৩৫

"তোমার মোবাইল"

নিঝুমের গলা শুনে ঝট করে ঘুরে তাকালো অয়ন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিঝুমের বিষাদগ্রস্ত চোখ জোড়ার দিকে।

"তোমার অহনা ফোন করছিল।"

"তু... তুমি কি রিসিভ করেছিলে ফোন?"

অয়নের গলার স্বরে কী ছিল জানেনা নিঝুম কিন্তু মনে হলো এই মুহূর্তে ছাদ থেকে লাফ দিতে পারলে বুঝি কিছুটা শান্তি পেত ও। ছেলেটা ওকে কত নিচু লেভেলের মনে করে? কষ্টে চোখে পানি চলে এল নিঝুমের... অবশ্য আজকাল ও এটাই সবচেয়ে সহজে পারে।

নিঝুমের মুখভঙ্গি দেখেই কিনা জানেনা, অয়নের রাগে তেতে উঠা মুখটা হঠাৎ আবার আগের মতো নরম হয়ে এলো। একটু অপরাধ বোধ কী নাড়া দিয়ে গেল অয়নকে... জানে না নিঝুম। তবে ও আর দাঁড়াল না ওখানে, জোরের সাথে না বলেই দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এল।

নিঝুমের যাওয়ার পথের দিকে অনেকটা সময় স্থবির হয়ে তাকিয়ে রইল অয়ন। মেয়েটার চোখের করুন অসহায় দৃষ্টিটা ওকে ক্রমাগত ভাঙছে ভিতরে ভিতরে, ও ঠিক বুঝতে পারছে নিঝুমের যন্ত্রনাটা... কাছের মানুষকে হারানোর যন্ত্রনা শতগুন হয়ে ফিরে আসছে... আর হারানোর এই যন্ত্রনাটা এক ভুক্তোভোগী ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না।

হাতে থাকা মোবাইলটা আবারো নিজের উপস্থিতি জানান দিল। অহনা আবারো ফোন দিচ্ছে। কী বলবে ও এখন? নিঝুমকে নিয়ে শ্রীমঙ্গল ওকে এখন যেতেই হবে, আম্মুর কথার নড়চড় হয় না আর আম্মুর কথার উপর ওদের দুই ভাই এর কথা বলার অভ্যাস খুব কম। যখনই বিশেষ কিছু নিয়ে কথা বলত দুইভাই এক সাথে বলত।

মনটা এতো খারাপ লাগছে যে অহনার ফোনটা তুলতেও ওর ইচ্ছে হচ্ছে না। অহনা যখনই ওর বিয়ের কথা শুনবে তখনই সিনক্রিয়েট করবে। অহনাকে খুব ভালভাবে চেনে ও। অহনা কলেজ লাইফে একবার সুইসাইড করতে চেয়েছিল... জানে অয়ন। মেয়েটা এক কথায় অসম্ভব জেদী। কোনটা রেখে কোনটা সামাল দিবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ও। আবার নিঝুমের এরকম মুখ দেখলে ঠিক মার ঝার খাবে ও। আর শ্রীমঙ্গল গেলে তো সোনায় সোহাগা। কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয়,সেখানে সন্ধ্যে হয়। কিন্তু ওর এখন সব পথ বন্ধ, যেতে ওকে এখন হবেই। বাঘ থাকলেও কী আর না থাকলেও বা কী।

পরদিন সকালেই ওদের শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে বের হতে হলো। একবার ট্রেনে, একবার প্লেনে.. এরকম করে করে শেষমেষ নিজেদের গাড়ি নিয়ে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা। রায়হান সাহেব এমনিতেই তেমন গাড়ি চালান না। তাই গাড়ির কথা বলাতে আর তেমন আপত্তি করেননি তিনি । তবে আসমা প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করছিলেন কিন্তু পরে রায়হান সাহেবের কথায় থেমে গেছেন। স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে স্পেস না দিলে নাকি ওদের আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা তৈরি হতে আরও সময় নিবে... আর এটা আসমা একদমই চান না। তার আশা সত্যি বিয়ের আগেই অয়ন আর নিঝুমের মধ্যে একটা প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হোক। অরণ্যর মতো এক লহমায় ভালোবাসা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে না পড়ুক... অন্তত বিন্দু বিন্দু করে গড়ে উঠা মায়ার পাহাড় যেন অয়নের মনে নিঝুম নামের একটা কল কল ধ্বনির ঝর্ণার জন্ম দেয়।

গাড়ি যাত্রাবাড়ীর ওভারব্রিজ পার হয়ে হাইওয়ে ধরে এগুতেই নিঝুম বলল," অয়ন গাড়িটা থামাও প্লিজ, আমি পিছনের সিটে গিয়ে ঘুমাব।"

"আরে..... এটা কেমন কথা? তুমি পিছনে গিয়ে শুলে আমাকে তো ড্রাইভার ভাববে সবাই, আর তুমি ঘুমিয়ে গেলে কিডন্যাপার ভেবে কিডন্যাপিং কেসে ফাঁসিয়ে দিতে পারে," অয়ন হালকা স্বরে বলল।

"ড্রাইভারকে ড্রাইভারের মতো লাগবে নাতো কিসের মতো লাগবে," আড় চোখে অয়নকে এক ঝলক দেখল নিঝুম, বুকটা টনটন করে উঠলো ওর। দীর্ঘ যাত্রায় রোদের হাত থেকে বাঁচার জন্যই হয়তো কালো সানগ্লাসটা পরেছে সে কিন্তু চোখ দুটো ঢেকে যাওয়ায় ওকে আরও বেশি অরণ্যর মতো লাগছে। দম আটকে আসতে চাইল নিঝুমের। হাজার হোক প্রিয় মানুষটার চেহারা... ওর চোখের সামনে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে অথচ কেবল চেহারাতেই যা মিল। অয়নের দিকে তাকালে অরণ্যর অনুপস্থিতি যেন আরো বেশি করে মনে পড়ছে নিঝুমের।

"মানে.. আমি তোমার ড্রাইভার?" অয়ন চোখ বড়ো বড়ো করে অবাক হওয়ার ভঙ্গী করল।

"না... তা হবা কেন, তুমি এই গাড়ির ড্রাইভার। আর আমার হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না, তুমি বড়ো জোর অহনা, না সরি তোমার অনার ড্রাইভার হতে পারো," কথাটা বলেই আবার মনযোগের সাথে নিজের হাতের নেইলপলিশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল নিঝুম। ওর কথায় অয়ন আর কথা বাড়াল না। কথা বাড়লেই এখন কথায় কথা বাড়বে কিন্তু সকালেও তো নাস্তার টেবিলে বেশ ভাল মুডেই ছিল নিঝুম।

নিঝুমের মন ঠিক কতটা খারাপ সেটা ও কাউকে বোঝাতে পারবেনা। অরণ্যর গুলি লেগেছে এই কথাটাই কেবল ওর স্মৃতিতে আছে স্পষ্টভাবে। বাকি গুলো ধোঁয়াশার মতো। এখন মনে পড়ছে, ওকে লাশ দেখানো হয়েছিল অরণ্যর কিন্তু ও তখন ওগুলো নেওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। নিয়মিতই ঘুমের ইনজেকশন দিতে হত ওকে, প্রচন্ড ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল। আর ওই ঘোর লাগা অবস্থায় হ্যালুসিনেশনে অরণ্যকেই সারাক্ষণ নিজের আশে পাশে দেখতে পেত ও। এমনকি মাঝে মাঝে মনে হত ওকে আদর করছে কেউ কপালে, চোখের পাতায়, নাকে, ঠোঁটে। কখনই মনে হয়নি ওর অরণ্য সত্যি নেই... বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

কিন্তু আজ সকালে ও যা দেখেছে সেটা দেখার পর থেকে ওর মন খারাপটা আরও দ্বিগুন হয়েছে। না অয়ন মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছিল তার জন্য নয়, বরং আজ ও স্পষ্টভাবে জানে ওর মানুষটা এ জনমে ওর কাছে আর কোনোদিনও ফিরবে না। ওকে ওভাবে আদর করার লোকটা মেঘের আড়ালে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। কেউ আর এখন জানালাটা একটু খোল ঝুম বলে বিরক্ত করবেনা, ওর হাতে খাবার জন্যও কারও আর এখন কোন বায়নাক্কা নেই। কী নির্ভার এক জীবন... অথচ নিঝুমের কাছে গোটা জীবনটাই অর্থহীন লাগছে। ও এখন আর কারও প্রয়োজন না... একটা অর্থহীন জীবন কেবল বোঝার মতো ওকে টেনে যেতে হবে.. ভাগ্যিস অরণ্য যাবার আগে দয়া করে ওকে শ্বাস নেয়ার একটা রসদ দিয়ে গেছে। দুহাত দিয়ে নিজের তলপেটটাকে আঁকড়ে ধরে নিঝুম.. যে ভাবেই হোক এই আলোটুকু ওকে বাঁচিয়েই রাখতে হবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস নিঝুমের হাড় পাজর ভেদ করে বের হয়ে আসে। গাড়ির গ্লাসের বাইরে নীল সীমাহীন অন্তরীক্ষ.. নিঃসঙ্গ গ্রহের মতো সেদিক পানে চেয়ে থাকে ও। আচ্ছা ওখানে গেলে কী প্রিয় মুখটাকে একটু ছুঁতে পারবে ও?

.................................................

"আচ্ছা তোমার কী মনে হয়? অয়ন আমাদের মেয়েটাকে দেখবে? " রুমানার এমন প্রশ্নে শাহেদ নিউজপেপার থেকে মুখ তুলতে বাধ্য হলেন।

"একথা এখন কেন রুমা?"

"জানিনা, কিন্তু ছেলেটা বৌভাতের পর আসল না, কেমন একটা কথা না। ধুর এর চেয়ে মনে হচ্ছে ফাহিমের সাথে বিয়েটা দিলেই ভাল করতাম, মনটা কেমন যেন খচখচ করছে। "

"এখন আর খচখচ করে লাভ নেই। অফিশিয়ালি বিয়েটা হয়ে গেছে সবার চোখের সামনে।"

"কিন্তু বিয়েটা তো নকল, সত্যি বিয়েটা তো এখনও হয়নি।"

"হাসালে রুমানা, তোমার মেয়ে কনসিভ করেছে আর বাচ্চা তো আসমান থেকে আসেনি। আসলে কী জানো, বাপেরও বাপ আছে।"

"মানে.. তুমি কী বোঝাতে চাইছ ? এ ধরনের কথা কেন বললে? "

"বিশেষ কিছু না... নিজে একটু ভাব তাহলেই বুঝতে পারবে।"

"হ্যাঁ, কিন্তু বাচ্চাটা তো আর অয়নের না.. তাই না? আর ডিএনএ টেস্ট করলেই সব সত্যি বের করে আনা সম্ভব, আসমা আপা কিছুই করতে পারবে না।"

"হুম তা ঠিক কিন্তু দুই ভাই কিন্তু জমজ ছিল, হুবুহু কার্বন কপি প্রায়। তাই ডিএনএ টেস্টেও যে ফাঁকিতে পরে যাবেনা তা মনে করোনা। ওদের বাইরের চেহারার মতো শরীরের ভিতরের অনেক কিছুই কিন্তু প্রতিবিম্ব হবার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। তাছাড়া অরণ্য মরে গেলেও ওদের পরিবারের সাথে পুলিশের হৃদ্যতা কিন্তু এখনও অটুট। এক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে ওদের হাত ওদিকে বেশ লম্বা। "

" সে যত লম্বা হাতই হোক টাকার চেয়ে লম্বা কারও হাতই না।"

"রুমানা প্লিজ, তোমার এসব কূট চাল গুলি চালা একটু বন্ধ কর। এক ফাহিম ফাহিম করে কান ঝালাপালা করে ফেললে তুমি, দয়া করে এবার এসব বন্ধ কর। নিঝুম কে আগে স্টেবল হতে দাও। ও যদি অয়নকে না চায় তখন নরমাল সেপারেশন করিয়েই ফাহিমের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিও। কিন্তু তার আগে ওদের একটু এডজাস্ট হওয়ার চেষ্টা করতে দাও।"

শাহেদের ধমক খেয়ে রুমানা একটু থমকালেন। না তিনিও আসলে ব্যাপারটা চাচ্ছেন না। কিন্তু অয়ন ছেলেটা এত ঘাড়ত্যাড়া ধারনা ছিল না তার। অরণ্য ওর ভাইয়ের চেয়ে অনেক বেশি ভদ্র ছিল।

...................................

বেলা এগারোটার দিকে একটা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে গাড়ি থামাল অয়ন। নিঝুমের একটুও ইচ্ছে ছিলনা নামার কিন্তু যতদিন যাচ্ছে ততই পেটের উপর চাপ বাড়ছে ওর। আগের চেয়ে ঘনঘন ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হয় এখন ওকে। আর অয়নকে এই কথাটা অনুরোধ করতে কী ভীষন বিচ্ছিরি লাগছে ওর।

বাচ্চা পেটে থাকলে নিজের স্বামীকে যে কথাগুলো খুব সহজে বলা যায়, সেগুলো অন্য কাউকে বলা কত কঠিন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এখন নিঝুম। ওয়াশরুমে পায়জামার ফিতেতে গিট লেগে ভয়নক অবস্থা হলো ওর। একেত উচু পেট, তার উপরে শক্ত করে গিট লেগে গেছে, কি করে খুলবে বুঝতে না পেরে কেঁদে দেওয়ার অবস্থা হল নিঝুমের।

এতক্ষণ ওয়াশরুমে কী করে মেয়েটা.... বিরক্ত হয়ে হাতঘড়িটা আবার চেক করল অয়ন। রাস্তাঘাটে যত দেরি করবে তত দেরি হবে ওদের শ্রীমঙ্গলে পৌঁছাতে। আরো পাঁচ মিনিট চলে গেল। ভিতরে ভিতরে এবার খানিকটা টেনশন হল ওর। ব্যাপার কী? মেয়েটা গেল কই? ধীর পায়ে লেডিস ওয়াশরুমের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ও। এতো মহা মুসিবত.... বের হয় না কেন নিঝুম? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাজগোছ শুরু করল না তো আবার, কেউ কেউ বেশ চুল টুল আচড়ে সেজেগুজে বের হচ্ছে দেখে কথাটা মনে হল অয়নের। কিন্তু নিঝুমের মুড এখন যথেষ্ট খারাপ, এখন সাজার কথা না ওর। পরের মুহূর্তে একটা কথা মনে পড়তেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল ওর, নিঝুম অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে যায়নি তো... এতো সময় তো লাগার কথা না।

শেষে ওয়াশরুমের কাছে যেয়ে কেউ কী আছেন বলে ডাকতে বাধ্য হল অয়ন। কী জানি কে কী মনে করে। ওর ডাক শুনে ভেতর থেকে এক খালা বের হয়ে আসল।

"কি কইবেন... কাউরে খুঁজতাছেন? "

"হ্যাঁ, মানে আমার ওয়াইফ বেশ অনেক সময় ধরে এখানে এসেছে কিন্তু এখনও বের হয়নি, আপনি প্লিজ একটু দেখবেন। "

"আইচ্ছা খাড়ান, আমি দেখতাছি। "

"প্লিজ... ও প্রেগন্যান্ট, নাম নিঝুম।"

"জে দেখতাছি।"

অয়ন উৎকন্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই মেয়ে এখনই ট্রাবল শুরু করে দিয়েছে, সামনের দিনগুলোতে কী করবে কে জানে? মহা বিরক্তিকর অবস্থা, কিন্তু সেই সাথে পেটের মধ্যে কেমন যেন অদ্ভুত কিছু অনুভূতি হচ্ছে... বুক ধুকপুক করছে, হাত পা অসাঢ়... আচ্ছা ওর কী ভয় হচ্ছে?সব মিলিয়ে লাইফের চৌদ্দটা বেজে গেছে বেশ বুঝতে পারছে ও।

অবশেষে এক সময় নিঝুমের দেখা মিলল। অয়নের দিকে তাকাতেই এক ধরনের অস্বস্তি লাগল নিঝুমের, নিশ্চই খুব বিরক্ত হয়েছে ও। কিন্তু কী জবাব দিবে নিঝুম।

"স্যার... ম্যডাম তো পায়জামার বনই খুলতে পারতাছিল না, একা একা ফুঁপায় ফুঁপায় কানতাছিল বাথরুমের মইদ্দে ," মহিলাটা দাঁতগুলো বের করে হাসতে লাগল। অয়ন কথাটা শুনে তাড়াতাড়ি একটা একশ টাকার নোট গুঁজে দিল মহিলার হাতে।

নিঝুমের খুব রাগ হলো মহিলার উপর... এতে এতো হাসার কি হলো উনার! কিন্তু মানুষটা ওকে সাহায্য না করলে নিঝুম কী করত সেটাও একটা কথা, তাই আর কথা বাড়াল না ও। কিন্তু তাতে ওর সবটা রাগ গিয়ে সোজা অয়নের উপর পড়ল। এহ... দয়া,দেখাইতে আসছে ওর উপর ফ্রিতে। ওর দয়া চাইছে নিঝুম? বেশি বেশি মাতব্বর। আর এক সেকেন্ডও ওখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে হলোনা নিঝুমের। হেটে সোজা গাড়ির কাছে চলে আসল ও।

"আরে কিছু খাবেনা? বের হয়ে আসলে কেন? " অয়ন নির্লিপ্ত মুখে জানতে চাইল।

"তুমি খেলে খাও। আমার খিদে নেই। "

"আর ইউ শিউর?"

"ইয়েস"

"ওকে তাহলে তুমি গাড়িতে বসো, আমি এসি ছেড়ে দিচ্ছি। আমি জাস্ট একটা কফি খেয়ে চলে আসছি।"

মুখটা শক্ত করে কোনমতে মাথা নাড়ল নিঝুম।

অয়ন গাড়ির এসিটা ছেড়ে দিয়ে আবারো রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকল। নিঝুমের মনে হলো কান্নাটা গলায় এসে আটকে গেছে, মনে হলো এক্ষুনি ও দমবন্ধ হয়ে মরে গেলে বেশ হতো। ওই যে মানুষটা এতো সাবলীল ভাবে হেটে চলে গেল, ওর অরণ্য হলে একগুঁয়ের মতো গাড়ির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। আর যদি ওকে বের করে নিয়ে যেতে না পারত তাহলে নিজেও যেত না।

"তোর মতো করে ভালোবাসার
আজ আর কেউ নেই আমার ,
তোর মতো করে অবিরত চাওয়ার
লোকটা আমার হারিয়ে গেছে ,
তোর মতো করে কেউ আর আজ
আমার মান ভাঙায় না,
ঝুম বলে আকাশের বুকে
একরাশ চুমোর ঝড় তোলে না।
আমার আকাশ এখন মেঘে ঢাকা,
তারাদের দেখা আমি আর পাইনা।

কেবল ঝাপসা চোখের আলোয়,
স্মৃতির অ্যালবামে,
আমি তোর ক্লান্ত, নিথর দেহটাকে দেখি
একখন্ড সাদা কাপড়ে লেপ্টে ছিলি
ভাসছিলি নীল আকাশের বুকে
একখন্ড শুভ্র মেঘ হয়ে।
তুই এখন আমার মনের অলিন্দে জমান
একটুরো সুখ স্মৃতি কেবল,
তোর মতো নিঝুমের অরন্যে
আজ আর কেউ হারায় না। "

......................................................

"অয়ন আমি বুঝতে পারছি না তুমি এগুলা কী বলছো উল্টাপাল্টা। তোমার মাথা কী খারাপ হয়ে গেছে? তুমি! তুমি কী করে তোমার ভাবিকে বিয়ে করতে পারো?" অহনা ফোনের ওপাশ থেকে প্রায় চিৎকার করে উঠল। এরকমটা যে হবে অয়ন আগেই বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু ওর হাতে এখন আর কিছুই করার নেই।

"অনা.. প্লিজ আমার কথাটা শোনো জান, আমি এখন বাধ্য হচ্ছি নিঝুমকে বিয়ে করতে, না হলে আমার আম্মুকে বাঁচানো সম্ভব ছিল না। ভাইয়া নেই, এই অবস্থায় যদি কোনভাবে নিঝুমের কিছু হয় আমার আম্মু মারা যাবে অনা, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আমি তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি , তোমাকে ছাড়া আমি আমার লাইফ চিন্তাও করতে পারিনা। " অয়নের কাতর গলা শুনে অহনা ক্ষনিকের যেন থমকে গেল। অয়ন সত্যি বলছে তো? তারপর আস্তে আস্তে একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ল ওর মুখে। নাহ, অয়ন সত্যি বলছে, কারন আজ সকালেই অয়ন ওকে সত্যি সত্যি বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে গভীর ভাবে আদর করেছে প্রথম বারের মতো। এর আগে অয়নের আচরনে ও কখনও এতটা এগ্রেসিভ ফিলিংস পায়নি। আর নিঝুমকে অহনা একদম সহ্য করতে পারেনা। নিঝুম... নিঝুম ওই মেয়েটা ওর সব জায়গা দখল করতে চায়। কিন্তু অহনা তো সেটা হতে দেবেনা, কিছুতেই না। ওই বাড়ির একমাত্র বউ ও হবে... কোনো নিঝুম ফিঝুম না।

কিন্তু তারপরও ওর কেন যেন মাঝে মাঝে মনে হয় অয়ন, নিঝুমকে ওর চেয়ে বেশি পছন্দ করে।কেমন সারাক্ষণ ওকে নিয়ে সব কথায় কথায় খালি নিঝুমের সাথে তুলনা করে, এটা একদম অপছন্দ ওর।

অয়ন ফোনটা পকেটে রেখে টেবিলে রাখা কফিটা শেষ করায় মনযোগ দিল। এখন বেশ কয়দিন অহনার কথা চিন্তা ওর না করলেও চলবে।

..........................................

"Mehfil me teri hum naa rahe jo
Gham toh nahi hai, gham toh nahi hai
Qisse humare nazdeekiyon ke
Kam to nahi hai, kam to nahi hai

Kitni dafaa subah ko meri
Tere aangan mein baithe maine shaam kiya"

ওদের শ্রীমঙ্গলে পৌছাতো পৌছাতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল। বাংলোটা বেশ ভালই বড়ো। ডুপ্লেক্স আর ছাদটাও বেশ সুন্দর লাল টালি দিয়ে করা। অয়ন এর আগেও একবার এসেছিল এখানে। সেবার সপরিবারে এসেছিল ওরা। বাংলোটার সামনে বেশ সুন্দর একটা বাগান আছে। লনটাও খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। অন্তত নিঝুমের ভারাক্রান্ত মনটা ভাল হবার জন্য যথেষ্ট। নিঝুম কিছুটা সময় লনের গোল বেদীর পাশের দোলনাটায় চুপ করে বসে রইল। জীবনটা বড্ড এলোমেলো ওর এখন। গন্তব্যবিহীন নৌকার মতো অনেকটা, পানিতেই আছে কিন্তু তার কোনো কূল নেই, কোথাও যাওয়ার কোন তাড়া নেই। অনেকটা সময় জার্নি করার জন্য কেমন বমিও লাগছে ওর.. তারপরও গুম হয়ে বসে রইল ও জায়গাটায়।

এর মধ্যেই শ্বাশুড়ি ফোন দিয়ে কাল একবার ডাক্তার দেখাতে বললেনন ওকে। নিঝুম কেবল হু হা করল। শাশুড়ীকে ও কী করে বোঝাবে অরণ্যকে বলা আর অয়নকে বলা ওর জন্য এক না। অরণ্য হলে বলতে হতো না, নিঝুম বলার আগেই ওকে নিয়ে ডাক্তারের ক্লিনিকে হাজির হতো। কিন্তু অয়নকে বললেও কতটা গুরুত্ব দিবে কে জানে। তারপরও এবার ওকে বলতে হবে বাচ্চাটার জন্য, তাতে অয়ন ওকে বেহায়া ভাবলেও ভাবতে পারে।

ঘরে ঢুকেই প্রথমে গোসল সারল নিঝুম। ভীষন মাথা যন্ত্রণা হচ্ছিল ওর, গোসলের পর মনে হলো কিছুটা ভাল লাগছে। কিন্তু সেই সাথে প্রচন্ড ক্ষুধাতে পেট মোচড়াচ্ছে। আসলে বমির ভয়ে ও তেমন একটা কিছু খায়নি পথে আর বেশ একটু অভিমানও হচ্ছিল অয়নের উপর। ভালোবাসার মানুষ না হোক, ওদের পরিবারের সদস্য তো ও। তার জের ধরেও কী ওকে একটু জোর করতে পারতনা অয়ন?

মন খারাপ করে সিড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগল নিঝুম। কিন্তু সিড়ির মাঝখানের ধাপটা নামার সময় হঠাৎ করেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল ওর, পরমুহূর্তেই চারদিকটা গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ঠিক একটা ফুটবলের মতোই বাকি দুইটা সিড়ি গড়িয়ে পড়ল ও।

হুশ যখন ফিরল তখন নিঝুমের চারপাশে বেশ অনেকগুলো মুখ। ভালো করে তাকাতেই মনে হলো এটা কোন একটা হসপিটাল বা ক্লিনিক। দুর্বলতার কারনে তখন ওর চোখ খুলে রাখাও দায়, কেবল শুনতে পেল কেউ একজন বলছে মিস্টার রহমান আপনার ওয়াইফের কপাল খুবই ভাল যে উনি বেশ হালকা পাতলা গড়নের আর খুব বেশি সিড়ি গড়িয়ে পড়েননি। আঘাতটা আর একটু জোরে হলেই বেবিকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যেত। নিঝুমের হাতটা ওই আধা আচ্ছন্ন অবস্থাতেই নিজের পেটের কাছে চলে গেল। মনে মনে ও প্রার্থনার সুরে বলল, " সবাই যায় যাক, তুই আমায় ছেড়ে যাসনা সোনা, তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই।"

তিনঘণ্টা পর্যবেক্ষনে রাখার পর নিঝুমকে ওরা ক্লিনিক থেকে ছেড়ে দিল। ডাক্তার বেশ কয়েকবার করে নিঝুমের খাবার দাবারের ব্যাপারে অয়নকে বলে দিলেন। সাথে পরদিন বেশ কিছু টেস্ট করাতেও বললেন। ওর রক্তশূন্যতা আছে বলে ওষুধের পাশাপাশি বেশ কিছু খাবারের নামও তিনি বলে দিলেন। নিঝুমের বেশ লজ্জাই লাগছিল ডাক্তার যখন অয়নকে স্ত্রীর শরীর এতো খারাপ আর ও খেয়াল করেনি বলে লজ্জা দিচ্ছিল। কিন্তু কতজনকে আর নিঝুম নিজেদের কেচ্ছা কাহিনি বলে বেরাবে। ও এমনিতেই এখন নিজের জীবন নিয়ে হতাশ। সামনের দিনের কথা ভাবলে গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই ওর নজরে আসছেনা।

গাড়ি থেকে নেমে অয়ন নিঝুমকে সোজা কোলে তুলে নিল। অয়নের এমন আচরনে নিঝুম হতভম্ব হলেও, প্রতিবাদ করলো না। কেবল ওর মানসপটে প্রথমদিনের স্মৃতিটা নাড়া দিয়ে গেল। অরণ্যও ওকে গাড়ির সাথে অ্যাক্সিডেন্টের পর কোলে তুলে নিয়েছিল। আজ আবারও একটা দুর্ঘটনা ঘটল, এখনও কী চক্রাকারে আগের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে?

নিঝুমকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে আনল অয়ন। ওগুলো সব নিঝুমের ঔষধ, জানে নিঝুম। । কিন্তু অয়নের মুখটা দেখে মনে হচ্ছে ও একটা রোবট। মুখ স্টেইনলেস স্টীলের মতোই শক্ত করে রেখেছে। হঠাৎ করেই নিঝুমের পুরো শরীরটা কেঁপে উঠল ভয়ংকর ভাবে, কে যেন কানে কানে বলে গেল, অয়ন এই মুহূর্তে প্রচন্ড রেগে আছে। ঠিক এমনই একটা মুখ ও দেখেছিল বেশ কয়মাস আগে, যেদিন লোকগুলো জোর করে ওর আর অরণ্যর বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। জমজ হওয়ার কারনে দুজনের মুখের গড়ন এক আর রাগ হওয়ায় সেটাকে প্রায় অভিন্ন বলে মনে হচ্ছে। নিঝুমের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল অয়নের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু অয়ন, অরণ্য না এই সত্যিটাও এখন ওর কাছে দিনের মতো স্পষ্ট। কিন্তু তারপরও কী ভীষন কষ্ট হচ্ছে ওর , ভীষন কষ্ট!

অয়ন আজ আসার আগে ওদের গাড়ির গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে অহনাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছে। তো খেয়েছে তো খেয়েছে, ও তো জানেই অয়ন ওর অনাকে ভালোবাসে, তবুও এই দৃশ্যটা ওকে এত কষ্ট কেন দিচ্ছে!

চলবে.......

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top