৬ষ্ঠ পর্ব

নিঝুম কি পরবে বুঝতে পারছেনা। অরণ্য ওই দিন নীল পরতে বলেছিল। কিন্তু আজও কি ও নীলই পরবে? কিন্তু কামিজ পরবে না শাড়ি পরবে? ওহ.... মেয়েদের কাপড় এত রকমের হওয়ার যন্ত্রনাটা খুব। এ পর্যন্ত দশটা কাপড় বের করে আয়নায় ধরছে আর রেখছে নিঝুম। কিন্তু কোনটা যে অরণ্য পছন্দ করবে?

"আপু তুই জিজুকে ফোন দে.... আর ভ্যাজাল এখানেই খতম কর। সবগুলো কাপড়ের আয়রন আজকেই নষ্ট হবে মনে হচ্ছে।"

আশুর কথায় হাসে নিঝুম । একেবারে জিজু! কালও ভাইয়া বলে ডাকছিল।

" আপু তুই হাসছিস কেন? তোর কি মনে হচ্ছে আমি তোর সাথে তামাশা করছি?"

"নারে বাবা। আচ্ছা আর হাসলাম না কিন্তু তুই আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচা প্লিজ। আমি কোনটা পরব এখনও ঠিক করতে পারছিনা," নিঝুম আশুর দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকাল।

"তাহলে বাইরে থেকে আসার সময় আমার জন্য দুটো করনেটো আইসক্রিম আনতে হবে, কোন নড়চড় হওয়া যাবে না," আশু দু'আঙ্গুল তুলে দেখায় মুনাকে।

"দুটো কেনো? তুই তো মানুষ মাত্র একজন। " নিঝুম জিজ্ঞেস করল।

আশু খুব আইসক্রিম খায়, খুব বাজে অভ্যাস আছে ওর এই ব্যাপারে। সুযোগ পেলেই খালি বাইরে থেকে খাবার কিনে আনে।

"তাতে কি? একটা তোর পক্ষ থেকে আর একটা জিজুর পক্ষ থেকে, " আশু হাসে। এই সুযোগ আপুর কাছ থেকে বাইরের কিছু খাওয়ার। নিঝুম বাইরের জিনিস তেমন একটা খেতে চায়না। পারলে ও চানাচুরও বুঝি ঘরে বানিয়ে খায়, একবার বানিয়েও ছিল। কিন্তু তেমন ভালো হয়নি।

"না। আমি একটা এনে দেব, প্রমিস। কিন্তু অরণ্যকে কিছু বলতে পারব না, " নিঝুম হাতের কামিজটা আলমারিতে তুলতে তুলতে বলল।

"তা হলে আমিও তোমার হেল্পের মধ্যে নাই, বুইঝো কিন্তু।"

আশু মুখটা হাড়ির মত করে রাগে। আপুটা সব সময় এমন করে। ওর বাচ্চাকে ও শিওর না খাইয়ে মেরে ফেলবে সুস্থ রাখতে গিয়ে।

"অ্যাই তুই এরকম দুষ্টু কেন? ওকি তোর দুলাভাই হয়েছে এখোনো? " নিঝুম সত্যি বিরক্ত, ওদের বিয়ে এখনও হয়নি আর তার আগেই কি অবস্থা শুরু করে দিয়েছে আশু।

"হুমম... আমিই কেবল দুষ্টু আর তোমরা সাধু। এইজন্যে দরজা বন্ধ করে জিজুর বুকের মধ্যে লুকিয়ে ছিলে?" আশু দুম করে কথাটা বলেই আবার থেমে গেল।

আশুর কথায় নিঝুম এমনভাবে কেঁপে উঠলো যে, ভূমিকম্প হলেও বুঝি এর চেয়ে কম কাঁপত ও।

" কি.. কি বললি তুই?"

"কি বললাম? বললাম যে দুইটা আইসক্রিম দিবা না দিবানা? " আশু আগের মতই স্বাভাবিক। ওদিকে নিঝুমের ঘাম দিয়ে জ্বর ছুটে যাওয়ার অবস্থা।

"উম.. ম..মানে তুই কি করে দেখলি, না মানে দরজা তো বন্ধ ছিল।"

নিঝুম এবার আর লুকাতে পারলনা। জিজ্ঞেস করেই ফেলল।

"তাতে কি?" আশু নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে বলে। যেন এটা একটা মশা-মাছির মতো তুচ্ছ কোন ব্যাপার।

"তাতে কি মানে? আশু তুই কি করে দেখেছিস প্লিজ বল?" নিঝুমের কেঁদে দেওয়ার অবস্থা।

"আগে বল আইসক্রিম দুইটা..." আশু হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। নিঝুমের চেহারা দেখে ও হাসি আটকে রাখতে পারছেনা। উহ....আপু না একটা ভীতু বগার ডিম।

"আচ্ছা আচ্ছা, " নিঝুমের হাত-পা তখন কাঁপছে। আশু যদি মাকে বলে দেয়! আর.. আর একথা যদি বড়ফুপির কানে যায়? গায়ের তাপমাত্রা দ্রত ওর হিমাংকের নিচে না চলে যায়।

"আপু কমনসেন্স বলে কিছু জিনিস আছে এই দুনিয়ায় বুঝলা, তোমরা দুজনে ঘরের মধ্যে দরজা আটকানো থাকলে কি আর করতে পারো, এটা বুঝতে আবার দেখা লাগে নাকি? আর আমি আন্দাজে ঢিল মারছি, সত্যি না হলে তোমার রিয়্যাকশন আলাদা হত।"

আশুর কথায় নিঝুমের মনে হলো খাটের নিচে গিয়ে লুকায় ও। ছি... কি গাধী ও?

"আশু তুই বড়ো বেশি পেকে গেছিস। আমি তো কাপড় ঠিক করছিলাম দরজা আটকে," বলেই জিভে কামড় দিল নিঝুম। এই তো সর্বনাশ করল ও নিজের।

"ও মাই গড! জিজু তোকে ওই অবস্হায় দেখছে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে?" আশুর চোখ ছিটকে চোখের কোটর থেকে বের হয়ে আসার দশা।

"মানে? তুই জানতি যে অরণ্য ওয়াশরুমে?" নিঝুম অবাক।

"উম.. মানে জিজু ওয়াশরুম কোথায় জিজ্ঞেস করছিল। তো আমি তোরটা দেখিয়ে দিয়েছি।"

আশু এবার মুখ ঘুরিয়ে বসল। আপু এবার চিল্লাবে শিওর।

"আশু তুই... গাধা, তুই ওকে আমার বাথরুম কেন দেখাবি?মেয়েদের বাথরুমে কত জিনিস থাকে পারসোনাল। "

নিঝুম সত্যি বেশ খেপেছে। আশু মাঝে মাঝে হুটহাট করে এমন কিছু কাজ করে, এতে নিঝুমের খুব রাগ হয়।

"সরি আপু, এটা আমার মাথায় ছিল না। সত্যি সরি। আর কক্ষনো হবে না। আচ্ছা একটা আইসক্রিম আনলেই হবে।"

আশুর কথায় নিঝুমের রাগটা পড়ে গেল। এতটা রিয়্যাক্ট করাও বোধহয় ঠিক না। আশু এখনো তো আসলে ছোট। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার মাত্র। নিঝুমের নিজেরই এখনও কতো ভুল হয়।

"ইটস ওকে। আর এই ভুল করবি না। অরণ্য না হয়ে অয়নও হতে পারত, তাই না? আর অরণ্য হলেও আমাদের বিয়ে এখনও হয়নি। আমার কথাটা কি তুই বুঝতে পারছিস আশু? " নিঝুম এবার নরম গলায় কথাটা বলে।

"হুমম... সরি আপু," আশুও দুঃখিত স্বরে বলে। ভুল তো আসলে ওর হয়েছে।

"আচ্ছা এখন কি পরব সেটা ঠিক করি চল।" নিঝুম আলমারি খুলে মেরুন রঙের একটা শাড়ি খুঁজতে লাগল। সিল্কের এই শাড়িটা ওর মামা সৌদি থেকে এনে দিয়েছিল যখন ও ইন্টার পড়ে। যতবার ও পরেছে ততবারই সবাই ওকে সুন্দর বলেছে।

............................................................

"তোমার কি পেট ব্যাথা করছে? "

অরণ্যর কথায় চমকে তাকাল নিঝুম।

"জি!"

কি বলছে অরণ্য। ওর পেট ব্যাথা করবে কেন?

"না মানে তুমি যেভাবে, মোচড়া মুচড়ি করছ তাতে সেরকমই মনে হচ্ছে। "

অরণ্যর কথায় নিঝুমের অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল। প্রায় বিশ মিনিট হয়ে গেছে ওরা গুলশানের এই রেস্টুরেন্টে এসে বসেছে। অর্ডার দেওয়ার পর থেকে অরণ্য সেইযে একভাবে নিঝুমকে দেখছে, ওর তাকান দেখে নিঝুম কোন ভাবে বসেই আসলে স্বস্তি পাচ্ছেনা।

কিন্তু অরণ্যর দেখা মোটে শেষই হচ্ছে না। কি দেখছে এত আল্লাহই জানে। নিঝুমের মনে হচ্ছে ও বেড়ালের সামনে বসে থাকা কোনো প্রজাপতি বা টিকটিকি... নড়লেই খপ করে ধরে খাবে। এখন এরকম করে তাকিয়ে থাকলে কতক্ষন স্থির থাকা যায়?

"তুমি এমন কিপটু কেন?" অরণ্য বিরস মুখ করে বলল।

"কিপটু?"

নিঝুম বুঝলো না ও কি এমন কিপ্টেমি করল। ওরা তো কোন কথাও বলছে না।  একজন সেন্টার অফ দি গ্যালাক্সির মতো কেন্দ্রে চুপ করে বসে আছে আর আরেকজন শাটল ট্রেনের মতো তার চারপাশে পাক খাচ্ছে ননস্টপ গতিতে, কোন স্টপেজ খুঁজে পাচ্ছে না।

"তা নয় তো কি? প্রায় নয় ঘন্টা বিয়াল্লিশ মিনিট পর দেখলাম তোমাকে আর তুমি আমাকে একটু শান্তি করে তোমাকে দেখতেও দিচ্ছ না। আমি দেখলে কি তোমার কোথাও লস হচ্ছে?" অরণ্য ঠিক একটা ছোট ছেলের মতো মুখ করে বলল।

নিঝুম এবার আর হসি আটকে রাখতে পারলনা। লোকটা কি? একদম পাগল একটা।

নিঝুমের হাসির তরঙ্গ অরন্যর মুগ্ধতাকে যেন আরো চারগুন বাড়িয়ে দিল।

অরণ্য বুঝতে পারছেনা, নিঝুমের চোখগুলো আসলেই সুন্দর নাকি ওগুলো নিঝুমের চোখ বলেই ওর কাছে খুব বেশি আকর্ষনীয় মনে হচ্ছে। সাথে কাজল দেওয়াতে এত অদ্ভুত একটা ইফেক্ট তৈরি হয়েছে যে অরণ্যর মনে হচ্ছে কালকের মতো আরো দুটো আদর ঝুমের কপালে একে দেয়।

হতাশ হয়ে নিজেই মাথা এপাশ ওপাশ করে অরণ্য।

না এত ধরনের দুর্দান্ত ইচ্ছে নিয়ে নিঝুমকে ওর বাবার বাড়িতে বেশিদিন ফেলে রাখা যাবে না, বিয়ে আর্জন্টলি ফিক্সড করতে হবে।

"স্যার, খাবার কি সার্ভ করব? " ওয়েটারের কথায় চমক ভাঙল অরণ্যর। নিঝুম তখনও মুখ নিচু করে হাসছে আর শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে পেচাচ্ছে। আচ্ছা নিঝুমকে একটা শাড়ি কিনে দিলে কেমন হয়? এটুকু তো অরণয় এখন দিতেই পারে। তখনই ও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, এখান থেকে বের হয়েই নিঝুমের জন্য একটা শাড়ি কিনবে ও।

খাওয়ার সময় তেমন একটা কিছু খেলনা নিঝুম। আর অরণ্য বার বার ওর প্লেটে এটা ওটা সমানে তুলে দিচ্ছে। নিঝুম অরন্যকে বোঝাতে পারছেনা যে লজ্জায় না, ও আসলেই কম খায়।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে অরণ্য ওকে নিয়ে একটা বুটিক হাউসে ঢুকলো। অরন্য প্রথমে পোড়া মাটির রঙের একটা শাড়ি কিনল। আসমা আন্টির নাকি এটা খুব পছন্দের রং। ওটার পরে একদম টকটকে লাল একটা জামদানী কিনল অরণ্য।

নিঝুম প্রথমে বুঝতে পারেনি যে অরন্য লাল শাড়িটা ওর জন্য কিনেছে। যখন বুঝল ততক্ষণে শাড়ির দাম পরিশোধ।

"অরণ্য আপনি প্লিজ এগুলো কিছু করবেন না। আ.. আমি ফ্যামিলির পারমিশন ছাড়া এটা নিতে পারবনা," নিঝুম ভয় পাওয়া গলায় কথাগুলো বলল।

"ঝুম এমন করে কেন বলছ? আমি আমার বউকে পছন্দ করে একটা শাড়িও কিনে দিতে পারবনা? "

অরণ্যর কথায় নিঝুম পড়ল মহা ফ্যাসাদে। কি জবাব দিবে ও এই কথার। বউ তো... কিন্তু বিয়ে হওয়া বউ আর বিয়ে ছাড়া বউয়ের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক।

"অরণ্য আপনি বুঝতে পারছেন না। আমি..  আমাদের মাত্র বিয়ে ঠিক হয়েছে। এখনও বিয়ের ডেট পর্যন্ত ফিক্সড হয়নি। আমি এখন কি করে এটা নেই?" নিঝুম বুঝতে পারছে অরণ্য এটা ওকে আন্তরিক ভাবেই নিজের মনে করে দিচ্ছে কিন্তু এই মুহুর্তে এটা ওর পক্ষে নেওয়া সম্ভব না।

" নিঝুম এর সাথে বিয়ে ফিক্সড হওয়ার কি সম্পর্ক? বিয়েটাতো হচ্ছে তাইনা? " অরণ্য অবুঝের মতো বলল। ওর খুব রাগ হচ্ছে, নিঝুমকে ও যতটা কাছের ভাবে নিঝুম বোধহয় ওকে সে ভাবে ভাবে না। বুকের কাছটায় কস্টের মতো কিছু একটা হচ্ছে অরণ্যর... এটার নাম কি? অভিমান!

নিঝুম অরণ্যকে কি করে ওর সমস্যাটা বোঝাবে বুঝতে পারেনা। ওর পরিবার যথেষ্ট রক্ষনশীল এখনও। এই যে আজকে ও অরণ্যর সাথে এসেছে, সেটা আজকের মধ্যেই ওর দাদুর বাড়িতে চাউর হয়ে যাবে। ওর চাচীরা এটা নিয়ে ঠিকই নানা কথা বলবে। শুধু ওর মা এখন আর তেমন পাত্তা দেয়না এসব কথা। আর বড়ো ফুপির কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছে বাবা প্রথমেই। কিন্তু এখন যদি ও শাড়ির প্যাকেট হাতে নিয়ে বাসায় ঢোকে তাহলে আর কোনোদিন অরণ্যর সাথে বিয়ের আগে বের হতে দেবেনা ফুপি। আর নিঝুম এটা একেবারেই চায় না। শাড়ি কাপড়ের লোভ ওর নেই কিন্তু এই যে আজ অরণ্যর সাথে সময় কাটালো এটা ওর কাছে অনেক কিছু।

"নিঝুম?"

"জি?"

"আমাদের বিয়েটা কি হচ্ছে... মানে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাওতো, নাকি তোমাকে ধরে বেঁধে  বিয়ে দিচ্ছে? " অরণ্যর গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, খুব ভারি কিছু যা নিঝুমকে আমূলে কাঁপিয়ে দিল। হঠাৎ করে নিঝুমের কান্না চলে আসে। লোকটা কি ওর উপর রেগে যাচ্ছে? কিন্তু ওতো অরণ্যকে অপমান করার জন্য কথাটা বলেনি।

অরণ্যর বোধহয় এবার নিঝুমের অন্ধকার মুখটা খেয়াল করল, তাই আর কথা বাড়াল না, "আচ্ছা চল এখন, আগে এখান থেকে তো বের হই। "

নিঝুমও আর কথা বাড়াল না। অরণ্যর পিছু পিছু  দোকান থেকে বের হয়ে আসল। গাড়িতে বসেও আর তেমন কথা হলো না। অরণ্য যখন বাসার সামনে গাড়ি থামাল , নিঝুম তখন ওকে আবারও বোঝানোর চোষ্টা করল। কিন্তু লোকটা মহা জেদী। নিঝুম বোঝাতে গেলেই, অরন্য শান্ত স্বরে হাত নেড়ে ওকে থামিয়ে দিল।

"ইটস ওকে, তোমাকে নিতে হবে না। আমারই ভুল হয়েছে। আমার ভাবা উচিত ছিল তুমি আসলে তো আমার কেউ নও। সরি এগেইন। "

নিঝুম থতমতো খেয়ে চুপ করে গেল। অরণ্য যে রেগে এ কথা বলছে সেটা এখন একটা পাগলেও বুঝবে কিন্তু লোকটা ওর অবস্থানটা বুঝতে পারছেনা। ওরা পৃথিবী নামক একটা অদ্ভূত গ্রহে বাস করে। এখানে বুকের ভেতর যা থাকে সেটাকে লুকিয়ে রাখতে হয়, এটাই নিয়ম। আজকে ওর যে আত্মীয়রা শাড়িটা দেখলে চোখ বড় বড় করবে, বিয়ের পর তারাই আবার স্বামী ঈদে কয়টা শাড়ি কিনে দিলো সেটা নিয়ে রীতিমতো জেরা করবে। তারপর সেই কম বেশির সাথে নিজেদের স্বামীর সামর্থ্যকে নিয়ে তুলনা করবে। পুরো ব্যাপারটাই এক কথায় অসহ্য।

গাড়ি নিঝুমদের বাড়ির গেটে এসে থামতেই,
অরণ্য নেমে নিঝুমের সীটের পাশের দরজাটা খুলে দিল।

নিঝুম নেমে অরণ্যর দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে  তাকাল যে অল্প সময়ের জন্য সেও ওর সাথে ভেতরে আসুক, বাবা - মার সাথে একটু কথা বলে যাক। কিন্তু অরণ্য সোজা গিয়ে নিজের সিটে বসল আর মুখ বাড়িয়ে আসি বলেই গাড়ি স্টার্ট দিল। নিঝুম কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু তার আগেই ওর সামনে দিয়ে গাড়িটা কেমন সুপারসনিক বেগে  বের হয়ে গেল।

বাসায় ঢুকে নিঝুম সোজা নিজের ঘরে আসল। ধ্যুৎ.. অরণ্যতো ওর সমস্যাটা বুঝলোই না।  বাবা মা নিঝুমকে কখনো কোনো কাজে তেমন একটা না করে না। তার কারন ও তেমন চালাক না হলেও নিজের গন্ডীর বাইরে খুব একটা যায় না। এই ঢাকার বুকে জন্মানো সত্ত্বেও ও নিজের শহর পুরোটা ভাল করে এখনও চেনে না। একবার পুরানো ঢাকায় এক বান্ধবীর বাসায় যেতে যেয়ে  ওর মাথা খারাপ হওয়ার জোগার। এত চাপা গলি যে গাড়িই ঢোকে না। শেষে অদীয়া এসে ওকে উদ্ধার করে। অদীয়ার  আব্বার পোষ্টিং তখন নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজারে। অদীয়া তখন ওর নানুর বাসায় থাকত, টিপুসুলতান রোডে। এরপর  থেকে কোনো বান্ধবীর বাসার প্রোগ্রামে গেলেও  নিঝুম এখন  আগে অদীয়াকে পটায়।

আর এখন সেই মেয়ে যদি  দুম করে একটা আট হাজার টাকার শাড়ি নিয়ে বাসায় ঢোকে..  সবাই কি বলবে? আর অরণ্য ব্যাপারটা রাগের মাথায় না নিলে নিঝুম তাকে বোঝাতে পারত যে, এমনিতেই মেয়েদের গায়ে ট্যাগ লাগানো থাকে যে মেয়েরা লোভী। যত পারে ছেলেদেরকে শুধু শোষন করে। অথচ কোনো ছেলে মনে হয় সহজে বলতে পারবেনা... তার মা তার বাবার টাকা সব ফুর্তি করে উড়ায়। নিঝুমরাও মধ্যবিত্ত। রুমানা সব সময় নানা খাত থেকে টাকা বাঁচিয়ে সংসারের জন্য এটা ওটা করে। আর নিঝুমও কোনো ভাবেই নিজেকে ঐ লোভী মেয়েদের তালিকায় দেখতে চায় না।
লোভী এই তকমাটা শুনতে একদম ঘেন্না করে ওর। নিঝুম বুঝতে পারছে যে, অরণ্যর দেওয়ার মধ্যে অন্য কিছু নেই। কিন্তু বিয়ের আগে এটা নেওয়া ওর পক্ষে সম্ভব না। ও বলতে চেয়েছিল যে, অরণ্য বরং এটা বিয়ের শাড়ির সাথে দিক অথবা বিয়ের পরে।

অরণ্যর বাবা মাও তো ব্যাপারটা ভালো চোখে না দেখতে পারে। মাত্র বিয়ের কথা হয়েছে আর নিঝুম এত টাকার একটা জিনিস গিফট হিসেবে নিয়ে নিয়েছে। না নিঝুম পারবেনা। আর নিঝুম অরণ্যর আয় সম্পর্কে এখন কিছুই জানেনা। কত টাকা বেতন পায়, ওর নিজের চলতে কত খরচ হয় আর পরিবারে কত দেয়... সব মিলিয়ে একদমই অদ্ভুত এক পরিস্থিতি।

আার বিয়ের আগেই পুরো দমে বউ হয়ে যাওয়া নিঝুমের পছন্দ নয়। প্রতিটা জিনিষের আলাদা একটা মজা আছে। বিয়ের পরে নিজের সংসারের জন্য একটা ডালের চামচ কেনার গল্প ওর মা এখনও শোনায়। তাহলে এই শাড়িটা, এই দিনটা না হয় ওদের একটা মধুর স্মৃতি হয়ে থাক। কিন্তু ওই লোক শুনলে তো ও বলবে। রাগের সাথে যেভাবে গাড়ি স্টার্ট করল, তাতেই নিঝুমের এখন ভয় হচ্ছে।

..............................................................

এশার আযানের আগে আগে রুমানা এসে মেয়ের রুমে ঢুকলেন।" নিঝু.... অরণ্য তোকে নামিয়ে দিয়ে কোথায় যাবে  তোকে কি কিছু  বলেছিল?"

মার কথায় নিঝুম বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। "মানে? আমি কি করে জানব উনি কোথায় যাবে?"

"না মানে.... আসমা আপা ফোন দিচ্ছিলেন। উনি অনেক সময় ধরে অরণ্যকে ফোন দিচ্ছেন। ফোন বাজছে কিন্তু ছেলেটা রিসিভ করছে না। তাই উনি জানতে চাচ্ছিলেন যে তুই কিছু জানিস কিনা?"

"না মা আমি কিছু জানি না, " নিঝুমের গলাটা কেঁপে গেল। কি বলছে মা এসব? এই ছেলে ওকে মেরে ফেলবে কষ্ট দিয়ে নিঝুম এখন নিশ্চিত।

এতক্ষন তো এক রকমের কষ্ট ছিল...  কিন্তু এখন  নতুন এক দুশ্চিন্তায়  পড়লো নিঝুম। না পেরে অরণ্যর নাম্বারে কল করল নিঝুম । কিন্তু একই অবস্থা। ফোন রিং হয় কিন্তু কল কেউ ধরে না। অরণ্য অবশ্য ওর উপর রাগ হয়ে আছে, সে কারনেও না ধরতে পারে। কিন্তু বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারলনা নিঝুম। ওর টেনশনে হাত পা কাঁপছে। আবারো ফোন করল ও.... অরণ্য ফোন কেন ধরছে না?

"প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ,
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ

প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ,
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ

তোমায় যত গল্প বলার ছিল,
তোমায় যত গল্প বলার ছিল,
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে ছড়িয়ে রয়ে ছিল,
দাওনি তুমি আমায় সেসব কুড়িয়ে নেওয়ার কোনো কারণ

প্রেমে পড়া বারণ,
কারণে অকারণ,
ওই মায়া চোখে চোখ রাখলেও ফিরে তাকানো বারণ

প্রেমে পড়া বারণ………………………….

শূন্যে ভাসি, রাত্রি এখনো গুনি,
তোমার আমার নৌকা বাওয়ার শব্দ এখনো শুনি।
শূন্যে ভাসি, রাত্রি এখনো গুনি,
তোমার আমার নৌকা বাওয়ার শব্দ এখনো শুনি।
তাই মুখ লুকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বসন্তের এই স্মৃতিচারণ

প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
মনে পড়লেও আজকে তোমায় মনে করা বারণ!"

Lyrics - Ronanjoy Bhattacharjee

আবারও ফোন করল নিঝুম । যত বার কল কেটে যাচ্ছ ততবারই ওর বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। তারপরই আবার কল করছে নিঝুম এই আশায় যে বুঝি এইবার ধরবে। কিন্তু না, কোনো খবরই নাই।

নিঝুমের অবস্থা এমন হলো যে, না পারছে অরণ্যর বাসায় ফোন করতে, না পারছে ওর কাছে যেতে। রাতের খাবার ও কি খেল কিছুই বলতে পারবেনা। এর মধ্যে শাহেদ একবার অরণ্যদের বাসায় ফোন দিয়েছিলেন। রায়হান সাহেব বলেছেন, ওদের দুশ্চিন্তা করার কোন  দরকার নেই। অরণ্য হয়ত কোনো জরুরী কাজে ফেঁসে গেছে। এরকম হতেই পারে.. এই সব পোষ্টের লোকের কাজের কোনো টাইম টেবিল থাকে না। "

নিঝুম ডাইনিং টেবিলে বসে সব শুনছিল। এই কথাগুলো ও নিজেই নিজেকে বারবার বলছে এতক্ষন। কিন্তু সেই সাথে ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল ওর," আল্লাহ প্লিজ ওকে দেখো।"

নিঝুম চোখের পানি কোনভাবে ঠেকিয়ে রাখতে  পারছিলনা।

ঘরে এসেই বামে পাশের জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল  নিঝুম। এই জানালাটায় খুব একটা দাঁড়ায়না ও। কিন্তু আজ কেন যেন ওখানে দাঁড়াতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। মনে হচ্ছে জানালাটা ওর খুব আপন কেউ। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলনা নিঝুম। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। কেন শাড়িটা ফিরিয়ে দিল?
কি এমন হতো? লোকে না হয় দুটো কথা বলতোই। কিন্তু সেই কষ্ট কি এখনকার চেয়ে বেশি হতো?

জানালার গ্লাসটা খুলে দিল নিঝুম।
কাল এখানে দাঁড়িয়ে যেমন অরণ্যকে দেখতে পাচ্ছিল, আজও যদি ওখানে তাকে দেখা যেত। মানুষের ইচ্ছেরা সব অনেক অদ্ভুত...তাই না? 

"যা পেয়েছি আমি তা চাই না।
যা চেয়েছি কেন তা পাই না।
ছেড়া ছেড়া ফুলে গাঁথা মালা
ভুলে পুরোনোকে কেন ভুলে যাই না।।"

নিঝুম চোখের পানি মুছে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে আশু মনখারাপ করে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

"কি রে আশু... কিছু বলবি? "

"আপু তুই মোবাইলে রিসেন্ট খবরগুলোর হেডলাইন দেখতো একটু," আশু গম্ভীর মুখে বলে।

"কে...কেন?" নিঝুমের গলা কেঁপে যায়।

"না মানে তখন দেখলাম পপুলারের সামনে কি নিয়ে যেন গন্ডোগোল হয়েছে। একটা বাস আর কয়েকটা প্রাইভেট কার ভাঙচুর হয়েছে। জিজু তো আজ ওনাদের বাসার গাড়ি নিয়ে এসেছিল তাই বললাম," আশু আস্তে আস্তে বলে থেমে যায়।

"গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে কখন? " নিঝুম ভালো করে  আওয়াজ করতে পারেনা। গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে!  অরণ্য ওখানে ছিল নাতো? নিঝুমের সব কেমন ঝাপসা লাগে।

"বিকেলে বোধহয়।"

বলেই আশু নিঝুমের গলা জড়িয়ে ধরে," আপু প্লিজ কাঁদিস না। জিজু ঠিক চলে আসবে দেখিস।"

চলবে.....

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top