৩১
আসমা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হিমালয় পর্বতকে দেখছেন। হ্যাঁ, হিমালয়ই তো... অয়নকে এই মুহূর্তে ঠিক হিমালয়ের সাথেই তুলনা করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
অয়ন এখন হিমালয়ের মতই অপ্রতিরোধ্য আর হিম শীতল ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সবার দিকে , যে কেউ ওকে এখন হিমের আলয় মানে বরফের ঘর বলতে দ্বিধা বোধ করবে না। চাহনীর তীক্ষ্ণতা এতই তীব্র যে, সবাই জমে যে যার জায়গায়। মনে হচ্ছে বুঝি শ্বাসও চলছে না কারও।
অয়ন এত গম্ভীর ভাবে বিয়ের কথাগুলো বলল যে, আসমা রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।
এও কি সম্ভব! নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অয়ন আর নিঝুম... তার মানে তার আদরের নাতিটা তাদের কাছেই থাকতে পারবে। ওকে আর দূরে কোথাও পাঠাতে হবে না। আনন্দে চোখে থেকে পানি বের হয়ে আসে আসমার।
ঘরে অদ্ভুত থমেথমে একটা পরিস্থিতি। নিঝুমের বড়ো ফুপিও কেমন হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অয়নের দিকে। এতদিন আসলে খুব খেয়াল করে দেখেননি তিনি ছেলেটিকে... আসলে দেখার প্রয়োজনও বোধ করেননি। চুপচাপ ঘরের এককোনে বসে থাকা ছেলেটা সেভাবে নজরে আসেনি দিলারার কেবল দেখতে দুভাই একইরকম, এটাই খেয়াল করেছেন। কিন্তু আজ ছেলেটাকে দেখে একদম অন্যরকম লাগছে, ভীষন ভীষন অন্যরকম, যেন সাধারনের মাঝে বিশেষ কেউ।
রায়হান সাহেবের মনে হলো, অয়নের উপর দিয়ে কোন ঝড় বয়ে গেছে। তা না হলে এই সুরে অয়ন সচরাচর কথা বলে না। ওর চোখদুটো লাল টকটক করছে, মাথার চুলগুলো এলোমেলো। উনি বেশ বুঝতে পারছেন ছেলে তার কোন কারনে কান্নাকাটি করেছে।
"অয়ন তোর কী হয়েছে বাবা? " রায়হান সাহেবের প্রশ্নে এতক্ষণে হুশ হল আসমার। তাইত নিঝুমের ফুপির তোপোর মুখে ছেলের উদভ্রান্ত চেহারা নজরে আসেনি তার। কেমন মা তিনি?
"অয়ন কী হয়েছে তোর?" আসমা ভয় ভয়ে জানতে চাইলেন।
"কিছু না, এইসব হাবিজাবি যা করছিলে এগুলো কার যুক্তিতে করছিলে আম্মু? আশু আমাকে ফোন না দিলে তো জানতেই পারতাম না। আর বিয়ে দিচ্ছো এতো এক অপরাধ... সাথে যার বিয়ে দিচ্ছ তার হুশ নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই অবস্থা। নিঝুম কী বুঝে শুনে করছে এই বিয়ে? আচ্ছা তারপরও মানলাম ও হয়তো রাজী সাফায়েতকে বিয়ে করার জন্য, সাফায়েতও সব জানে কিন্তু তার পরও মামীকে না জানিয়ে এই বিয়ে দেওয়া তো অন্যায়। আম্মু তোমার ছেলে লুকিয়ে চুরিয়ে বিয়ে করে কী বিপদ ঘটিয়েছে দেখতে পাচ্ছো না নিজের চোখে? আবারও আরও কোনো অঘটন চাও তোমরা?"
অয়নের কথায় একদম মূক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন আসমা৷ সত্যিই একদিক চাপা দিতে গিয়ে আরেকদিকের ভাঙ্গনের কারন হতে যাচ্ছিলেন তিনি। নিঝুম আর নাতির চিন্তায় স্বার্থপরের মত আচরন করে ফেলেছেন সাফায়েতের মায়ের সাথে। অয়নের কথায় খুবই লজ্জা লাগতে লাগল আসমার, কোনোরকম উত্তর না দিয়ে তাই অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।
ঘটনাটা ঘটায় আসলে সবাই কমবেশি লজ্জিত, এমনকি নিঝুমের বড়ো ফুপুও। শেষ পর্যন্ত রুমানাই নিজেকে সামলে নিয়ে কথা শুরু করলেন, " অয়ন তুমি কী ব্যাপারটা ভাল করে চিন্তা করে বলছ? পরে আবার কোনো রকম দুঃখ হবে নাতে? "
"আন্টি আমি নিঝুমকে বিয়ে করব, আপনার চিন্তার কোন কারন নাই... শুধু বাচ্চাটাকে সুস্থ ভাবে দুনিয়ায় আসতে দিন। আর আমি তো বলেছি ততদিন নিঝুম আমাদের বাসায় বড়ো বৌয়ের মর্যাদা নিয়ে থাকবে। আমার মা যথেষ্ট যত্নশীল এই বিষয়ে... আপনাদের অভিযোগ করার কোন সুযোগই সে দিবে না। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন।"
"কিন্তু অয়ন, আমার নিঝুমের নামে মানুষ অনেক কিছু বলবে, তার কী হবে? সেই অপবাদ তো তুমি ঘুচাতে পারবেনা। এই মাত্র তোমার মামী যে দুর্নাম আমার মেয়ের নামে দিল তার কী হবে? তুমি হয়ত তোমার ভাইয়ের বাচ্চার কথা ভেবে এই বিয়েতে রাজি হলে কিন্তু আমার নিঝুমের বদনাম তো তাতে ঘুচবে না। আর পরে তুমিই যে কথা রাখবে তার কি প্রমান আছে।"
" কিন্তু আন্টি এই সময় আমি যদি নিঝুমকে বিয়ে করিও সেটাও তো অবৈধ, আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? "
"না, আমি বুঝতে পারছি না, আর তার চেয়েও আমি বুঝতে চাচ্ছি না। আমার মেয়ের এক্ষুনি বিয়ে হওয়া দরকার। ওর পেটে বাচ্চা আছে এটা মানুষ জানার আগেই বিয়ে হতে হবে। এই বাচ্চার বাবা অরণ্য না তোমাকে হতে হবে,পারবে? " রুমানা একদমে কথাটা শেষ করলেন।
"আন্টি, আমি তো বলছি যে আমি বিয়ে করব। তাহলে ওর বাবার পরিচয় নিয়ে ঝামেলা হবে কেন?"
"অয়ন তুমি বাচ্চা হবার পরে ওদের দায়িত্ব নিচ্ছ, কিন্তু এই বাচ্চা কার, তার কী জবাব হবে?" রুমানার প্রশ্নের বানে জর্জরিত অয়নের একেবারে দিশেহারা অবস্থা। এটা একটা প্রশ্ন বৈকি। কিন্তু এখন বিয়ে তো বৈধই হবে না। ও কী করবে?
"অয়ন... আমি একটা কথা বলতে চাই, যদি তুমি কথাটা ভালো মনে করে শোন।"
"জি অবশ্যই, বলুন।"
"বলছি তুমি কী আপাতত একটু অভিনয় করতে পারবে, একটা বিয়ের অনুষ্ঠানের বর সাজতে হবে। "
অয়ন কথাটা শুনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। অহনা জানতে পারলে কী হবে... ও তো পাগল হয়ে যাবে। তখন ও কী করবে?নিজের অজান্তেই ঢোক গিলল অয়ন।
"অয়ন? "
"জি?"
"তুমি কী পারবে?"
"ফুপু অয়ন কী পারবে? ওইটা আমিও করব, আগে বিয়েটা করে নেই, হ্যাঁ। আমিও ওইটা খেলব অরণ্য আসলে, ঠিক আছে," খুব উৎকন্ঠা নিয়ে বলে উঠে নিঝুম। এরা এত কী বলছে.. কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না। সব খালি ঝগড়া ঝগড়া কথা বলছে.. এরকম হলে ওর বেবিটার ভয় করবে না? আর বেবি ভয় পেলে অরণ্যর কতো দুঃখ হবে বলো।
সবাই নিঝুমের কথায় মুখ অন্ধকার করে ফেলল। আশুর চোখ দিয়ে জল নামি নামি করছে। এ কেমন পরিস্থিতি.. এ যেন বুক ফাটা কান্না হাসির ঝর্ণা হয়ে তপ্ত ধরনীকে শীতল করতে বইছে।
আসলে নিঝুম এই ভাল তো এই খারাপ থাকে। কখনও একদম স্বাভাবিক আবার কখনো কখনো এরকম। যখন স্বাভাবিক থাকে তখন কোনো কথাই বলে না। ঠিকমতো খায়ও না। তারচেয়ে পাগলামি করতে করতে একটু খায়,তবে সেটা শুধু আশুর হাতে।
"অভিনয়টা কি জরুরি? " অয়নের কন্ঠে দ্বিধা.. ঠিক মন থেকে মেনে নিতে না পারলে যা হয়।
"তাহলে নিঝুমের উপর আর কোনো নোংরা কথা বলার রাস্তা থাকে না। আসল বিয়েটা পরে করলে, এখন শুধু অনুষ্ঠান করে মানুষের সামনে জানান হলো যে অরণ্য নেই কিন্তু বিয়ের সম্মন্ধ যখন হয়েছিল, তখন পরিবারের লোকজন মিলেই তোমাদের এই বিয়েটা ঠিক করেছে। এতে তোমার আপত্তি আছে কোনো? "
"কিন্তু অলরেডি চারমাস হয়ে গেছে বোধহয়। বিয়ের প্রহসন করলেই কী সবার মুখ বন্ধ করতে পারবেন? আমার কিন্তু মনে হয়না, " অয়ন চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রশ্নটা করল। ওর মাথা এখন টর্নেডোতে ফেনিয়ে উঠা জলরাশির চাইতেও জোরে জোরে পাক খাচ্ছে। ওর বিয়ের নকল খবর শুনলেও তো মেয়েটা পাগল হয়ে উঠবে, ওর সত্যি ভয় হচ্ছে... এই বিয়ের খবর সহ্য করতে পারবে তো অহনা? মেয়েটা যদি সিন ক্রিয়েট করে বা সুইসাইড এটেম্পট করে তখন কী হবে? অহনাকে যে ওর ভারি দরকার। অহনাকে ছাড়া একপা চলাও যে ওর জন্য মুশকিল এখন। কিন্তু নিঝুম, বাচ্চাটা ওদেরই বা কী হবে? সব একসাথে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে... দায়িত্ব এত বড়ো জিনিস, তার জন্য এতবড়ো কুরবানি ওকে দিতে হবে আগে যদি জানত, তাহলে প্রেম অন্তত জীবনে করত না। তাতে আর কিছু না হোক নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে এত বড়ো বেঈমানিটা ওকে করতে হতো না।
"অয়ন তুই কিছু স্পষ্ট করে বলছিস না কেন? " আসমা অসহিষ্ণু স্বরে জানতে চান।
"আম্মু আমি বিয়ের অভিনয় প্রয়োজন হলে করব কিন্তু বাচ্চাটা ভাইয়ার, এটাও কি ভাইয়া ডিসার্ভ করে না? বাবার নামটা লুকিয়ে ফেললে তো ওর আর কোনো অস্তিত্বই থাকলনা পৃথিবীর বুকে।"
অয়নের কথায় আসমা আর রায়হানের বুকের ক্ষতটা যেন আরও বাড়ল। চোখের সামনে বিগত দিনগুলোর ছবি একের পর এক ভেসে উঠতে লাগল। তাদের ছোট্ট অরণ্য গুটি গুটি পায়ে সারাবাড়ি হাটছে, দুইভাই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাবার সাথে স্কুলে যাচ্ছে, সাইকেলে চড়ে প্রাইভেটে যাচ্ছে, বন্ধুদের সাথে মাঠে ক্রিকেট খেলছে, কোনটা থেকে কোন স্মৃতি মনে করবেন আর মুছবেন তারা। হাজার স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন, হঠাৎ বুলেট নামের কালো অন্ধকার তাদের সব স্বপ্নকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে চলে গিয়েছে। এখন আর কোনো স্বপ্ন তারা দেখতে চান না। এখন স্বপ্ন দেখতে ভীষন, ভীষন ভয় হয় তাদের।
"তাহলে আমার আর কোন উপায় নেই আসমা আপা। আমি ফাহিমের সাথেই আমার নিঝুমের বিয়ের ব্যাপারটা ঠিক করে ফেলি। ফাহিম নিঝুমকে যথেষ্ট পছন্দ করে, আগে ফাহিম তেমন গরজ দেখায়নি কিন্তু যখনই নিঝুমের বিয়ের সংবাদ শুনেছে, তখন নিজেই আমাকে ফোন করে বলেছিল আন্টি আমাকে একবার ফোন করে জানালেনও না। ওর নাকি নিঝুমকে আগে থেকেই খুব পছন্দ কিন্তু নিঝুম নিজে থেকে ওকে কিছু বলেনি বলে ও ডিগ্রীটা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল।"
রুমানার কথা শুনে আসমার কান্নায় গলা বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। কী এক মাথা খারাপ করা পরিস্থিতি আসলো... এ কেমন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হচ্ছে তাদের? এক সেকেন্ডের জন্য যদি আশায় বুক বাঁধেন তো পর মুহূর্তে হতাশার পাহাড় যেন ঘিরে ধরে আষ্টেপৃষ্টে। এর শেষ কোথায় কেউ কী বলতে পারে?
"না... তার আর দরকার পড়বে না। আচ্ছা আপনারা সব ব্যবস্থা করেন, আমাকে শুধু তারিখটা জানিয়ে দিবেন। আমাকে ব্যাংক থেকে ছুটি নিতে হবে," অয়ন একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাগুলো বলে যায়। আয়োজন করে নিঝুমের সাথে ওর বিয়ে, কেন যেন বিশ্বাস হতে চাইল না। অরণ্য তাহলে এবার পৃথিবীর বুক থেকে সত্যি সত্যি মুছে যাবে। কেউ আর কোনোদিন অরণ্য রহমানকে খুঁজবে না। অরণ্য রহমান কেবল অমুক নাম্বার ফাইলের নিচে একটা ফাইল নাম্বার হয়েই বেঁচে থাকবে?
অয়নের আশ্বাসে সবার মুখে স্বস্তির আভাসটা ফিরে এলো আবার। অয়নের আর এক সেকেন্ড ওখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো না। এলোমেলো পায়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল চোখে পড়ল অরণ্যর ঘরের দরজাটা হা করে খোলা। কৌতুহল নিয়ে সামনে এগুতেই চোখে পড়ল অরণ্যর কোল বালিশটা দু'হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে নিঝুম। কেউ এই মেয়েটার মনের খবর রাখে না, কারো কাছেই ওর মনের চাওয়ার কোনো দাম নেই। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল...
সবার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কী হবে? ও নিজেও কী মেয়েটার মনের কানাকড়ি মূল্য দিয়েছে? আর সবার মতোই ঔ তো কেবলই মানুষ কী বলবে তা নিয়েই মাথা ঘামালো,তাই অন্য কারো দোষ ধরা ওর সাজে না।
ফিরে আসতে গিয়ে চোখে পড়ল দুই একটা মশা নিঝুমের পায়ের কাছে ভন ভন করছে। চেষ্টা করে একটাকে মারতে পারল, আর একটা উড়ে কোথায় যে লুকাল খুঁজেই পেল না ... শেষে ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে আপাতত দায়িত্ব সাড়ল, বাড়তি হিসেবে ভাঁজ হয়ে থাকা কাঁথাটা মেলে দিল নিঝুমের গায়ের উপর। বেচারি.... বিনা দোষে সাজা পেল।
সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভাল লাগলো না .. প্রায় চোরের মতোই নিঃশব্দে পালিয়ে এল ও অরণ্যর ঘর থেকে। কিন্তু কার কাছ থেকে পালাল ও? নিজের কাছ থেকে নাকি নিঝুম?
চলবে...........
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top