২য় পর্ব

"বুঝলাম না, ব্যাথা পেয়েছে মানে ?"

রুমানার প্রশ্নে হুশ হলো নিঝুমের।

এই রে, এখন কি হবে? ওতো কিছু বলেনি মাকে। শুধু আশু জানে। কিন্তু এই অরন্যই যে সেই ছেলে সেটা তো আর আশু জানেনা।

কিন্তু  নিঝুম কিছু বলার আগেই আন্টি নিজে থেকে বললেন, "না মানে ওর হাতের কনুইয়ের কাছে এরকম লালচে হয়ে আছে তাই জিজ্ঞেস করলাম।"

"ওহ, আর বলবেন না। রিকশা থেকে নামতে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে। এত কেয়ারলেস নিজের ব্যাপারে মেয়েটা, " রুমানা না বলে পারলেন না। "এই পাঁজি মেয়েটা নিজেকে একটুও সামলে রাখতে পারেনা, এতো চঞ্চল... ওর টেনশনেই আমার প্রেশার প্রায়ই বেড়ে যায়।"

আসমা বেগম রুমানার কথায় না হেসে পারলেন  না। মেয়েটা দেখতে বেশ। ছেলের সাথে মানাবেও ভালো। চেহাড়াটা খুব মনকাড়া। বেশ উচু লম্বাও আছে। এখন ছেলের পছন্দ হলেই হয়। বিয়েতো করতেই চায়না, ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছেন।

"তোমার নামটা তো জানলাম না মা? " আসমা বেগমের কথায় নিঝুম একটু হকচকিয়ে গেল। গাড়িতে আসতে আসতে একবার ওনাকে নামটা বলেছিল কিন্তু ও... কি জানি ভুলে গেছে হয়ত।

"কি হল নিঝুম আন্টিকে নামটা বলো।"

বড় ফুপির কথায় তাড়াহুড়ো করে নিজের নামটা দ্বিতীয় বারের মতো বলল নিঝুম, " জি, নিঝুম আফরোজ।"

"নিঝুম আফরোজ.. সুন্দর নাম," এতক্ষণে রায়হান সাহেব কথা বললেন, উনি পাত্রের বাবা।

এরপর ছোটোখাটো কিছু প্রশ্ন, দেশের রাজনীতি, খেলাধুলা বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো। রুমানার মনে হলো ছেলের মায়ের নিঝুমকে বেশ পছন্দ হয়েছে। বার বার ওর হাতটা নিয়ে নিজের হাতের মধ্যে রাখছিলেন।

এক পর্যায়ে রায়হান সাহেব হঠাৎ বলে বসলেন,
" আপনারা কিছু মনে না করলে... আমার মনে হয় ওদেরকে একটু আলাদা করে কথা বলতে দেওয়া উচিত। এখনকার ছেলে-মেয়েতো, নিজের  স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।"

শাহেদও, রায়হান সাহেব তালে তাল মেলালেন,
" হ্যাঁ, হ্যাঁ.. নিজেরা নিজেরা ওরা একটু কথা বলুক। আল্টিমেটলি লাইফটা ওদের, ডিসিশনটা ওরা নিলেই ভাল হয়।"

অন্যসময় হলে বড়ো ফুপি এতক্ষণে ঠিক না করে দিতেন। কিন্তু এখন কিছুই বললেন না। ভাগ্য এত খারাপ কেন নিঝুমের আজকে আল্লাহই জানেন। আজকে ফুপি মানা করতে পারত যে, অপরিচিত ছেলের সাথে এভাবে আমরা মেয়েকে কথা বলতে দেই না। পেটের মধ্যে যে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে নিঝুমের... এত বোর্ড পরীক্ষার চাইতেও খারাপ অবস্থা।

মনে হচ্ছ একশটা প্রজাপতি পেটের মধ্যে ফরফর করে উড়ে বেড়াচ্ছো। মাগো... এই লোকের সামনে ও একা একা কি করে কথা বলবে? নিঃশব্দে একটা ঢোক গিলল নিঝুম। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর, আল্লাহ প্লিজ বাঁচাও।

টেনশনের চোটে বার বার মুখের সামনের চুল গুলো কানের পেছনে নিয়ে গুঁজছিল নিঝুম। পাশ থেকে আশু ফিসফিস করে বলল," এই আপি... দুলাভাই তো সেই লেভেলের হ্যান্ডসাম রে। তোদের বিয়ের পরে দুলাভাইকে বলবি তো আমাকে একদিন একটু কলেজে নামিয়ে দিতে, দাম আকাশে উঠে যাবে আমার।"

আশুর কথায় নিঝুমের পা এর কাঁপুনি আরো বেড়ে গেল। দুলাভাই!

অরণ্য... না নিঝুমের দিকে তাকাচ্ছে না ওকে কিছু জিজ্ঞেস করছে। লোকটার ভয়েস কত সুন্দর, কিন্তু সেতো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। মনে হয় সুপার গ্লু লাগিয়েছে... ফার্স্টক্লাস কোয়ালিটির।

রুমানা বলল," নিঝুম তোরা কথা বল। আমরা বরং সেই ফাঁকে ভাবীদের বাসাটা একটু ঘুড়িয়ে দেখাই।"

নিঝুম অস্বস্তির সাথে মাথা নাড়ল। ওই লোক তো কিছুই বলছে না। হবু বর পুলিশ বলাতে কি লোকটা মাইন্ড করেছে? আচ্ছা একটু বেশিই হয়ত বলে ফেলেছে কিন্তু তাই বলে কি ওর সাথে কথাও বলা যাবে না? নিঝুমের তো ভীষন শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে লোকটার কথা । নাকি ও নিজেই সরি বলে নেবে। কিন্তু নিঝুমতো আর ওনার নাম বলেনি। আর বললেই কি বিয়ে হয়ে গেল নাকি?

বড়োরা সবাই উঠে যেতেই পুরো ঘরটা একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অরণ্য- নিঝুম দুজনেই কেবল এদিক ওদিক দেখছে.. কেউই কথা বলার কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

ওদের এরকম চুপচাপ থাকতে দেখে শেষ পর্যন্ত আশুই প্রশ্নটা করল, " ভাইয়া আপনি কোথা থেকে পড়াশোনা কমপ্লিট করেছেন ? "

"ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে "

বলেই আবার মুখ বন্ধ লোকটার, নিঝুমের মনে হলো ওকে রীতিমতো অপমান করা হচ্ছে।

'ওহ.. কোন সাবজেক্টে?" আশুও দমবার পাত্রী নয়।

"ইংলিশে "

রাম গরুরের ছানা..  রাগে দাঁতে দাঁত ঘষলো নিঝুম। হাসতে বুঝি অনেক টাকা ট্যাক্স লাগে?

" ওয়াও...  আচ্ছা ভাইয়া আপনি কি ঘুরতে খুব পছন্দ করেন? না মানে আপির খুব ঘোরার শখ তো... আর আপির ফটোগ্রাফির হাতও  কিন্তু চমৎকার।"

আশুর কথায় নিঝুম ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। আশুর কি মাথা খারাপ হলো? কি বলছে ও এসব। একেই তো নিঝুম লজ্জায় লাল হচ্ছে আর এই ফাজিল মেয়েটা কি সব বলে বেড়াচ্ছে অপরিচিত লোকটার কাছে।

কিন্তু তারচেয়েও আশ্চর্যের বিষয় হলো আশুর কথার পরেও অরণ্যের তেমন কোনো রেসপন্স নেই। দায়সারা ভাবে একটু হাসল। নিঝুমের এখন সত্যি খুব অপমান লাগছে... লোকটা কি মনে করে নিজেকে? এমন একটা ভাব করছে যেন কোনোদিন ওকে দেখেনি। হসপিটালে তো একেবারে ওর হাতটা দুইহাতের মুঠোয় পুরে ধরেছিল! তাহলে এখন কি এমন হলো যে ওকে চিনতেই পারছে না।

দু একটা যা প্রশ্ন করলো সেটাও নিঝুমকে না বলে আশুকেই করা হয়েছে বলে মনে হলো। কোথায় পড়ে ওরা? আশু ভবিষ্যতে কি হতে চায় ? ওর প্রিয় গায়ক কে? নিঝুমের মনে হলো অরণ্য ইচ্ছে করে ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে। বেশতো জীবনসঙ্গীনি হিসেবে ওকে না হয় নাই পছন্দ হলো, কিন্তু তাই বলে স্বাভাবিক আলাপও কি করা যাবেনা?

নিঝুমের হয়ত তখন অরণ্যর চোখের ভাষা বুঝতে ভুল হয়েছিল। ওটা আসলে হয়তো কেবল মানবিকতাই ছিল কিন্তু তারপরও এক জন আরকজনকে পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও চেনে। এভাবে একেবারেই না চেনার ভান মানুষ করেই বা কিভাবে?

আচ্ছা অরণ্য কি ও বাসা পর্যন্ত ওদের সাথে আসেনি বলে রাগ হয়েছে? কিন্তু এতে নিঝুমের কি দোষ? ওকি জানত যে ওই সেই ছেলে। নিঝুম এর আগে কখনও এরকম করে কারও সাথে কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়নি, আর আজ যখন প্রথম বারের মত ব্যাকুল হচ্ছে তখন সেই ছেলে ওকে মোটে পাত্তাই দিচ্ছে না।

কেমন একটা কান্নার দলা পাকিয়ে আসতে লাগলো নিঝুমের বুকের কাছটায়। এরা কতক্ষন থাকবে? বেশিক্ষণ লোকটার কাছ থেকে অবহেলা সহ্য করতে পারবেনা ও। চোখদুটো কেন যেন ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো নিঝুমের। দুঃখ, অপমান, অভিমান সব একসাথে নিঝুমের বুকের ভিতর যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। কি করবে এখন নিঝুম? কেন লোকটা তখন এত অসহায় চেহারা করে ওর হাতটা ধরে থাকল? ওই মুহূর্তটা তো কিছুতেই ভুলতে পারছেনা নিঝুম।

খানিক পর শাহেদ এসে অরণ্যকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেলেন। ওখানে বড়রা সবাই খুব জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। রায়হান সাহেব আর নিঝুমের বড়ো ফুপুতো তাদের চাকরি জীবনের গল্প শোনাচ্ছেন। আর শাহেদ, রুমানা, আসমা বেগম ওনাদের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাচ্ছেন। নিঝুম আর আশুও অরণ্যের পিছে পিছে ডাইনিং রুমে আসল। মেহামানদের জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন তাই হালকা কিছু নাস্তা পরিবেশন করলেন  রুমানা। নিঝুমও হাতে হাতে রুমানাকে সাহায্য করল।

অরণ্যকে কেকের পিস তুলে দিতে গিয়ে ওর কব্জির সাথে হাতের হালকা ছোঁয়া লাগতেই তাড়াতাড়ি হাত গুটিয়ে নিল অরণ্য। ব্যাপারটা চোখ এড়ালোনা নিঝুমের। এই হাতটাই তো ঘন্টা কয়েক আগে ওর হাতটাকে ছুঁয়ে রেখেছিল পরম মমতায়। আর এখনই অস্পৃশ্য হয়ে গেল? এই অল্প সময়ের  মধ্যে? থাক আর কিছু দেবেনা নিঝুম,  তাড়াতাড়ি অরণ্যর পাশ থেকে সরে এল ও।

আসমা বেগম যতবারই ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন, ততবারই অরণ্য বারবার চোখ সরিয়ে সরিয়ে নিচ্ছে। আসমার মনে কেন যেন একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগলো কিন্তু পরক্ষনে সেই ভাবনাটাকে তিনি ঝেড়ে ফেলে দিলেন । মনে হয় সত্যিই অরণ্যর নিঝুমকে তেমন পছন্দ হয় নি।

তবে আসমার নিঝুমকে দেখেই মনে হয়েছিল  অরণ্যর বোধহয় এই মেয়েকে পছন্দ হবেই হবে। কিন্তু এখন ওর ভাবসাব দেখে তিনি নিজেও শঙ্কিত বোধ করছেন। মেয়েতো বেশ ভালো। দুপুরেও যখন কথাবার্তা বলেছিলেন, বেশ ভাল লেগেছিল। সত্যি বলতে কি অরণ্যর অনেক মেয়ে বন্ধু আছে ছাত্রজীবনের। তাদের অনেকে ওকে বেশ পছন্দও করে। একবারতো পুতুল নামের একটা মেয়ে, অরণ্যর দুই ক্লাস জুনিয়র হবে একেবারে বাবা মা নিয়েই হাজির হয়েছিল ওনার বাড়িতে। মেয়েটার বাবা মাও মোটামুটি আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়ে ছিলেন যে তারা খুবই আগ্রহী। আসমা ওই কথা অরণ্যর সামনে বলতেই, ছেলে হাসতে হাসতে বাঁচে না। বলে ওমা, ওই চীজ বাসায় ঢুকলে তুমি আর কোনোদিন রান্নাঘর থেকে মুক্তি পাবে না। ননীর পুতুল ওটা। ওর ঈদের মার্কেট সিঙ্গাপুর ছাড়া হয়না জানো তুমি? আমার এই বেতনে ওর নেইলপালিশও হবে না। এমনি বলে আমাদের বদনামের শেষ নেই, তার ওপর এমন সাজুনি বুড়ি কপালে জুটলে, আমায় নির্ঘাত দুনম্বরী করতে বাধ্য করবে ও।

আসমা বেগম হতাশ হয়েছিলেন । সেটা প্রায় আট- নয় মাস আগের ঘটনা।

কিন্তু আজ দুপুরে মেয়েটার ইনজেকশন দেওয়ার সময় অরণ্য যেভাবে ওর হাত ধরে রেখেছিল  তাতে তিনি একটু আশার আলো দেখেছিলেন। কিন্তু এখন ছেলের আচরনে তো উল্টো কিছু দেখতে পাচ্ছেন। এই ছেলে তাকে একদন্ড শান্তিতে থাকতে দিবে না। অসহায় ভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।

ছেলের পছন্দ হলে আজকেই পাকা কথা দিয়ে যেতেন তিনি কিন্তু এখন আর সাহস হচ্ছে না। আর তারচেয়েও বেশি হচ্ছে মন খারাপ।

রায়হান সাহেবও স্ত্রীর মন খারাপটা ধরতে পারলেন  কিন্তু সবার সামনে তো আর সব কিছু জিজ্ঞেস করা যায়না। নিঝুমদের বাসা থেকে বের হয়ে আসার সময়, বাসায় গিয়ে আত্মীয় স্বজনের সাথে একটু আলোচনা করে সিদ্ধান্তটা জানাবেন বললেন তিনি। সরাসরি একেবারে না কথাটা আসলে... রায়হান সাহেব লজ্জায় বলতে পারলেন না মেয়ের বাবাকে। দিলারা আপাই বা কি ভাববেন।

শাহেদও সাথে সাথে 'নিশ্চই' বলে সমর্থন করলেন।

পাত্রপক্ষ চলে যেতেই ঠোঁট উল্টালেন রুমানা। বললেন, "ছেলের ভাবগতিক তেমন সুবিধার লাগল না, মনে হয় উত্তরটা না হবে। "

শাহেদ কিছু বললেন না। নিঝুমের বড় ফুপু দিলারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গেস্টরুমে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। তার একটু বিশ্রামের খুব প্রয়োজন। আয়েশারও একটু মন খারাপ হলো। ভাইয়াটা দেখতে বেশ সুন্দর ছিল আপির সাথে খুব মানাত।

নিঝুম সোজা গিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। ওর খুব মাথা যন্ত্রনা হচ্ছে, সাথে হাতের যন্ত্রণাও বেড়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে বুকের মধ্যে। কেমন যেন খামচি দিয়ে উঠছে.. উহ্ এত কষ্ট কেন হচ্ছে? কি এমন হয়েছে?  লোকটার ওকে পছন্দ হয়নি, সে কারনে এড়িয়ে গেছে। বেশ করেছে। ভাল ব্যবহার করলে হয়ত, না শোনার পর আরও খারাপ লাগত। তারচেয়ে বরং এই ভালো হয়েছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেও তো সেই চোখ । সন্ধ্যার অরণ্যকে ছাপিয়ে বার বার দুপুরের অরণ্য এসে ওর  মনের আঙ্গিনায় হানা দিচ্ছে। কোনটা  সত্য আর কোনটা মিথ্যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে নিঝুমের, কি করবে এখন ও?

...........................................................

অরন্য বুঝতে পারছেনা... ওর আসলে কি করা উচিৎ?  মা সকাল থেকেই পেছনে লেগেছিল যে ওর জন্য মেয়ে দেখতে যাবে। বাবার কোন কলিগের ভাস্তি। না গেলে নাকি বাবার মান সম্মানের ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত তাই রাজি হতে হয়েছে অরণ্যকে।

কিন্তু মাকে ডাক্তার দেখিয়ে  নিয়ে আসার পর থেকে ওর আর একটুও নড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল না। চোখ খুললেই নিঝুমের সুন্দর চোখদুটো ভেসে উঠছিল। এ কি বিপদে পড়ল অরণ্য। ও যত ভুলতে চাইছে তত বেশি করে মনে পড়ছে ওই মুখ। কিন্তু ওই মেয়ে তো অলরেডি এনগেজড। তারসাথে আবার একই প্রফেশনে চাকরি করে ওর উড বি হাসব্যান্ড। কিচ্ছু করার নেই অরন্য.... নিজেই নিজেকে বুঝিয়েছে ও।

জীবনে এই প্রথম বারের মত কোনো মেয়েকে পছন্দ হলো কিন্তু মনের খাঁচায় আটকানোর আগেই পাখি ফুড়ুৎ। এখন এই ফাঁদে আটকে মর নিজে। কার মুখ দেখেে যে আজ বের হয়েছিল অরণ্য.. আম্মু কয়েকবার মানা করেছিল যে আজকে থাক, কিন্তু ওই শোনেনি।

পাত্রী দেখার কোনো ইচ্ছেই আর অরণ্যর হচ্ছে না। কিন্তু না গিয়ে উপায় নেই, মার মন খারাপ হবে। আর এই জায়গায় অরণ্য খুব দুর্বল। আম্মু... আম্মুর পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত তাই কাপড় পরতে বাধ্য হলো ও, কিন্তু তার খানিক পরেই অফিস থেকে ফোন এল।

এই মুহূর্তে অফিসের মিটিংয়ে আছে অরণ্য। আরও পনের মিনিট হয়ত লাগবে শেষ হতে।অনেকক্ষন ধরে কেউ একজন ওকে কল করছে অনবরত।

মিটিং থেকে বের হয়েই ফোনটা রিসিভ করল অরণ্য,"হ্যাঁ বল।"

"ভাইয়া তুমি কি সত্যি এই মেয়েকে বিয়ে করবেনা? ভাল করে ভেবে বলো।"

ওপাশ থেকে বিস্মিত একটা সুর ভেসে আসে।

"আমি তো বললামই, আই হ্যাভ নো ইন্টারেস্ট।" অরণ্যর সোজাসাপ্টা উত্তর।

"একবার ছবিটা একটু দেখে নিতে, পরে আফসোস করতে পারবে না কিন্তু। আর মার খুব পছন্দ হয়েছিল মেয়েটা। "

অরন্য  কিছু বলল না। ও ভাল করেই জানে ব্যাপারটা। মার ওকে বিয়ে দিয়ে নাতি দেখার শখ হয়েছে। মায়েরা কেন যে কিছু বুঝতে চায়না।

"ভাইয়া মেয়েটা কিন্তু সুন্দর আর ফ্যামিলির লোকজনও ভালো মনো হলো।"

অরণ্য এবার অসহায় বোধ করল,"অয়ন...  প্লিজ।"

"আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু তাহলে আমি কিন্তু আমার জন্য বলব মাকে... তখন কিন্তু একেবারেই বাগড়া দিতে পারবেনা বলে দিলাম।"

অয়নের কথায় হেসে ফেলল অরন্য। অয়ন ওর থেকে মাত্র  দশ মিনিটের ছোট। ওর জমজ ভাই। দেখতে ওরা দুজন হুবুহু একই রকম। হুট করে দেখলে যে কোনো মানুষ ধোকা খেয়ে যায়। এমনকি কাপড় পাল্টে পরলে বাবা - মাও মাঝে মাঝে গুলিয়ে ফেলে। ওরা ছোট থাকতে অবশ্য মার ভুল হতোনা কিন্তু এখন ওরা বড় হওয়ার পর মাঝে মাঝে একজনকে আরেকজন ভেবে ভুল করেন, চোখে একটু কম দেখেন তো।

আর সেই সুযোগটাই আজ  নিয়েছে অরণ্য। একইতো নিঝুম নামের মেয়েটা ওর শান্তির চৌদ্দটা বাজিয়েছে তারমধ্যে অফিস থেকে মোক্ষম সময়ে ফোন আসল। হেড অফিস থেকে জরুরী মিটিং কল করেছে। ডি আই জি স্যার উপস্থিত থাকবেন মিটিংয়ে, না গিয়ে উপায় নেই।

অরণ্যর মাথায় আসছিল না ও কি করবে।  আম্মুকে বললেই মন খারাপ করবে। শেষে দেখা যাবে প্রেশার বেড়ে গিয়েছে।

এমন সময় হঠাৎ করে ব্যাংক থেকে অয়নের ফোনটা এল। অরণ্যর কাছে অয়ন তখন অয়ন না সাক্ষাত দেবদূত। অয়ন একটা প্রাইভেট ব্যাংকে নতুন জয়েন করেছে। অয়ন একটা ফোন কিনবে বসুন্ধরা সিটি থেকে। যে সেট পছন্দ হয়েছে সেটা ওর বাজেটে কুলোচ্ছে না। দশ হাজার টাকা শর্ট। অরন্য সাথে সাথে দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু তার বিনিময়ে অয়নকে কিছু সময়ের জন্য অরণ্য হতে হয়েছে আরকি। বাসার  পেছনের গেট দিয়ে চুরি করে বের হতে হয়েছে অরণ্যকে মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে।

"নো ওয়ে, " অরণ্য মাথা নাড়ল। অয়নের যদি ওই মেয়ে পছন্দ হয় তাহলে তো ও বেঁচে গেল। অবশ্য তাতেও আসলে অরণ্যর নিজের বিশেষ কোনো লাভ নেই। তবু এই মুহুর্তে মনের পুরোটা জুড়ে নিঝুম মেয়েটা রাজত্ব করছে। সহসাই তাতে অন্য কারো নাম খোদাই হবে না। আচ্ছা নিঝুম নামের মেয়েটার কার সাথে বিয়ে ঠিক? ওটা কি ওর প্রেমের বিয়ে না পারিবারিক ভাবে ঠিক হয়েছে... অরণ্য কি একটু খোঁজ নেবে। যদিও সরাসারি নিঝুমের নাম্বারটা ওর কাছে নেই তবে ওর বাবার নাম্বারটা আছে। আর ওই নাম্বার দিয়ে নিঝুমের বাসার ঠিকানা খুঁজে বের করা ওর কাছে কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু করবে কিনা সেটাই সিদ্ধান্ত  নিতে পারছেনা। নিঝুম যদি ওকে ভুল বোঝে।

"ওকে, আমি ছবি পাঠাচ্ছি। তোমার জন্য না হোক অন্তত আমার জন্য কেমন হয় তাই না হয় জানাও," অয়ন হাসতে হাসতে বলল।

অয়নের ধারনা মেয়েটাকে দেখলে ভাইয়া মত পাল্টাতে পারে। আসলে আম্মুর খুব পছন্দ হয়েছে। অয়ন ভয়ে আম্মুর দিকে তাকাতে পারছিলনা। ওই বাসায় যেয়ে অয়ন খুব কম কথা বলছিল কারন ভাইয়ার গলার স্বর একটু বেশিই ভারী। আম্মু বুঝে ফেলে। তাই  আম্মু -আব্বু ড্রইং রুমে থাকা অবস্থায় অয়ন কোনো কথাই বলেনি। মুরুব্বিরা উঠে গেলে তবে ও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।

আসলে নিঝুম মেয়েটাকে একবার দেখেই ওর ভাবি হিসেবে পছন্দ হয়েছে কিন্তু ভাইয়া অনুরোধ করেছিল পারলে বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে। ভাইয়ার নাকি একটা মেয়েকে ভারি পছন্দ হয়েছে। তাই আরও খানিকটা অভিনয় করতে হলো অয়নকে। কিন্তু মেয়েটা ওর দিকে কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল... একটু অভিমান করে করে। ওই তাকানোর কারনটা অয়ন ধরতে পারছিলনা। ও তো এই মেয়েকে চেনেই না। কিন্তু মেয়েটার চোখে স্পষ্ট অভিমান আর অনুযোগের ঘনঘটা ছিল।

"তুই কি সিরিয়াস? " অরণ্য জিজ্ঞেস করল।

"ভাইয়া মেয়েটা আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিল,  আমি শেষ। শুধু তুই বলেছিলি যে কোনোভাবে বিয়েটা থামা , সেজন্য ভাল করে একটা কথাও বলিনি, " অয়ন, অরণ্যর উপর অপরাধের সব দায়ভার চাপিয়ে দিল।

"আচ্ছা আচ্ছা পাঠা... দেখি কোন দেশের রাজকন্যা পছন্দ হলো আমার ভাইয়ের," অরণ্য দুষ্টু একটা হাসি দিল। অয়ন আসলে খুব পড়ুয়া। অরণ্য সবসময় ওর থেকে একটু পিছিয়ে থাকতো পড়াশোনায়। তারপরেও কিভাবে কিভাবে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেল সেটা একটা আশ্চর্যের বিষয়। অবশ্য,  অয়ন ওর পেছনে বসে পরীক্ষা দিয়েছিল। আর ওদের পুরো গ্রুপটাই সেটার সুবিধা পেয়েছে। সাত জনের গ্রুপে ছয়জনই চান্স পেয়েছিল ওরা।

অয়ন পড়া শেষ করেই বাইরে চলে যেতে চেয়েছিল। অরণ্য আটকিয়েছে। ওর আসলে অয়নকে ছাড়া কেমন একা একা লাগে। ও অয়নকে বলেছে যদি এখানে সুবিধা করতে না পারিস, তাহলে পরে যাস। চলে গেলেই তো বাবা- মাকে হারিয়ে ফেললি, অয়ন আর কিছু বলেনি।

হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ আসতেই মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রীন আনলক করল অরণ্য। কিন্তু জীবনের প্রতিটা বাঁকই আসলে রহস্যে ঘেরা। কখন, কেন, কোন ঘটনা ঘটে সেটার প্রেক্ষাপট আসলে এক উপরআলা ছাড়া কেউ জানেনা।

এক মুহূর্তের মধ্যে  অরন্যর চোখদুটো যেন অপার্থিব এক সৌন্দর্যের সাথে আটকে গেল। ছবিটা ওর চোখ দুটোকে চুম্বকের মতো টানছে। শ্বাস ফেলতে ভুলে গেল অরণ্য। কেউ কি করে এত সুন্দর হয়? কি কাল গভীর চোখ দুটো। অরণ্য কি ডুব দেবে ওই চোখে? আলতো করে নিজের  হাতের উল্টো পিঠটা ওর নরম গালে একটু ছুঁয়ে দেবে? ওর মুখের সামনে এসে পড়া চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দেবে? ওর ছোট্ট কপালটাতে একটা ভালবাসার স্পর্শ একে দিবে? উহ.. অরণ্যর অঙ্গুল গুলো ছটফট করতে লাগল ছবির রাজকন্যাটাকে বাস্তবে আবার একটু ছুঁয়ে দেখার।

অয়নের কাছ থেকে দ্বিতীয় মেসেজটা আসার পর ঘোর  কাটল অরণ্যর।

সাথে সাথে অরণ্যর মনে হল হৃৎপিণ্ডটা এক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে ওর।  সর্বনাশ...  এখন কি হবে?

ছবিতে ঝুমকে কি সুন্দর লাগছে। অরণ্য হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছেনা। লক্ষ্মী নিজে থেকে এসেছে ওর কাছে আর ও তাকে পায়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছে।

........................................................

অরণ্যর কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অয়ন সোজা কল করল অরণ্যকে," কি ভাইয়া, কেমন লাগল?"

অরণ্যর বুকে তখন হাতুড়ি পেটা হচ্ছে। কি করবে এখন ও?  অয়নকে ও যেমন বলেছে, ও তাই করেছে। এখনতো রাগে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে অরণ্যর।

"ভাইয়া বলো না? " অয়ন আবার প্রশ্ন করল।

"অয়ন.." কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকল অরণ্য।

"কি ব্যাপার? ভাইয়া কি হয়েছে তোমার?" অয়ন অবাক।

" সর্বনাশ হয়েছেরে ভাই," অরণ্য ঢোক গিলল। "এখনতো আম্মুকেও কিছু বলে লাভ হবে না।"

"মানে? " অয়ন কিছু বুঝতে পারলনা। এইতো ভাইয়া খুব হাসছিল।

"মানে আমি যে মেয়ের কথা বলেছিলাম, ওটাতো নিঝুমই ছিল। মানে ছবির এই মেয়েটা। এখন কি হবে বলত ছোট? ওকে না পেলে ঠিক মরে যাব," অরন্য শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলল অয়নকে ব্যাপারটা।

অয়নও,  অরণ্যর কথা শুনে অবাক।  অরণ্যর আসলেই কপাল খারাপ, তা না হলে এমন হয়। অরণ্যর অবস্থা ভেবে অয়নের হাসিও পাচ্ছিল সেই রকম। ভাইয়া বেশি বুদ্ধি করতে যেয়ে ধরা খেয়েছে। এতক্ষণে অয়ন বুঝতে পারছে মেয়েটা অমন অভিমানী ভঙ্গিতে কেন তাকাচ্ছিল ওর দিকে। না, না ভুল হলো ওর দিকে তো না,  অরণ্যর দিকে।

নিঝুমের তারমানে ভাইয়াকে পছন্দ। একা একাই রুমে বসে হাসতে লাগল অয়ন।

"ভাইয়া এত চিন্তা করিস না। নিঝুম তোকে অনেক পছন্দ করে। ওতো আর জানেনা যে ওটা আমি,  তুই নোস। আর আমি কোনো কথাই আসলে বলিনি। বেচারির সেজন্য খুব মন খারাপ ছিল। এতক্ষণে অভিমানের কারন বুঝতে পারছি। তুই কালকেই যা ওদের বাসায়,  তুই দুই মিনিট কথা বললেই ওর রাগ পানি হয়ে যাবে,"অয়নের কথায় এতক্ষনে এক চিলতে হাসি ফুটল অরণয়র মুখে। ঝুম ওকে পছন্দ করে তাহলে। অয়ন কথা বলেনি বলে রাগ হয়েছে ওর ঝুমের।

"দাঁড়াও কালকেই যাব তোমার কাছে, দেখি কত কথা বলতে পারো আমার সাথে।"

চলবে.......

গল্পটি ভাল লাগলে ভোট আর কমেন্ট করার অনুরোধ রইল।

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top