৯ম পর্ব

মিটিং থেকে বের হয়েই আজ নিঝুমকে ফোন দিল অরণ্য। দুপুরে খাওয়ার পরে একবার কথা হয়ছিল।তারপর থেকে আর কথা হয়নি। ঘড়িতে রাত প্রায় একটা বাজে। অয়নকে ফোন দিয়ে গ্যারেজ এর চাবিটা ওর রুমে রাখতে বলল অরণ্য। বাসায় ফিরে যত রাতই হোক গাড়ির ইনসুরেন্সের কাগজের লাস্ট ডেটটা দেখতে হবে ওকে আজ। বাবার গাড়িটা মূলত ওই চালায়। অয়ন কদাচিত ব্যবহার করে। তা না হলে বাসার মেইনগেটের চাবি একটা করে ওদের চার জনের কাছেই আছে। তাই রাত হলেও বাসায় ঢুকতে কোনো সমস্যা হয় না অরণ্যর। প্রথম প্রথম আসমা রাত জেগে বসে থাকতেন ওর জন্য কিন্তু এখন অরণ্যর রাগারাগিতে ওর খাবার টেবিলে ঢেকে রেখে শুতে চলে যান তিনি। ওকে প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য বাইরে খেতে হয়, মাকে তাই এতো রাত অবধি বসিয়ে রাখতে চায় না অরণ্য।

ঝুমের জন্যও একটা স্পেয়ার চাবি বানাতে হবে ভাবতে ভাবতে অফিসের গাড়িতে উঠে বসল অরণ্য। ড্রাইভার মুর্শিদ তখন বসে বসে ঢুলছে ঘুমে।

প্রথমেই ঝুমদের বাসায় যেতে চেয়েছিল অরণ্য। কিন্তু সহকর্মী পার্থ সাথে থাকায় খানিকটা পথ ওকে এখন উল্টো যেতে হবে। তবে পার্থ ছেলেটা খুব ভাল আর খুব মজা করে কথা বলতে পারে। অল্প কিছু দিনেই ওর সাথে বেশ ক্লোজ হয়ে গিয়েছে অরণ্য।

তবে পার্থ ছেলেটার মনে খুব বেশি দয়ামায়া। এত মায়া নিয়ে ও এই প্রফেশনে কেন এসেছে সেটাও আরেক অদ্ভুত ব্যাপার। ও হচ্ছে কেমন যেন একটু কবি টাইপের লোক। তবে ছেলেটার জীবনে খুব দুঃখ জনক একটা অধ্যায় আছে সেটার জন্যই হয়ত ওর এই জীবনে আসা।

পার্থকে ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়েই অরণ্য গাড়ি ঘোরাতে বলল। উহ... কতক্ষণ বউটাকে দেখেনা। এখনি বিয়ে করতে পারলে বেশ হত। তা না দুনিয়ার লোক নাচবে, গাইবে, খাবে বলে ওদের চারা মুখে দিয়ে চাবাতে হবে। এ যেন ময়রার দোকানের মিষ্টি। আলমারিতে কাচ দিয়ে আটকানো। যতই লাফালাফি করো লাভ নেই। যতই লোভ হোক না কেন দেখেই তৃপ্তি পেতে হবে। জঘন্য... এমন হবে জানলে ও জিন্দেগীতে এরকম সম্মন্ধ করে বিয়েতে রাজি হত না। এর চেয়ে তো প্রেম করে কোর্ট ম্যারেজ করা ভাল, সব ঝামেলা এক বেলায় শেষ। মা একটু চিল্লাত তারপর সব ঠান্ডা।

বিয়ের পরে টানা কিছুদিন ছুটি নেবে অরণ্য অফিস থেকে। ওই কয়দিন  ঝুমকে এক্কেবারে সামনে স্ট্যাচু করে রেখে দেবে ও। একটুও নড়তে দেবে না। উমম.... মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যাওয়া যায়? এমন কোথাও যেতে হবে যেখানে বারান্দায় গেলেই সামনের দৃশ্য দেখে বউটার মনটা ভরে যায়। চিটাগং যাবে না সিলেট যাবে? পাহাড় খুব বেশি পছন্দ অরণ্যর। কিন্তু নিঝুমের কোনটা বেশি পছন্দ জানা নেই ওর। আজকেই জিজ্ঞেস করতে হবে।

নিঝুমদের বাসার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে অরণ্যর এতক্ষণে মনে হলো যে বড় ধরনের একটা ভুল করে ফেলেছে ও। প্রথমত অফিসের গাড়ি ব্যাক্তিগত ভাবে আটকে রাখা অন্যায়, দ্বিতীয়ত কতটা সময় এখন ওকে এখানে থাকতে হবে জানে না ও। ড্রাইভার মুর্শিদ মনে হয় সকাল থেকেই এভাবে দৌড়ে বেরাচ্ছে। ওকে বিদায় দিয়ে দিল অরণ্য। যদি সুবিধামত যাওয়ার কিছু না পায় তাহলে অয়নকে বলতে হবে আসতে। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো আজকে ও ইউনিফর্মে আছে। ওর অবশ্যই উচিৎ ছিল আগে বাসায় যাওয়া। যাক.. যা হয়ে গেছে তো হয়ে গেছে।

নিঝুমকে ফোন দিতেই চট করে ফোনটা রিসিভ হলো। আসসালামু আলাইকুম শুনে একটু ভড়কে গেল অরণ্য। ব্যাপার কি? অরণ্যও সালামের উত্তর দিল। ব্যাপারটা আসলে ভালই লাগল ওর। কেউ একজন আন্তরিক ভাবে ওর জন্য শান্তি কামনা করে, জিনিসটা সুখকর।

"আমি এসেছি, কিভাবে আসব?"

"আপনি দরজায় আসুন। আব্বু দরজা খুলে দিচ্ছে।"

আব্বু শব্দটা শুনে অরণ্যর রীতিমত ভীমরতি খাওয়ার যোগাড়। বলে কি নিঝুম, গেট স্বয়ং শ্বশুর মশাই খুলবেন! কি জানি কি আছে কপালে। আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে নিঝুমদের বাসার মেইন দরজার একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল ও, বড়ো করে একটা শ্বাস নিয়ে কলিং বেলটায় চাপ দিল। তখনি হঠাত মনে হলো...  আচ্ছা শ্বশুর মশাই দরজা খুলে যদি জিজ্ঞেস করেন যে, 'কি ব্যাপার তুমি এই সময় এখানে কেন?'তখন কি জবাব দিবে অরণ্য। কিছু একটাতো বানিয়ে বানিয়ে বলতেই হবে।

যাই হোক ভাবাভাবির আগেই শাহেদ দরজাটা খুললেন। না কোন রাগের চিহ্ন সেখানে দেখতে পেল না অরণ্য। বরঞ্চ বেশ হাসিমুখেই ওকে ভেতরে যেতে বললেন। কিন্তু ভিতরে ঢুকে অরণ্যর চোখ ছানাবড়া। 

সবার আগে ওর চোখ পড়ল মা আসমা বেগমের উপর। এরপর একে একে রায়হান সাহেব, অয়ন সবাই। ওরা ছাড়াও এখানে আরও অনেক লোক আছে যাদের অরণ্য জীবনেও দেখেনি। ছোট বাচ্চাকাচ্চা একগাদা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিশ্চিন্তে। এদের আচরনই বলে দিচ্ছে যে এরা নিঝুমের আত্মীয় স্বজন। তাদের মাঝে অরণ্যর নিজেকে অসহায় মানুষের বাচ্চা বলে মনে হতে লাগল।

তার চেয়েও আজব জিনিস হলো পুরো বাসা নানা রকম বেলুন দিয়ে সাজান। বেলুন দিয়ে কেন সাজান এই প্রশ্নটাই  সবথেকে আগে অরণ্যর মাথায় আসল? কারও জন্মদিন বোধহয়। বোধহয় না, নিশ্চিত ভাবে কারও জন্মদিন।  আর সেটা যদি নিঝুমের হয় তাহলে একেবারে বিশ্রী একটা অবস্থা হবে আজ ওর। কারন কোনো রকম গিফট দেওয়ার মতো কন্ডিশনে নেই ও এই মুহূর্তে।

"অরণ্য এসো বাবা, ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?" রুমানার কথায় একপাশে রাখা একটা সোফায়  গিয়ে বসল অরণ্য। মায়ের দিকে তাকাতেই তিনি চোখ ফিরিয়ে পাশের এক মহিলার সাথে কথা বলতে লাগলেন। রায়হান সাহেবের দিকে চোখ পড়তেই তিনি খুব ব্যাস্ত সমস্ত ভাবে নিঝুমের বাবাকে  ডাকতে লাগলেন... তার নাকি একটা টুথপিক খুব দরকার। আর অয়ন... সে এক ভাবে সুবোধ বালকের মতো নিজের মোবাইল দেখছে তো দেখছেই, দুনিয়া উল্টে উত্তর মেরু দক্ষিন মেরুতে চলে এলেও বোধহয় তার হুঁশ হবেনা।

বাসার সবাই মিলে যে ওর বিরুদ্ধে বড় ধরনের একটা ষড়যন্ত্র করেছে সেটা বুঝতে অরণ্যর মোটেই বেগ পেতে হলোনা কিন্তু কথা হলো এই সিনেমার মেইন হিরোইন কই?

খানিক বাদেই নিঝুমের দেখা মিলল। হাতে বিশাল একটা কেক ধরে রয়েছে। অরণ্য সত্যি খুব মুশকিলে পড়ল। কার জন্মদিন, কাকে শুভেচ্ছা   জানাবে কিছুই ও বুঝে উঠতে পারছেনা। একদমই  একটা হযবরল অবস্থা। সবচেয়ে রাগ হচ্ছে অয়নটার উপর। দিব্যি কি সুন্দর ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলে বসে ভাব নিচ্ছে।

"বাসায় চল আগে, রামধোলাই যদি আজকে না দেই তোকে," দাঁতে দাঁত ঘষল অরণ্য।

শাহেদ অরণ্যকে খাবার টেবিলে এসে বসতে বললেন। খাবার সব বেড়ে দেওয়া হয়েচে ইতিমধ্যে। কিন্তু বাকিরা কেও এগোচ্ছে না দেখে অরণ্য অস্বস্তির সাথে সবার দিকে তাকাল। বাসা ভরা মেহমান আর ও এদের কাউকে চেনে না, কি বলে ডাকবে তাও বুঝতে পারছে না।

এরইমধ্যে মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক নিজের  থেকে এসেই পরিচিত হলেন অরণ্যর সাথে। উনি সম্পর্কে নিঝুমের ছোটমামা হন। ঢাকা ওয়াসায় চাকরি করেন। তিনিই জানালেন সবার রাতের খাওয়া শেষ, শুধু অরণ্য একাই বাকি।

কথায় কথায় তিনি আরও জানালেন যে সবাই ওর জন্যই এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলেন।

কিন্তু অরণ্য কিছুতেই বুঝতে পারছিলনা এই এত রাত জেগে এক গুষ্টি লোক কেন ওর জন্য অপেক্ষা করছে? আর বাচ্চাগুলোও সেই রকম এক একটা। সমানে ভু ভু শব্দ করে বেড়াচ্ছে। সাথে হা হা হি হি মারামারি ও চলছে সমানতালে। কোথায় ও ভাবল ঝুমের সাথে কিছুটা একান্তে সময় কাটাবে আর এতো একদম মেলা চলছে বাসার মধ্যে। এরকম জানলে জিন্দেগীতেও হ্যাঁ বলত না ও। ওই অয়ন ফাজিলটাও যদি ওকে একটু হিন্টস দিত তাহলে আজকে শিওর প্ল্যান চেঞ্জ করত ও। আজকে না এসে কালকে আসত। কিন্তু এখন আর কোনো দিকে মুভ করার অবস্থা নাই। পড়েছ মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে। অগত্যা কি আর করা, টেবিলে গিয়ে বসতে হলো অরণ্যকে।

কি মনে করে আসমা বেগম এতক্ষণে ছেলের পাশে এসে বসলেন। নিজেই পোলাও তুলে দিলেন ওর প্লেটে। অরণ্য নিঃশব্দে খাবার খাওয়া শুরু করল। মার এত চুপচাপ আচরন মানেই হলো বাসায় গিয়ে আজ ওর খবর হবে।

মুরগির রোস্টটা অরণ্যর প্লেটে তুলে দিয়ে আসমা আস্তে আস্তে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন খাবার কেমন হলো বল? সব নিঝুম রান্না করেছে। অবশ্য ওর মা আর মামী সাথে ছিলেন।

অরণ্য ওর মায়ের আচরনের  কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা। মার মুড কি ভাল না খারাপ এখন? তবে ঠোঁট টিপে একটু হাসতে দেখল মনে হলো ও মাকে। তাতে মনে হলো খুশি না হলেও রাগ করেও নেই আম্মু। এবার একটু সাহস পেল অরণ্য। আস্তে করে জিজ্ঞেস করল," এ বাসায় প্রোগ্রাম আছে আমাকে আগে জানাওনি কেন? আমি তাহলে একটু প্রস্তুত হয়ে আসতাম। একদম খালি হাতে চলে এসেছি বোকার মতো৷,আজ কার জন্মদিন? "

ওর কথায় আসমার খুব হাসি পেল। কিন্তু তিনি তথ্য ফাঁস করতে রাজি নন। তিনিও বেশ উপভোগ করছেন ব্যাপারটা। ছেলে তার কাজের চাপে একদম মনভোলা হয়ে গেছে।

" তোকে কেন জানাব? তুই আমাকে বলে এসেছিস? তাও আবার অফিস শেষে, রাত একটা বাজে। যেমন বউয়ের কাছে এসেছিস, তেমন তাকেই জিজ্ঞেস কর। "

মার কথায় এবার লজ্জা পেল অরণ্য। ইশশ... সত্যিই তো। এভাবে মায়ের কাছে ধরা খেয়ে আর কোন কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না ওর।

"ঝুমকে আগে একা পেয়ে নেই তারপর দেখাব মজা," খাবার খেতে খেতে বিরবির করতে লাগল অরণ্য।

খাবার শেষে এবার বোধহয় কেক কাটার পালা শুরু হবে। অরণ্য ড্রয়িং রুমের সাথের লাগোয়া ছোট্ট বারান্দাটায় এসে দাঁড়াল। আজ বোধহয় আর নিঝুমের সাথে কথা হবেনা। একটু মন খারাপ হলো অরণ্যর, কালকের মতো আজকেও ফোনই ভরসা।

"জিজু আপু ডাকছে। "

আশুর ডাকে চমকে উঠল অরণ্য। মনে মনে নিঝুমকে আশা করেছিল ও। কিন্তু বরাবরের মতোই আজও সে লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।

"তুমি যাও আমি আসছি," অরণ্য হাসল। " কিন্তু আশু... আজ কার জন্মদিন বলতো?"

" সেটা এখন ভিতরে আসলেই জানা যাবে জিজু।"

কোথাও থেকে কোন সাহায্য না পেয়ে অসহায় চেহারা করে আশুকে অনুসরন করল অরণ্য।ভিতরে  ঢুকেই দেখে সবাই টেবিলের চারদিকে দাঁড়ান। বাচ্চাগুলো সব কেক কাটার জন্য মোটামুটি প্রতিযোগিতা করছে। কি একটা  লজ্জার ব্যাপার, কার যে জন্মদিন অরণ্য সেটাও বুঝতে পারছেনা। ঝুম যদি একটু কাছে আসত, তাহলে না হয় ও জিজ্ঞেস করতে পারত। অরণ্য  যেয়ে সবার পিছনে দেয়ালের একপাশে চেপে দাঁড়াচ্ছিল। কিন্তু রুমানা হায় হায় করে উঠলেন, তারপর তাড়াতাড়ি অরণ্যকে মাঝখানে এনে  দাঁড় করিয়ে দিলেন।

এতক্ষণে অরণ্য মোটামুটি নিশ্চিত যে আজ নিঝুমেরই জন্মদিন। শিট... একদম বাজে একটা ব্যাপার হয়ে গেল

অরণ্য নিঝুমকে শুভেচ্ছা জানাতে যাবে কিন্তু তার আগেই অয়ন ছুরি হাতে ওর পাশে এসে দাঁড়াল।

"ভাইয়া তুই কেকের ওপাশটায় কাট আর আমি এপাশে। "

কথাটা অরণ্যর মাথায় সেকেন্ডে ষাট বার পাক খেল। হায় হায় আজ তো ওর আর অয়নের জন্মদিন। টানা কয়েকদিনের মিটিংয়ের ঠ্যালায় ও  পুরো ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। কি রকম একটা হয়ে গেল। সাথে সাথে মায়ের মুখের দিকে তাকায় অরণ্য, আসমাও ছেলের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন।

"নে হয়েছে। মনে যে নেই সে আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি। এ জন্য সবাইকে বলে দিয়েছি, কেউ যেন তোকে শুভেচ্ছা না জানায়। "

অরণ্য সত্যিই এবার লজ্জা পেল। হবু শ্বশুর বাড়ির লোকের সামনে এ কি হেনস্থা। কি মনে করবে এরা..  যে এখনই এই। মেয়ে বিয়ে দিলে নিঝুমের কি হাল করবে ও?

অয়নই বা কি মনে করবে? যদিও ঘটা করে জন্মদিন ওদের কোনোকালেই তেমন হয়নি। ওই একটা কেক এনে আশে পাশের দু এক বাসার বাচ্চাদের ডাকা হত। আর কলেজে ওঠার পর তো বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা বাজিতেই দিন পার। তবে বাসায় মা ওই দিন বিশেষ কিছু রান্না করে সবসময়। ওদের দু'ভাইয়েরই  বিরিয়ানীর প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে। তাই এইদিনে ওটা মোটামুটি কমন ওদের বাসায়৷ রায়হান সাহেবও জন্মদিন পালনে উৎসাহী নন, তবে বাসায় ঘরোয়া ভাবে একটু ভালো খাওয়া দাওয়ায় উনার আপত্তি নেই।

সেখানে এই এক বাড়ি লোকের সামনে, যার অধিকাংশই বাচ্চা তাদেরকে রেখে ওরা দুটো বড় বড় ছেলে মানুষ কেক কাটলে কেমন দেখায়? অরণ্য কথাটা অয়নের কানে কানে বলল।

এরপরের কাজটুকু অয়নই করল। অরণ্য, আসমা আর রুমানা দু'জনের হাত ধরে নিজেদের পাশে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। আশু এই ফাঁকে অনেকগুলি ছবি তুলল ওদের।

এত রাতে এমন হৈ হুল্লোড় করে জন্মদিন, অরণ্যর বেশ মজাই লাগল। শুধু একটা জিনিসে ওর মন ভরল না, সেটা হলো ঝুম এর সাথে তখনও ওর কোন কথা হয়নি। অবশ্য চোখে চোখে দুই একবার ইশারা বিনিময় হয়েছে... কিন্তু তাতে কি আর মন ভরে?

নিঝুমের আজ উপর নিচ করতে করতে পায়ের পাতা শেষ। এত স্বল্প সময়ে অনুষ্ঠানের ব্যাবস্থা  করতে যেয়ে ওকে দৌড়াতে নয়, পারলে উড়তে হচ্ছে। তবে অরণ্যর জন্য এটুকু করতে পেরে ওর খুব ভাল লাগছে। দুইদিন আগে আসমা আন্টির কাছে ফোন দিলে ফোনটা হবু শাশুড়ি নয় বরং অয়ন ধরেছিল। আন্টিকে চাইতেই অয়ন বলেছিল, ঝুমি প্লিজ একটা সিক্রেট কথা ছিল। নিঝুম বেশ অবাক হয়েছিল অয়নের এমন আচরনে... সিক্রেট কথা?  তাও আবার ওর সাথে! কি এমন কথা থাকতে পারে অয়নের ওর সাথে যা অরণ্যর সামনে বলা যায়না।

এরপর অয়নই ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিল "ভাইয়ার জন্মদিনে তোমার কোনো প্ল্যান আছে?"

"অরণ্যর জন্মদিন! কবে?" নিঝুম কি বলবে বুঝতে পারছিল না। অরণ্যর সাথে ওর পরিচয়ের আসলে তো খুব বেশিদিন হয়নি আর ও এসব জিজ্ঞেসও করেনি।

"পরশু..." অয়ন জানিয়েছিল।

"আমি তো জানতামই না। থ্যাংকিউ সো মাচ," মনে মনে সত্যিই খুশি  হয়েছিল নিঝুম। পরশু, তারমানে একদিন অন্তত সময় পাওয়া যাচ্ছে হাতে।

"ইউ আর ওয়লকাম কিন্তু ওই দিন কিন্তু এই অধমেরও জন্মদিন, " অয়ন দুষ্টুমিচ্ছলে বলেছিল।

"ওহ.. হ্যাঁ, তাই তো, " নিঝুম বোকার মতো হেসে ফেলেছিল।

এরপরের বাকি প্ল্যানটুকু নিঝুম, আশু, অয়ন, আসমা আর রুমানাকে সাথে নিয়ে করেছে। ওদের প্ল্যান শুনে শেষে শাহেদ বলেছেন, "এক কাজ করি। ওই দিন তাহলে কাছের আত্মীয়দের বাসায় আসতে বলি। অরণ্যর সাথে ওদের পরিচয়টা এই ফাঁকে হয়ে যাক।"

অরণ্যকে কতটা আনন্দ দিতে পারল বুঝতে পারছেনা নিঝুম। একেতো সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে এসেছে বেচারা,  তারপর কাপড় চোপরও পাল্টায়নি। সাথে অসহায়ের মত চেহারা করে এদিক ওদিক যেভাবে তাকাচ্ছে তাতে ওকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে উল্টো কষ্ট দিয়ে ফেলল কিনা বুঝতে পারছেনা নিঝুম। বাবার প্রস্তাবটা বোধহয় এখন না রাখলেই হতো। আত্মীয়দের সাথে বিয়ের পরে পরিচয় হলেও তো তেমন কোন সমস্যা হতো না। একদম নিজেরা নিজেরা করলে বোধহয় বেচারা এত অস্বস্তিতে ভুগত না।

ঘড়িতে রাত তখন প্রায় তিনটা বাজে। আত্মীয়রা সব যার যার বাসায় যাওয়ার জন্য তোরজোর করছে, আসমা বেগমও বাসায় যাওয়ার জন্য একদম তৈরি। অয়ন গাড়িও বের করতে যাচ্ছিল কিন্তু মাঝখানে বাঁধ সাধলেন নিঝুমের বাবা। প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, " রাত তো প্রায় শেষ বেয়াইন, এখন আর বাড়ি গিয়ে কি করবেন? তারচেয়ে বরং একেবারে সকালের নাস্তা সেড়ে বাসায় যান। "

কথাটা শুনে আসমা প্রবল আপত্তি জানালেন কিন্তু নিঝুমের আত্মীয়রা সব একেবার জোঁকের মতো তাকে ছেঁকে ধরলো। নিঝুমের বড় ফুপি দিলারাও  শেষ পর্যন্ত রায়হান সাহেব আর আসমা বেগমকে অনুরোধ করলেন এত রাতে বাসায় না ফিরতে। বাকি রাতটুকু সবাই না হয় গল্প করেই কাটিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু অরণ্যর সকাল থেকেই আবার অফিসে মিটিং চলবে, ওকে যে কোনভাবেই এখন বাসায় ফিরতেই হবে। ঘুমে চোখ ভেঙ্গে আসছে ওর। কিন্তু আসমা একা একা ওকে  ছাড়বেনও না। ছেলে সারাদিন খেটে খুটে এখন গাড়ি চালাতে গেলে শেষে কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট করে বসে থাকবে, আসমার এক কথা  অরণ্যকে কোনভাবেই তিমি একা ছাড়বেন না। ওকে নিয়ে এমনিতেই খুব ভয়ে থাকেন তিনি।

শেষে দোতলার গেষ্টরুমে ঘুমানোর ব্যাবস্থা হলো অরণ্যর জন্য। অরণ্যর বাবা - মায়ের জন্য নিঝুমের রুমটা দেওয়া হলো।

বাকি আত্মীয়রা নিচের ড্রইং রুম আর অন্যান্য রুমে থাকবে। এরমধ্যে অয়ন আর আশু মিলে এক ঘোষনা দিল। সবাই মিলে ড্রইংরুমে বসে গানের কলির শেষ অক্ষর নিয়ে খেলবে.... ঘুমুবে না। না..  না... করতে করতে শেষ  পর্যন্ত বাসার অধিকাংশ সদস্যই আবার এসে খেলায় অংশ নিল। অরণ্যও ভদ্রতা করে বসল কিছুক্ষণ। কিন্তু ওর যেভাবে চোখ লাল হয়ে উঠছে তা দেখে আসমা ওকে ঠেলে ঘুমাতে পাঠালেন উপরে, না হলে কালকের মিটিং একদম পন্ড হবে ওর।

অরণ্য উপরে এসে বিছানায় শুতে যাবে অমনি দরজায় ঠক ঠক শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়াল। এখন আবার কে এল?

দরজাটা খুলতেই দেখে আসামী হাজির।

"শুভ জন্মদিন"

নিঝুমের হাতে একটা তোয়াল আর কি যেন।

অরণ্য মুখটা বেঁকিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল।

"কি হলো ? রাজপুত্তুরের চেহারা এমন পেঁচামুখো হলো কি করে?" নিঝুমের খুব মজা লাগছে। বেচারা বোধহয় মনে করেছিল এত রাতে নিঝুম ওকে একা একা ডেকেছে.... হি হি।

অরণয় এবার এমন কটমট করে নিঝুমের দিকে তাকাল যে পারলে ওকে চোখের আগুন দিয়েই ও ঝলসে ফেলবে।

"কি হলো, আশ্চর্য তো... এতো সুন্দর সারপ্রাইজ দিলাম।" নিঝুম আসলেও হাসি আটকাতে পারছেনা। অরণ্য রাগলেও এত সুন্দর দেখাচ্ছে...  মনে হচ্ছে ক্লাস টু এর বাচ্চা।

অরণ্য উত্তর না দিয়ে আস্তে করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

"একি... কাপড় পাল্টাবেন না? আব্বু কাপড় পাঠিয়ে দিল।"

নিঝুমের কথায় ওর হাতের দিকে তাকাল অরণ্য। কাপড় আসলেই পাল্টানো দরকার ওর। তাই আর কথা না বাড়িয়ে নিঝুমের হাত থেকে টেনে নিল ওগুলো।

এরপর নিঝুমের সামনেই গায়ের শার্ট একটানে খুলে বিছানায় ফেলল।

নিঝুম ভ্যবাচেকা খেয়ে সাথে সাথে চোখ বন্ধ করল, " ছি...আপনার কোনো লজ্জা শরম নেই। এরকম ভাবে একটা মানুষের সামনে...  ছি।"

"আছে তো। এজন্য শুধু শার্ট খুললাম। আর এতে এত ছি.. ছি.. এর কি আছে? " বলেই  পাশের ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকল অরণ্য। এরপর কাপড় পাল্টে এসে বলল, " বউয়ের সামনে সব খোলাই জায়েজ আছে।"

নিঝুম সাথে সাথে দুই হাত দিয়ে কান চাপল। ওর এখন জরুরী ভিত্তিতে এখান থেকে যাওয়া উচিত, না হলে এই লোকের শয়তানি শুরু হবে।

"আপনি ঘুমান, আমি গেলাম।"

"এরকম করে অপমান করার কি দরকার ছিল?"

"মানে?"

"মানে আবার কি?  এত রাতে লোভ দেখিয়ে নিয়ে এসে এখন এক পিস কেক খাইয়ে বলছে শুভ জন্মদিন। যেন কেক কেনার পয়সা আমার নেই। "

অরণ্যর কথায় নিঝুম এবার সত্যি খানিকটা বিব্রত বোধ করল। তাইত, অরণ্যর জন্মদিনে বিশেষ কিছু একটা দেওয়া উচিত ছিল ওর। কিন্তু কি কিনবে বুঝতে না পেরে নিঝুম শুধু সুন্দর একটা কার্ড কিনেছে। মনে করেছে পরে অরণ্যকে সাথে নিয়ে একটা সুন্দর দেখে শার্ট কিনে দিবে। আসলে ও এত লম্বা.... আর নিঝুমের শার্ট কেনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আর অন্য কিছু কি কিনবে ওর মাথায় আসেনি। আসলে অরণ্যর কি ভাল লাগে সেটা ও এখনও পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেনি। আর জন্মদিনের সামনে জিজ্ঞেস করলেই ও ধরে ফেলত। আর অরণ্যর জন্য খালি একা কিনলে তো হবে না, অয়নকেও তো দিতে হবে সেক্ষেত্রে। এতসব ভেবে শেষ পর্যন্ত ও কেক আর কার্ডই শুধু কিনেছে।

"কি? কথা সব হাওয়ায় উড়ে গেল ম্যাডামের?" অরণ্য ওর সামনে এসে তুড়ি বাজাল।

"মোটেই না। আমি গিফট আপনাকে ঠিকই দিব। কিন্তু আমি আসলে আপনার শার্টের সাইজ জানি না, তাই কিনিনি, " নিঝুমের মনটা একটু খারাপ হলো। এত কষ্ট করল সারাদিন ধরে আর তার কি পুরষ্কার মিলল। হুহ্ আগে জানল কিচ্ছু করত না। ফোনে এক হ্যাপি বার্থডে জানিয়ে দিলেই হতো। কোনো কথাও শোনা লাগত না।

"আমার শার্টের সাইজ জানতে আবার আমাকে লাগবে কেন তোমার? অয়নতো আছেই তোমার গুনধর চামচা। "

অরণ্যর কথায় এবার হেসে ফেলল নিঝুম। তা অবশ্য হতো। কথাটা যে ওর মাথায় আসেনি তা নয়। বাট ও অরণ্যর সাথে যেয়ে ওদের শার্ট কিনে দিবে। অরন্য পছন্দ করুক অয়নের জন্য, ও অরণ্যরটা পছন্দ করে কিনে দিবে।

"ও ম্যাডাম... আবার কোথায় হারিয়ে গেলেন?" অরণ্যর কথায় সচকিত হল নিঝুম।

"না কিছু না। আপনি ঘুমান।"

"ঝুম প্লিজ পাঁচ মিনিট বস না। আমি কত কষ্ট করে তোমার জন্য এতটা পথ ঠেঙিয়ে এলাম," অরণ্য কাতর স্বরে বলে।

"প্লিজ প্লিজ এখন না। এখন আব্বু আমাকে উপরে পাঠিয়েছে । সবাই জানে আমি এঘরে। এখন আর দাঁড়ান যাবে না, অন্য কোনোদিন। " নিঝুম বের হতে যাচ্ছিল, কিন্তু অরণ্য তার আগেই ওর পথ আটকে দাঁড়াল।

" উহু... আমার জন্মদিনের উপহার না নিয়ে তো আমি তোমাকে যেতে দিব না ঝুম।"

চলবে.....

গল্পটি ভাল লাগলে ছোট্ট স্টার বাটনটি চেপে ভোট দিন। কমেন্টে আপনার অনুভূতি আমাকে জানান, ধন্যবাদ।

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top