৩০

"এ ভুবনে ডুবল যে চাঁদ সে ভুবনে ফুটল কী তা?
হেথায় সাঝে ঝরল যে ফুল হোথায় প্রাতে ফুটল কী তা?
এ জীবনের কান্না যত- হয় কী হাসি সে ভুবনে?
হায়?জীবন এত ছোট কেনো? এ ভুবনে?"

                          -তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়

"আশু তুই এভাবে সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস? " বড়োফুপির কথায় চমকে উঠল আশু।

"আ..আমি.. ফুপি," ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল আশু।

"হ্যাঁ.. আর তোর মা কই? কাউকে পাচ্ছি না কেন?"

"ফুপি মা তো একটু জিজুদের বাসায় গেছে..."

"কাদের বাসায় গেছে! "

"না মানে ওই অরণ্য ভাইয়া, ওনাদের বাসায় গেছে," থতমত খেয়ে বলল আশু। বড়ফুপির চোখে মনে হয় স্যাটেলাইট বসান। সারা পৃথিবীর ইঞ্চি ইঞ্চি খবর উনার জানা থাকে, মহা জ্বালা।

"অরণ্যদের বাসায়! ওখানে গেছে কেন? এতদিন পরে ওই বাড়িতে তোর মায়ের কী কাজ পড়েছে? আর এসব জিজু ফিজু কী ভাষা... যতো নোংরা আর অসভ্য জিনিস, আর কখনো যেন না শুনি এসব ভাষা। বিয়ে হতো পারেনি তার আগেই এরা দুলাভাই বলা শুরু করে দিয়েছিল," রাগে গজগজ করে থাকেন দিলারা।

"জি.....আর বলব না," আশু মিন মিন করে উত্তর দিল। মনে মনে বলল জিজু আর কী করে বলবো.... বলার তো কোন সুযোগই নাই।

"অ্যাই তোর আম্মু কখন আসবে?"

"আমি জানিনা ফুপি।"

"নিঝুম কই? ওর জন্য ভাল একটা ছেলে  দেখেছি।"

"আপু তো আম্মুর সাথে.. না মানে আপু তো ওই বাড়িতে..না মানে " সব গুলিয়ে ফেলে আশু। এই বড়ো ফুপির এতো বড়ো বড়ো চোখ কপালে উঠতে দেখলে ওর এমনি পিলে চমকে যায়।

"অ্যাই সত্যি করে বলতো.. তুই এরকম তোতলাচ্ছিস কেন? কি জট পাকাচ্ছিস? "

"না.. না... ফুপি, আমি কোন জট পাকাচ্ছি না... সত্যি বলছি," আশু নিজের গলা ছুয়ে প্রমিস করল। কিন্তু দিলারা বেগমের অভিজ্ঞ চোখ, ভাস্তিকে এমন হড়বড় করতে দেখে ওনার সন্দেহ আরও জোরাল হলো।

" আশু.... রুমানা আর নিঝুম এখন কোথায় সত্যি  করে বলবি।"

ফুপির অগ্নিদৃষ্টির সামনে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে গেল আশুর, ফুপির দৃষ্টি দিনকে দিন পাকা জহুরীর মতো হয়ে যাচ্ছে... শেষ পর্যন্ত আশু কথাটা বলেই ফেলল,"ফুপি.. আসলে আম্মুর কোনো দোষ নাই।"

আশুর তোতলামি ততক্ষনে বড়ো আকার ধারন করছে, মাথা পুরোপুরি ফাঁকা।

"তোর বাপ কই? "

"ফুপি সবাই আপুর বিয়েতে..."

কথাটা বলেই আবার জিভ কাটল আশু,আজ সব গুলোবে ও।

"বিয়ে... কার বিয়ে? নিঝুমের!"

"জি..."

আশু সাথে সাথে মুখ চাপা দিল কিন্তু সর্বনাশ ততক্ষনে  হয়ে গেছে।

"তা নিঝুমের বিয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে কেন? আমাকে জানায় নাই কেন তোর মা... আমি কী নিঝুমের বিয়ে ভেঙ্গে দিতাম, না আমি ভাল পাত্রের সম্মন্ধ আনতে পারতাম না যে তোর মা সবকিছু  লুকায় আমার কাছ থেকে। এত বছরেও তোদের কিছু হতে পারলাম না, অথচ ছোট ভাইয়ের পরিবারটাকে সব সময় নিজের পরিবার বলে ভাবছি।"

"ফুপি আসলে একটা বড়ো গোলমাল হয়ে গিয়েছিল...."

"কী গোলমাল? "

"ফুপি আপু আসলে.. আসলে "

"তুই কী বলবি না তোতলাতেই থাকবি?"

"বড়ো ফুপ্পি আপু মা হতে চলেছে,"বলেই  ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল আশু। আজ এখানে  রোজ কেয়ামত হবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না আর তার জন্য একমাত্র ও দায়ী।

........................

"আসমা এখনও ভেবে দেখ, তুমি কিন্তু পরে অনেক কষ্ট পাবে। আর আমাদের অরণ্যর সন্তান মানে আমাদের কাছে অরণ্য,ওকে ছেড়ে দূরে থাকা আমাদের পক্ষে কী করে সম্ভব?"রায়হান সাহেব গম্ভীর স্বরে জানতে চাইল।

"আমি জানি, কিন্তু তুমি বুঝতে পারছনা এই বিয়েটা না হলে লোকে নিঝুমের দিকে আঙুল তুলবে। ওদের বিয়ে হয়েছিল এটা কেউ মানবে না। অরণ্য কাবিনটা নিঝুমকে দিয়েছিল আর নিঝুম এখন সেটা কোথায় কিছুই বলতে পারছে না। ও বলে কাবিনটা নাকি অরণ্য আবার ওর কাছ থেকে  নিয়েছিল কিন্তু পরে অরণ্য ওটা কোথায় রেখেছে নিঝুম জানেনা।

এখন এই সব প্যাচে পড়ে নিঝুমের বদনাম হলে আমার ছেলেটা মরেও শান্তি পাবে না। ওর ভালবাসার মানুষটাকে কষ্ট পেতে দেখলে ওর কষ্ট আরও বাড়বে, আ... আর নিঝুমের মা কে আমি ভয় পাই। রুমানা যদি কোন কারনে নিঝুমকে ওর আত্মীয় ফাহিমের সাথে বিয়ে দিতে চায়, তাহলে অরণ্যর চিহ্নটাকে ওরা একদম নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। আর যদি ওরকম কিছু নাও হয়, দেখা গেল জন্মাবার সাথে সাথে কিছু একটা করল বাচ্চাটার সাথে। কারন সে ক্ষেত্রে ওরা বাচ্চাটার অস্তিত্ব ছিল,তার প্রমানই রাখবে না। আর ফাহিম ছেলেটা হয়ত জানবেই না বা জানলেও হয়ত শুধু বাচ্চা না নিয়ে নিঝুমকে বিয়ে করতে চাইবে। কিন্তু আমি আমার অরণ্যকে এভাবে হারিয়ে যেতে দেব না। সাফায়েতের সাথে আমার কথা হয়েছে, আমরা এখন যে প্রোগ্রামটা রাখছি এটা একটা ফলস প্রোগ্রাম কিন্তু এতে রুমানা শান্ত হবে। আসল বিয়েটা নিঝুমের ডেলিভারির পরে হবে। কিন্তু সেটা পরে গোপনে করতে হবে। এটা রুমানার শর্ত ছিল যে ওর পরিবারের কেউ যেন বিষয়টা না জানে যে... এটা অরণ্যর বাচ্চা। এই শর্তেই ওরা বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আসতে দিতে রাজি হয়েছে। আমার অরণ্যকে বাঁচানোর আর কোনো পথ নেই... আমি নিরুপায়। আজকের বিয়েটা একটা অভিনয় কিন্তু এই অভিনয়টুকু আমাদের জন্য বড়ো কঠিন আর তার চেয়েও বেশি প্রয়োজনের," আসমা কাতর সুরে বললেন। তিনি আসলেও ভয় পাচ্ছেন। অরণ্য মারা যাবার পর থেকে এই ভয় তার মনের মধ্যে চেপে বসেছে।

"সাফায়েত কি জানে বিয়েটা মিথ্যা? ওকে সব পরিস্কার করে বলেছ তো আসমা? নিঝুমের বা ওর সন্তানের ব্যাপারে সাফায়েতের মনে কোন ভুল ধারনা নেই তো? " রায়হান সাহেব বিমর্ষ স্বরে জানতে চান। অরণ্য নিজের সাথে সাথে এই পরিবারের সব হাসি,আনন্দ সব সঙ্গে করে নিয়ে চলে গিয়েছে। কে বা কারা অরণ্যকে মারল সেটা এখনও স্পষ্ট না তবে ওর সহকর্মী পার্থ বলেছে, অরণ্য নাকি বড়ো এক দল শয়তানের বিরুদ্ধে লেগেছিল, তারাই সম্ভবত এটা করেছে। কেসের তদন্তও জোরেসোরেই চলছে তবে কবে এর সুরাহা হবে সেটা কেউই সঠিক করে বলতে পারছেনা।

"আমি সাফায়েতকে সব খুলে বলেছি ভাল করে। ধর্মত নিঝুমের বিয়েত এখন হয়না, কিন্তু সমস্যা হলো নিঝুমের এই অবস্থা কারও সামনে বলাও যাবেনা। এটা রুমানার প্রথম শর্ত ছিল। ওর পরিবারের নাকি মুখ দেখানোরও উপায় থাকবেনা। অরণ্যর সাথে নিঝুমের  বিয়ে হয়েছিল... পেটে বাচ্চা দেখলে সেটা নাকি কেউ বিশ্বাস করবেনা। সবাই নাকি বলবে ওটা  নিঝুমের অবৈধ সন্তান। রুমানা আমাকে প্রথমদিনই কথাটা সরাসরি বলেছে। আমার খুব খুব কষ্ট হয়েছিল জানো... আমার অরণ্যর একমাত্র স্মৃতি। ওদের বিয়ের কাবিনও অরণ্য আমাকে দেখিয়েছিল। ওটা আমার অরণ্যরই বাচ্চা, তুমি বিশ্বাস কর।"

"আমি জানি আসমা, আসলে আমাদের কপালেই দাদা- দাদী হওয়ার সুখটা ছিল না। ঠিকআছে যা ভাল মনে হয় কর। আমি তোমার সঙ্গে আছি। "

"হুমম.. অয়নটা যদি একটু আমাদের কষ্টটা বুঝতে পারত,ও যদি নিঝুমকে একটু মেনে নিত।" আসমা কান্না জড়ানো কন্ঠে বললেন।

"ব্যাপারটা শুধু তা নয় আসমা, নিঝুমকেও তো মেনে নিতে হবে। ও কী পারবে অরণ্যর জায়গায় অয়নকে মেনে নিতে? তারপর আবার ওরা জমজ, অনেক কিছুই একই রকম। অয়নকে দেখলে নিঝুমের উল্টো অরণ্যকে বেশি করে মনে পড়বে।"

"জানি,কিন্তু অয়ন সাহায্যের হাত বাড়ালে, নিঝুম এক সময় সেটা কাটিয়ে উঠতে পারত।আর জমজ বলেই যেমন সমস্যা আছে তেমনই সুবিধাও আছে। মানুষের চেহারাটা অনেক বড়ো জিনিস, আর অয়ন, অরন্যর মতো নয়, কিন্তু ও ওর মতো করেও নিঝুমের সাথে মানিয়ে নিতে পারত।"

রায়হান সাহেব আর কথা বাড়ালেন না।  আসমা একবার কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে, সেটা পরিবর্তন করান খুব কঠিন। খুবই জেদি স্বভাবের। দুই ছেলেও মায়ের এই স্বভাবটাই পেয়েছিল, মনে মনে উপরআলার সাহায্য চাইলেন তিনি এ ব্যপারে।

............................

নিঝুম কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে দেখল নিজেকে, কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ওকে।কেমন বউ বউ লাগছে নিজেকে..... ও হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল প্রতিটা গয়না। অরণ্য ওকে দেখলে আজ পাগল হয়ে যাবে ঠিক।

ইশশসস ওর বোকা বরটা এখনো আসছে না, নিঝুম কত সুন্দর করে সেজেছে আর লোকটা এখনও রাগ করে বসে আছে। হয়ত আজও প্রথম সেই ঘুরতে যাওয়ার দিনের মতো গাড়িটা মোড়ের মাথায় থামিয়ে বসে আছে? পুরো পাগল একটা।

নিঝুম ওর হাতের ভারী বালাদুটো নাড়তেই সাথের কাঁচের চুড়িগুলো কেমন অদ্ভুত আবেগ বেজে উঠল.. কী যেন বলতে চাইল, কিন্তু নিঝুমের এমনি পোড়া কপাল...  কাঁচের চুড়ির ভাষা পড়তে যে ও জানেনা।

"আরে এত শব্দ করে বাজিস না, যতই ডাক পাগলটা রাত ছাড়া আসবে না... অনেক রাতে এসে আমাকে কানে কানে কত কিছু বলে যায়। ওর অনেক কষ্ট জানিস... কাউকে ও দুঃখের কথা বলতে পারেনা, তাই শুধু আমাকেই বলে।"

পর্দার পিছে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনলেন আসমা । নিঝুমের কষ্টগুলো দূর করার ক্ষমতা যদি তার থাকত। কি অবর্ননীয় কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা... গোপনেই চোখের পানিটা মুছলেন তিনি। অয়নটার উপর অভিমান হলো খুব, অরণ্যর কথা ভেবেও কী ও নিঝুমের দায়িত্বটা নিতে পারতনা। এমন তো না যে নিঝুম পাত্রী হিসেবে যোগ্য ছিলনা। ডিভোর্সি, বাচ্চাওয়ালা মেয়েগুলোর কী আবার বিয়ে হয়না। সাফায়েত কী করছে না? তাহলে ও করলে এমন কী ক্ষতি হতো? অয়ন, অরণ্যর ছায়া... ওর সাথেই নিঝুম হয়ত সব চেয়ে তাড়াতাড়ি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারত। কিন্তু ছেলেটা এই কথা শুনতেই রাজি নয় বিয়ে করা তো দূরের কথা।

"নিঝুম.."

"কী মামনি?"

"চল মা... সাফায়েত বসে আছে।"

"সাফায়েত... সাফায়েত কে?"

"বিয়ের বর"

"ওহ.. হ্যাঁ, চল চল, আগের কাজ আগে। এই বিয়েটা হয়ে গেলে আমি কিন্তু আজ সারারাত অরণ্যর সাথে গল্প করব। কেউ আমাকে বকতে পারবে না, আর আজ বকলেও আমি শুনবও না। ও খালি আসে আর একটা কথাও না বলে চলে যায়। ও চলে যায় কেন মামনি? ও আর আগের মতো আমার কাছে থাকে না কেন ? "

আসমা এর কী উত্তর দিবেন? কিছুই বলার নেই।

"আচ্ছা আগে চল তো, পরেরটা পরে কেমন," নিঝুমকে এনে সাফায়েতের পাশে বসালেন আসমা। কী সুন্দর লাগছে তার মা টাকে.... চোখের জলে চারদিকটা ঝাপসা হয়ে আসতে চাইলেও, জোর করে আলগা একটা হাসি ঝুলিয়ে দিলেন আসমা নিজের ঠোঁটের কোনে।

রুমানাকে দেখে আজ অনেকদিন পর খুব স্বাভাবিক লাগছে। কাজী সাহেব আগেই সব লিখে রেখেছেন। ওরা তাতে সিগনেচার করলেই হয়ে যাবে। আসমা সাফায়েতের পাশে বসে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই আশু আর ওর বড়ো ফুপুকে নিয়ে হুড়মুড় করে এসে ঢুকল।

"শাহেদ এগুলো কি হচ্ছে? " দিলারা তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইলেন।

"বড়োআপা আপনি? "

শাহেদ রুমানাকে পই পই করে মানা করেছিল বড়ো আপার কাছ থেকে ব্যাপারটা লুকাতে।

"এসব কী অনাসৃষ্টি কথা শুনছি আমি। এমন সব বিষয়গুলো কেন আমাদের কাছ থেকে লুকানো হয়েছে? নিঝুমের জন্য এই সম্মন্ধটা আমি এনেছিলাম। আর যখন তোমাদের ছেলে মেয়েরা এসব অনাচারগুলো করলো তখন আমি তোমাদের শত্রু হয়ে গেলাম। "

"বড়োআপা আপনি বিশ্বাস করুন পুরো ব্যাপরটা আমরা যখন জানতে পেরেছি তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, সর্বনাশ ঠেকানোর রাস্তা থাকলে, আমরা আপনকে সব জানাতাম। কিন্তু এমন ভয়নক পরিস্থিতির শিকার এখন আমরা, না পারছি গিলতে, না পারছি ফেলতে। আর দোষ দিয়েও তো কোনো লাভ হচ্ছে না। অরণ্যই তো নেই৷ " রুমানা কোনোমতে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল।

"কিন্তু তাই বলে নিঝুম মা হতে যাচ্ছে এতবড়ো সংবাদটা তুমি আমাদের কাছ থেকে লুকালে কী করে? তোমাদের বিবেকে একটু বাঁধল না। আর অরণ্যর এত বড়ো সাহস হলো কী করে? আর সেই সাথে তোমার মেয়ে... বাপরে বাপ, তোমার এই ভ্যাবলা মার্কা মেয়ে যে তলায় তলায় এতোটা নীচে নেমে গেছে, সে যে এতো শেয়ানা আমি তো  জানিনি... পুরো পরিবারের মুখে চুনকালি দিয়ে তবে ছাড়ল তোমার মেয়ে।"

"আপা আপনি একটু শান্ত হোন, ভালয় ভালয় এই বিয়েটা হয়ে যাক, আমি সব আপনাকে বলব, আপনি দয়া করে এখানে একটু বসুন।"

"তোমার কি মাথা খারাপ রুমানা? তোমার মেয়ের পেটে বাচ্চা? এরকম অবস্থায় কেমনে বিয়ে হবে? তুমি, তোমাদের সবারই কী মাথা খারাপ আর আসমা ভাবী আপনিও কি জানেন না? রায়হান ভাই কই? আমি রায়হান ভাইয়ের সাথে কথা বলব। এই বিয়ে কি ধর্মে মানবে,সবাই ঝাঁটাপেটা করবে তোমাদের, এক অন্যায় লুকাতে গিয়ে তোমরা দ্বিগুন অন্যায় করছ।"

"আপা আপনি দয়া করে থামেন, আপনার রায়হান ভাইয়ের কোনো দোষ নেই এতে। সে আমাকে বারন দিয়েছিল। আর আমিও অনেক দুঃখে পড়ে এতে রাজি হয়েছি। আমার অরণ্যর নামে একটার পর একটা অভিযোগ। কেন কী এমন করেছে ও? গোপনে বিয়ে করেছিল এই তো... কিন্তু কী পরিস্থিতিতে ওরা বিয়ে করেছিল তার কোন ধারনা আপনাদের নাই। আমরা তো নিঝুমকে বউয়ের মর্যাদা দিয়ে আনতে চেয়েছি আমাদের কাছে। আমরা তো আমাদের নাতিকে অস্বীকার করছি না। তারপরও যদি আপনারা নিঝুমের অবস্থা বুঝতে না চান, তাহলে আমরা কী করব বলুন তো? "

"রুমানা... আসমা ভাবী এগুলো কি বলছে? আর তোমরা উনাদের এসব বলার আগে আমার সাথে একবার আলোচনা করার প্রয়োজনও বোধ করনি! "

"বড়পা, আমরা কী বলতাম বলুন তো? বলার মতো মুখ আমাদের থাকলে তো। আর অরণ্যকে তো আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। ও যে নিঝুমকে এমন বিপদে ফেলবে কী করে জানব," রুমানার কথায় স্পষ্ট অভিযোগ। নিঝুম ভয়ে ভয়ে তাকাল মায়ের দিকে। আম্মু অরণ্যকে কেন বকছে.. কী করলো আবার ওর বোকা বরটা।

"ওদের বিয়েটা কী সত্যিই হয়েছিল? কোনো ভাঁওতাবাজি ছিল না তো?" দিলারা অসহিষ্ণু স্বরে জানতে চাইলেন। মাথা খারাপ হয়ে গেছে তার, নিঝুমের বেলাল্লাপনা সহ্য করা তার ধৈর্য শক্তির বাইরে... এই মেয়েকে তিনি কতোটা বিশ্বাস করেছিলেন।

"হ্যাঁ, আমি নিজে ওদের বিয়ের কাবিন দেখেছি," আসমা অনমনীয় স্বরে বললেন।" কাবিনটা নকল ছিল না আপা। আমি ছেলেকে ফেরেশতা বানাতে না পারলেও অমানুষ বানাইনি।"

আসমার কন্ঠের দৃঢ়তা দিলারা বেগমকে এবার নমনীয় হতে বাধ্য করলেন.. দুশ্চিন্তাগ্রস্থ সুরে বললেন, "বিয়ে যদি সত্যি হয়, সেক্ষেত্রে বাচ্চা তো বৈধ। শাহেদ তোরা এই ধোঁকাবাজির আশ্রয় কেন নিচ্ছিস। বিয়েটা হোক, সমস্যা নাই কিন্তু এভাবে তো বিয়ে অবৈধ। পাত্র সবকিছু জানে?"

"জি.. আমি বলেছি সব ওকে। সাফায়েত সব জানে। "

আসমা শান্ত স্বরে দিলারাকে উত্তর দিলেন, যদিও অরণ্যর নামে বলা প্রত্যেকটা কথা তখনও হুলের মতো ফুটছে তার কানে।

"আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার সাফায়েত এত বড়ো ভুল করতে পারে না।"

চিৎকার শুনে সবাই ঘরের দরজায় দাঁড়ান অপরিচিত মহিলাটির দিকে ফিরে তাকাল। মধ্যবয়স্ক  মহিলাটি তার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা চেপে ধরেছেন, তার চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে... মুহূর্তের মধ্যে ঘরের আবহ আগের চেয়েও শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে দাঁড়াল।

"ভাবি তুমি আমার কথাটা শোন একটু, " আসমা তাড়াতাড়ি মহিলাটির দিকে এগিয়ে গেল। মহিলাটি সম্পর্কে সাফায়েতের মা হন।

"না, তোমরা সবাই একজোট হয়ে আমার সহজ,সরল ছেলেটার উপরে নিজের ছেলের পাপটা চাপিয়ে দিতে চাইছ। এভাবে অরণ্যর পাপ তোমরা কী করে আমার ছেলেটার উপরে..." ডুকরে কেঁদে উঠলেন সাফায়েতের মা।

সাফায়েতের মায়ের কথাগুলো নিঝুমের বুকের ভিতরে তুমুল ঝড় তুললো। সবাই এত বার বার অরণ্যর কথা কেন বলছে ?

"ভাবি আমি তোমাকে সব বলতাম, তুমি বিশ্বাস কর। সাফায়েতকে আমি খুব ভালবাসি বলেই নিঝুমকে ওর হাতে তুলে দিয়ে নিজের নাতিটাকে একজন ভাল বাবা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।"

"তা তুমি ঠিক বলেছ আসমা, আমার ছেলেটা অনেক সরল আর ভাল মানুষ। ঘোর প্যাচ বোঝে কম। তোমাদের খুব ভালোবাসে, কিন্তু তাই বলে ওর এতবড়ো ক্ষতি করবে তোমরা? বলছি ওই মেয়ে যদি এত ভালই হয় তাহলে তোমার আরেক ছেলে কেন ওই মেয়েকে বিয়ে করবে না? "

"ভাবি অয়ন, অন্য কোনো মেয়েকে পছন্দ করে বোধহয়। তাছাড়া ও নিঝুমকে ওই চোখে কখনো দেখেনি।"

আসমা, সাফায়েতের মাকে কথাটা বোঝানোর আপ্রান চেষ্টা করলেন কিন্তু সাফায়েতের মা এখন এসব শুনতে অপারগ।

"মিথ্যে কথা, আসলে এই চরিত্রহীন মেয়েটা তোমার ছেলের সাথে সম্পর্ক করে বিয়ের আগেই বাচ্চা বানিয়েছে। এখন তোমার ছোট ছেলেকে বিয়েতে রাজি করাতে না পেরে তুমি এই বাজে মেয়েটাকে আমার সহজ সরল ছেলের ঘাড়ে গছানোর বুদ্ধি করেছ। এত বড়ো পাপ তোমরা করতে পারলে, তোমাদের বিবেকে বাঁধল না? তোমাদের উপর আল্লাহর গজব পড়বে দেখে নিও, কেউ তোমাদের বাঁচাতে পারবেনা।"

সাফায়েতের মায়ের অভিযোগে আসমা মনে মনে মাটিতে মিশে যাচ্ছিলেন। অরণ্য এ কী করে গেল। কতবড় অপবাদ আজ মানুষ ওকে দিচ্ছে। ছেলেটা মরেও শান্তি পাবে না, আজীবন জ্বলবে। নিঝুমকে ভালোবাসার শাস্তি অরণ্যকে আজীবন ভোগ করতে হবে। আসমার মনে হল তিনি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন।

"কাউকে বিয়ে করতে হবে না, বেড়িয়ে যান এখান থেকে। নিঝুমের দায়িত্ব আমার, আমি বিয়ে করব ওকে।"

বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো।

লাল চোখজোড়া মেলে  সবার দিকে তাকিয়ে আছে অয়ন। মাথার চুল গুলো এলোমেলো, মনে হচ্ছে বড়ো ধরনের কোন ঝড় বয়ে গেছে ওর উপর দিয়ে।

"কিন্তু অয়ন... " রুমানা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অয়নের হাতের ইশারায় থেমে গেলেন।

"আর কোন কথা বাড়াবেন না আন্টি, আপনাদের মেয়ের বিয়ে নিয়ে কথা তো, আমি কথা দিলাম, বাচ্চার জন্মের দুইমাস হোক, আমি নিঝুমকে বিয়ে করব। কিন্তু আমার শর্ত হলো ততদিন নিঝুম অরণ্যর বউ হয়ে এই বাসায় থাকবে। আপনারা কোনো রকম আপত্তি করতে পারবেন না।"

চলবে...

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top