২১

"জিজু... আমরা এতদূরে আসলাম আর একবার একটু কুয়াকাটার বিচ ঘুরে দেখবো না? আমার বান্ধবী ঐশী ওর ফুফুদের সাথে কুয়াকাটা ঘুরতে গিয়েছিল। ও বলেছিল এই সমুদ্র সৈকতটাও নাকি অনেক সুন্দর। জিজু প্লিজ আমরা একদিনের জন্য কি ওখানে যেতে পারিনা? এতদূরে বারবার তো আমাদের আসা হবে না, "আশু খুব করুন মুখে অরণ্যর কাছে আবদার করতে লাগল।

"কিন্তু আশু ওখানে যেতে হলে তো অন্তত দুদিনের একটা প্রিপারেশন লাগে। আমার হাতে তো একদম সময় নেই," অরণ্য অসহায় ভঙ্গিতে বলে উঠে। ছোট মানুষ শখ করছে, না বলাও মুশকিল।

"জিজু প্লিজ," আশু কন্ঠে কান্নার আভাস।

অরণ্য এবার সত্যি চিন্তায় পড়ে গেল। আশু ওর একমাত্র শালী, তার উপর আবার বয়সে ঝুমের ছোট। এছাড়া আশু ওদের প্রচুর সাহায্য করেছে বিভিন্ন সময়। সেদিন তো ধরা ধরা খেতে খেতে বাঁচিয়ে দিয়েছে অরণ্যকে। এমন শুভাকাঙ্ক্ষীর  অনুরোধ ফেলে দেয়া কি ঠিক হবে? কিন্তু অরণ্যর হাতে ছুটিও তো নাই, মহা জ্বালায় পড়া গেল। এদিকে বাবা আর শ্বশুরও এসে হাজির হয়েছেন। পরশু সবার একসাথে ঢাকা ফিরে যাবার কথা। অয়ন তো কালকেই চলে যাবে সকালে। এখন এই অবস্থায় কিভাবে কি করবে ও? কুয়াকাটা যাওয়া মানে কাল সারাদিন,পরশু ব্যাক আসলেও বরিশাল আসতেই আধাবেলা আর দুপুরে ব্যাক করলে তো একদম রাত হয়ে যাবে। তার পরের দিন ওরা যদি প্লেনেও ব্যাক করে তাও দুপুর হয়ে যাবে। এরকম হলে মির্জা স্যার ওকে কত আদরের সাথে যে অভ্যর্থনা জানাবেন এখনই বুঝতে পারছে  অরণ্য।

"আমার বরটা কি খুব ব্যাস্ত? " নিঝুম কফির মগটা ধরিয়ে দিল অরণ্যর হাতে। সাদা রঙের নেসক্যাফে লিখা লাল মগটা থেকে গরম ধোয়া উঠতে দেখে অদ্ভুত এক ধরনের আনন্দ হলো অরণ্যর। না ঠিক কফি দেখে নয়, কিন্তু নিঝুমের কফির মগ এনে ওর হাতে দেওয়াটা, এই যত্নটুকু খুব ভালো লাগল অরণ্যর.. এই চাওয়া পাওয়ার হিসেব রাখতে নেই, এই অনুভূতি গুলো অমূল্য।

"তোমার কি খুব কফির তেষ্টা পেয়েছিল? " নিঝুম অরণ্যর গায়ে হেলান দিয়ে বসল। অরণ্য ছাদের কার্নিশে দুই পা ঝুলিয়ে বসেছিল,নিঝুম ওর পাশে বসতেই সতর্ক হয়ে উঠল।

"ঝুম এখানে বসো না। চলো ওই দোলনায় গিয়ে বসি।"

"কেন? "

"জায়গাটা রিস্কি পাখি।"

"তাহলে তুমি বসেছিলে কেন? নাকি ছাদের দেয়াল গুলোও তোমাকে ভয় পায়। "

নিঝুমের কথায় হো হো করে হেসে উঠল অরণ্য।

"পুলিশে ছুলে ছত্রিশ ঘা - তো পুলিশের ছায়া দেখলেও মানুষ আৎকে উঠে। মনে করে মানুষ নয়.. নিশ্চই কোনো বিপদ এসেছে। "

"হি হি... কিন্তু আমি তো ভয় পাই না। "

"তুমি আর ভয় পাবে কি করে? তোমাকে দেখলে তো পুলিশ অফিসারও উল্টো ভয়ে থাকে," অরণ্য হাসল।

"ঘোড়ার ডিমের পুলিশ অফিসার, আমাকে তো বাঁচাতেই পারলা না," কথাটা বলেই সাথে সাথে অরণ্যর মুখের দিকে তাকাল নিঝুম। কথাটা কানে যেতেই অরণ্যর মুখ শক্ত হয়ে গেছে। গরম কফির মগটা এত জোরে চেপে ধরলো ও যে হাতটা পুরো লাল হয়ে গেল।

নিঝুম মনে মনে নিজেকে  কষে একটা থাপ্পর লাগাল। সব সময় ওর এরকম হয়, মুখ ফসকে এমন সব কথা বলে ফেলে ও যে পরে নিজেরই লজ্জা পেতে হয়।

তাড়াতাড়ি অরণ্যর হাতের উপর হাত রাখল নিঝুম।

"সরি প্লিজ, আমি এমনি কথার তালে তালে বলে ফেলেছি। কিছু মিন করে বলিনি। রাগ করোনা প্লিজ। "

নিঝুমের টেনশন দেখে সহজ হওয়ার চেষ্টা করল অরণ্য। না সত্যিই তো... নিঝুমের কি দোষ? ওতো যা সত্যি তাই বলেছে। কিন্তু সত্যি কথার ঝাঁঝ বেশি আর গায়েও লাগে বেশি। অরণ্য নিজে নিজেই মাথা নাড়ল, নিজেকেই বলল... নিজের  দুর্বলতার ভার অন্যের উপরে চাপান উচিত নয়।

"না আমি ঠিক আছি, তুমি এত চিন্তা করোনা। "

অরন্য নিঝুমের হাতটা নিয়ে হাতের উল্টোপিঠে আস্তে করে একটা চুমো খেল।

" আই অ্যাম সরি। আমি আমার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি, তোমাকে রক্ষা করতে পারিনি, "কথাটা বলতে বলতে অরণ্যর গলাটা ধরে এল।

নিঝুমের খুব কাঁদতে ইচ্ছে হলো। কেন খালি খালি এই বাজে কথাগুলো ওর মুখ দিয়ে বের হলো। ও তো নিজেই সব ঘটনার সাক্ষী,তারপরও কেন?  অরণ্যকে ও একদমই কষ্ট দিতে চায়নি, তারপরও। হঠাৎ ফুঁপিয়ে কান্না এল নিঝুমের।

নিঝুমের কান্না শুনে তাড়াতাড়ি কফির মগটা নামিয়ে রাখল অরণ্য। " ঝুম কি হলো? এই পাগল।আরে....।"

কিন্তু কে শোনে কার কথা। নিঝুম কান্নার দমকে তখন রীতিমতো কাঁপছে।

"আমি ভুলে বলে ফেলেছি, প্লিজ। তুমি মাইন্ড করোনা আর কখনো এই ভুল হবে না। "

অরণ্য থামাতে না পেরে নিঝুমকে বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিল।

" এই পাগলী আমি কি তোমার কথায় মন খারাপ করেছি নাকি? আমার মন খারাপটা অন্য কারনে। আমার দুঃখ আমি তোমাকে ওই বিপদ থেকে বাঁচাতে কেন পারলাম না। আমার ক্যালকুলেশন, আমার দক্ষতা নিয়ে আমার নিজের মনেই হাজারটা প্রশ্ন তৈরী হচ্ছে। তার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত এই মন খারাপ আমার যাবে না। "

অরণ্যর কথায় নিঝুম কান্না বন্ধ করলেও মাথা নিচু করে রইল। অরণ্য যা বলল সেটা যদি সত্যিও হয় তারপরও নিজের দোষটা নিঝুমের চোখে ফুটছে। কি দরকার ছিল ওর? অরণ্য ওকে ফেলে তো যায়নি, বিপদে সে নিজেও ছিল। ছি.. নিঝুম একদম স্বার্থপরের মতো আচরন করে ফেলেছে। খুব খুব লজ্জা লাগছে ওর আর তারচেয়ে বেশি লাগছে কষ্ট।

"দেখি মুখটা তোল," অরণ্য প্রায় জোর করে নিঝুমের মুখটা উঁচু করে তুলে ধরল।

বড়ো বড়ো দুটো দিঘী ভেসে উঠল যেন অরণ্যর চোখের সামনে। আর তাতে হাজার হাজার লাল শাপলা ফুটে আছে। কেঁদে কেটে গোলাপি হয়ে গেছে নিঝুমের চোখ দুটো। এটুকুতেই ফুলে উঠেছে চারদিকটা। অরণ্যর মনে হলো এই তাকিয়ে থাকা ওর কোনোদিনও শেষ হবে না।

ঝুম হচ্ছে ওর কাছে বেহায়ার স্বর্গের মতো। আর এই বেহায়া হতে অরণ্যর একটুও গায়ে বাঁধে না। নিঝুম বুঝে ওঠার আগেই ওর কপালের উপর ঠোঁট জোড়া চেপে ধরে অরণ্য। কিন্তু এই আদরে  নিঝুমের কান্নার বেগ বাড়ল বই কমল না। অরণ্যর    পাগল পাগল লাগে ঝুমের লালচে গোলাপি মুখটা দেখে। বুকের মধ্যে আচমকাই সব অচেনা অনুভূতি গুলো ধুমকেতুর মতো উদয় হয়। এই চিন চিন করে ওঠা ব্যাথার নাম কি করে ভালোবাসা হয় এটা মাঝে মাঝে বড্ড ভাবায় অরণ্যকে।

মেয়েটা কিছু হলেই হাউমাউ করে কাঁদে কেন? ওর কান্নাটা একদমই সহ্য করতে পারেনা অরণ্য। পাগলের মতো নিঝুমের মুখটাকে আকড়ে ধরে এলোপাতাড়ি আদর করে অরণ্য। নিঝুমের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই তাকে শুষে নেয় নিজের রুক্ষতা দিয়ে।

নিঝুমের কান্নার শব্দ অরণ্যকে এত উৎলা কেন করে? মনে হয় তীব্র এক শূন্যতা তৈরী হয়েছে আশেপাশে। আবহাওয়া বৈরী রূপ ধারন করে নিমেষেই, না নিঝুমকে কাঁদতে দেবে না অরণ্য.. কিছুতেই না ।

কতটা সময় কেটে গেল হিসেবে বিহীন। নিঝুম অরণ্যর গলা জড়িয়ে পড়ে আছে নেশাগ্রস্থের মতো। অরণ্যর গেঞ্জির কলারটা মুঠিতে খামচে ধরে আছে সে, যেন ছাড়লেই হারিয়ে যাবে অরণ্য।

"বউ..."

"উমম..."

"বলছি বড়ো বিপদে পড়লাম যে "

"কি? "

"আশু এসে আবদার করেছে কুয়াকাটা ঘুরবে, কি করি বলতো? আমার যে ছুটি শেষ। সময় মতো অফিসে জয়েন না করলে পরে বিয়ের সময় একটু বেশি ছুটি নিব সে উপায় থাকবে না।"

নিঝুমের চোখ দুটো এবার হেসে উঠল। অরণ্যকে বলা যাবেনা, বায়নাটা মোটেই আশুর নয়... আবদারটা ওর। কিন্তু নিঝুম বললেই অরণ্য ছুটি নেই বলে বাহানা দিবে। কিন্তু আশুকে না বলা অরণ্যর জন্য একটু টাফ। আফটার অল আশু ওর অনেক হেল্প করে।

"ঝু..ম।"

"কি?"

"কি খালি হাসছ মিটমিট করে, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। "

"বারে উত্তর কি আমার কাছে আছে নাকি? আর তুমি না পারলে কি করার আছে, যাবে না কুয়াকাটা। দুনিয়ার সব কিছু দেখতে হবে এমন কোন কথা আছে নাকি কোথাও।"

নিঝুমের বলার ঢঙে যা বোঝার বুঝে গেছে অরণ্য। নিঝুমও এখন বিরোধী দলের লোক। কার  কোথায় যাবে ও?

"তারমানে তুমিও যেতে চাচ্ছো? "

"আশ্চর্য আমি আবার কি বললাম। "

"কিছু বলতে হবে না, তোমার আচরন দেখেই বোঝা হয়ে গেছে।"

অরণ্যর কথার প্রতিবাদ করল না নিঝুম। যতই তর্ক করুক ব্যাটার মাথা হেভি শার্প, ঠিক ওর মনোভাব ধরে ফেলেছে।

"আমরা কি তাহলে কুয়াকাটা যাবো?" নিঝুম আহ্লাদী স্বরে জানতে চাইল।

"হ্যাঁ নিশ্চই। আমার ফ্রেন্ডের ছোট ভাই আবরার আছে পাথরঘাটায় পোস্টিং। ওকে বলে হোটেল কনফার্ম করাচ্ছি আর ওরা গাড়ি পাঠাতে পারবে কিনা দেখছি। তোমরা সকাল আটটার মধ্যে রেডী হয়ে নিলে বিকেলের মধ্যে পৌছে যাবে শিওর, যদি রাস্তায় কোনোরকম গ্যাঞ্জাম না হয়। "

"তোমরা তোমরা করছ কেন?"

"তাহলে কি বলব? "

"তুমি এমন ভাবে বলছ যেন তুমি আমাদের সাথে যাচ্ছ না? "

"আমি সত্যি ই যাচ্ছি না ঝুম। আমাকে যে কোন ভাবে পরশুদিন অফিসে জয়েন করতে হবে। সেটা রাত হলেও।"

অরণ্যর কথায় এত্ত মেজাজ গরম হলো নিঝুমের যে মনে হলো ব্যাটার মাথাটা একদম ক্রিকেটের ব্যাট দিয়ে ফাটায়। বিয়ে হতে পারলনা আর ব্যাটার রোমান্স করার সব শখ শেষ। এই জন্য মানুষ বিয়ে করে না, বুঝতে পারছে ও। গার্ল ফ্রেন্ডের পিছনে দেদারসে টাকা উড়াও ক্ষতি নাই কিন্তু বউকে একটু সময় দিতেও এদের খুব কষ্ট.. কিপটুস কোথাকার।

"তাহলে আমরাও আর যাচ্ছি না," নিঝুম সাফ সাফ বলল।

"আরে তা কেন? আশু এত শখ করে বলেছে যখন ঘুরে আসো। আর আমি না থাকলেও বাবা আছে, তোমার আব্বুও তো আছে। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কোনো সমস্যা হবে না ইনশাল্লাহ।"

নিঝুমের এবার খুব রাগ হলো। এই লোক কি পাগল  নাকি? যাবি না তো ঠিক আছে, কেউ যাবে না। নিজে যাবে না আবার ওকে ফোর্স করে কোন সাহসে!

অরণ্য নিঝুমের সামনে বসেই সবার সাথে যোগাযোগ করে সব ফাইনাল করে দিল। হোটেল, গাড়ি সব। কাল সকাল আটটায় রওনা হলে নিঝুমরা দুপুরের মধ্যে কুয়াকাটায় পৌছে যাবে আরাম করে।

নিঝুম চুপ করে সব শুনল৷ কিচ্ছু বলল না। ঘরে এসে নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে নিল। অরণ্য ঢাকায় ফিরবে তো... ঠিক আছে, তাই সই।

পরেরদিন সকালে সবাই সময় মতো তৈরি হয়ে গেল। আসমা বেগম দুই ছেলের কেউ যাচ্ছে না দেখে রাগ হচ্ছিলেন কিন্তু পরে রায়হান সাহেবের কথায় থেমে গেলেন। এতদিন অফিস থেকে ছুটি পাওয়া আসলেই একটা বিরাট সমস্যা। কিন্তু দুটো ছেলের একটাও থাকবে না, মনটা বেশ ভার হলো আসমার। বাচ্চারা যাতে আনন্দ করতে পারে  সেজন্যই না এত কিছুর আয়োজন করলেন তিনি আর সেই ওরাই থাকছেনা।

গাড়িতে নিঝুমদের রওনা করিয়ে দিয়েই অরণ্য আর অয়ন রওনা দেবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। অরণ্য একটু কনফিউজড। কালকে একবার দুইবার বলেই ঝুম ওকে আর বিরক্ত করেনি ৷ অরণ্য এতে একদিকে যেমন স্বস্তি পেয়েছে আবার মনটা একটু খারাপও হয়েছে। ও যাবে না তারপরও এত খুশি ঝুম। একটু মন খারাপ তো করা উচিত ছিল ও যেতে পারছেনা দেখে। কিন্তু অরণ্যর ঢাকা যাওয়াও খুব দরকার, না হলে ঝুমের সাথে থাকার চান্স ও মিস করত না। কিন্তু কাল পার্থ ম্যাসেজ করেছে 'ভাই কেমন আছেন?'

খুব সাধারন একটা কথা।

কিন্তু একই ম্যাসেজ চারবার। তারমানে ওর ঢাকায় যাওয়াটা জরুরি । এটা ওর আর পার্থর সাংকেতিক একটা কোড, এমনি হলে একবার করে। চারবার মানে রাইসুলের ব্যাপারে কোন তথ্য আছে। আর সেটা সামনা সামনি জানতে হবে। আর এই তথ্য যত দ্রুত ওর কাছে আসবে তত দ্রুত রাইসুলকে জেলে ভরা অরণ্যর জন্য সহজ হবে।

গাড়িতে সবাই উঠে বসলে দরজা টেনে বন্ধ করতে গিয়ে অরণ্য দেখে নিঝুম নেই। একটু আগেই তো ছিল এখানে... আশুর সাথে হাসছিল, মূহুর্তের মধ্যে কোথায় গেল?

"আশু... নিঝুম কোথায়?"

"জানিনা তো জিজু, মাত্রই তো ছিল।"

অরণ্য বিরক্ত মুখে নিঝুমকে ফোন দিল কিন্তু ফোনও নট রিচেবল আসছে।

"কি হল অরণ্য, নিঝু ধরছেনা? " রুমানা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। এই তো একটু আগে মেয়েটা ছিল এখানে। কোথায় গেল? ওয়াশরুমে যায়নি তো? কোথাও গেলে একটু বলে যেতে হয় সেটাও এই মেয়ে ভুলে যায়। কি করে যে নিজের সংসার করে খাবে এই মেয়ে?

"আমি দেখছি, হয়ত নানুর সাথে দেখা করতে গিয়েছে ।"

অরণ্য নীচ তলার সবগুলো ঘর ভাল করে খুঁজল,না নেই। বোধহয় উপরে গিয়েছে। কিছু ফেলে রেখে আসেনি তো যেটা আনতে গিয়েছে। তাই হবে শিওর। হয়তো মোবাইলটাই ফেলে রেখে চলে এসেছিল ম্যাডাম।

অয়নকে গেটের বাইরে দেখতে বলে অরণ্য দোতলায় চলে আসল নিঝুমকে খুঁজতে।  প্রতিটা ঘর এমনকি প্রতিটি বাথরুম পর্যন্ত ভাল করে খুঁজল ও কিন্তু নিঝুমের কোথাও কোনো নাম নিশানা খুঁজে পেল না।

ঘন্টাখানেক আগে পার্থর কাছ থেকে একটা মেসেজ এসেছে। ছয় ডটের। তারমানে খুবই জরুরি কিছু। হঠাত করে গলা শুকিয়ে আসল অরণ্যর। ঝুম কোথায় গেল? রাইসুল কিছু করল নাতো? দেশ ও দশের নিরাপত্তায় যারা থাকে তাদের পরিবারগুলো আবার সবচেয়ে বেশী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে সবসময়। ঝুম কোথায় কোথায় যেতে পারে ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করল অরণ্য।

*******************

"এসব কি? "

"কি? "

"আমি কিসের কথা বলছি তুমি খুব ভালো করে জান ঝুম। সবাই গাড়িতে উঠে বসে আছে আর তুমি ছাদে এসে দেলনায় বসে দোল খাচ্ছ কোন আক্কেলে। "

"সে কি গাড়ি এখনও ছেড়ে যায়নি? প্রায় বিশ মিনিট হয়ে গেছে, " নিঝুম খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল।

"হোয়াট? গাড়ি ছেড়ে যাবে মানে কি? তোমাকে রেখে গাড়ি চলে গেলে তুমি কি পায়ে হেটে যাবে অতদূর? সেল্ফ কনফিডেন্সে ভালো কিন্তু তাই বলে এতো না। "

"আমি মোটেই সেরকম ভাবছি না। "

"তা হলে?"

"তা হলে কিছু না। আমি কুয়াকাটা যাব না। তোমার সাথে ঢাকা যাব। আমি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি, এই যে।"

নিঝুম ওর পাশে রাখা ব্যাগটা দেখাল।

"হোয়াট কাইন্ড অফ জোক ইস দিস? তোমার যখন যা করতে মন চাবে তুমি তাই করবে? "

"এখানে জোক করার মতো কি করলাম আমি ? আমি আমার স্বামীর সাথে যেতে পারিনা?"

"নিঝুম তুমি আমার চাইতেও ভাল জান যে আমার সাথে যাওয়া তোমার ফ্যামিলি এখন মেনে নিবে না। আমার ফ্যামিলিতে বাবা ছাড়া সবাই এটা জানে, বাট তোমার বাবা- মা মানবেন না। সো গাড়িতে যেয়ে বস।"

"না সেক্ষেত্রে আমি তাহলে এখানে নানুর কাছে থাকছি। আম্মুরা ঘুরে আসুক আশুকে নিয়ে। তুমি যখন যাচ্ছ না তখন আমিও যাবনা। সিম্পল..। "

নিঝুমের আচরনে আর কথায় এবার খুব রাগ হলো অরণ্যর। ইচ্ছামতো সব কিছু করা যায় নাকি? ও আর একটা কথাও না বলে পাজাকোলে করে তুলে নিল নিঝুমকে, এক হাতে নিঝুমের ভারী ব্যাগটাও। সোজা নিচের সিড়িতে পা রেখে নিঝুমকে নামাল অরণ্য।

"সোজা গিয়ে গাড়িতে উঠো... এক্ষুনি স্টার্ট দিবে গাড়ি। "

"না আমি এখানে নানুর কাছে থাকব, তুমি যাও। "

"এখানে থাকবা মানে? এটা কি তোমার নানুবাড়ি নাকি যে ইচ্ছে হলেই থাকা যাবে? আর কেনই বা থাকবা যখন তোমার পরিবারের কেউ থাকছেনা।"

অরণ্যর কথায় এবার কাজ হলো। নিঝুম এক সেকেন্ডও আর দেরী না করে সোজা যেয়ে গাড়িতে উঠে বসল।

"এতো অভিমান যে কোথ থেকে আসে," একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরণ্য। নিজেই নিজেকে বলল," হলো না।"

তারপর অয়নের কানে ফিসফিস করে বলতেই , অয়ন কেবল হেসে মাথা দোলাল।

অরণ্য সোজা গাড়িতে এসে উঠল নিঝুমের পাশে,"নিন ড্রাইভার সাহেব... গাড়ি স্টার্ট দিন। "

অরণ্যর কথায় সবাই অবাক। তবে আসমা খুব খুশি হলেন। কেরামতি যে সব নিঝুমের বুঝতে বাকি রইল না তার। তবে নিঝুমের মুখ দেখেই বুঝলেন কিছু ঝামেলা হয়েছে দুটোর মধ্যে। মহা ঝগরুটে হবে দুটো। কিন্তু আবার একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতেও পারবে না, জমবে ভাল।

গাড়িতে সবাই বিভিন্ন ধরনের গল্প করছে। শাহেদ হঠাৎ রাস্তায় এক লোকের হাতে মাছ দেখে তার ছোটবেলায় হাট থেকে মাছ কেনার গল্প বলতে শুরু করে দিলেন। রায়হান সাহেবও তখন তার অভিজ্ঞতার ঝুলি খুললেন, ছোটবেলায় কত কিছু  দুষ্টামির ছলে চুরি করেছেন সেগুলো বলতে লাগলেন আর সবাই হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল। আশুর তো চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়তে লাগল। বেশি হাসলেই ওর এই সমস্যা তৈরি হয়।

কিন্তু এত আনন্দের মধ্যেও নিঝুম একদম চুপ। মনে হচ্ছে একটা অনুভূতি বিহীন রোবট। একভাবে সেই কখন থেকে বাইরে তাকিয়ে আছে। অরণ্যর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেনা আর হাসি তো দূরে থাক। অরণ্যও কিছু বলার চেষ্টা করল না। ঝুমের মুড যে অফ সেটা ওর চেয়ে ভালো এখন আর কেউ জানেনা।

দেখতে দেখতে একসময় সাগর কন্যা কুয়াকাটায় পৌছে গেল ওরা। হোটেল পৌছে রুমে ঢুকতে ঢুকতে প্রায় তিনটা বাজল ওদের। অরণ্যর জন্য রুমের বুকিং ছিল না তবে এটা টুরিস্ট সিজন না হওয়ায় এই হোটেলেই পর্যাপ্ত রুম পাওয়া গেল। তার একটায় উঠে গেল ও।

খাবার খেয়ে বের হতে হতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেল। ওদের হোটেলটা বীচ থেকে কাছেই। সামান্য হাটলেই সামনে বিশাল সমুদ্র হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

মুশকিল হলো নিঝুম তখনও গুম মেরে আছে। অরণ্য ইচ্ছে করে হাটার গতি কমিয়ে দিল। মহারানীর মান ভাঙানো দরকার। ওর খুশির জন্যই না শেষ পর্যন্ত ঢাকা না গিয়ে এদিকে আসল ও। এখন মন খারাপ করে থাকলে পুরো ওর চেষ্টাটাই বিফলে যাবে। জানে খুব কড়া ভাষায় কথা বলেছে ও আজ ঝুমকে । কিন্তু মেজাজ ওরও খারাপ হয়েছিল। আর বউ ওর জেদি নাম্বার ওয়ান। বাজে কথা না শোনা পর্যন্ত গাড়িতেও উঠছিল না। কি সাহস... একা একা বরিশাল থাকবে তাও সে কুয়াকাটা আসবেনা।

"মন কারিগর চলো বাঁধিঘর
জীবন যেখানে মানা
মন কারিগর চলো বাঁধিঘর
নতুন এক স্বপ্ন ডানা "

"ঝুম আইসক্রিম খাবে? আচ্ছা থাক ওই দোকানগুলোতে অনেক আচার আছে, আনব?

আচ্ছা থাক ওই যে ওখানে ওই ছেলেটা বোধহয় বাদাম বিক্রি করছে, বাদাম কিনে আনি হ্যাঁ?"

একের পর এক প্রশ্ন... কিন্তু অরণ্যর একটা প্রশ্নের উত্তরও নিঝুম দেয়নি। আর সবগুলো অফার লুফে নিয়েছে আশু। কি আর করা অরণ্যকে সব এনে দিতে হয়েছে। নিঝুম একটা জিনিসও ছুঁয়ে দেখেনি। সেই আসাই আসলি অরণ্য নদীর জল ঘোলা করে। ধুরর...।

বীচে নামতে গিয়ে বালির বস্তা পার হবার সময় হাত ধরে সবাইকে নামতে সাহায্য করল অরণ্য। ভাব দেখে নিঝুম দূরে আরেক পাশ দিয়ে নামল। এরপর সারাক্ষণ নিজের মায়ের লেজ ধরে বাবা মায়ের লক্ষী মেয়ে হয়ে পুরো সময়টা কাটাল। অরণ্যর ভারী রাগ হলো এবার। এত জিদ দেখানোর কি হলো? খারাপ ব্যবহার করছে বলেই তো সাথে সাথে ভুল শোধরাবার জন্য ঢাকা যাওয়া বাদ দিয়ে কুয়াকাটা আসল। তো এখন একদম রেগে বোম হয়ে থাকতে হবে? রাগ অরণ্যরও আছে। একবার করলে তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল। খালি ওর দোষ খুঁজে বেড়ায়। আর ওর নিজের কোনো দোষ নেই? সব কাজ বাদ দিয়ে এইসব ঢং করে বেড়াতে হলে তো ওর আর সংসার করা লাগবে না। আবার বিয়ের সময় বর কি দিল তাও তো খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞেস করবে সবাই। শাড়ি কত টাকার দিল, গয়না কয় ভরী? আর সে জন্য ওকে ইনকাম করতে হবে না? সরকার এমনি এমনি চেহারা দেখে বেতন দিবে।আবার ঘুষ খেলেও দোষ। যাবে তো যাবে কোনদিকে ও। রাগে বীচ থেকে আসার পর আর নিজের রুম থেকে বেরই হলো না অরণ্য। রাগ আর বিরক্তি দুটোই লাগছে ওর। মেজাজ এক কথায় টং হয়ে আছে এখন অরণ্যর।

কতক্ষন পার হলো জানেনা, হঠাত মোবাইলের ভাইব্রেশনে ঘুম ভাঙল অরণ্যর। দুই তিন ঘন্টা হয়েছে বোধহয়। ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ মাথা কাজ করল না ওর। নিঝুমই তো লিখা উঠছে। কিন্তু হিসেবে মতে নিঝুমের তো ওকে ফোন করার কথা না এখন। তবে?

অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটা ধরল অরণ্য।

"অরণ্য " নিঝুম ভীত স্বরে ডাকল।

" বলো " অরণ্য গম্ভীরমুখেই জবাব দিল। মেজাজটা এখনও ঠান্ডা হয়নি ওর। যখন ইচ্ছা কথা বলবে যখন ইচ্ছা বলবেনা... ফাইজলামি।

"অরণ্য বাঁচাও প্লিজ।"

স্পিকারের ওপাশ থেকে একটা ভয়ংকর আর্তনাদ শোনা গেল।

চোখের নিমেষে ঘুম ছুটে গেল অরণ্যর, শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল শিরশির করে।





"আমি তোমাকে অনেকবার বলছি❤
আবার বলছি❤
বারবার বলবো❤
বলতে বলতে গলা শুকিয়ে ফেলবো❤
তবুও বলবো❤

ভালোবাসি তোমাকে
বৃষ্টি যেভাবে ভালোবাসে মাটিকে❤

ভালোবাসি তোমাকে
রাত যেভাবে ভালোবাসে সকালকে❤

তুমি কি ভালোবাসো আমাকে? "

( This poem written by sinhapunam for Lukochuri.) 

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top