২৭
"তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?"
নিঝুমের কথায় অরণ্য গভীর এক চিন্তার রাজ্য থেকে ছিটকে বেড়িয়ে এল। এতক্ষণ ও যেন একাই এক নিস্তব্ধ মহাদেশে ঘুরে বেরাচ্ছিল।
নিঝুমের প্রশ্নে অবাক হলো অরণ্য, ওর মন খারাপ... এরকম কেন মনে হলো নিঝুমের?
"না তো, হঠাৎ এমন কেন মনে হলো তোমার?"
"তুমি কেমন মন খারাপ করে বসে আছো।
আই অ্যাম সরি... আসলে তুমি তো ওষুধ পর্যন্ত এনে দিয়েছিল, আমিই ভুল করে খাইনি সব দোষ আমার।"
গাড়িটা বেশ জোরের সাথে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল।
"তারমানে, তুমি ওটা খাওনি!" অরণ্যর গলার স্বর এমনি বিস্ময় মাখানো যে, নিঝুম ভয়ে এতটুকু হয়ে গেল।
"আমি...ভুলে গিয়েছিলাম, পরে মনে হলে খেয়েছিলাম কিন্তু ততক্ষণে বাহাত্তর ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছিল," নিচু স্বরে কথাটা শেষ করল নিঝুম।
"ঝুম তুমি এত দায়িত্ব জ্ঞানহীন কি করে হতে পারো ? আমি ডক্টরের কাছে শুনে জিনিসটা নিয়ে গেলাম আর তুমি জাস্ট ভুলে গেলে?"
"সরি, আমার মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল পুরো ব্যাপারটা। কুয়াকাটা যাওয়ার আনন্দে সব গুবলেট হয়ে গিয়েছিল," নিঝুম, অরণ্যর দিকে ভয়ে তাকাতে পারলনা। অরণ্যর চেহারা বলে দিচ্ছে নিঝুম খুব বড়ো একটা ভুল করে ফেলেছে।
"খুব ভালো, এই বার পাহাড়ের সমান পেট নিয়ে ঘুরে বেড়াও, আমার কি? " কপালে বিরক্তির ছাপ ফেলে গাড়িকে আবার সচল করলো অরন্য।
"এই তুমি আমাকে ভয় দিচ্ছ কেন? " নিঝুম অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলল। সেই কখন থেকে মুখ অন্ধকার করে আছে অরণ্য.. কী বিচ্ছিরি লাগছে ওর।
"ভয় আর আমি? কি যে বল না। উল্টো ঝটকা তো তুমিই আমায় দিলে," হতাশ সুরে বলল অরণ্য। "বিয়ের দুই মাসও গেলনা আর তুমি বাচ্চা বানিয়ে ফেললে।"
"আমি বুঝতে পারছি , আমি খুব বোকার মতো একটা কাজ করে ফেলেছি। কিন্তু এখন কি করব বুঝতে পারছিনা।"
"কি আর করবে.. খানিক পর পর বমি করবে, বান্ধবীরা সব বিয়ের পর এখানে ওখানে ঘুরতে যাবে, তুমি তখন বাচ্চার ন্যাপি পাল্টাবে, এমনকি হানিমুনে যেয়েও তুমি অসুস্থ হয়ে পরতে পারো। " চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলল অরণ্য। " মানুষ বিয়ের দুই তিন বছর পর বাচ্চা কাচ্চার চিন্তা করে, আর আমার এমন কপাল হানিমুনের আগে বাচ্চার দুধ আর প্যাম্পার্সের হিসেব করতে হবে।"
নিঝুম,অরণ্যর মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। এগুলো অরণ্য বলছে? নিঝুমের মনে হলো এই অরণ্যকে ও চেনেনা। অরণ্য কি ভীাষন রাগ হয়ে গেছে।
একদিকে দুশ্চিন্তা অন্যদিকে অরণ্যর গম্ভীর মুখ... নিঝুমের খুব কান্না পেল। কিন্তু এখন কান্না করলে যদি অরণ্য মনে করে যে ও ইচ্ছে করে এমন ঢং করছে। লুকিয়ে চোখের কোনে আসা পানিটা আঙ্গুলের মাথা দিয়ে মুছে নিল নিঝুম। ওদের বাবু হবে এটা শুনে যে কেউ খুশি হবে না সেটা নিঝুম জানে কিন্তু তাই বলে অরণ্যর কাছ থেকে এমন রাফ ব্যবহার ও আশা করে নি। ভুল ওর একটু হয়ে গেছে , কিন্তু অরণ্যর আচরন দেখে মনে হচ্ছে নিঝুম জেনে বুঝে সব করেছে। কি রকম রাগ রাগ হয়ে কথা বলছে, আর একবারও তাকাচ্ছেনা ওর দিকে।
সিগন্যালে পড়ে গাড়ি সব সারি বেঁধে থামতেই একটা বাচ্চা মেয়ে কয়েকটা বকুল ফুলের মালা নিয়ে এসে ওদের গাড়ির পাশে দাঁড়াল। বাচ্চাটাকে দেখে অরণ্য এমন ভাবে গ্লাস উঠালো যে, নিঝুমের রীতিমতো লজ্জা লাগল। অরণ্যর প্রতিটা আচরন বলে দিচ্ছে সে নিঝুমের উপর বিরক্ত, স্টিয়ারিংটা এমন ভাবে ঘোরাচ্ছে যে মনে হয় পারলে আছড়ে ভেঙ্গে ফেলত। নিঝুমের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বাচ্চা মেয়েটার কাছ থেকে বকুলের মালাগুলো নিয়ে খোঁপায় আটকায়, কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। সত্যি বলতে অরণ্য এখন যেভাবে কথা বলছে, তাতে বিয়ের আগে হলে ও কী করতো নিঝুম জানেনা। কিন্তু এখন নিজেকে সার্কাসের কোনো সদস্যই মনে হচ্ছে। ডাক্তারের সামনে যাই বলুক না কেন অরণ্যর আচরন বলে দিচ্ছে এই বাচ্চা ওর চাইনা। আচ্ছা দুই বছর পরে না হয়ে এখন হচ্ছে, তাতে সমস্যাটা কোথায় এটাই নিঝুমের মাথায় আসছেনা আর ওদের বিয়ে এই হলো বলে।
নিঝুম গাড়ির জানালার দিকে মুখ করে বসে রইল। চোখে চোখ পড়লে যেখানে মনের মেঘ দেখা যায়, সেখানে ভুল স্বপ্ন দেখার মাশুল ওকে দিতে হবে বৈকি। এক ফোঁটা পানিও ও আর মুছল না। অরণ্য জানলও না চোখের কোল বেয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা নদীটা নিঃশব্দে কি কঠিন এক প্রতিজ্ঞা করে বসল।
ঘ্যাচ করে গাড়ির ব্রেক কষতেই চমকে উঠে চোখ দুটো খুলল নিঝুম। চোখটা খুলেই অবাক হয়ে গেল। এটা তো ওদের বাসা নয়, ওর শ্বশুরবাড়ি। আসলে কোনটাই বোধহয় ওর না.. যা হোক কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো অরণ্য ওকে এখানে কেন নিয়ে এল?
অরণ্য নিচু স্বরে কাকে যেন বলল, " সব কিছুর এরেঞ্জমেন্ট কি বাসায় করা সম্ভব হয়েছে? ওরা এক্সপার্ট তো? দেখ কোনো ভুলচুক হলে কিন্তু আমি কাউকে ছাড় দিবনা,সোজা মামলা ঠুকে দিব।।"
অরণ্য কথাগুলো এমন ফিসফিস করে বলছিল ফোনে.. যে নিঝুমের ভয়ই লাগল। অরণ্য কী বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছ নাকি? কিন্তু ডাক্তারের সামনে তো বেশ স্পষ্ট করেই বলল যে, বেবিকে ওরা রাখবে। তাহলে? নিঝুমের হঠাত খুব হাত পা কাঁপতে লাগল, ওর সিক্সথ সেন্স বলছে সামনে খারাপ কিছু একটা হবে। মনটা কেমন যেন এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠল।
"নিঝুম, ভিতরে এসো। আম্মুর সাথে একটু দেখা করে যাও।"
কথাটা বলেই অরণ্য গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। নিঝুমের একটুও যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, কিন্তু এখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, না
বলার কোনো রাস্তা ওর নেই। মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই অরণ্যর পিছু পিছু শাশুড়ির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও।
আসমা এসে নিঝুমের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গেলেন। মেয়েটার চেহারা এমন হয়ে আছে কেন?
"নিঝুম... মামনি কি হয়েছে তোর? এরকম দেখাচ্ছে কেন? তুই কাঁদছিলি নাকি?"
শাশুড়ির কথায় ভেতরে ভেতরে একটু ঘাবড়ে গেল নিঝুম। এখন মামনিকে ও কী জবাব দিবে?
নিঝুম কী বলবে বুঝে উঠার আগেই অয়ন এসে ওকে ঝামেলার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।
"ঝুমঝুমি একটু এদিকে এসো তো, আমি তোমাকে একটা জরুরি জিনিস দেখাই। আসলে একটা ব্যাপারে তোমার কাছে সাহায্য দরকার আমার.. প্লিজ হেল্প মি।"
নিঝুম অয়নের পিছে পিছে ওর ঘরের দিকে চলল । আসার সময় অরণ্য, ওর শাশুড়িকে একপাশে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে কী কী বলছে মনে হলো। আচ্ছা ওরা সত্যি সত্যি বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছে নাতো?
"এটা দেখতো ঝুমঝুমি," অয়ন নিঝুমের সামনে সুন্দর রুবির একটা সেট বের করল। " কেমন এটা?"
"এটা কার? " নিঝুমের মনে হচ্ছে এটা অনা নামের সেই মেয়েটার জন্য কিনেছে অয়ন। তারপরও জিজ্ঞেস করল, আন্দাজে কিছু বলা ঠিক না।
"ঝুমঝুমি এটা না একটা সিক্রেট আর এই বিষয়ে আমার না... তোমার কাছে হেল্প চাই।"
"আমার হেল্প?"
"হুমম.. তুমিই খুব সহজে আম্মু আর ভাইয়াকে এ ব্যাপারে ম্যানেজ করতে পারবে। "
"কোন ব্যাপারে?"
"ঝুমঝুমি আমি একটা মেয়েকে খুব ভালবাসি। ওর নাম অহনা আফরোজ। আমি শর্ট করে অনা বলি। আমার বিশ্বাস ওর সাথে কথা বললে তোমারও খুব ভালো লাগবে ওকে।"
" আচ্ছা " নিঝুমের রবোটের মতো মাথা দোলাল। অয়নের কথা আসলে ওর মনোযোগ কাড়তে পারছেনা.. সমস্ত মন জুড়ে অরণ্যর বিরক্ত মুখটা খেলে বেড়াচ্ছে।
"অনার সাথে আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল এই ব্যাংকের জবের মাধ্যমেই। অনাও ইন্টারভিউ দিয়েছিল আমার সাথে একই ব্যাংকে কিন্তু আমাদের এখানে ওর জবটা হয়নি, তাই এখন অন্য একটা ব্যাংকে ঢুকেছে। তুমি প্লিজ আমাকে একটু হেল্প করবে ঝুমঝুমি অনার ব্যাপারে.. তুমি বললেই আম্মু আর ভাইয়া ওকে মেনে নিবে।"
অরণ্য মেনে নিবে? কী যেন? তবুও আনমনে মাথা দুলাল নিঝুম, "ঠিক আছে।"
"ওহ থ্যাংকস, ইউ আর এ সুইট হার্ট। আচ্ছা ওর সাথে তোমার একদিন পরিচয় করিয়ে দিব, কেমন? "
"আচ্ছা। "
"ওয়েট এক সেকেন্ড," নিজের মোবাইল ওপেন করে বেশ সুন্দরী এক মেয়ের ছবি বের করল অয়ন। মেয়েটা আসলেই অসম্ভব সুন্দরী, হাসিতে আভিজাত্য ফুটে উঠেছে.. চোখ দুটোয় নীলচে আভা ।
"ওর চোখদুটো অমন বিদেশিদের মতো নীল কেন? " নিঝুম জিজ্ঞেস না করে পারল না।
"ঝুমঝুমি, অনার আম্মু ইংল্যান্ডের আর বাবা বাংলাদেশি। অনার যখন আট বছর বয়স তখন ওনাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তারপর থেকে ও বাবার সাথেই আছে। "
"ওহ... "
নিঝুমের এই মুহূর্তে আসলে কোনোকিছুতেই মন বসছে না,মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে আছে। অরণ্য কী এমন আলাপ করছিল ফিসফিস করে?
"আমি এখন ও ঘরে একটু যাই, আম্মুকে ফোন করে জানাতে হবে যে আমি এখানে।"
নিঝুম দ্রুত এ বাসা থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল,ওর কাছে এবাড়ির বাতাসও এখন কেমন যেন লাগছে।
"ও শিওর," অয়ন হাসল। " তাহলে কি ধরে নিব হেল্পটা আমি পাচ্ছি।"
নিঝুম হাসল," নিশ্চই।"
.......................
নিঝুম ডাইনিং রুমের কাছাকাছি এসে দেখল, অরণ্য ডাইনিং রুমের দরজায় পিঠ রেখে বুকের উপর আড়াআড়িভাবে নিজের হাতদুটো বেঁধে রেখেছে। মুখটা এখনও আগের মতোই চিন্তাক্লিষ্ট আর গম্ভীর।
নিঝুমকে এগিয়ে যেতে দেখে ও নিজেই ওকে জিজ্ঞেস করল, " কথা শেষ হলো দেবরের সাথে?"
"হুমম.."
" তাহলে এদিকে এসো," অরণ্য কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমের দিকে নিয়ে চলল নিঝুমকে। নিঝুমের শরীর মন দুটোর কোনোটাই আজ চলছে না। কালকের মতো আজও কী বৃষ্টি হবে? আজও কী অরণ্যর সাথে ওভাবে রিকশায় বাড়ি যেতে পারবে ও ? আজও কি হিমালয়ের বিশালতা দিয়ে ওকে কাছে টানবে প্রিয় পুরুষটা, নাকি বিরক্তিতে ওকে দূরে ঠেলে দিবে?
নিঝুমের থেকে থেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। ওকি তবে ভুল একটা মানুষকে এতোটা সম্মান আর ভালোবাসা দিল? অরণ্য কী তবে ওই বিশেষ চেহারার পিছে নিজের সত্যিকারের চেহারাটাকে লুকিয়ে রেখেছিল এতোদিন ?
"আরে ঝুমঝুমি... কী ব্যাপার? তোমার কি খারাপ লাগছে? বসবে? " অয়ন পাশ থেকে জানতে চাইল।
"না.. না আমি অরণ্যর পিছনে পিছনে আসলাম... আসলে ওই ডেকেছিল।"
"হ্যাঁ সেইতো, তুমি আসছনা দেখেই তো ভাইয়া বলল তোমাকে ওঘরে নিয়ে যেতে।"
ওরা সবাই মিলে কোনো একটা ষড়যন্ত্র করছে নাতো? নিঝুম ভয়ার্ত চোখে দেখল অয়নকে। কিন্তু অয়নের মুখতো খুব স্বাভাবিক।
অরণ্যর ঘরের দরজায় পা দিয়ে আরেক দফা কেঁপে উঠলো নিঝুম। পুরো ঘরটা একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার, আর মধ্যেখানে উঁচু কিছু একটার চারপাশে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে গোল হয়ে। নিঝুমকে ঢুকতে দেখে ওখানেই থামতে বলল ওকে অরণ্য।
নিঝুমের একদম কাছে এসে হাতের মোমবাতিটা জ্বালাল অরণ্য। মোমবাতির মৃদু আলোয় গা একদম ছমছম করে উঠল নিঝুমের। আশে পাশে দাঁড়ান মানুষগুলোর ছায়াও কেমন ভুতুড়ে মনে হতে লাগল।
ভয়ে পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে নিঝুমের, কপাল দিয়ে দরদর করে ঘাম পড়ছে, ওর বাচ্চাটাকে বোধহয় এরা বাঁচতে দিবে না, বৈধ হয়েই বা কী লাভ হলো ওর? এই মুহূর্তে অরণ্যর হাত ছাড়িয়ে কোথাও দৌড়ে পালাতে পারলে বোধহয় বেঁচে যেত বাচ্চাটা। কিন্তু আশেপাশের ছায়াগুলো ক্রমশ ওকে ঘিরে ধরছে... নিঝুমের মনে হলো ও জ্ঞান হারাচ্ছে।
..............................................
প্রচন্ড কানফাটা তালিতে ঘোর কাটল নিঝুমের। চোখটা খুলতেই আলোয় আলোয় ধাঁধিয়ে গেল চারদিকটা। কে যেন প্রচন্ড মমতা নিয়ে আকড়ে আছে ওকে, পাশে তাকিয়ে ভীষন অবাক হলো নিঝুম, "আম্মু? "
"হ্যারে নিঝু... তুই এতো খারাপ মেয়ে, আমার জানা ছিলনা। আমি তোর এতো পর হয়ে গেছি এখন? আর এই দুদিনের চেনাজানা দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলেটাই এখন তোর আপন হয়ে গেছে? আসমা আপা ফোন না দিলে তো সত্যি সত্যি অনেক কিছু জানতে পারতাম না," রুমানার সুরে আক্ষেপ ঝড়ে পড়ছে।
"আম্মু সরি, আমি... ভয়ে তোমাদের কিছু বলতে পারিনি," নিঝুম কেঁদে গাল ভাসাল।
"আম্মু প্লিজ আপিকে মাফ করে দাও," আশুও অপরাধীর সুরে বলে উঠল।
"তুমি তো এরকমই বলবে, তোমারও কঠিন বিচার করব আমি।"
রুমানার কথায় চুপসে গেল দুই বোনই।
"রুমানা আজ আর ওদের বকোনা... দোষ শুধু ওদের না, আমারও হয়েছে। আমিও তোমাকে বলিনি। মনে করেছি, বিয়ের অনুষ্ঠানের পর পরই তোমাকে বলে দিব। কিন্তু ঘটনা এভাবে প্যাঁচ খেয়ে যাবে বুঝিনি। আমরা সবাই অপরাধী তোমার কাছে, আমাদের ক্ষমা করে দাও বোন। মনে অভিমান রেখ না। তারচেয়ে আমাদের স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে, আমরা একটা ছোট্ট ফুলকে পাবো, তার জন্য নতুন বাবা, মাকে বরং অভিনন্দন জানাই। "
আসমার কথায় এতক্ষণে যেন স্বাভাবিক হয়ে আসল পরিবেশটা। চোখ গুলো বড় বড় হয়ে গেল নিঝুমের। অসংখ্য বেলুন দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে ঘরটাকে। মাঝে একটা টেবিল রাখা, তাতে মিডিয়াম সাইজের একটা কেক আর টেবিলের ওপাশে পুরো ঘটনার নায়ক অপরাধীর মতো ঘাড় গোঁজা করে দাঁড়িয়ে আছে। রুমানার কথাগুলো খুব লেগেছে বোঝা যাচ্ছে অরণ্যর মুখ দেখে কিন্তু নিঝুমই বা কী করতে পারে এ ব্যাপারে।
"আন্টি প্লিজ দুঃখটা ভুলে যান, দেখুন আমার ভাই কেমন অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের আর বকবেন না। ওই পরিস্থিতিতে ওরা যা ভাল মনে করেছে সেটাই করেছে। আর পরে ভয়ে আপনাদের কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু কোনোকিছু অস্বীকার তো করছেনা ওরা... প্লিজ ওদের মাফ করে দিন।"
অয়নের কথায় রুমানা আর কথা বাড়াল না, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা কী করে সামাল দিবেন সেটাই ভাবলেন। নিঝুমের ফুপুরা এ খবর শুনলে রুমানাকে একদম খেয়ে ফেলবে... শুধু বিয়েতো নয়, বাচ্চার মাও হয়ে গেছে নিঝুম। ননদদের কথার ভয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল রুমানা।
শাহেদ আর রায়হান সাহেব এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। রুমানাকে থামতে দেখে রায়হান সাহবে নিজেই নিঝুমের কাছে এগিয়ে এলেন।
"আর বকাবকি মন খারাপের দরকার নেই। আর দশ বারো দিনও সময় নেই, আমরা আমাদের মেয়েকে নিয়ে আসবো। বেয়াইন যদি আর একবারও আমার মাকে বকেন তাহলে আমার বাড়ির বউ আমি আজকেই রেখে দিব কিন্তু। "
রায়হান সাহেবের কথায় রুমানা - শাহেদ দম্পত্তিসহ সবার মুখেই একটু একটু করে হাসি ফুটলো এবার, সেই সাথে একটু স্বস্তিও।
"আরে ঝুমঝুমি দেখি হাসতেও জানে... আমি তো মনে করেছি, বিনি পয়সায় এই মেয়ে খালি কাঁদতে জানে। ভাস্তি হলে ঠিক কাঁদুনি বুড়ি হবে একটা... দেখে নিও মা। "
অয়নের কথায় এবার দুষ্টু মিষ্টি হাসির একটা তরঙ্গ বয়ে গেল পুরো ঘরটা জুড়ে। এরপর আস্তে আস্তে আবার বিয়ে বাড়ির আমেজে ফিরে এলো ওরা, হাসি ঠাট্টায় বাকিটা সময়টা পার করল দুটো পরিবার ।
...........................................................
চোখে মুখে পানি দিয়ে অরণ্যর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল নিঝুম,আজ এত কিছু হলো একসাথে, তারপরও কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে। পরিবারের কাছ থেকে কোন কিছু লুকিয়ে রাখা যে কী কষ্টের আগে জানা ছিলনা নিঝুমের, বিশেষ করে বাবার কাছ থেকে আর এজন্যই নিজেকে খুব বেশি করে অপরাধী মনে হচ্ছিল ওর।
"খুব বেশি মন খারাপ? খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমার ঝুমকে?"
গমগমে এই কন্ঠস্বরের সাথে জোরেসোরে উষ্ণ পানির একটা ঢল আসছে বুঝতে পেরে আকাশের দিকে মুখ ঘুরাল নিঝুম।
অরণ্যর কথাগুলো এখনো দিব্যি কানে বাজছে ওর। তবে যাই হোক, ওর বাবা- মাকে ডেকে বাচ্চার পিতৃত্ব যে সে স্বীকার করেছে এই ঢেড়। আর ওর মাও সুযোগ পেয়ে অরণ্য আর ওর পরিবারকে কম কথা শোনায়নি ভদ্র ভাষায়। সেই সুবাদে অরণ্য ওকে দু' চারটে কথা শোনালে সেটুকু ওকে হজম করতে হবে বৈকি... একদম পুরো দোষটাই অরণ্যর কাঁধে চাপালে তো হবে না।
"আমার বউটা আজ অনেক দুঃখ পেয়েছে, আমি জানি। কিন্তু আজকে একটু কান্না কান্না মুখটা দেখার লোভ হচ্ছিল, " পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে নিঝুমের কানের পিছনে মুখ লুকাল অরণ্য... খুব সাবধানে নিঝুমের তলপেটে নিজের হাতটা রাখল।
" সরি ঝুম।"
অরণ্যর আচরনে নিঝুম কাঁদতে ভুলে গেল তবে ঠোঁট ফুলিয়ে অভিযোগ করতে ভুলল না।
" কিন্তু তুমিতো গাড়িতে বসে আমাকে কতকিছু বললে, কী পরিমান আপসেট ছিলে," নিঝুমের গলাটা এবার ধরে এলো।
"আর তুমি তাই বিশ্বাস করলে? আমাকে তোমার এত খারাপ মনে হয়? তুমি জানো আমার ওই কথা শুনে কী আনন্দ হচ্ছিল? "
অরণ্যর কথায় এবার একটু হকচকিয়ে গেল নিঝুম। অরণ্যর আনন্দ হচ্ছিল!
আসলে তো ওরও খুব আনন্দ হচ্ছিল ওই কথা শুনে। মা হবে শুনলে কী কোন মেয়ের দুঃখ হয়? জানেনা নিঝুম.. তবে অরণ্যর কথায় তখন দুঃখ আর ভয় দুটোই হচ্ছিল ওর।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দুঃখ আর ভয়ের বদলে, রাগ আর অভিমান এসে ভর করছে ওর উপর। ওকে নিয়ে অতোটা সময় তাহলে অভিনয় করা হয়েছে... আর কক্ষনো কথা বলবে না ও অরণ্যর সাথে।
.
.
.
কিন্তু ওই যে স্বভাব... খুব বেশি সময় রাগ করে থাকার অভ্যাস তো নিঝুমের নেই, আর অরণ্যর সামনে তো সেটা একেবারেই না। তাই ঠিকই গলে গিয়ে অরন্যর বুকের মাঝখানে মুখ লুকাল ও।
"অ্যাই ভাইয়া, তোরা এখানে না দাঁড়িয়ে বরঞ্চ নিজের রুমে যা। এখান থেকে তোদের এই মান - অভিমান শুনতে শুনতে আমার কান পঁচে গেল। "
অয়নের টিটকিরিতে টিকতে না পেরে কানচেপে অরণ্যর ঘরে আসল ওরা।
"আচ্ছা অরণ্য তুমি সত্যি রাগ হবেনা, যখন আমি পাহাড়ের সমান পেট নিয়ে তোমার সামনে ঘুরে বেড়াবো? তখন তো আমাকে তোমার আর ভাল লাগবে না। "
"পাগল..... তুমি এখনো ওই কথা ধরে বসে আছো? আমি তো দুষ্টুমি করছিলাম, তোমাকে ক্ষেপাবো বলে। ওই পাহাড়টাতো আমার পৃথিবী ঝুম, ওর ভিতরে একটা আমি দিন দিন বড়ো হবো, হাসবো, খেলবো। ওটা আমার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান, ওকে আমি কী করে ঘৃনা করব?"
"তাহলে, কথা দাও আর কখনো এমন করে আমার সাথে অভিনয় করবে না। "
"চেষ্টা করব।"
"না চেষ্টা নয়, কথা দাও।"
"কথা দিলে যদি রাখতে না পারি। তাই চেষ্টা করব, তোমার সাথে আর অভিনয় না করার। এখন ঝটপট একটু আদর দাওতো," বলেই নিজের কপালটা বাড়িয়ে দিল অরণ্য নিঝুমের দিকে।
খুব যত্ন করে অরণ্যর কপালে একটা ভালোবাসার টিপ আঁকল নিঝুম। মানুষের অনুভূতি গুলো কী খুব দ্রুত পাল্টাতে পারে। ও কী করে অরণ্যকে ভুল বুঝল,ওর নিজের মাথাতেই সেটা এখন আসছেনা। কী প্রগাঢ় মায়ায় ছেয়ে আছে ওর গোটা পৃথিবীটা.. এই তো আস্ত একটা পৃথিবী ওকে জড়িয়ে ধরে আছে আর ও কিনা বোকার মতো... নিজের বোকামিতেই হাসল নিঝুম।
"ঝুম.. জানো, আজ না আমি খুব খুশি হয়েছি যখন তুমি গাড়িতে বসে কাঁদছিলে। তুমি এক সেকেন্ডে কেমন করে আমার বাবুর মা হয়ে গেলে ঝুম, তুমি তো একবারও ভাবলে না যে, তুমি এখন থেকে আর অন্যদের মতো যা ইচ্ছা করতে পারবেনা। সবচেয়ে বড় কথা তুমি একবারও বললে না যে, মা হওয়া যদি অপরাধ হয়, তাহলে ওর জন্য সব চেয়ে বড় দোষী হলাম আমি। তুমি... তুমি না একটা পাগল আছো সত্যি।"
"আমি না জানো ভাবছিলাম যে তুমি আমাদের বেবিটাকে রাখতে দিবে না, অ্যাবরশন করিয়ে ফেলবে। "
" তারমানে আমি খুব ভালো অভিনেতা কী বলো?" নিঝুমের পেটটায় আবার হাত রাখল অরণ্য। কী আজব, ওর অংশ আরেকটা শরীরে বড়ো হবে, কেমন আজব না?
"কোনো সন্দেহ নাই কিন্তু আর কোনোদিন এই রকম অভিনয় করলে আমি তোমাকে কোনোদিনও মাফ করব না। "
"এই কান ধরলাম," অরণ্য সত্যি করে নিজের দুইকান টেনে ধরল ক্লাসের দুষ্টু ছেলেদের মতো।
অরণ্যকে এমন করতে দেখে অনেক কষ্টে নিজের হাসি চাপাল নিঝুম... পাগল কোথাকার।
নিঝুম যখন বাসায় ফিরে যাবার জন্য
বাবা-মায়ের সাথে গাড়িতে উঠলো, অরণ্যর চোখ দুটো তখনও নিঝুমের পিছু ছাড়ছিল না।
আজ ওদের জীবনের একদম অন্যরকম একটা অধ্যায় শুরু হলো, লুকোচুরির দিন বুঝি ফুরিয়ে এলো.. এক চিলতে হাসি একটু একটু করে একই সুতোর টানে দুজনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে, এই সুতো ভালোবাসার, ভালোলাগার।
.
.
.
"অরণ্যদা ব্যাস্ত?"
"নাতো পার্থ কেন? "
"না অনেক বার কল দিয়েছি ধরছিলেন না।"
"আসলে আজ শ্বশুর, শাশুড়ি, বউ, শালী সব একসাথে এসেছিল, তাই ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম। কোনো বিশেষ খবর? "
" হ্যাঁ... বিয়ের দিনের জন্য যে বিউটি পার্লারে বুকিং দেয় আছে, ওটা চেঞ্জ করান। অন্য কোনটা ঠিক করতে বলেন বা আপনি ঠিক করেন, ওখানে রাইসুলের সুপারি দেওয়া আছে।"
পার্থর কথায় সতর্ক হলো অরণ্য, এক্ষুনি নিঝুমকে ফোন করতে হবে।
চলবে.......
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top