১৯

অরণ্যরা নদীর পাড় থেকে বাসায় ফিরে এসেই দেখে খাওয়া দাওয়ার বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। তিনটা বড়ো বড়ো ডাইনিং টেবিল পাতা হয়েছে ড্রয়ইরুমের পাশের হল ঘরটিতে।

ওদের বাসায় আরো অনেক আত্মীয় স্বজনের সমাগম ঘটেছে। অরণ্যর নানুই দাওয়াত করেছেন সবাইকে অরণ্যর হবু বউ দেখার জন্য। ঢাকায় বিয়ে হলেতো সবাই যেতে পারবেনা, তাই এই বিকল্প আয়োজন। 

নিঝুমকে শাড়ি পরতে বললেন রুমানা। গ্রামের অনেক আত্মীয় আজ আসমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে, অরণ্যর হবু বউ দেখবে বলে। আর নতুন বউকে কামিজ পরা অবস্থায় দেখতে এখনও ততটা সাচ্ছন্দ্য বোধ করে না এ দেশের মানুষ। নিঝুমও তাই মায়ের কথায় শাড়িকেই প্রাধান্য দিল আজকের রাতের অনুষ্ঠানের জন্য।

ব্যাগ থেকে জাম রঙের একটা জামদানী শাড়ি বের করলো নিঝুম, তাতে সূক্ষ্ম রুপালি সুতোর কাজ করা। নিঝুম শাড়ি পরে তৈরি হতেই আশু মুঠো ভর্তি ফুল নিয়ে এসে হাজির, " আপু জিজু এটা তোমাকে পরতে বলেছে।"

আশুর হাতে বেলি ফুলের মালাটা দেখে মনটা আনচান করে উঠল নিঝুমের। অরণ্য কি করে জানল যে ওর এই মুহূর্তে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল একটা ফুলের মালা খোঁপায় পরার। চোখে আলতো করে কাজল টানার পর লিপস্টিক দেবে কি দেবে না করতে করতে শেষ পর্যন্ত হালকা গোলাপি লিপস্টিকটা একবার ঠোঁটে বুলাল নিঝুম। অরণ্য পছন্দ করে না যদিও, তবু শাড়ির সাথে একটু না দিলে কেমন যেন বেশি সাদামাটা দেখায় আর এদেশে নতুন বউ বেশি সাদামাটা হলে আত্মীয়-স্বজন আগেই মুখ ঘুরায়। এদের কাছে বউ মানেই হচ্ছে সোনার থালার মতো চকমকে। তবে অরণ্যর সতর্কবানীও এক সেকেন্ডের জন্য ভুলল না নিঝুম।

নানুর ঘরে যাওয়ার মাঝপথে হালকা আলো আধারিতে এক জোড়া হাত চেপে ধরলো নিঝুমকে। নিঝুম বাঁধা দেয়ার কোন রকম সুযোগই পেলনা তার আগেই ওর ঘাড়ে,গলায় অগনিত গরম নিঃশ্বাসের ছোঁয়া এসে হামলে পড়তে লাগল। তবে হাতের ছোঁয়াটা এখন বড্ড পরিচিত নিঝুমের...  আনমনেই এক টুকরো আলোর ফালি জেগে উঠল নিঝুমের মনের আকাশে।

নিঝুমের গায়ের মিষ্টি ঘ্রানে টালমাটাল তখন অরণ্য। আশুর হাতে পাঠিয়ে দেয়া বেলি ফুলের গন্ধ তখন অ্যালকোহলের মতোই নেশা ছড়াচ্ছে... ওর প্রতিটি রক্ত কনিকায়। কখন যে নিজের অজান্তেই মাত্রা ছাড়া হচ্ছিল অরণ্য নিজেও তা বুঝতে পারেনা।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিঝুমের তীক্ষ্ণ স্বর ওকে সতর্ক করে তুলল।

" অরণ্য প্লিজ এভাবে যখন তখন  এগুলো করা ঠিক না।"

কথাটা অরণ্যর কাছে ঠিক কষে একটা থাপ্পরের মতো লাগল। গালের চামড়ার চাইতে বেশিই জ্বলে উঠল ভেতরটা। নিঝুমের চোখে কী ও নিজেকে বড়ো বেশি তুচ্ছ করে ফেলেছে? নিজের উপর ভিষন রাগ হলো।

টু শব্দ না করে নিঝুমকে ছেড়ে দিল অরণ্য, তারপর হনহন করে সামনে চলে গেল নিঝুমকে পিছনে ফেলে রেখে।

নিঝুম খানিকটা সময় বোকার মতো তাকিয়ে রইল। ও কি অরণ্যর সাথে খুব বেশি রুড আচরন করে ফেলেছে? এমন কেন হচ্ছে? এই মানুষটা ওর কাছে এখন নিজের জীবনের চেয়েও দামী, আর তার সম্মানটাও। হুটহাট ওরকম করতে থাকলে... কেউ দেখে ফেললে অরণ্যর অনেক বদনাম হবে।  আর এটা নিঝুমের সবচেয়ে বড়ো ভয়, অরণ্য ওদের বাড়ির বড়ো জামাই আর লোকটা সেটা বুঝতেই চাইছে না। শুধু শুধু ওকে ভুল ভাবছে।

আসমা,  নিঝুমকে ড্রইংরুমে নিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। নিঝুম সালাম দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চোখ তুলে অরণ্যকে খুঁজছিল কিন্তু হল রুমের কোথাও অরণ্যর ছায়াও দেখতে পেলনা নিঝুম। একটু পরে লম্বা মতো কেউ একজন এসে ঘরে ঢুকলো। আড়চোখে তাকিয়েও নিঝুম বুঝল ওটা অয়ন। কানে সব সময়ের মতো হেডফোন ঝুলছে। কিন্তু অরণ্য তাহলে কোথায় গেল? এতক্ষণে একবারও এই ঘরে আসল না। ফোন দিলে ফোনও রিসিভ করছে না। এতো আনন্দের মধ্যেও নিঝুমের মন ক্রমশ খারাপ হতে লাগল।

বেশ অনেকক্ষণ গল্প গুজবের পরে খাবার দাবারের পর্ব শুরু হলো। নিঝুম ফাঁক পেয়ে মাকে বলে বের হয়ে আসল হলরুম থেকে। অরণ্যর সাথে কথা বলা খুব দরকার ওর... এখুনি।

কিন্তু অরণ্যকে কোথাও  খুঁজে পেল না নিঝুম। গেল কোথায় লোকটা? একা একা এই অন্ধকারে নিচে যেয়ে বসে থাকবে না নিশ্চই। তারপরও সাহস করে নিচতলাটা একবার ঘুরে দেখল ও।

খুঁজে খুঁজে না পেয়ে মন মেজাজ এবার সত্যি বিগড়াতে লাগলে নিঝুমের । আবার কোথাও বের হয়েছে নিশ্চিত। নিঝুমের মনে হচ্ছিল রাগে ফুলের মালাটা ফেলে দেয় ও খোঁপা থেকে। ও এত যত্ন  করে সাজল আর আর ওকে এক ঝলক দেখতেও চায় না লোকটা। দরকার নেই, একদম দরকার নেই। লোকজন চলে গেলে সাথে সাথে কাপড় পাল্টে নিবে ও। কি মনে করেছে অরণ্য.... নিঝুম ওর জন্য হা পিত্যেশ করে মরে যাবে? জীবনেও না। একটু পরেই সব খুলে ফেলবে ও।

ড্রইংরুমে যেয়ে বসতেই, নানু ওকে সবার সামনে সোনার একটা হার পরিয়ে দিলেন। এটা নাকি নানাভাই ওনাকে বিয়ের সময় পরিয়ে দিয়েছিলেন। নানু এটা তার বড়ো নাতির বউয়ের জন্য রেখে দিয়ে ছিলেন। এ বাড়ির ছেলের ঘরের বাচ্চারা সব ছোট ছোট। অরণ্যই হচ্ছে এ বাসার সবচেয়ে বড়ো নাতি। সেই সুবাদে নিঝুমই হারটার দাবীদার। হারটা পরার পর নিঝুমের অভিমান এবার আকাশে গিয়ে উঠল। কি আশ্চর্য, অরণ্য কেমন মানুষ! বিয়ের আগের এসব ছোট খাট অনুষ্ঠান গুলোতে কে না উপস্থিত থাকে। নানু কত শখ করে ওকে হারটা পরিয়ে দিলেন, আর যার বউকে দিলেন তার এসবে কোন আগ্রহই নেই। নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন একটা মানুষ। মনে মনে এত্তগুলা বকা দিল নিঝুম অরণ্যকে। আজব একটা লোক শুধু পারে আজবাজে জিনিস গুলো করতে।

নিঝুম লক্ষ্য করল অয়ন মাঝেমাঝেই এই ঘরে আসা যাওয়া করছে। অরণ্যকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আশুকে দিয়ে ওকেই ডাকিয়ে আনল নিঝুম।

"কি হয়েছে ঝুমঝুমি? "

" তোমার ভাইয়াকে খুঁজে পাচ্ছিনা। সে আমার কোন ফোনও রিসিভ করছে না।"

"আমি যখন আসছিলাম তখন তো ভাইয়াকে  কাপড় পাল্টাতে দেখলাম। আমিতো মনে করলাম এখানে আসবে বলেই  ভাইয়া কাপড় পাল্টাচ্ছে। আচ্ছা... তুমি ভয় পেয়না, আমি দেখছি। "

খানিক পরে অয়ন এসে নিঝুমকে অরণ্যর রুমে যেতে বলল। অয়নের গলার স্বরে এবার অদ্ভুত একটা জিনিস খেয়াল করল নিঝুম, অস্বাভাবিক গম্ভীর। অয়ন কখনো ওকে ঝুমঝুমি ছাড়া ডাকে না কিন্তু এখন সে ওকে কিছু বলেই সম্মোধন করলনা, স্রেফ নিচু গলায় কথাটা বলেই চলে গেল আসমা আন্টির কাছে। অয়নের বলার ভঙ্গিতে ওখান থেকে উঠে আসতে বাধ্য হলো নিঝুম।

অরণ্যর ঘরে গিয়ে দেখে আগের মতোই ফাঁকা এখনো ঘরটা। নিঝুম আগেও একবার খুঁজে গিয়েছে... তখনও ঘরটা একইরকমই ছিল। অয়ন কেন ওকে এখানে আসতে বলল বুঝতে পারলনা নিঝুম। কেউই তো নেই ঘরে। অরণ্য আবার দুষ্টুমি শুরু করল না তো ওর সাথে? বাথরুমে গিয়ে লুকায়নি তো?

হতে পারে। এতক্ষণে একটা হাসি ফুটল নিঝুমের মুখে। অরণ্যর বোধহয় লুকোচুরিটা খুব পছন্দের একটা খেলা। কিন্তু ও তো পুলিশ...  লুকোচুরির বদলে বরং চোর, ডাকাত ,পুলিশ এই খেলাটা অরণ্যর পছন্দের হলে ভাল হতো। কিন্তু বাথরুমের  দরজাটা খোলার পর মুখটা আগের চেয়েও অন্ধকার হয়ে এক নিঝুমের। কিচ্ছু নেই এখানে একদম ফাঁকা।

নিঝুম বের হয়ে যাবে এমন সময় অয়ন এসে ঢুকল ঘরে।

"ওটা বোধহয় তোমার জন্য।"

টেবিলে চাপা দেওয়া এক টুকরো কাগজ আঙ্গুল দিয়ে দেখাল অয়ন নিঝুমকে।

কাগজটা হাতে নিয়ে নিঝুম বোকার মতো তাকিয়ে রইল।অরণ্য ঢাকায় যাচ্ছে! এতক্ষণে ওর লঞ্চ বোধহয় টার্মিনাল ছেড়ে চলেও গিয়েছে। নিঝুম কি করবে বুঝতে  না পেরে ফ্যালফ্যাল করে অয়নের দিকে তাকিয়ে থাকে।

"ডোন্ট আপসেট ঝুমঝুমি.. ভাইয়া কোনো জরুরী কাজে ঢাকা গিয়েছে নিশ্চই। কাজ হলেই চলে আসবে," অয়ন নিঝুমকে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল।

নিঝুম চুপ করে শুনল শুধু... অয়নের কথার  কোন উত্তর দিলনা। অয়নও আর কথা বাড়ালনা। বলার জন্য কথাটা অয়ন  বলল বটে,  কিন্তু ব্যাপারটা ওর কাছেও গোলমেলে ঠেকছে। ইমার্জেন্সী থাকলে ভাইয়া এরকম হুটহাট করে চলে যায় ঠিকই কিন্তু তাই বলে কাউকে না বলে যাওয়ার রেকর্ড এই প্রথম। আর কেউ না হলে ওকে অন্তত বলে যায় কারন তখন ভাইয়ার জায়গায় অনেক সময় ওকেই ভাইয়ার হয়ে প্রক্সি দিতে হয়। কিন্তু এখন তো আর সেটা সম্ভব না। পুরো ঘটনাটায় ভীষন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে  অয়ন কিন্তু সেটা বোধহয় নিঝুমকে এখন জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে না, বেচারি খুব আপসেট হয়ে আছে এই মুহূর্তে।

.................................

"এই নিঝু... কিরে? বিছানায় এরকম বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছিস কেন? খাবিনা? " রুমানা এসে নিঝুমকে ঠেলতে লাগলেন।

"আমার খুব ঘুম পাচ্ছে , আমাকে একটু ঘুমাতে দাও না মা, " নিঝুম বালিশে মুখ গুঁজেই কথা গুলো বলল। মুখ তুললেই মা বুঝে ফেলবে ও কেঁদেছে আর তখন হাজার প্রশ্নের উত্তর দিতে  হবে। নিঝুমের এখন একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না কোন ধরনের কথা বলতে।

মা বেড়িয়ে যেতেই  নিঝুম আবার বালিশে মুখ গুঁজল। অরণ্যর এত রাগ! আর নিঝুমতো ওর কাছে যাচ্ছিল ক্ষমা চাইতে... এটুকু সময় কি ওকে দেওয়া গেল না। আর নিঝুম ভুল কি বলেছে? একবার ঝোঁকের বশে হয়ে গেছে বলেই কি সেই কাজটা বার বার করতে হবে? ওদের গোপন বিয়ের কথা এখন কেউ জানে না। বাসা থেকে কাবিন করেও রাখা হয়নি। তাহলে হুট করে এই অবস্থায় যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে কি করে মুখ দেখাবে ওরা সবার সামনে? আসমা আন্টিরা অনুরোধ করে শুধু ওদের কাবিনটা করে রাখলেও ঝামেলা অনেকটা মিটে যায়।

অরণ্যকে এই কথাটা বলার জন্য খুঁজছিল নিঝুম।  ছেলেপক্ষ  বার বার অনুরোধ করতে থাকলে মেয়েপক্ষ সেটা বেশিদিন না বলতে পারে না কিন্তু ওই লোক সেটা ঠান্ডা মাথায় শুনলে তো।

"একেবার চোরের মতো বের হয়ে গেছে কাউকে কিছু না বলে। নিষ্ঠুর একটা লোক৷ আবার বলে ভালবাসি। ঘন্টার ভালোবাসা। "

গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে নিঝুমের। কিন্তু জোরে কাঁদবে কি করে ও? কাঁদলে তো  সবাই ছুটে আসবে, ওই পাষান মানুষটা ছাড়া।

আসলে রাগ, দুঃখ, অভিমান কোনটা ছেড়ে কোনটা যে বেশি  হচ্ছে বুঝতে পারছেনা নিঝুম। কেবল একটা জিনিস বুঝতে পারছে, প্রচন্ড যন্ত্রনা হচ্ছে ওর। আর নিঝুম সেটা সহ্য করতে পারছে না।

অরণ্য এভাবে ওকে ফেলে কেন চলে গেল? কি অপরাধ ওর?

লঞ্চের দাঁড়িয়ে রাতের নদীর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার বৃথা চেষ্টা চালাল অরণ্য। চব্বিশ ঘন্টা মাত্র... অথচ এই নদীই কাল রাতে এক অপরূপ সৌন্দর্যের আধার মনে হয়েছিল ওর।

এখন বোধহয় নিঝুমকে একবার ফোন করা দরকার। দ্রুতহাতে নিঝুমের নাম্বারে কল করল অরণ্য।

"হ্যালো "

নিঝুম স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু হঠাৎ করে তাল সামলানো আসলে মুশকিল... বিশেষ করে কেউ যখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

" কি করছো ঝুম? " অরন্য বুঝতে পারছে নিঝুমের কান্না, কিন্তু আজ ওর কিছু করার নেই। সব মন খারাপ দূর করার ক্ষমতা মানুষের হাতে থাকেনা। আজকের কারনটাও তেমন। আর এটুকু ওর কাছে প্রয়োজন বলেও মনে হয়েছে। সম্পর্কে মাঝে মাঝে কিছুটা দূরত্ব, আয়নার মতো কাজ করে। খুব কাছে থাকলে যে চেহারাটা ঘোলাটে লাগে, দূর থেকে তার সম্পূর্ণ  অবয়বটা পরিস্কার দেখা যায়। আর আজকে ঢাকা ফেরত আসার এটা একটা বড় কারন অরণ্যর জন্য।

"কিছুনা আপনি কি করছেন? " নিঝুমের কথা বলতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অরণ্যর কাছে সেটা প্রকাশ হচ্ছে বলে ওর নিজের উপর ভীষন রাগ হচ্ছে।

" ঝুম আমি ঢাকা যাচ্ছি। "

"হমম "

"রাতের খাবার খেয়েছ?"

"আপনি ? "

"না খেয়ে আসার সময় ছিল না আর মাকে বললে আসতে দিত না।"

"হমম," নিঝুম দু'চোখের পাতা চেপে ধরে কান্না থামাতে চাইল। লোকটা কি নিষ্ঠুর, কি সামান্য কারনে ওকে এত বড়ো শাস্তি দিল। আবার এখন দেখ কি স্বাভাবিক গলায় ওকে প্রশ্ন করে চলেছে সে, যেন কিছুই হয়নি।

"তুমি বোধহয় খাওনি, যেয়ে খেয়ে নাও।"

নিঝুমের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল এটা বলতে যে, আমার খাওয়া নিয়ে আপনার এত চিন্তা করা সাজে না। কিন্তু সব সময় সব কথা বলতে নেই। সেটা সত্যি হলেও না। সত্যিটা সহজ ভাবে নেওয়ার মতো মেরুদণ্ড সবার থাকে না। অরণ্যরও নেই। তাই শুধু শুধু অরণ্যকে বিশেষ একটা সম্মানের জায়গায় বসানোর কোনো মানে নেই, সেও আর পাঁচটা ছেলের মতোই সাধারন।

"আপনি খান, খেয়ে শুয়ে পড়ুন। "

নিঝুমের স্বরের রুক্ষতায় আজ ব্যথিত হলো অরণ্য। বউটা খালি ওকে উল্টো বোঝে। 

"আচ্ছা রাখি তাহলে।"

"আচ্ছা, " বলে রেখে দিল নিঝুম। একটুও ইচ্ছে হচ্ছিল না ফোনটা রাখতে, কিন্তু অভিমানে গলা পর্যন্ত উপচে আছে নিঝুমের, অরণ্যর দায়সারা ফোনে তাই আর কথা বলতে ইচ্ছে হলো না ওর।

আজ অনেকদিন পর একা শুতে হবে নিঝুমকে। অরণ্য নেই, কেমন একটা শূন্যতা গ্রাস করতে লাগল নিঝুমকে।

নিঝুম নিজেই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, কি হয়েছে অরণ্য গিয়েছে তো? অরণ্য আসার আগেও তো ও একাই ছিল। তখন তো এমন হতো না,তবে আজ কি হলো? তখন পারলে আজও ও  পারবে। আর নিঝুম অরণ্যকে ফেলে যায়নি, অরণ্য ওকে ফেলে রেখে গিয়েছে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও খাবার গলা দিয়ে নামল না নিঝুমের।শেষ পর্যন্ত না খেয়েই বালিশে মাথা গুঁজল ও।

..................................

"শোনো, কোন একদিন

আকাশ, বাতাস জুড়ে রিমঝিম বরষায়

দেখি, তোমার চুলের মত মেঘ সব ছড়ানো

চাঁদের মুখের পাশে জড়ানো

মন হারালো, হারালো, মন হারালো

মন হারালো, হারালো, মন হারালো

মন হারালো, হারালো, মন হারালো

মন হারালো, হারালো, মন হারালো

সেইদিন "

পরদিন বিকেলে সবাই ওরা ছাদে বসে আছে। অয়ন সব পিচ্চিদের নিয়ে গানের আসর বসিয়েছে। নিঝুম আসতে চায়নি বলে আশুকে দিয়ে জোর করেই ওকে ডেকে আনিয়েছে অয়ন। না পেরে নিঝুম মাদুরটার  এক কোনায় চুপ করে গিয়ে বসল। ধীরে ধীরে মুরুব্বী দুই একজনও এসে বসল ওদের পাশে।

গানটার জন্যই কিনা কে জানে, আকাশের কোনে সত্যি সত্যি একটু একটু করে মেঘ জমছে। অয়ন চমৎকার  গান গাচ্ছে, কিন্তু নিঝুমের সেটা কান দিয়ে ভাল করে ঢুকছে না। ওরা ঢাকায় কবে যাবে, সেটাই এখন ওর মাথায় ঘুরছে। সারারাত এক ফোঁটা ঘুম হয়নি নিঝুমের। সকালে ওঠার পর থেকে আসমা আন্টির থমথমে মুখটা দেখে মনটা আরও খারাপ হয়েছে ওর। অরণ্য এভাবে যাওয়াতে আন্টিও খুব রেগেছেন কিন্তু তাতে অরণ্যর কি? সে তো দিব্যি হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে আর অরণ্যর ভাগের সব বকা আজ অয়ন খাচ্ছে।

অয়নকে বকা দিয়ে আন্টির রাগ হয়তো একটু কমেছে কিন্তু নিঝুম কি করবে? কালকে নদীর পাড়ে গিয়ে যে আনন্দটুকু হয়েছিল সবটুকু অরণ্য নিজের সাথে নিয়ে চলে গেছে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়া এখন নিঝুমের কাছে আর কিছুই বুঝি বাকী নেই।

এক সময় সত্যি সত্যি চারদিক অন্ধকার করে কালো মেঘের দল উড়ে চলে এল। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হতেই বড়রা সবাই  হুটোপুটি করে নিচে ছুটল। কারও টানা বারান্দায় কাপড় শুকাতে দেওয়া, তো কারও আবার আচার তুলতে হবে। 

ছোটরাও সবাই নিচে যাবার জন্য ব্যাস্ত এমন সময়  গানের  নতুন কলি শুনে থমকে গেল সবাই। কেউ একজন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছাদে উঠে আসছে। স্বরটা একদম নতুন।

"আরো একদিন

তামসী তমস্বিনী রাত্রি

ঘুম ঘুম, নিঝঝুম-

জীবন পথের সব যাত্রি

আমি একেলা

চলেছি নিরুদ্দেশ যাত্রি

রাতজাগা একপাখি

শুনি জীবনজয়ের গীতগাত্রি

মনে হল মোর দুখরাতে

যেমন করে ভোলাতে

মন হারালো, হারালো, মন হারালো

সেইদিন"

গানটা শোনার সাথে সাথে নিঝুমের চারপাশে হাজার ফুলের মেলা শুরু হয়ে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার আকাশটা  দারুন রোমান্টিক মনে হতে লাগল। বৃষ্টিতে মাখামাখি লোকটাকে দেখে নিঝুমেরও ওদের সাথে গলা মিলিয়ে গাইতে ইচ্ছে হলো....

"আরও একদিন

আমার খাঁচার পাখি চন্দনা

গীতহীনা, আনমনা,

কি যে ভাবে বসে তা জানি না।

সন্ধ্যাবেলায়

হঠাৎ ঘরেতে ফিরে দেখি

উড়ে গেছে, চলে গেছে

আমার খাঁচার পাখি চন্দনা

মনে হল মোরে পিছে ফেলে

যেদিন তুমি চলে গেলে

মন হারালো, হারালো, মন হারালো

মন হারালো, হারালো, মন হারালো

সেইদিন "

(গীতিকার... সলীল চৌধুরী)

অরণ্যকে দেখে কখন রাগ অভিমান ভেঙ্গে ঐ পথটুকু পাড়ি দিল নিঝুম... ও নিজেও জানে না।
অরণ্যর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তেই ওকে দুহাতে বন্দী করে নিল বর্বর লোকটা, বুকের সাথে মিশিয়ে নিল মুহূর্তেই।

কিন্তু সেই মুহুর্তে পাশ থেকে টিটকিরির শব্দে  কেউ বলে উঠল," ভাইয়া তোর ঝুমঝুমিটা তো ভীষন বেহায়া, একদম সেল্ফ রেসপেক্ট নেই।"

চলবে......

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top