্যি সত্যি কণা একটু পরে হেসে হেসে সজীবকে বিদায় দিয়ে আমাদের দিকে  এগিয়ে এসে জাহিদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
❝কাদের স্যারের হোমওয়ার্ক করছিস? স্যার কিন্তু অপমান করবে❞
❝না করি নাই। এরকম প্যাচালের জিনিস কেন দেয়? কোন বই ঘাঁটব?❞
❝কেন? ইংলিশ লিটারেচার এর মিডল এইজের হিস্ট্রি ঘাটবি। ওখানেই সব থাকবে❞

❝তুমি করে এনেছ?❞
ওদের দুজনের কথার মাঝে বাম হাত ঢুকিয়ে দেয়ায় কণা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে আমার মুখদর্শন করল, তারপর দৃষ্টি সরিয়ে জাহিদকে বলল,
❝যার যার কাজ যে যে করে আন। আমি কারো চাকর না যে খেটে খুটে সব বের করে রেডিমেড পড়াশোনা পরিবেশন করব! যদি সম্ভব হয়, ঐ রূপাকে বলিস। ঐ মেয়েগুলো তোদের সব করে দিবে। আমি না❞

কণা হনহন করে আমার পেছনে ফেলে চলে গেল। আমি জানি, কণাই আমাকে হোম ওয়ার্ক করে দিবে, এবং ও ই করবে। মেয়েটা উপরে উপরে যতই রাগ দেখাক, ওর ভেতরটা মাখনের মত নরম, আহ! এখন কেবল উপরের শক্ত খোলস ছাড়িয়ে মাখন পর্যন্ত হাত নিতে হবে।

কণা মহসিন হলের মাঠের পাশের টং এ গিয়ে নুডলস খাচ্ছে। এই মামার নুডলস বড় বিখ্যাত। সাথে দুপাশে নীনা আর স্নিগ্ধাও আছে। তিন জন মিলে নিশ্চয়ই আমার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করার কার্য সাধন করছে। আমি এসে যখন কণার চুলে হাত দিলাম, তখন কণা নুডুলসের বাটি হাতে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আমার হত ছুড়ে ফেলল।
❝ফাজলামোর যায়গা পাস না তুই? আমার চুলে হাত দিস কেন?❞
❝ওসব তোর চুল না, আমার ডার্লিং এর। আমার ডার্লিং এর চুলে আমি হাত দিব, তোর কি?❞
❝চড় মেরে দাঁত ফেলে দেব তোর!❞

কণা রেগে চলে যাওয়ার চেষ্টা চালাতেই আমি ওর হাত ধরে আটকে আবার বেঞ্চে বসিয়ে দিলাম। স্নিগ্ধা আর নীনা বরাবরের মত আমাদের কর্মকান্ডের দর্শক হয়, আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমি জোর করে ওর কাছ থেকে নুডুলস এর বাটি নিয়ে ওর এঁটো করা চামচ দিয়ে খাচ্ছি। কণা নিঃসন্দেহে এই চামচ আর ধরবে না, এমনকি খাবেও না। ওর খাবারটাই মাটি করে দিয়েছি আমি। তবুও আমি খাচ্ছি আর ও আমাকে দেখছে। খাওয়া শেষে মামাকে বলে বিল বাকি রেখে কণাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি ভেতরের দিকে। ওদিকটায় ছেলেদের হল। কণা জেদ ধরে পা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে হাঁটছে। আকাশের পশ্চিম দিকে সূর্য বেশ অনেকটুকু হেলে পড়েছে। আসরের আজানের আর মিনিট চল্লিশেক বাকি। আমি একবার সূর্যের দিকে ওর দিকে চাইলাম। মুখটা পাথরের মত করে রেখেছে। ভীষণ ইচ্ছা করছে গভীর চুম্বনে ঐ পাথর গুড়িয়ে তা থেকে পানি ঝরাই। সেটা অসম্ভব। এটা পাব্লিক প্লেস। তার উপর আমি প্রেমিক হিসেবে যতটা সাহস দেখাই, ততটাই ভীতু। এই কথা এই প্রথম নিজের কাছে স্বীকার করলাম। এর আগে নিজের কাছে দূরে থাক, অন্যের কাছেও এমনটা স্বীকার করিনি!

কণাকে নিয়ে মোড়ে এনে আঁজলা ভরে ওর মুখখানা উঁচু করে ধরলাম।
❝এইটুকুন শরীরে এত রাগ আর অভিমান কেন? সারাক্ষণ রাগে এমন ফুঁসতে থাকো কেন? আমার বুঝি ভালো লাগে? আচ্ছা সরি, আর হবে না। এই যে, কান ধরছি!❞

কণা এবার গললো না, বরং বুকে হাত বেঁধে ভাব নিয়ে বলল,
❝কান ধরে উঠবস করো❞
আমি জিভ কাটলাম।
❝ছিঃ ছিঃ, কি বলো এসব? উঠবস করলে এই ক্যাম্পাসে মুখ দেখাতে পারব? তার চেয়ে বলো তোমাকে একটা কিস দেই?❞
কণা দুম করে বুকে ধাক্কা মেরে চোখ বড় বড় করে বলল,
❝অসভ্য! এসব করলে খুব মুখ দেখাতে পারবা, না?❞
আমি হেসে ওর হাত ধরে টেনে আমার বুকে চেপে ধরলাম। কণা হেসে ফেলল। আমি চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে বললাম,
❝আজ ভালোবাসা দিবসের শেষ প্রহরে এসে আমার কপালে ভালোবাসা জুটছে! সারাদিন তো মনে হলো, আজ বুঝি বিশ্ব করলা দিবস!❞
❝করলা দিবস হবে কেন?❞
❝তোমার মুখ খানা যে করলার মত করে রেখেছিলে, তাই!❞

কণাকে নিয়ে দুষ্টুমি করতে করতে আমাদের ভবনের দিকে এগিয়ে আসলাম। স্নিগ্ধা আর নীনা সেখানে এসে সবার সাথে জয়েনও করেছে। নীনা কেমন করে যেন আমাদের দেখছে, যেন আমাদের দুজনকে চ্যালাকাঠ দিয়ে পিটিয়ে আলাদা করবে! আমি নিশ্চিত, কণাকে সব ডাইনীবিদ্যা, নাট্যবিদ্যা এই মেয়ে দিচ্ছে। থাকে না প্রতিটা মেয়েদের সার্কেলে একটা করে কূটনী? এই নীনা হচ্ছে তেমন একজন, আমি নিশ্চিত। তবুও আমার চিন্তা নেই। কণাকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হয়, তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।

দেখতে দেখতে আমরা শেষ বিকেলে বাসায় রওনা করেছি। বাসায় যখন ঢুকছি, তখন ঘণ্টার কাঁটা আটটার ঘরের মাঝামাঝি এসেছে। আমি আমার ঘরে পা রাখতে যাবো, ওমনি পিতা মহোদোয়ের উদয় হলো।
❝এত রাত হলো কেন তোর আসতে?❞
❝আব্বু ক্লাস ছিল, রাস্তায় জ্যাম ছিল❞
❝নাকি ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসা করতে গিয়েছিলি?❞

আমি চমকে উঠলেও নিজের সমস্ত অভিনয় প্রতিভার ব্যবহার করে প্রতিবাদ করলাম।
❝কি যে বলেন না আব্বু! আমি একদম এসব করি না!❞

আব্বু কিছু না বলে চলে গেলেন। ইশ, উনি যদি সত্যটা জানত! হয়ত জানে, তাইই জিজ্ঞাসা করল! কিন্তু আমি তো বেফাঁস কোনো কাজ করিনি! তবে? শার্ট খুলে লুঙ্গি পরে প্যান্টও বদলে নিলাম। সেসব হ্যাঙারে রেখে জানালার কাছে যখন গেলাম, তখন আবার নিচের তিন তলার জানালায় চোখ পড়ল। সেখানে তুতুন হেলান দিয়ে বই পড়ছে। বোধহয় পরীক্ষা চলে ওর। তখনই আমার খেয়াল হলো, তুতুনকে অনেক দিন দেখি না। মাঝে মাঝে ছাদে উঠলে অন্যান্য পিচ্চিদের চোখে পড়ে, কিন্তু তুতুন আসে না। রাস্তায়ও ওকে দেখি না। আগে সামনের মুদির দোকানে চিপ্স কিংবা আইসক্রিম কিনতে যেত। এখন আর সেখানেই দেখি না। মেয়েটা ভালো আছে তো? থাকবে হয়ত, ভালোই তো থাকবে। ঐ বয়সটাই তো ভালো থাকার।

আমি আনমনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তুতুনকে দেখে কেন আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলব? হয়ত অতীতের স্মৃতি মনে পড়ছে বলে! যাক বাবা, এখনো খারাপ নেই আমি। অনেক ভালো আছি! তবুও তুতুনকে দেখছি আমি। এই পিচ্চিকে দেখতে ভালো লাগে কেন? এত পিচ্চি একটা মেয়ে, কি নরম, কি বোকা, কি ভীতু! কেমন মায়া মায়া একটা মুখ। যে জানালাটা দেখছি, ওটা কি ওর ঘরের জানালা? হবে হয়ত।

আমি জানালার পাশ থেকে সরে এসে গোসলে ঢুকলাম। বালতি পানিতে পূর্ণ করে মাথায় ঝপাৎ ঝপাৎ পানি ঢালছি। প্রচুর পানি মাথায় দেয়ায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আর তখনই চোখের সামনে তুতুনের মুখ খানা ভেসে উঠল! আমি দ্রুত হাত দিয়ে মুখের পানি মুছে চোখ খুললাম। এমন হলো কেন?! আশ্চর্য, তুতুনকে একটু দেখলাম বলে?! অদ্ভুত খুব! এই পিচ্চিকে মেয়েকে নিয়ে কেন ভাবছি আমি?

শরীরে সাবান ঘষতে ঘষতে ভাবছি, এমন তো না যে তুতুনের সাথে কখনো ফ্লার্ট করার চেষ্টা করেছি, কিংবা ইচ্ছা করেছে। বরং ওকে কোনো ভুল করতে দেখলে বেশি করে বকে দেই। এর বেশি কিছু তো নেই! অবশ্য মেয়েটা অনেকটা আদুরে ভীতু বিড়ালের মত। আমাকে দেখলেই ভয়ে পালাই পালাই করে, আর আমারও ওকে দৌড়ামি দিতে লোভ জাগে। থাকে কিছু বাচ্চা পোলাপান যাদের দেখলেই একটু আদরের মত করে মারতে ইচ্ছা করে? তুতুন ঠিক তেমন।

ধুর! বেশি ভাবছি। এরচেয়ে পড়ার দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার। কিছু কাজ না করলে এই সেমিস্টারে ডাব্বা মারব। কণা তখন আবার দেখা যাবে আমাকে কোনো হোমওয়ার্কই করে দিবে না। গার্লফ্রেন্ড থেকে সার্ভিস পেতে চাইলেও তো একটু পড়া লাগবে! অবশ্য টপার হলেও একটা সুবিধা আছে, সুন্দরীরা কাছে ঘেঁষে। এটাও সুন্দরীদের কাছে ঘেঁষার একটা সুযোগ, হা হা হা!

.......................

অনেক দিন পর আজ ছাদে উঠলাম। মাঝে কাপড় চোপড় নাড়তে এসেছিলাম, তাও খুব বেশি সময়ের জন্য না। মুমু আর ঝুমু বেশ কয়েকদিন এসেছিল, তবে সুবিধা করতে পারেনি। একে তো জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষা চলছে যার ব্যাপারে আমি জীবন মরণ সিরিয়াস, তার উপর গেলে আম্মুর বকা খেতে হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিশ্চিত ছাদে গেলে ঐ অশুভ ভাইয়াটার সামনে পড়ব। তখন সে আঙুল তুলে শাসিয়ে বলবে, ছাদে কি? ছাদে কি হ্যাঁ?  পরীক্ষা চলে না? বাসায় যাও! তারপর আমি মুড অফ করে বাসায় এসে জেলখানার কয়েদীদের মত কান্নাকাটি করব, কোনো পড়া হবে না। বিলাসিতা করে সময় নষ্টের মত সময় হাতে নেই আমার। একারণে এতদিন পর ছাদে উঠলাম।

রিটেন পরীক্ষা শেষ। সামনে প্রেক্টিক্যাল পরীক্ষা। কিছুদিন ছুটি পেয়েছি, তাই লম্বা সময়ের জন্য রিফ্রেশ হতে এসেছি। আজ ঝুমু মুমু কেউ আসেনি, ওদের ম্যাম এসেছে। আমি একা একাই ছাদে এসে চুপচাপ বসে আছি, আর একটু পর পর চশমা ঠেলে দিচ্ছি। মার্চ মাস প্রায় শেষ, গরমও পড়তে শুরু করেছে। আমি চুল গুলো দুই ঝুঁটি করে রেখেছি। আজকের আকাশে অনেক রোদ, তবে ছাদের যে কোণায় একটু উঁচু যায়গা আছে, সেখানে রোদ লাগছে না। আমি চুপচাপ আকাশ দেখি। আজকাল সারাক্ষণ বইয়ের উপর আঁকা ইকরি মিকরি কালো কালো অক্ষর দেখতে দেখতে চোখের পাওয়ার আরও কমে গেছে। এখন আকাশ, রোদ, মেঘ এসব দেখে চোখের পরিশ্রম করছি।

ঐ যে, ওওওইইইই যে আমার যম চলে এসেছে ছাদে! আশ্চর্য! এতদিন পর একদিনের  জন্য ছাদের আসলাম, আর আজকে একেও কেন আসতে হলো? না আসলে কি হতো? আমি তো একটু পর চলেই যেতাম! এখনই আমাকে বকাবকি শুরু করবে, নিশ্চিত আমি!

আগে ভেবেছিলাম, উনারা বুঝি এই বাড়ির বাড়িওয়ালা। যেভাবে ছাদে এসে দাপট দেখান, এমনটা না ভাবার কোনো কারণ নেই। পরে আম্মুকে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করে জানলাম, উনারা ভাড়াটিয়া! বাব্বাহ, ভাড়াটিয়া হয়েও এত তেজ? ছেলেরা আসলে এমনই হয়। ভীষণ খারাপ। এজন্য আমার ছেলেদের ভালো লাগে না। আমি ঠিক করেছি, আমি কোনোদিন প্রেম করব না। প্রেম দূরে থাক, আমি তো বিয়েই করব না! এসব বকাঝকা আর হম্বিতম্বি আমার সহ্য হয় না!

আমি চুপ করে শুভ ভাইয়াকে দেখেও না দেখার ভাণ করে রইলাম। তাকালেই যদি বকা দেয়? অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম, কখন সে বকা দেবে। দেখি, আজকে উনার সাথে ঝগড়া করতে পারি কিনা?

ওমা, এই লোক দেখি আমাকে কিছুই বলছে না! সে কি আমাকে কিছু বলবে না? আগের মত বকবে না? ছাদ থেকে ভাগতে বলবে না? আমি আড়চোখে তাকে খেয়াল করি। ফোন কানের উপর চেপে ধরে হাসছে সে। কার সাথে এত সুখের আলাপ চলছে? বোধহয় শুভ ভাইয়া প্রেম করছে! ভালোই হলো, এখন নিজের মত থাকবে, আমাকে জ্বালাবে না। আর এরপর যদি কিছু বলে, আন্টিকে বলে দিব উনার প্রেম করার কথা, হি হি হি!

চলবে...

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top