৪৮


আসমা বেগম থরথর করে কাঁপছেন অন্ধকারে। ভীষন ভীষন খারাপ লাগছে তার এই মুহূর্তে, বুক ধড়ফড় করছে সেই সাথে।

সারাদিন পরে ছেলেটা বাইরে থেকে এসেছে দেখে তিনি অয়নের সাথে কথা বলতে ওর ঘরে এসেছিলেন। কিন্তু ঘরে পা দিয়ে অয়নকে না পেয়ে খোলা দরজা দিয়ে বারান্দায় এসে  দাঁড়িয়েছিলেন।

দুই ভাই পাশাপাশি থাকতো বলে ওদের দুজনের  ঘরের সাথে একটা কমন বারান্দা আছে। মনে করেছিলেন অরণ্যর বিয়ের পর অয়নকে দোতালার রুমে পাঠিয়ে দিবেন। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হয়নি, অরণ্যটা নিজেই নাই হয়ে গিয়ে তার সমাধান করে দিয়ে গিয়েছে।

কিন্তু বারান্দায় পা দিয়েই এক অজানা আতঙ্কে   বরফের মতো জমে গিয়েছেন তিনি। এতদিনের বিশ্বাস কেমন খড়কুটোর মেতে ভেসে গিয়েছে।

"এই না প্লিজ..  ছাড়ো।"

কেমন আদুরে স্বরে কথা বলছে নিঝুম। চোখের পাপড়িগুলো একটা আরেটাকে চুম্বকের মতো টেনে ধরেছে ওর, চোখ খুলতেই পারছেনা নিঝুম হাসির উন্মাদনায়। উল্টো পানি গড়িয়ে  গড়িয়ে পড়ছে ওর চোখের কোল বেয়ে।

"উহু.. … আজ সারাদিন বাইরে ছিলাম, এখন একদম বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখব বউটাকে," অরণ্য নিঝুমের পেটের উপর নাক ঘষতেই ওর চুলগুলো খামচে ধরল নিঝুম। কিন্তু জানালার ওপাশ থেকে নিঝুমের খিল খিল হাসি কী ভীষন কুৎসিত লাগল আসমা বেগমের কানে, কাউকে  বলে বোঝাতে পারবেন না তিনি।

অয়ন নিঝুমকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রীতিমতো গলায়, বুকে,পেটে এলোপাতারি আদর করছে। নিঝুমের কাপড় চোপড় ততক্ষণে  বেসামাল হয়ে পড়ে আছে একপাশে।

আসমা বেগমের মনে হলো তিনি সহ্য করতে পারছেন না। এত অনাচার তার সংসারে... তাই বুঝি তার সংসার ভেস্তে যাচ্ছে।

বারান্দাটা অন্ধকার হলেও ওদের ঘরটা উজ্জ্বল আলোতে ভেসে যাচ্ছে আর সেই আলোয় নিঝুমের সুখী সুখী চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন তিনি।

হতবাক হয়ে গেলেন আসমা। নিঝুমকে দেখলে তো এখন অসুস্থ বলে মনে হয়না। এটা যে অরণ্য না সেটা খুব ভালে করেই বোঝে সে এখন। তাহলে! এভাবে অয়নের সাথে কিভাবে কী? ছি...।ঘৃনায় গা গুলিয়ে আসতে চাইল আসমার। অরণ্যর প্রতি নিঝুমের ভালোবাসাটা একদম খাঁটি মনে করেছিলেন তিনি।

অরণ্যর সন্তান পেটে নিয়ে অয়নের সাথে এভাবে? আর লোক দেখান বিয়েটা হলেও ধর্মীয় মতে বিয়েটা এখনো বাকি.... এই অবস্থায় অয়নের সান্নিধ্যেটুকু কী এতই প্রয়োজন ছিল এই মেয়ের! আর কয়েকটা দিন কী শুধু অরণ্যর হয়ে থাকা যেত না?

অয়নটার উপরও ভীষন রাগ হলো আসমার। ওর কাছ থেকে এরকম নোংরামো আশা করেননি তিনি। নিজ সন্তানের এমন অধঃপতন কার কাছে বলবেন তিনি? আধুনিকতার হাওয়ায় মানুষ আজ কোন কিছুকেই পরোয়া করেনা, বিয়ে ছাড়া এমন সম্পর্ক যে ব্যাভিচার... হোক তারা যতই একজন আরেকজনের কাছে ওয়াদাবদ্ধ, এটা ভাবতেই আসমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। অয়নকে এই শিক্ষা তিনি দেননি। ব্যাভিচারের গুনাহ মাফ হয়না জানা সত্বেও অয়ন এমনটা করল..... রাগে গা জ্বলতে লাগল আসমা বেগমের।

অরণ্য বা অয়ন কেউই এমন ছিল না। কিন্তু নিঝুম ওদের জীবনে আসার পর থেকে ওরা দুভাই এমন  বেহিসেবী চালচলন শুরু করেছে। অরণ্য তাও বিয়ে করে নিয়েছিল তাদের অজান্তেই কিন্তু অয়ন যা করেছে তাতে ওকে জুতোপেটা করতে মন চাইছে আসমার। সব নষ্টের গোড়া এই নিঝুম, কেন খাল কেটে কুমির এনেছেন সেই আফসোসে আসমার এখন মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। বেশ হতো ওই মেয়ের তার খালাত ভাইয়ের সাথে বিয়ে হচ্ছিল.... ফালতু ফালতু তিনি ওটা আটকালেন।

ঘাড়ের কাছটায় যন্ত্রনা হচ্ছে খুব, প্রেশার বাড়ছে মনে হয়। এই মেয়ে তার সংসারটাকে নরক কুন্ড বানিয়ে ছাড়বে বোধহয়, নিঝুমের জন্য এক বুক ঘৃণা আর অয়নের জন্য ভয়ে... চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল আসমার । গালের উপর গড়িয়ে পড়া পানি মুছতে মুছতে সোজা নিজের বিছানায় এলিয়ে পড়লেন তিনি। অরণ্যকে এমন ভাবে ঠকাতে পারে নিঝুম! অথচ তিনি মনে করেছিলেন নিঝুমের ভালোবাসার মধ্য দিয়েই তার অরণ্য অদৃশ্য আলো হয়ে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে।

....................................

"এই না প্লিজ তুমি আগে খাও। সারাদিন টো টো কোম্পানির মতো ঘুরতে থাকো, তোমার স্বাস্থ্য একদম খারাপ হয়ে যাচ্ছে।"

কিন্তু নিঝুমের অনুযোগ কান দিয়েই ঢোকাল না অরণ্য।

"উফফ... ঝুম বড্ড যন্ত্রনা করছো," অরণ্য ক্লান্ত শরীরে মাথাটা নিঝুমের পেটের উপর রাখল। এখন প্রায়ই পুচকুটার ঢুপঢাপ লাথির আওয়াজ পাওয়া যায়। এত নড়ে কেন কে জানে।

"আরও করব, যতক্ষণ খাবার না খাবে ততক্ষণই করব। তুমি বড্ড অনিয়ম করছো আজকাল," নিঝুম চাপা স্বরে বলে উঠল। অরণ্য খুব টেনশনে আছে সেটা ওর চোখের বিপর্যস্ত চাহনিই বলে দিচ্ছে তবু লোকটা ওর কাছ থেকে সেটা লুকানোর সব চেষ্টা করে যাচ্ছে।

"আচ্ছা দাও।"

"তো সরো, এভাবে দুহাত দিয়ে আটকে রাখলে বাপ ছেলের মধ্যে থেকে আমি ছুটি নিব কিভাবে? "

"বলো বাপ - মেয়ের মধ্যে থেকে, আমার একটা ছোট্ট আম্মু চাই।"

"কিন্তু আমার ছোট আব্বু চাই।"

"ঝুম.... "

"অরণ্য.... "

"আব্বু পরের বারে আগে আমারটা, তারপর তোমারটা পূরন করবে আল্লাহ।"

"এহ, উনি সবজান্তা সব জেনে বসে আছে,আল্লাহ কী তোমার একার? আমি জানি  আমার একটা ছোট্ট রাজপুত্র হবে।"

"রাজপুত্র মানেই ফ্যাসাদ, রাজপুত্রর সাথে তার রাজ্য চাই," অরণ্যর হাতদুটো ততক্ষনে পেট ছেড়ে নিঝুমের কানের লতিতে গিয়ে পৌছেছে। দুই আঙ্গুলের মাঝে আলতো হাতে ওর কানের লতিটা চেপে ধরতেই, নিঝুমের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। এই জায়গায় ওর ভীষন সুরসুরি লাগে আর এই লোক খালি ওর কান হাতায়, মনে হচ্ছে পিঁপড়ার দল বিরবির করে হেঁটে বেড়াচ্ছে ওর সারা গায়ে। বিড়ালের মতো কান ছাড়ানোর প্রানান্তকর চেষ্টা করতে লাগল নিঝুম।

"ইশশ, আর রাজকন্যার বুঝি রাজপুত্র, রাজ্য এসব চাই না? চিটিংবাজ কোথাকার। রাজকন্যা পালতে খরচ বেশি," হাঁসফাস করতে করতে বলল নিঝুম।

"তো আমার রাজকন্যার বাপ কী গরীব নাকি? ঢাকায় নিজের বাসা আছে, ভালো চাকরি করে, আর কী চাই?"

"তো আমার রাজপুত্রের বাপেরও পয়সা আছে, সেও গরীব না।"

"উহু তোমার ওই রাজপুত্তুরের পয়সা আমি দিতে পারবনা।"

"মানে...  কেন?  কেন দিবানা? ও তোমার বাচ্চা না? "

"এহ আমার খেয়ে পড়ে ওটা আমার কাছ থেকে আমার বউকেই চুরি করবে, দেব না তোমার ছেলেকে পয়সা, দেখি তুমি কী কর।"

"ছি...  তুমি কী রকম বাবা? নিজের ছেলেকেই সহ্য করতে পার না।"

"পারিই তো না। আমার ঝুমকে আমি কাউকে দিব না ব্যাস...  ঝুম শুধু আমার।"

"পারভার্টেড লোক.... নিজের ছেলেকে কোন মানুষটা হিংসা করে,আজব! "

"আমি করি,আমার বউকে আমি কাউকে দিব না, কোন ছেলে ধরলেই মেরে তক্তা বানিয়ে দিব।"

"তারমানে তুমি ওই অনা ফনাকে হ্যাপি করতে ব্যাস্ত থাকবে আর আমি আমার ছেলেকে আদরও করতে পারবনা? " নিঝুম মুখ ভেঙচালো।

"ঝুম অনাকে তুমি আমাদের মধ্যে আর আনবে না কথা দিয়েছিলে কিন্তু।"

"ওকে কিন্তু আমার ছেলে না পারলে তোমার মেয়েকেও তুমি আদর করতে পারবেনা বলে দিলাম," রাগে নিঝুমের গালদুটো লাল হয়ে গেছে। এতো সাহস, ওর ছেলেকে বলে মেরে তক্তা বানাবে... হুহ।

"আরে এটা একটা কথা। আর হ্যাঁ, আমার প্রিন্সেস আমার বুকের মধ্যে থাকবে। এটাই ফাইনাল। আর কোন আর্গুমেন্টে কোন কাজ হবে না।"

"আর আল্লাহ ছেলে দিলে?"

"বললাম তো হবে না আর যদি ছেলে হয় তাহলে তুমি আমার কাছ থেকে কোন গিফটই পাবা না.. পরিস্কার বলে দিলাম।"

"লাগবে না, আমার ছেলে বড়ো হয়ে আমাকে কিনে দিবে।"

"হা... হা.. আগে তোমার ছেলে বড়ো হোক।"

"হবেই তো... এতে এত হা হা করে হাসার কী হলো?"

নিঝুম নিয়ন্ত্রন হারিয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল অরণ্যকে কিন্তু ঘরের  দরজায় জোরে জোরে শব্দ হওয়াতে থেমে গেল ও। কে প্রশ্ন করার  আগেই ওপাশ থেকে শাশুড়ির গম্ভীর গলার আওয়াজ শোনা গেল।

নিঝুম তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য ব্যাস্ত হতেই  লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল অরণ্য। কিন্তু ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। নিঝুমকে দরজা না খোলার জন্য বলার আগেই হুট করে দরজা খুলে দিয়েছে নিঝুম। গল্পে গল্পে ও এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে, শাশুড়ি অয়নকে এভাবে ওর রুমে দেখলে কী ভাববেন সেটা ওর একদমই মাথায় ছিল না। দরজাটা হাসি মুখে খুলতেই শাশুড়ির ঠান্ডা কড়া চাহনি চোখে পড়ল নিঝুমের, এরকম দৃষ্টিতে উনি এর আগে কখনও ওকে দেখেছেন বলে নিঝুমের মনে পড়ল না।

নিঝুম ভাল করে কিছু বোঝার আগেই রাগে ফেটে পড়লেন আসমা বেগম।

"ছি নিঝুম... তোমার একটু বাঁধল না এসব করতে? আমার ছেলেটা মরেছে এখনও বছর পেরোয়নি আর তোমার সব দুঃখ এর মধ্যেই মরে গেল। এই বলে তুমি অরণ্যর জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিলে.... আর এখন অয়নের সাথে ছি.."

নিঝুম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। আসমা বেগমের কথাগুলো ওকে সুঁইয়ের মতো এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে।

" সব মিথ্যা ছিল তারমানে? সব তোমার ভাঁওতাবাজি ছিল? তুমি তোমার পেটের বাচ্চাটার জন্মটাকেও একটু শুদ্ধ রাখলে না নিঝুম, কেমন মা তুমি?"

আসমার প্রশ্নের বাণে জর্জরিত নিঝুম দিশেহারা হয়ে গেছে ততক্ষণে। চোখে দিয়ে ভাল করে না কিছু দেখছে আর না শুনছে। শাশুড়ি অরণ্যকে, অয়ন ভাবছে বলেই এতেকিছু বলছে এটা ও বুঝতে পারছে কিন্তু তারপরও আসমার কথাগুলো ওর কলিজার একেবারে ভিতরে যেয়ে লেগেছে। ওর বাচ্চার জন্ম ও অশুচি করে দিয়েছে এই কথাটা কেন যেন ও নিতে পারছেনা। প্রচন্ড দুঃখে চোখ ফেটে কান্না আসছে নিঝুমের। অরণ্য ওকে কেন এতো দুঃখ দেয়, আর কত কষ্ট ওর পাওনা?

অরণ্যর কানে মায়ের প্রত্যেকটা কথা স্পষ্ট ভাবে ঢুকেছে। মা যে ওদের ভুল ভাবছে আর সেটাই যে স্বাভাবিক এতে কোন ভুল নেই, কিন্তু তারপরও হুট করেই মনটা খারাপ হলো অরণ্যর। ধুর, নিঝুমকে কেবল একটার পর একটা ব্যাথা দিয়েই যাচ্ছে ও। এরকম শারীরিক অবস্থায়ও ছাড় পাচ্ছে না মেয়েটা। আচ্ছা ও সত্যি মরে গেলে কী হতো ঝুমের?

অয়নকে দরজার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে আসমার রাগটা আরও বাড়ল। অয়ন কিছু বলতে যাবে তার আগেই তর্জনী তুলে বললেন," খবরদার অয়ন আমাকে উল্টো বোঝানোর চেষ্টা করবি না। কত খারাপ একটা মানুষ হয়ে গেছিস তুই, আমি তোকে এভাবে ভাবতেই পারছি না।"

নিঝুমের পা দুটো যেন ওর কাছে ছুটি চাইছে,আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল ও।

"ঝুম "

প্রায় দৌড়ে এসে নিঝুমকে ধরল অরণ্য। আরেকটু হলেই বুঝি সর্বনাশ হয়ে যেত কোন। ভয়ে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে অরণ্যর।

কিন্তু আসমা বেগম আজ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। গভীরভাবে কিছু ভাবার মন মানসিকতা আজ তার নেই। মনে হচ্ছে আজ তিনি বধির, অনুভূতিশূন্য। ছেলের বউয়ের কীর্তিকলাপ নাকি হারিয়ে যাওয়া ছেলের অসম্মান কোনটা আজ তাকে এতো ব্যাথাতুর করে তুলেছিল  জানেন না তিনি।

"অয়ন নিঝুমের কাছ থেকে তুই সর বলছি। ওর জন্য এখনো আর পাঁচটা ছেলের মতোই হারাম তুই।"

একরকম গর্জে উঠলেন আসমা বেগম।

"কিন্তু আম্মু "

"আর একটা কথা না... ছাড় ওকে। আগে সত্যি সত্যি বিয়ে কর ওকে, তারপর ওর সাথে ওসব নোংরামো গুলো করিস, আমি বাঁধা দিবনা।"

মায়ের আদেশ,  এর পরে আর কোন কথা চলেনা। কিন্তু অরণ্য আজ নিরুপায়। তাই বাধ্য হয়ে মুখ খুলল।

"আম্মু নিজের বিয়ে করা বউকে আর কয়বার বিয়ে করব?"

"অয়ন ওটা লোকদেখানো বিয়ে ছিল তুই খুব  ভাল করে জানিস।"

" কিন্তু আমি তো অয়ন না আম্মু,"

"তার মানে! "

হতবাক হয়ে গেলেন আসমা। অয়ন কী এখন নতুন করে তামাসা শুরু করবে আর বলবে যে ও অরণ্য।

"আম্মু আমি..  আমি অরণ্য।"

আসমা বেগম কথা না বলে চুপ থাকলেন কিছুটা সময়। নিঝুম, অয়নকে এতটাই কাবু করে ফেলেছে নিজের জালে যে, অয়ন এখন নিজেকে অরণ্য বলেও চালিয়ে দিতে চাচ্ছে। কী লজ্জা কী লজ্জা.....

অরণ্য মায়ের এরকম অদ্ভুত হাসি হাসি চেহারা দেখে সমস্যাটা বুঝে ফেলল। আম্মু মনে করছে ও আগের মত লুকোচুরি খেলছে মায়ের সাথে। কিন্তু ওতো অয়নকে ছাড়া একা লুকোচুরি খেলতে অভ্যস্ত না। তাইতো ধরা খেয়ে গেল ঝুমের কাছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের পাঁজর নিংড়ে বের হয়ে এল...  হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলাটা যদি আবার ফিরে পাওয়া যেত।

"আম্মু বিশ্বাস করো আমি সত্যি বলছি," অরণ্যর চোখে অনুনয়।

আসমা বেগম হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারলেন না। কিন্তু তার কেন যেন বুক কাঁপছে ছেলের দিকে তাকিয়ে। এটা যদি সত্যি সত্যি অরণ্য হয় তাহলে তার অয়ন...

তার অয়ন কই!

আসমার মুখ থেকে হাসিটুকু ধীরে ধীরে বিলীন  হতে লাগল। তিনি বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন না, কিন্তু ছেলের কাতর চোখদুটো তাকে বলে দিচ্ছে তিনি আবারো ভয়ংকর কিছুর মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন, ভয়নক কিছুর..... খুব ভয়ংকর কিছুর।

.................................................…..…..... 

নিঝুম বালিশে মুখ চেপে শুয়ে আছে, কিন্তু তার   পরও ওর ফোঁপানোর শব্দটা বন্ধ করতে পারছেনা। অরণয় করুন মুখে বারবার ওর চোখের পানি মুছে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে বিফল হয়ে বসে আছে। কী বলবে কিছু মাথায় আসছেনা। মেয়েটা একদম ওর দোষে এতগুলো কথা শুনল আর তাও এত খারাপ একটা বিষয় নিয়ে যে অরণ্যর এই মুহূর্তে রাগে নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু সেটা করলেও দেখা যাবে কোন না কোন ভাবে সবাই ঝুমের দোষই দিবে শিওর, তাই যথেষ্ট কষ্ট করে নিজেকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে ও।

"ঝুম প্লিজ আমার কথাটা একটু শোন। তুমি তো জানো যে আম্মু তোমাকে কতটা আদর করে, কত পছন্দ করে। তোমার সাথে যখন আমার প্রথম দেখা হয় ক্লিনিকে তখনই আম্মু তোমাকে সাথে সাথে পছন্দ করে ফেলেছিল। আমি নিজে না গিয়ে অয়নকে পাঠিয়েছি সে জন্য কী রাগ হয়েছিল, দুই ভাই মিলে কতবার কান ধরে উঠবস করেছি... তুমি প্লিজ আম্মুর কথাটা ধরোনা।"

কথাগুলো নিঝুমকে ঠিক কতটা স্বস্তি দিল জানেনা অরণ্য তবে নিঝুম শোয়া থেকে উঠে বসল। নাকটা একদম টুকটুকে লাল হয়ে আছে, চোখদুটো ফুলে একদম একাকার। অরণ্যর মনে হলো এই সবকিছুর জন্য শুধু ও দায়ী। ওর জন্যই তার প্রিয় দুটো মুখ এরকম অসহায়ের মতো কেঁদে ফিরছে। এদের ও এতো এতো সুখ দিতে চায়, আর ওর কারনেই ওর পরিবার শুধু দুঃখ পায়। ওর আসলে এই চাকরি করতে আসাই ভুল হয়েছে। এর চেয়ে পাশ করেই বাইরে কোথাও স্কলারশিপের অ্যাপ্লিকেশন করা উচিত ছিল ওর অয়নের মতো। তাহলে ওর পরিবার ভাল থাকত। বাইরে থাকলে নিশ্চই রাইসুলের মতো লোক ওর পিছনে পড়ত না,অয়নটাও আজ বেঁচে থাকত।

উফফফ...এত মানুষের চোখের জলের ভার ও  সইবে কী করে?  আম্মুকে কী বলবে? সেওতো ওই কথা শোনার পর থেকে পাথরের মতো মুখ করে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছে। আর মনে হয় কোনদিন ওর মুখ দেখবে না আম্মু। তাহলে? তাহলে অরণ্যর বেঁচে থেকেই বা লাভ কী?

"অ্যাই অ্যাম সরি।"

নিঝুমের আঙুলের স্পর্শে ঘোর কাটল অরণ্যর। ভাবনায় তলিয়ে গিয়েছিল ও একদম।

"সরি!  না ঝুম তোমার কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার। আমি একটা অপদার্থ ভাই , একটা অপদার্থ ছেলে, একটা অপদার্থ স্বামী আর...  আর একটা অপদার্থ বাবাও। দেখনা আমার সামনেই বারবার আমার নিষ্পাপ বাচ্চাটা জন্মের জন্য অপমানিত হয় আর আমি প্রতিবারই অক্ষমের মতো সেটা শুনি, প্রতিবারই শুনি।"

অরণ্যকে এরকম আবেগপ্রবন হতে দেখে নিঝুম সাথে সাথে নিজেকে  সামলে নিল। সত্যিই তো মামনি যে ওকে কত আদর করে সেটা কী ওর অজানা? আর ওর আম্মুও কী কম কথা শুনিয়েছে ওকে যখন প্রথম ওর প্রেগনেন্সি ধরা পড়ল। তাহলে এখন শাশুড়ির কথায় এত বেসামাল হলে হবে কেন? যুদ্ধতো একা অরণ্য করছেনা, ও নিজেও করছে.... গোটা পরিবার করছে।  খুব  সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেশের সব মানুষই করছে। অনেকগুলো অকুতোভয় মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধের মাঠে নামতে যাচ্ছে। জীবন নিয়ে ফিরবেই তার কোন আশ্বাস তো সত্যিই নেই। তবে ও কেন বোকার মতো ভেউভেউ করে কাঁদবে? যোদ্ধাদের কাঁদতে নেই।

"ছি...  অ্যাই বোকা ছেলে তুমি এতো কাঁদ কেন? " অরণ্যর মুখটা দুই হাতের ভিতরে আকড়ে ধরল নিঝুম। তুমি জান না বাবাদের কাঁদতে নেই। তুমি যদি এমন করে কাঁদ তাহলে ও ভয় পেয়ে কার কাছে লুকাবে? আমি কার বুকে লুকাব?"

নিঝুমের কথায় কাজ হলো। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করল অরণ্য। কিন্তু সত্যি আসমা বেগমকে তখন ভিতরে ভিতরে ভাঙতে দেখেছে ও, আম্মুর মুখোমুখি দাঁড়াতে ভীষন ভয় হচ্ছে ওর।

"চল"

"কোথায়?"

"মামনির কাছে "

"আম্মু... আম্মু এখন একটু নিজের মতো থাকুক ঝুম। অয়নের ব্যাপারটা এত সহজে মেনে নেওয়া  সম্ভব না আম্মুর জন্য।"

"সেজন্যই যাবো... চল।"

"কিন্তু "

"কোন কিন্তু না। এখনই সবচেয়ে ঠিক সময়, এখনই তার তোমাকে প্রয়োজন, এই সময় একমাত্র তুমি ওনার ভিতরের ঝড়টাকে থামাতে পার।"

অরণ্যর ভিতরের দোদুল্যমান অবস্থাটাকে এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল নিঝুম। প্রায় একরকম টানতে  টানতে ওকে নিয়ে আসল শাশুড়ির ঘরে।

"মামনি.."

"আম্মু..."

ওদের ডাকে আসমা বেগম কেমন কেঁপে উঠলেন। কে ডাকল? অরু আর অনু না? হুড়মুর করে উঠে বসলেন আসমা বেগম বিছানার উপর। তার বাচ্চারা এসে গেছে। স্কুল মনে হয় ছুটি হয়ে গেছে। ওদের খাবার টেবিলে দিতে হবে। কিন্তু সামনে এরা কারা?

"আম্মু "

"কে?"আচ্ছন্ন স্বরে বললেন আসমা বেগম। এটাতো অরণ্যর গলা মনে হয়!নাকি অয়ন।

"আম্মু...  ও আম্মু " অরণ্য ভয়ে মাকে ধরে দুবার জোরে জোরে নাড়া দিল।

"কে অরণ্য? "

"হুমম"

"অয়নটাকে দেখছি না... ওকে ডাকত বাবা, কতদিন ওকে দেখিনা," মায়ের কথায় অরণ্যর গলা শুকিয়ে গেল। অয়নকে কী করে ডাকবে ও? ওকে কী করে আনবে আম্মুর সামনে?

" মামনি... এই তো অয়ন," নিঝুম তাড়াতাড়ি আসমার সামনে এসে দাঁড়াল।

"কই...  কোথায় আমার অয়ন? " অসহিষ্ণু স্বরে চারদিক খুঁজতে লাগলেন আসমা।

"এই তো এই যে। আপনি চোখ বন্ধ করে দেখুন তো টের পান কিনা, " নিঝুম, আসমার একটা হাত নিয়ে নিজের পেটের উপর চেপে ধরতেই ধুপ করে একটু নড়ে উঠল নিঝুমের পেটটা। যেন জানান দিল, আমি আছি...  আমি আছি।

অনেকটা সময় আসমা চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল তার দুই গাল বেয়ে।

" জানিস মা,  আমার অয়নটা না এমনিতে খুব লক্ষী ছিল। অরুটা যতটা দুষ্ট ছিল ও ঠিক তার উল্টো। সারাদিন খালি পড়ত। যত দুষ্টুমির বাসা হলো এই বড়টা, ছোটটাকে শুদ্ধ  নাচিয়ে বেড়াতো।"

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আসমা। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,"অনুর মতো তোর ছেলেটাও খুব মা ন্যাওটা হবে দেখিস। তবে বাপের কিছু বৈশিষ্ট্য তো পাবে। তাই দুষ্টও হবে খুব। ওকে খুব আগলে রাখবি, খুব সাবধানে... একদম তোর বুকের মধ্যেখানে।"

চলবে.........

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top