মাতাল হাওয়ায়

ভীষন জোরে কিছু একটা পড়ার শব্দ পেয়ে ফিরোজা স্বামীর দিকে চোখ তুলে তাকালেন। স্ত্রীর কুঁচকে যাওয়া কপাল দেখে জহির সাহেবের বুঝতে অসুবিধা হলোনা যে ফিরোজা অসম্ভব রকমের বিরক্ত কিন্তু তারপরও তিনি একমনে খেতে লাগলেন, জানেন আপাতত এ সমস্যার কোন সমাধান তার হাতে নেই।

"সেই তখন থেকে যা ইচ্ছা করছে মেয়েটা, আমার  মনে হয় এই বিয়েটা এখন না দেয়াই ভালো হবে। পরে কিন্তু তোমাকে অনেক কথা শুনতে হবে, বলে রাখছি।"

হলেও কিছু করার নেই, বিয়েটা হবে আর সেটা আজই।

বলছি কি পরীর বদলে তুমি বরং শান্তাকে বিয়ে করতে বলো ওদের, পরীতো বয়সে ছেলেটার বেশ ছোট।

ফিরোজা, তুমি যে খরচা করে বাজারে যাও, তারপর দশটা দোকানে ঘুরে একটা কাপড় পছন্দ করো। তারপর সেই কাপড়টা কেনার জন্যই আরো দশ দোকান ঘুরো, কিন্তু তারপর আবার ঠিক ঐ দোকানের ঔ কাপড়টাকেই কেন, কেন বলতো?

ফিরোজা উত্তর দিলেন না। স্বামী কি বলতে চাইছেন তিনি বুঝতে পারছেন কিন্তু কথা হলো যার বিয়ে সে তো ব্যাপারটা বুঝতে চাইছে না। পরী কোনভাবেই এই ছেলের সাথে বিয়েতে রাজি না।

সাঈদ ছেলে হিসেবে খুবই ভাল ফিরোজা। বেশি বয়সে বিয়েটা সব সময় মানুষের দোষ নয়।

সেটা আমাকে বলে কি লাভ বলো, কথাটা বরং তোমার ভাস্তিকে বোঝাও... কাজে দিবে।

ফিরোজার কথাটা অত্যন্ত যুক্তি সঙ্গত, জহির সাহেব কথা না বাড়িয়ে পুনরায় খাওয়ায় মনযোগী হলেন।

পরীর ইচ্ছে হচ্ছিল একটা দড়ি নিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ে। কিন্তু অত্মহত্যা মহা পাপ, তাই সে এ পথে পা বাড়ায়নি। কিন্তু বড়ো চাচা তার সাথে এরকম কেন করলো এই দুঃখ পরীর যাচ্ছে না।

সাতদিন পরে পরীর  বিয়ে হলো বড়ো চাচার পছন্দের ছেলের সাথেই। ছেলের টাকা পয়সার কোন সমস্যা নেই, ভাল সরকারি চাকুরি করে  কিন্তু বয়সটা বড্ডো বেশি। পরীর সাথে একদমই বেমানান... কোথায় ঊনিশ বছরের ডানপিটে দস্যি মেয়ে আর কোথায় ছত্রিশ বছরের বুড়ো। লোকটার নিশ্চই ইয়া বড়ো একটা ভুড়ি আর স্টেডিয়ামের মতো গোল একটা টাক থাকবে, অনেকটা মোটু পাতলুর মোটুর মতো। কথাটা মনে হতেই রাগে, হতাশায় পরীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

বিয়েতে দাওয়াত প্রার্থী নেহায়েত কম না। আত্মীয় স্বজনের আদর আহ্লাদও তাই কম ছিল না। কেউ কেউ পাত্রের অনেক টাকা পয়সার যেমন গুন গাচ্ছিল তেমনি অমন বুড়ো বয়সে টাকার পাহাড় হবেই বলতে ছাড়ছিল না। পরীর কানে এগুলো হাওয়ায় উড়ে উড়ে আসছিল।

বিয়ের পরে পরীকে নিয়ে ওর স্বামী তার সরকারী কোয়ার্টারে এসে উঠল।

গাড়িতে পাশাপাশি বসলেও স্বামীকে এক নজর দেখার ইচ্ছা পরীর হয়নি। রাতে নিজে বাসর সজ্জাতেও ওর বিয়ে, স্বামী এসব  নিয়ে কোন আকর্ষন বোধ হলোনা। মনে মনে সে তার মৃত মায়ের কাছে অভিযোগের পাহাড় জমালো।

ফোঁটায় ফোঁটায় চোখের পানি পড়তে পড়তে পরী এক সময় ক্লান্ত হয়ে বালিশে গা এলিয়ে দিল। কেউ একজন খুব যত্ন করে ওকে নরম কম্বল দিয়ে মুড়ে দিল... এটুকু ঘুমের ঘোরে পরীর কাছে মায়ের আদর তুল্য। ঘুমের ঘোরে অলীক পৃথিবীর মায়া খুবই বর্নিল। কতশত অদেখা স্বপ্নগুলো কতো সহজেই তখন হাতের মুঠোয় এসে যায়, পরী ঘুমের মধ্যেই তৃপ্তির হাসি হাসে।

মাঝরাতে তলপেটের মৃদু যন্ত্রনায় ঘুম ভাঙ্গে পরীর। ঘরে ঢোকার পরে একবার তাকিয়ে দেখেছিল বাথরুমের অবস্থান কিন্তু এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে সেটা যে কোন রাজ্যের সীমানায় পড়ে পরীর তা আন্দাজেরও বাইরে। ঢুলু ঢুলু চোখে বিছানা থেকে উঠতে যেয়ে কারও শরীরের উপর গড়িয়ে পড়ল পরী শাড়ির আঁচলে প্যাচ খেয়ে।

সময় মতো দুটো হাত পরীকে না ধরলে হয়তো মশারি ছিড়ে সোজা মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে হতো ওকে কিন্তু ধরে নিয়ে সে বেচারা যা পেল তা তার চিন্তারও অতীত।

"ছাড়ুন... ছাড়ুন বলছি। সুযোগ পেয়েই অমনি গায়ে হাত দেয়া, মানুষের মতে মানুষ হলে  এই বুড়ো বয়সে এমন ভীমরতি ধরতো না যে নিজের মেয়ের বয়সি মেয়েকে বিয়ে করতেন," সাপের মতো হিস হিস করে কথাগুলো বলে উঠে পরী। ঘেন্নায় কেমন বমি পাচ্ছে ওর। পেটফুলো বুড়োর টাক মাথাটা নির্ঘাত পাঁচ টাকার কয়েনের মতো চকচক করে। তাতে দুই তিনটা তাল গাছের মতো সরু সরু চুল... হতে পারে ব্যাটা তাতেই দিনে চৌদ্দবার চুল আচড়ায়। ইয়াক... ওই লোক ওকে জড়িয়ে ধরবে ভাবতেই আবার গলায় দড়ি দেয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয় পরীর।

পরীর মুখের অমন ঝামটা খেয়ে হাত দুটো গুটিয়ে নিল বেচারা। পরীরও অনুতাপ হওয়ার বদলে বিজাতীয় এক ধরনের আনন্দ হলো। বিজয়ী হওয়ার আনন্দ... বেশ উচিত শিক্ষা হয়েছে ব্যাটার, সুযোগ পেয়েই মেয়ে মানুষের কোমর আগলে ধরার সাধ ঘুচে গেছে নিশ্চই এতক্ষনে। এখন বাপ বাপ করে ওকে বড়ো চাচার ঘরে আবার ফিরিয়ে দিয়ে আসলেই হয়। এমন বুড়ো ভামের সাথে সংসার করার ওর আদৈ কোন শখ নেই, লোকটা ওকে যা মনে হয় ভাবুকগে তাতে পরীর কিচ্ছু আসে যায় না।

একবার ভাবল বাথরুম কোনদিকে তা জিজ্ঞেস করে লোকটাকে কিন্তু তাতে আবার তার কাছ থেকে সাহায্য নেয়া হয়ে যায় আর পরী এই লোকের কাছে ঋন রাখতে চায় না।

হাতরে হাতরে লাইটের সুইচ খোঁজার মতো কঠিন কাজ বোধহয় আর নেই তবে মোবাইলের টর্চের বদৌলতে সেই অসাধ্য কাজটা পরী  ঠিকই সাধন করতে পারল। কাজ শেষে বাথরুমের ছিটকিনি আটকে বিছানায় তাকিয়ে একই জায়গায় শোয়া আবার ঠিক হবে কিনা একটু ভাবল পরী। কিন্তু এই অর্ধেক রাতে আর কোথাও শোওয়ার মতো জায়গা নেই আর বর লোকটা কোথাও যায়নি এতো অপমানের পর তখন পরীই বা অন্য কোথাও শোবে কেন? মোবাইলের টর্চ বন্ধ করার আগে এক ঝলক লোকটার পিঠ ছাড়া আর তেমন কিছুই  চোখে পড়ল না পরীর। লোকটা ওর ঝাড়ি খেয়ে বিছানার একপাশে উল্টো হয়ে শুয়ে আছে। জয়ের আনন্দে ডঙ্কা বেজে উঠলো কেমন পরীর  মনের তানপুরায়। বৌভাতে ও বাড়ি ফিরে গেলে সহজে আর এ মুখো হবেনা... এই লোক নিজেও  যেন ওকে আর ফিরিয়ে আনার নাম না নেয় সে  পরিকল্পনাও পরী মনে মনে  ঠিক করে ফেলল।

সকালে উঠে পরী লোকটাকে আর দেখতে পেল না। সূর্যের সাথে সাথে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আবির্ভাবও বাড়তে লাগল। এক সময় বৌভাত উপলক্ষে নিজের বাড়ির লোকজনেরও দেখা মিলল পরীর। নতুন একটা কাতান শাড়ি পরিয়ে তখন পরীকে বৌভাতের জন্য তৈরী করা হচ্ছে।

বুড়ো জামাই ওর বড়োসর অফিসার বলে কোয়ার্টারটা বেশ জায়গা নিয়ে তৈরি। দোতলা বাসার সামনের লনে বড়ো করে সামিয়ানা,   টানিয়ে কন্যাপক্ষের সবার খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। পরীর খালাত বোন তমা হাসতে হাসতে বলেই ফেলল, এরকম বড়ো বাড়ি আর অতো সুন্দর বর পেলে সে নিজেও এমন বিয়ে বসতে রাজি হয়ে যেত... যদি তার জামিরের মতো বর না থাকত।

তমার স্বামী জামির দেখতে অত্যন্ত সুদর্শন। সে বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। মাস্টার্স পাশ... সেই সঙ্গে খুবই কর্মঠ। বাবার ব্যবসার হাল ধরে সে পৌত্রিক ব্যবসাটিকে দ্বিগুন বড়ো করে ফেলেছে দুই বছরের মাথায়। এমন লোকের সাথে ওই বুড়ো ভামের তুলনা করায় পরীর চোখে আবারো পানি এল। পরী বুঝতে পারছে এখন থেকে নিত্য নতুন টিপ্পনী শোনাই ওর দৈনিকের কাজ হয়ে দাঁড়াবে।

কিরে পরী.. মুখ অমন হাড়ির মতো বানিয়ে রেখেছিস কেন?

পরীর ছোট ফুপুর মেয়ে ফাতেমা এসে জানতে চায়। ফাতেমা পরীকে নিজের আপন বোনের মতোই ভালোবাসে। পরীর গোমরা মুখটা তাই ফাতেমার ঠিক সহ্য হয়না।

ফাতেমাবু আমার কপালটা এতো খারাপ কেনো বলতে পারো?

খারাপ! খারাপ কেনো?

বাবা জন্মের পর পরই মারা গেল, মা ছেড়ে গেল নাইনে উঠতেই। নিজের ভাই-বোন বলতে কেউ নেই। এখন বিয়ে হলো তাও এক বুড়োর সাথে.. মুখ হাড়ি বানাব না তো কি খুশিতে ধেই ধেই করে নাচব।

পরীর কথায় ফাতেমা বিষন্ন মুখেও হাসল। সত্যি মেয়েটা আভাগী, খুব ছোট বয়সেই সে বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলেছে । তবে বাবা-মায়ের অভাব কিন্তু পরী তেমন করে বোঝেনি যতোটা সে মুখে মুখে বলে বেড়ায়। জহির মামা আর ফিরোজা মামী পরীকে নিজের মেয়ের মতোই মানুষ করেছেন, যেমন নিজের ছেলে কামরানকে করেছেন। বরঞ্চ কামরানকে মাঝে মাঝে পরীর জন্য অনেক মার খেতে হয়েছে। পরী কেবল নামেই পরী, নাহলে আনোয়ারা ভিলাতে সে দস্যুরানী নামেই পরিচিত। মা-বাবা নেই বলে ফাতেমার নানীর সব মনযোগ থাকত পরীর প্রতি আর জহির মামা, ফিরোজা মামী এরা ফেরেশতার মতো না হলেও লোক ভালো। পরীকে এই ছেলের সাথে যখন তারা বিয়ে দিয়েছেন, তখন নিঃসন্দেহে এই ছেলে মানুষ হিসেবে ভালো।

ফাতেমা বলল,"শোন পাগলী, মানুষ তার এক জীবনে সব সুখ পায়না। আর ভালো মন্দ সব মিলিয়েই মানুষ। জামাই বয়সে একটু বেশিই বড়ো তোর থেকে কিন্তু তাতে সে লোক মন্দ তাতো বলা যায় না।"

ফাতেমার কথায় পরীর মনের মেঘটা একটু কাটল। এটা ঠিক বয়স বেশি মানেই তো আর সে লোক খারাপ তা না। কিন্তু ঐ লোক এতো বড়ো ওর থেকে.. সে এতকাল বিয়ে না করে বসে ছিল কেন? তার নিশ্চয়ই কোন খুত আছে যেটা বড়ো চাচারা জানে না।

মুহুর্তের মধ্যে পরীর মনে আবার অসন্তোষ দানা বাঁধতে লাগল।

ফাতেমা আর পরীর কথার ফাঁকেই এক ভদ্রমহিলা এসে সোজা ঘরে ঢুকে গেল। চলনে বলনে সে অতিশয় স্মার্ট তবে ভীষন মিশুক প্রকৃতির। পরীকে দেখেই  জানতে চাইল 'তুমি কি সাঈদের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী? আমি অধরা, সাঈদের বন্ধু।"

পরী হ্যাঁ, না কিছুই বলল না।

ওই বুড়োর নাম সাঈদ এটুকু পরী জানে কিন্তু তার বান্ধবীর সামনে সেটুকু জাহির করা ওর কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হলো না। বিশেষ করে ও যখন স্বামী নামের প্রানীটিকে ভালো করে চেনে পর্যন্ত না। তাছাড়া বিয়ের কনেকে সবাই সাজ পোশাক দেখলেই চিনে ফেলে। ফালতু ফালতু জিজ্ঞেস করার মানে কি? তার পর পরই পরীর মনে হলো,
ঐ লোক আবার নিজের বান্ধবীকে সি আই ডি বানিয়ে পাঠায়নি তো?

পরীকে অধরার সাথে আলাপ করতে দিয়ে ফাতেমা ঘরে থেকে সরে এল।

অধরা পরীর কাছে অনেক কিছু জানতে চাইল যার পচানব্বইভাগ উত্তর পরীর অজানা। প্রশ্নগুলো পরীর বিরক্তি ক্রমশ বাড়াতে লাগল। সাঈদ নামের লোকটিকে নিয়ে ওর কোন মাথাব্যাথা নেই আর তার বান্ধবী ওকে বারবার শুধু সাঈদের বিষয়েই প্রশ্ন করছে... কে জানে কেন।

অধরা নিজের মোবাইলে এবার কিছু ছবি বের করে পরীকে দেখাতে লাগল। ছবিটা তাদের কোন স্টাডি ট্যুরের। খুবই ভাল কথা... কিন্তু  পরী এবার প্যাচ খেয়ে গেল অধরার প্রশ্নে। এই ছবিতে ওর স্বামী সাঈদ কোনটা? কি ভয়ঙ্কর প্রশ্ন।

এটা কবেকার ছবি তা কে জানে? তার উপর পরী ঐ লোকের কাছে নিতান্ত অসহায় এক বাচ্চাই বলা যায়... ঐ বুড়োকে ও খুঁজে পাবে এ কি চাট্টিখানি কথা? কিন্তু তবু নিজের সম্মান বাঁচাতে এবার ভালো করে ছবিটা দেখার ভাব করল পরী।

দেখেই পরীর চোখ কপালে উঠল।

ওরে সব্বোনাশ... এখানে তো একদল ছোরা-ছুরি গা লেপ্টা লেপ্টি করে বসে আছে। এর মধ্যে কোনটাকেই তো পরী চিনছে না। বিরক্ততে কপাল কুঁচকে এল পরীর।

"কি হলো পরী সাঈদকে চিনতে পারছ না? না চিনলে বলো আমি হেল্প করছি," অধরা মিষ্টি করে হাসল। 

পরী বোকার মতো হাসল। আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আসলে ওর এখন আর কোন রাস্তা খোলা নেই অধরার সামনে। বর ব্যাটাকে চিনলে না ও তাকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু পরী তো তার মুখের ম্যাপও চিনে না, শুধু শুধু অক্ষরেখা, দ্রাঘিমারেখা ধরে টানাটানি করলেই হবে?

"এই যে দেখো এটা সাঈদ, এই যে কালো রঙের গেঞ্জি পরা। বুক পকেটে কাল সানগ্লাস।"

ছবি দেখে এবার পরীর মাথা ঘুরিয়ে উঠল। এই লোক ভুড়িওয়ালা আর টেকো হলে কেমন লাগবে পরী বুঝতে পারছে না কিন্তু একটা জিনিস চোখে পড়ার মতো, তা হলো লোকটার ওই বয়সের শরীরের গড়ন বেজায় ভাল ছিল আর মাথায় চুলের স্তুপ...  মাশাআল্লাহ। এতো পুরো দস্তুরে  নায়কের মতো দেখতে! পরী বোল্ড আউট কন্ডিশনে ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। এই লোক বুড়ো হলেও মনে হয় খুব বেশি খারাপ দেখতে হবে না।

"চিনতে পেরেছ পরী এখন," অধরার চোখ দুটোয় বিষন্নতা ছড়িয়ে পড়ছে।

"জি.." পরী মেকি হাসি হাসল। হাসি আসছে না কিন্তু ঢিল তো ছুটে গেছে হাত থেকে, আর বুড়োর মন এখন ওর আওতার বাইরে। যাক গে পরী তো আর চেহারার জন্য বিরোধিতা করেনি ওর সমস্যা লোকটার বয়স নিয়ে। বাপরে কতো বড়ো ওর চেয়ে, সে নাকি ওকে ভালোবাসবে..  এটা একটা কথা?

"সাঈদ তোমাকে খুব ভালোবাসে তাই না? সেদিন তোমার কথা খুব বলছিল ও, অনেক প্রশংসা করছিল বসুন্ধরায় গয়নার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। "

"আমার! "এবার পরীর অবাক হবার পালা। উনি পরীর নামে প্রশংসা করছিল অধরার কাছে! এই প্রথম লোকটার জন্য সত্যি সত্যি কৌতুহলের সৃষ্টি হলো পরীর মনে। সাঈদ লোকটা মন হয় আসলেও তেমন খারাপ না। আসলে সে খারাপ এমনটা কেউ বলেই নি ওকে বরঞ্চ সবাই ওকে উল্টোটাই বলেছে। কিন্তু পরীর মন ধরে নিয়েছে সে খারাপ। কিন্তু এখন অধরার মুখে তার প্রশংসার কথা শুনে পরীর মনের বরফে কিঞ্চিৎ ফাটল দেখা দিল। লোকটা কি তবে বড়ো চাচার কথার মতো ভালো!

এই প্রথম পরীর চোখে ছবিটার একটা বিসদৃশ্য দিক চোখে পড়ল। অধরা ছবিটিতে সাঈদের একদম গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। এই গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝে কি যেন একটা আছে.. পরীর মনে হঠাত এক ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম হলো। পরী দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। যা মনে হয় করুকগে..  না ও সাঈদ নামের লোকটাকে জানতে চায় আর না তার ছবির বিষয় বস্তু।

কিন্তু পরীর জন্য আজ আরও চমক অপেক্ষা করছিল। ও যখন মনে মনে ছবিতে দেখা সুদর্শন লোকটির ফুলো পেট আর স্টেডিয়ামের মতো টাকটির এডিট ভার্সন ক্রিয়েট করছিল তখন বড়ো চাচী ওকে ডেকে নিয়ে এক রাজপুত্রের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। পরী তাকিয়ে দেখল লোকটার মোটেই কোন পাকা চুল নেই আর না স্টেডিয়ামের মতো বিশাল কোন টাক। ফিটফাট পোশাকে তাকে ঐ পুরনো  ছবিটার চেয়েও আরো অনেক বেশি  আকর্ষনীয় লাগছে, পরী অপলক চোখে তাকিয়ে রইল, যেন কেউ ম্যাজিক দেখাচ্ছে। আর তা না হলে ওর চোখই নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷

"দেখতো পরী, সাঈদ বলছে ওর নাকি খুব দরকারি কিছু কাজ আছে আজ বাড়িতে, আমাকে বলছে তোকে একাই আমাদের সাথে নিয়ে যেতে। কিন্তু বৌভাতে এভাবে বর সাথে না গেলে লোকে কি বলবে?" বড়ো চাচী কাতর গলায় বললেন।

এ যে গতরাতের মরিচের ঝাল সেটা বুঝতে সময় লাগলো না পরীর। কিন্তু ও একা বাসায় ফিরে গেলে বড়োচাচা ওকে আস্ত রাখবে না প্রথম কথা কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা পরী নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। ওর স্বামী মোটেই কোন হেঁজিপেঁজি লোক না, দেখতে সে পরীর চাইতে বরং বেশিই সুন্দর। পরী তো সুযোগ পেলেই তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে, দেখে ওর মন খুশিতে কয়বার ডিগবাজিও খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু কি করে এই লোকের মান ও ভাঙ্গাবে তার কোন কায়দা কানুন পরীর মাথায় আসছে না।

শেষে ভেবে ভেবে ক্ষমা চাওয়াটাই সবচেয়ে সহজ বলে মনে হলো পরীর। কিন্তু সে জন্য তো নিরিবিলি পরিবেশ চাই আর ওরা এখন আত্মীয়-স্বজনের মেলার মধ্যমনি হয়ে আছে।

পরীকে সাঈদ প্রথম দেখেছিল যাত্রী ছাউনির নিচে। সেদিন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। বাসে উঠাটা রীতিমতো যুদ্ধ মনে হচ্ছিল ওর। তারপরও আপাদমস্তক রেইনকোটে নিজেকে মুড়িয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তখনই প্রথম পরীকে চোখে পড়ে। অল্প বয়সের মেয়েটি কোন একটা কারনে বার বার চোখ মুছছিল আর বিরবির করে কথা বলছিল। মেয়েটার কান্নার মধ্যে ভীষন একটা আকুলতা ছিল যেটা সাঈদের মনকে বার বার ছুঁয়ে যচ্ছিল।

সাঈদের তখন বার বার ওর ছোটবোন সারার কথা মনে হচ্ছিল। ওদের মা যখন মারা যান সারা তখন ক্লাস নাইনে পড়ে, এমন করেই আকুল হয়ে কাঁদছিল সেও। পরীকে দেখে সেই স্মৃতি গুলোই যেন তাজা হচ্ছিল।

সারা এখন স্বামীর সাথে ইটালিতে থাকে। ফুটফুটে একটা ছেলে আছে ওর। কিন্তু আদরের বোনটিকে যখন তখন আর দেখা হয়ে উঠে না সাঈদের। বর্তমান সময়ের বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমগুলোই এখন যা ভরসা। তবু ওকে ছুঁয়ে দেখতে খুব ইচ্ছে হয়, ভাগ্নেটাকে কোলে নিতে শখ জাগে।

ওর ছোট ভাই রওনক  এবার ভার্সিটিতে ঢুকলো। ওর দিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। না হলে উচ্ছন্নে যেতে কতক্ষন।

এসব করে নিজের জীবন গোছানোর দিকে নজর দেয়নি সাঈদ। ছাত্রজীবনে অধরার প্রতি ভীষন  আগ্রহ জন্মেছিল কিন্তু সেও ওর জীবন যুদ্ধ দেখে তখন পাশে থাকার সাহস হারিয়ে ফেলেছিল। সাঈদও বাঁধা দেয়নি। নিজের ভবিষ্যত ভাবার মতো অবস্থায় তখন ও ছিল না। অভিভাবকহীন পরিবারে এক রাতের মধ্যে অভিভাবক হয়ে উঠা সাঈদ তখন অলীক দিকশূন্য পুর যেন। কোন কূল নাই কিনারা নাই। সদ্য ভার্সিটি পাশ করা ছেলেটির তখন নিজের ক্যারিয়ার ছাড়াও একহাতে বাবা-মা দুজনের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। এই ভার বইতে বইতে কখন যে নিজের জুলফির কোনের চুলগুলোতে বর্নহীন উই পোকাদের বসবাস শুরু হয়েছে বুঝতেই পারেনি। কেবল ফুপু মাঝেমাঝে বায়না ধরতেন ," সারার বিয়ে হয়ে গেছে এইবার একটা বিয়েটা কর। দেখিস এরপর মেয়ের বাবারা তোর কাছে মেয়েই দিবেনা। "

মাস খানেক আগেও ফুপু ওকে এই একই পাঠই পড়িয়েছেন আর সাঈদ বরাবরের মতোই সালমান খানের উদাহারন দিয়ে নিজেকে অজুহাত মুক্ত করেছে। কিন্তু কাল রাতে পরীর মুখ ঝামটা খেয়ে সাঈদের প্রথমবারের মতো মনে হয়েছে ওর সিদ্ধান্ত নিতে কোথাও বড়ো আকারের গলদ হয়ে গিয়েছে। ওভাবে দেখেই ভালো লেগে যাওয়াতে পরীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া একদমই উচিত হয়নি। ওর আর সালমান খানের ইমেজ যে কখনই এক না এটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে সাঈদ এখন।

এই প্রথম মনে হয়েছে ওই উর্বশী রাতে ঝড়ো হাওয়ায় যা মনে দোলা দিয়ে গিয়েছিল তা বইবার ক্ষমতা ও হারিয়েছে। পরীর মতো সদ্য ফোঁটা ফুলের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা ওর আর নেই। ওর সাথে পরী কখনো খুশি হবে না।বাকি রাতটা সাঈদ পার করেছে অসম্ভব এক যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে। সকালে উঠেই নিজে নিজে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাঈদ, পরীকে ও মুক্ত করে দিবে। 

"আপনার কি মন খারাপ?"

সাঈদ হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। কাল রাতে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর মুখে কটু বাক্য শোনার পরও  কি ওর আকাশে পেখম তুলে আনন্দ করা সাজে?

কিন্তু পরীর উপর আসলে রাগ হয়নি সাঈদের, ভুলটা তো ওরই.. পরী নেহায়েতই সেখানে ফাঁদে পড়া একটা শিকার মাত্র। বয়সের পার্থক্য যে মনের উপর এতো বড়ো বেড়াজাল তৈরি করতে পারে সাঈদ জানতো না। জানলে কখনোই এই ভুল করতো না।

"আপনি আমার সাথে কথা বলবেন না?" পরী মন খারাপ করে জানতে চায়। সে ভুল করেছে বলেছে সাঈদকে কিন্তু লোকটা তারপরও কি গম্ভীর হয়ে আছে। একটুও ওর সাথে কথা বলতে চাইছে না।

সাঈদ এবারও উত্তর দিল না। ওর কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছেনা আর নিজের বিয়ে করা বউয়ের উপর সামান্য একটু আধটু অভিমান নিজের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। সাঈদের আসলে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

রাত এখন দশটা ছুঁই ছুঁই। একঘন্টা হলো ওরা পরীদের বাসায় এসে পৌছেছে। একটু পরেই হয়তো রাতের খাওয়া শুরু হবে। সাঈদ আসতে চাই ছিলনা একদমই কিন্তু পরীই অনুরোধ করে ওকে আসতে বাধ্য করেছে। পরীর কাতর চোখের অনুরোধ শেষ পর্যন্ত ফেলতে পারেনি সাঈদ। চাচা শ্বশুরও ভীষন করে অনুরোধ করছিলেন। অগত্যা আসতে হয়েছে সাঈদকে পরীর স্বামী হয়ে। কিন্তু বুড়ো টাইটেলটা নিয়ে  সত্যি ও বড়ো মনঃকষ্টের  মধ্যে আছে। এমনকি  নিজের পছন্দ করা বউয়ের সাথেই ও এখন সহজ হতে পারছে না।

"ও মাগো "

চিৎকার করে সাঈদের উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল পরী।

হতভম্ব সাঈদ কিছুই বুঝতে না পেরে পরীকে জোরে আকড়ে ধরল," কি হলো?"

"মা.. মাকড়শা..  এত্তো বড়ো," বলেই সাঈদের বুকে মুখ লুকাল পরী।

"আচ্ছা আমি ফেলে দিচ্ছি।"

এই প্রথম হাসল সাঈদ, মেয়েটা আসলেই বাচ্চা।

"না.. না আপনাকেও কামড়ে দিবে,  কি বিশ্রী ওর পা গুলো," পরী হাত দিয়ে সাঈদকে বাঁধা দিল।

"আমাকে কামড়ে দিলে তোমার কি?"

"বারে আমার জন্য আপনি কামড় খেলে সেটা তো আমার দোষ হবে।"

"তুমি মাকড়সা খুব ঘেন্না করো তাই না?"

"ভীষন "

"আমিও ভীষন কুশ্রী তোমার চোখে..  আমাকেও ভীষন ঘেন্না করো তাই না?"

পরীর এবার খুব কষ্ট হলো। ও না জেনে খুব বড়ো একটা ভুল করে ফেলেছে। ও ধারনাই করতে পারেনি সাঈদ তার দশটা বছর ভাই-বোনদের জন্য উজার করে দিয়ে দিয়েছে। ওর মনে হয়েছিল ও অনাথ বলে বড়ো চাচারা ওকে পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। অথচ তারা ওর ভালোর জন্যই...  আসলে ওর নিজের মনটাই কুটিল। কোন কিছুকেই কেন যেন ও সহজ ভাবে নিতে পারেনা। মা মারা যাবার পর থেকে এই ব্যাপারটা ওর প্রায়ই হয়। সেই একই কারনে দোষ না করেও সাঈদকে দোষী ভেবেছিল পরী।

"দেখি সরে বস আমি মাকড়সাটা ফেলে দিয়ে আসি।"

সাঈদ খপ করে মাকড়সাটা সুটকেসের পিছন থেকে ধরে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে দিল।

পরী নিশ্চল চোখে সাঈদকে দেখছিল। লোকটা অতি মাত্রায় সুন্দর। গায়ের রঙ ওর চেয়ে দুই পরতা বেশি উজ্জ্বল। আর এই লোককে কিনা ও ভুড়িওয়ালা মনে করে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। ওর মনে সব কিছুকে নিয়েই  নেতিবাচক প্রভাবটা যে কেন আগে  আগে আসে তা একমাত্র ওর মনই জানে, কিন্তু তার ভুক্তভোগী হতে হয় ওর পুরো পরিবারকে।

আনমনে অভ্যাস বশতই সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করল সাঈদ। এই একটা বদঅভ্যেস ওর মজ্জাগত হয়ে গিয়েছে, কিছুতেই ছাড়তে পারে না।

"একটা কথা..."

"কি?"

"সিগারেটের ধোঁয়া আমার একেবারেই সহ্য হয় না, বাসায় গিয়ে ওটা ঘরের বাইরে গিয়ে খাবেন।"

পরীর কথায় এবার মনে হয় বেশ মজা পেল সাঈদ। মেয়েটা বড্ড অদ্ভুত ধরনের। ও জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলনা, তাই জানতে চাইল," কেন তুমি কি আবার আমার সাথে বাসায় ফিরে যাবে নাকি?"

"আমি যেতে চাই বা না চাই আপনার উচিত আমাকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া।  না হলে আমি তো শুধু বুড়ো বলেছি, পরের বউ দোজবরে বলবে। আমরা এই বয়সের মেয়েরা একটু বেকুব টাইপের হয়ে থাকি, সবগুলোই প্রায় একই রকম মাথামোটা।"

"না এর পর বিয়ে করলে আর এতো ছোট মেয়েকে বিয়ে করবো না, সমবয়সী করার চেষ্টা করবো। বেশি ভালো হয় বড়ো বাচ্চাকাচ্চা সহ কাউকে পেলে, একদম ঝামেলা থাকবে না," বলেই হাসে সাঈদ। ন্যাড়া বেলতলায় কবার যায় কে জানে? এ জনমে আর বিয়ের মুখ দেখবে না।

কথাটা হজম করতে পরীর খুব কষ্ট হলো কিন্তু  কথায় আছে এক মাঘে শীত যায়না। মনে মনে বলল,"আবার বিয়ে করা আমি ছুটোচ্ছি তোমার।"

"কাকে বিয়ে করবেন অধরাকে?" হঠাত জানতে চায় পরী।

"কাকে! "বিমূঢ় হয়ে জানতে চাইল সাঈদ। অধরাকে... অধরার কথা পরী জানল কি করে?

"না মানে সমবয়সী বাচ্চা ওয়ালা বললেন তাই অধরা কথা বললাম।"

সাঈদ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল কিছুটা সময়৷  হাতের সিগারেটটা সামনে রাখা একটা ক্রিস্টালের বোলের মতো শোপিশে চেপে বন্ধ করে দিল।

অধরা ওর ফেলে আসা জীবনের একটা অধ্যায়, একটা সময় সাঈদের সবটা জুড়েই অধরা ছিল। কিন্তু এখন নেই, কিছুতেই নেই।

কিন্তু পরী ওর আগামীর ভবিষ্যত হতে রাজি কি? কিছু কথা নিভৃতে একান্ত মানুষের সামনেই তুলে ধরা যায়, হাটে-বাজারে জনে জনে নয়। কিন্তু পরীকে সেক্ষেত্রে ওর পরী হয়ে উঠতে হবে, 
তবেই পরীকে অধরার কথা বলা সম্ভব।

"আপনি কি আমার কথায় আবার রাগ হলেন?"

"পরী, অধরা আমার জীবনের একটা কঠিন সত্য।  আমি জানিনা অধরা সম্পর্কে তুমি কতটুকু জান, কিভাবে জান কিন্তু এক সময় সে আমার কাছে মহা মূল্যবান ছিল। কিন্তু আজ সে আমার কাছে এতটাই মূল্যহীন যে ওকে দেখলে আমি রাস্তার উপর হেসে হেসে কথা বলি। যদি ভালোবাসা বেঁচে থাকত তবে ওর জন্য চোখের কোনে অশ্রু আর বুক ভরা হাহাকার থাকত, অভিমান থাকলে ওকে দেখে না চেনার ভান করতাম। আমি এর কিছুই করিনা। কারন ওর উপস্থিতি আমার কাছে কোন অনুভূতিই তৈরি করেনা। না হলে অনন্ত বিশ্বাস ঘাতক বলার অধিকারটুকু আমার ছিল।"

সাঈদের মনে অধরাকে নিয়ে কোন তীব্র ব্যাথা আছে এটা বুঝতে পরীর সময় লাগল না কিন্তু তবু পরীর মনে সূক্ষ্ম একটা অভিমানের জন্ম হচ্ছে আর সেটা  একটু একটু করে অসংখ্য ডাল পালা মেলছে। এই হিংসা করাটা মহা মুর্খামী বুঝতে পেরেও পরীর বুক ভারী হচ্ছে, ঠোঁট ফুলে উঠছে, চোখের কোন কাঁটা কাঁটা লাগছে। অধরা আজ না থাকুক, অতীতে কেন ছিল সেই কৈফিয়তও ওর বরদাস্ত হচ্ছে না। এ তো বড়ো জ্বালা। এখন মনে হচ্ছে সাঈদ এতো সুন্দর না হয়ে পেট ফোলা, টেকো হলেই পরীর ভাল হতো। তাহলে অন্তত পরী ছাড়া আর কেও সাঈদকে ভালোবাসতো না।

  উফঃ এর মধ্যে ভালেবাসাও ফাঁক গলে ঢুকে গেল নাকি আবার ওদের মধ্যে...  পরীর আবার গলায় দড়ি দিতে মন চাইল।

"পরী"

"জি"

"আমাকে কাল সৈয়দপুর যেতে হবে একটা কাজে। দুদিনের জন্য যাব.. এই দুদিন তুমি বরং এখানেই থাকো। আমি ফিরে এসে তোমায় বাসায়  নিয়ে যাব। "

"আমাকে ফেলে রেখে যাবেন! "

"তুমি যাবে আমার সাথে?"

"না নিলে কেমন করে যাবো?"

"আমার কিন্তু সারাদিন অনেক কাজ থাকবে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত।"

"রাতে ফিরবেন তো?"

"তা ফিরব। "

"তাহলেই চলবে।"

সাঈদ হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইল। পরী বোধহয় এ যাত্রায় পাশ করে গেল। কাল ওরা কক্সবাজারে যাবে। জীবনে এক বয়সে অনেক অপ্রাপ্তি ছিল সাঈদের টাকার জন্য। কিন্তু এখন সাঈদের যথেষ্ট ভালো অবস্থা..  তা দিয়ে পরীর মতো মেয়েটার কিছু স্বপ্ন না হয় পূরন হোক।

"আচ্ছা আপনি আমাকে কেন বিয়ে করলেন, না মানে এত মেয়ে থাকতে আমি কেন? "

"তোমার সরলতা দেখে, তোমায় কাঁদতে দেখে।"

"আপনি নিজের চোখে দেখেছেন আমায় কাঁদতে! কিন্তু আমাকে আপনি কোথায় দেখলেন বিয়ের আগে?"

"পরে বলবো, আগে বলো আমি খুব কুৎসিত হলে কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে?"

"জানিনা হয়তো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনি কুৎসিত হলেই ভাল হতো।"

"কেন? "

"সাঈদের প্রশ্ন পরীর কথা আটকে গেল। কেন! ..  ও এখন এই কথা বলতে পারবেনা। কি ভীষন লজ্জার কথা..  একবার দেখেই বরের প্রেমে পড়ে গেছে, বরও এখন মজা ওর উপর মজা নিবে।"

"কি হলো বলো?"

"জানিনা।"

সাঈদ হাসল,"তা হলে এখন কালো, মোটা, বেটে বরও ভাল ছিল মনে হচ্ছে?"

"হ্যাঁ"

"এতো হিংসা কেন করছো পরী অধরাকে, ও নেই। তোমার জায়গা কেউ দখল করতে পারবেনা।"

"কিন্তু আগে তো ওখানে অধরা ছিল, আপনি কেন তাকে ভালবাসতেন?"

সাঈদের মুখ এবার সত্যি উজ্জ্বল হয়ে এল।

"তুমি কি আমার মতো বুড়োর প্রেমে পড়ে গেলে পরী?"

"যদি পড়ি তাহলে কি ধরে মারবেন?"

"মারব কিনা জানি না তবে খুব করে জড়িয়ে ধরবো, বুড়ো মানুষ তো অল্প বয়সী মেয়েদের  ধরার সুযোগ পেলেই হামলে পড়ি।"

উহহ... সবটা মনে করে বসে আছে দেখো। গতরাতের কথা মনে হতেই বুক ধুকপুক করতে লাগল পরীর। সেই দুঃখে আজ একবারও ওকে জড়িয়ে ধরেনি বুড়ো দাদু আর পরীর কতবার করে মনে পড়ছে সে কথা। কিন্তু বুড়ো মিনসে তবু  একবার জড়িয়ে ধরেনি। জালিম বুড়ো.....  হোক দেখতে নায়কের মতো সুন্দর, তাতে কি.. ওর  থেকে কত্তো বড়ো.. সেটা কি একদম ফালতু? বাচ্চা ভেবেই তো ওকে মাফ করে দেয়া যায়।

সাঈদ চিন্তামগ্ন পরীকে দেখতে লাগল। সেদিনের মতোই আত্মভোলা, একাই বিরবির করে কথা বলছে নিজের সাথে। ঠিক সেদিনও এমন হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে কথা বলছিল পরী যাত্রী ছাউনিতে। কি যে হয়েছিল সাঈদের, মনে হচ্ছিল  কি ভীষন অসহায় হয়ে কাঁদছে মেয়েটা, বুক চিনচিন করছিল ওর অসহায় আবেগে।

পাগলী একটা... হাসল সাঈদ।

কাল ওকে বুড়ো বলেছিল না পরী? আজ সেই বুড়ো বলার সাধ পরীর ঘুচিয়ে দিবে ও।

মনে মনে কাল রাতের জন্য নিজেকে পোড়া কপালি তকমা লাগিয়ে দিচ্ছিল পরী। এ জীবনে ওর স্বভাবের জন্য আর কারো ভালোবাসাই ওর পাওয়া হলো না। জীবনটাই বৃথা, পরী তোর মরাই ভালো রে, তুই বরং আজই মরে যা।

নিঃশব্দে সাঈদ কখন ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি পরী। দুটো সবল হাত পিছন থেকে ওর কোমর জড়িয়ে ধরতেই তির তির করে কেঁপে উঠল পরী। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল।

"পরী আমি কিন্তু বুড়ো আর বুড়োদের কিন্তু মাথার ঠিক থাকে না," সাঈদ ফিসফিস করে বলে উঠল।

বেসামাল পরীর গলার কাছে, গালে, ভেজা চোখে তখন অসংখ্য অনুভূতির দল কল কাকলি করে জানান দিতে লাগল... জীবনে বসন্ত এসে গেছে।

ভালোবাসা বড়ো বেহিসাবি... যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ কিছুই সে মানেনা।

"আজ ফাগুন হাওয়ায় আগুন লেগেছে মনে, বসন্তের এই মাতাল হাওয়ার সনে।"

( সমাপ্ত)

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top