১৪
#লুকোচুরি
#পর্ব_১৪
হাতরে হাতরে পাশের বালিশটা টেনে কানের উপর দিল নিঝুম। ফোনের রিং টোনটা খুব বিচ্ছিরি লাগছে। একটা আছাড় মেরে ফেলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে নিঝুমের। ওর আরামের ঘুমটার দিল চৌদ্দটা বাজিয়ে। উঠে বসে কলটা কাটতে যেয়ে কলার আইডি দেখে থেমে গেল ও। অরণ্য....। সাথে সাথে চারদিকটা ভাল করে দেখল নিঝুম। অরণ্য... অরণ্য কোথায় গেল?
ফোনটা তখনও ওর হাতের মধ্যে বাজছে। কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভারী কন্ঠস্বরটা ভেসে এল,
" আমার ঘুম পরীটার ঘুম কি ভাঙ্গল?"
"আপনি কই?"
"সরি বউ, একটা আর্জেন্ট কাজে বের হয়ে আসতে হলো। তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় এত কিউট লাগছিল যে, ঘুমটা আর ভাঙাতে ইচ্ছা হলোনা।"
"তাই বলে আমাকে না বলেই," অভিমানে গলাটা বুজে এল নিঝুমের.. কথাটা শেষ করতেই পারলনা ও।
"সরি, আচ্ছা ফোন যে জন্য করলাম সেটা শোনো আগে।"
"আমি শুনব না আমার মন খারাপ, " নিঝুমের মনটা আসলেই খারাপ হয়ে গেছে। কেন চলে গেল লোকটা ওকে রেখে? এখন ওর অরণ্যকে কি ভীষন দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। ওর মুখটা ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। অরণ্যকে ওর এক্ষুনি চাই। এক্ষুনি...এক্ষুনি। এক্ষুনি ওকে জড়িয়ে না ধরলে ও মরে যাবে।
"ঝুম... আমার কথাটা আগে শোনো একবার, তুমি আমার লক্ষী বউ না বলো?" অরণ্য সময় নিয়ে আস্তে আস্তে কথা গুলো বলল। আসলে চাইলেও হয়না। পরের চাকরি করা লোকের এসব শখ থাকতে নেই আর এখন একদিনও কারন ছাড়া ছুটি নিতে চায়না অরণ্য। নানুবাড়ি বেড়াতে গেলে এমনি কিছু ছুটি নষ্ট হবে, তার উপর বিয়ের সময় আবার ছুটি। এতদিন ছুটি পাওয়া সম্ভব না ওর পক্ষে... কর্তৃপক্ষ ঠিক কথা শুনিয়ে দিবে।
কিন্তু নিঝুমকে প্রতিদিন বুকের মধ্যে নিয়ে শোয়াটা এমন নেশার মতো হয়ে যাচ্ছে ওর যে এখন ঝুমকে ছাড়া এক রাত থাকতেও পারে না অরণ্য। ঝুমের চুলের রাজ্যে নাক ডুবিয়ে না দিলে, ওই আদর আদর গন্ধটা নিজের ফুসফুসে ছড়িয়ে না দিলে... অরণ্যর মন আর শরীর কোনটাই ঠান্ডা হয়না। নিঝুম প্রথম দিকে যেমন দূরে দূরে থাকত এখন সেই নিয়মটা কেমন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। আগে দূরে বসলেও জড়সড় হয়ে বসত আর এখন কাছে থাকলেও ওর চোখ, নাক, চুল সব হাত দিয়ে দিয়ে দেখে। কি দেখে তা আল্লাহ মাবুদই জানে.....
অরণ্য যদি জানতে চায় কি দেখছ, তখনই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে কিছু না। এখন আবার জেদ ধরাও শিখছে। আগে খালি লজ্জা পেত, বউ হওয়ার পর থেকে কেমন যেন পাগলি হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা,খালি কথায় কথায় জেদ করে।
"না, আমি শুনব না। আমাকে না বলে চলে গেলেন কেন আপনি? আপনি আমাকে একটুও পছন্দ করেন না, আমি জানি।"
নিঝুমের প্রত্যেকটা কথায় অভিমান গুলো কেমন ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে। অরণ্যর কষ্ট হয়। বউ তার বড্ড চাপা মনের। অরণ্যর হঠাত নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হয়। ও প্রতিদিন নিঝুমকে দেখতে যাচ্ছে নিয়ম করে এটা ঠিক, কিন্তু নিঝুমের ভিতরের নিঝুমটা তো এখনও ওর অচেনা। আর নিঝুম যদি অভিমান করে একবার নিজেকে একটা শক্ত খোলসে আটকে ফেলে তাহলে জনমভর কেবল একটা সুখি মানুষ সেজে থাকার অভিনয় করে যাবে। অরণ্য সেটা একদমই সহ্য করতে পারবেনা।
"ঝুম....সোনা," অরন্য কি বলবে বুঝতে পারেনা। কাছে থাকলে মাথায় হাত বুলিয়েই মাফ পাওয়া যায়। কিন্তু দূর থেকে সব কিছু খুব কঠিন। কিন্তু আজ অরণ্যর কাজের চাপ অনেক বেশি। বিশেষ একটা তদন্তের কাজে পার্থ আর ও আজ ঢাকার বাইরে থাকবে সারাদিন। ফোন বন্ধ থাকবে হয়ত অনেক সময়। এই কথাটা জানাতেই ফোন দিয়েছিল এখন কিন্তু বউতো ওর কোন কথাই শুনছে না।
"না " নিঝুম অবুঝের মতো জিদ ধরেই থাকে। অভিমানে কান্না পাচ্ছে ওর।
এবার ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়।
"ঝুম... আমাকে ভুল বুঝনা বউ ৷ তোমাকে ওভাবে ছেড়ে আসতে আমার অনেক কষ্ট হয়। আর তাই প্রতিদিন তোমাকে আবার একটু খানি দেখতে অতটা পথ উল্টো ঘুরি। এখন আমার প্রফেশনটাই এমন যে, আসলে কাউকেই খুশি রাখা সম্ভব হয় না। সৎ থাকতো টাকা নাই, অসৎ হওতো বেহেশত নাই, ঠিকমতো ডিউটি কর তো পরিবার সাথে নাই। আসলে প্রফেশনে ঢোকার আগে এত কিছু ভাবি নাই। খালি রিস্ক আছে তাই ভাবছি। তো রিস্ক নিয়েই তো দুনিয়ায় আসছি। মার পেটেই মরে যেতে পারতাম৷ জমজ বাচ্চারা প্রায়ই বিভিন্ন সমস্যায় ভোগে। আমি কিন্তু হওয়ার পর খুব দুর্বল ছিলাম অয়নের তুলনায়। অনেকেই বলছিল বোধহয় বাঁচবে না। তাই রিস্ক নিয়ে চিন্তা করি নাই। কিন্তু এখন যতই তোমার সাথে জড়াচ্ছি ততই ভয় হচ্ছে। আমি বোধহয় তোমাকে কখনো খুশি রাখতে পারবোনা। ইতিমধ্যেই নানা ভাবে তোমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলছি," অরণ্যর কথায় নিঝুমের ঘুমের রেশটা এবার পুরোপুরি কাটল।
অরণ্যর কি কোনো কারনে মন খারাপ? এমন কথা কেন বলছে? ওকে কষ্ট দিয়েছে মানে? লোকটার গলার স্বর অমন দুঃখী দুঃখী কেন শোনাচ্ছে? নিঝুমের মনে হলো নিজের গালে দুটো থাপ্পর মারে। আসলে অরণ্যর জায়গা থেকে কখনও ওকে বোঝার চেষ্টাই তো করেনি নিঝুম। ওর স্বামী হওয়া ছাড়াও লোকটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়িয়ে থাকে, তার টেনশনও থাকে, দায়িত্বও থাকে। খালি বউ নিয়ে চিন্তা করলে তো অরণ্যর চলবে না। কোথাও কোনো অন্যায় হলে, সেখানে তো ওকে যেতে হবে অন্যায়কে দমন করতে।। তাদেরকে তো বউয়ের মন খারাপ ছিলো বললে চাকরি থাকবে না।
"সরি প্লিজ, আপনি মন খারাপ করবেন না। প্লিজ আমি বুঝতে পেরেছি," নিঝুম একটু হাসার চেষ্টা করল। "আমি আসলে দুষ্টুমি করছিলাম, আপনি এতো সিরিয়াসলি নিয়েন না।"
"না... না... তুমি সরি কেন বলছ। উল্টো আমার তোমাকে সরি বলা উচিৎ। "
"একটুও না। আমি আসলে মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছি, আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করছিল না। দুঃখিত। "
"সত্যি? "
"হ্যাঁ.. সত্যি"
"তাহলে একটা কিসি দাও।"
"কি? "
"একটা চুমো দাও।"
"আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।"
"তা একটু হইছে, কালকে প্রথম খাইছি তো, লোভ এখনও যায় নাই।"
"ছি...."
"ছি!..... ছি কেন?আমার বিয়ে করা বউকে চুমো দিব তো প্রবলেম কি? আমার কাছে লাইসেন্স আছে তোমাকে ভালোবাসার।"
"ওরকম চুরির বিয়ের লাইসেন্সের কোনো দাম নেই।"
নিঝুমের এই কথায় অরণ্যর এবার সত্যিই একটু অভিমান হলো। বারবার এই ভাবে খোটা দেওয়া কি জরুরী? ওকি ইচ্ছা করে প্ল্যান প্রোগ্রাম করে ঘটনাটা ঘটিয়েছে?
"আচ্ছা থাক লাগবেনা। আর লাগলে আমি অন্য কারও কাছ থেকে ওটা ম্যানেজ করে নিব, " দুম করে রেগে কথাটা বলেই ফেলল অরণ্য। একটা চুমুই তো খেতে চাইছে... তার জন্য এত লেকচার। দরকার নাই। নিঝুম ওর জিনিসপত্র সব আলমারিতে তালা দিয়ে রাখুক। অরণ্যর আজকে এমনিতেই অনেক কাজ। তারপরও আজকে ও ইচ্ছে করেই নিখোঁজ হবে। যাবে না আজ মোহাম্মদপুর... যতো ইচ্ছা রাগ করো।
অরণ্যর কথায় নিঝুমের মনে হলো ওর পুরো দুনিয়াটা একবার চক্কর দিয়ে উঠলো। কি বলল লোকটা! ছি... ছি... এই জিনিসও ম্যানেজ করে নেওয়া যায়?
"আপনি... আপনি একটা অসভ্য আর অমানুষ ধরনের লোক। আপনার রুচি এত নিচু আমার জানা ছিল না, " ঠাস করে ফোনটা কেটে দিল নিঝুম।
ছি..! কি নোংরা একটা কথা বলল লোকটা। নিঝুম দেবে না বলেই অন্য মেয়ের কাছ থেকে ম্যানেজ করে নিতে হবে? এতই চাহিদা তার এসবের? আর এই লোকটাকে ভালোবাসে ও! নিজের উপরেই কেমন ঘেন্না ঘেন্না লাগছিল নিঝুমের।
নিঝুমের আচরনে অরণ্য পুরোই থ মেরে গেল। কি আশ্চর্যের কথা। পাগল হয়ে গেল নাকি ঝুম? ওকি সত্যি সত্যিই অরণ্যর ওই কথা বিশ্বাস করল? এগুলো যে ও অভিমান করে বলেছে, সেটা তো একটা পাগলেও বোঝে? আবারও ফোন করতে গিয়ে কলটা কেটে দিল অরণ্য। না থাক... মনটা কেমন যেন খিঁচড়ে গেছে ওর। ফোন ও কাটেনি, যে কেটেছে দায় তার। করলে করবে, না করলে নাই। ফোনটা একবার সুইচড অফ করতে গিয়ে আবার ওভাবেই রেখে দিল ও। পাগলিটা যদি আবার এক্ষুনি ফোন করে? না পেয়ে অমনি আবার কান্নাকাটি শুরু হবে। তারচেয়ে সাইলেন্ট থাক। ফোনের ভাইব্রেশনটা অফ করে দিয়ে ফোনটা আবার পকেটে ভরল অরণ্য।
..................................
"নিঝু.... " রুমানা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে খানিকটা সরিষার তেল একটা বোতলে ভরলো। মা বাড়ি থেকে পাঠিয়েছেন। একেবার ঘানিতে ভাঙ্গানো খাঁটি তেল। রুমানার বাবা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঘানি থেকে ভাঙিয়ে আনেন। বোতলটার মুখ আটকে ভাল করে মুছল রুমানা । এটা অরণ্যর মাকে দেবেন বলে মনে করেছে রুমানা। আসমা প্রায়ই বিভিন্ন খাবার ইচ্ছে হলেই বানিয়ে বানিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন নিঝুমের নাম করে। রুমানার বেশ লজ্জাই লাগছে ওসব নিতে।
"কিছু বলছ আম্মু, " নিঝুম তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসল।
"বলছি আসমা আপা তো বারবার তাগাদা দিচ্ছে, পরশু দিনই বরিশালল যেতে চায়। আশু আর আমার ব্যাগ রেডি করে ফেলেছি। তোর আব্বুর ব্যাগও গুছিয়ে রেখে দিয়েছি। এখন তুই তোর কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিলেই হয়।"
তাইতো, নিঝুমের এতক্ষণে খেয়াল হলো ওর কাপড় গোছাতে হবে। সকাল সকাল ওই লোকের সাথে ঝগড়া করে মাথা থেকেই বের হয়ে গিয়েছিল গোটা ব্যাপারটা। তাড়াতাড়ি ঘরে এসে নিজের ছোট্ট ট্রাভেল ব্যাগটা বের করল নিঝুম। অরণ্যকে জিজ্ঞেস করতে হবে, ওর নানুবাড়িতে নদী আছে কিনা... ওর নদীর পাড়ে ঘুরতে খুব ভালো লাগে।
এখনই শুনি... বলেই অরণ্যকে ফোন দিল নিঝুম। অরণ্যর ফোন বাজল কিন্তু রিসিভ হলো না। নিঝুম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল এগারটা পঁচিশ বাজে। বোধহয় ব্যাস্ত আছে। দশ মিনিট পর আবার ফোন দিল ও। কিন্তু এবার নট রিচেবল আসল। নিঝুম আবার আধাঘন্টা পরে ফোন দিল। একই অবস্থা। ফোনের পর ফোন বেজেই যাচ্ছে কিন্তু ফোন কেউ ধরছেনা।
------------------------------
নিঝুমের এখন কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া বোধহয় সহজ। লোকটা সেই সকালে কথা বলেছে আর এখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। সে একটাবার ফোনও করে নাই ওকে আর না ওর ফোন রিসিভ করেছে। দুপুরের পর থেকে নিঝুমের শরীর আর চলছে না। একদম মরার মতো পড়ে আছে ও বিছানায়। এরকম হলে ও এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে।
" আমাকে একবার জড়িয়ে ধর প্লিজ,একবার আমার ফোনটা ধর," বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল নিঝুম। "আমি আর রাগ করব না ওসব কথায়।"
কিন্তু অরণ্যর ফোনটাও যেন আজ মরে গেছে।
"এই আপু খেতে আয়, আম্মু কত মজা করে পুডিং বানিয়েছে আর তুই সেই বিকেল থেকে কেমন দম মেরে পড়ে আছিস,এক্ষুনি চল।"
"আশু প্লিজ বিরক্ত করিস না তো, আমার ক্ষিধে পায়নি । তুই খা যেয়ে। "
" আশ্চর্য তো এরকম করছিস কেন? জিজু কিছু বলেছে নাকি?"
আশুর কথায় এবার যেন গরম তেলে পানি পড়ল৷ এতক্ষণের জমান রাগ আর দুশ্চিন্তার পাহাড় উগরে দেওয়ার একটা রাস্তা পেল নিঝুম।
" কেন, ওই বদমাইশ লোকটা কি বলবে... হ্যাঁ? আর আর ওই লোক কিছু বললেই আমার তাই মানতে হবে নাকি? এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে যা আশু, আমার মন মেজাজ ভাল নেই,প্লিজ।"
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মার বকা খেয়ে নিচে এসে খেতে বসতে হলো নিঝুমকে। গলা দিয়ে কিছু নামছে না আর মার বকার ভয়ে কিছু বলতেও পারছেনা ও। কি বলবে? অরণ্য ফোন ধরছে না।
তখন মায়ের উত্তর হবে.. অরণ্য একটা ছেলে মানুষ, তার অনেক জরুরী কাজ থাকে। সারাক্ষণ খালি ফোন করতে থাকলে সেই জরুরী কাজগুলো সে করবে কখন? নিঝুম নিজেও সেটা জানে। কিন্তু ওর মন এমন অস্থির হলে ও কি করবে? এই মুহূর্তে অরণ্যর কাছে যাওয়ার মতো কোন অপশন ওর জানা থাকলে ও কোন সময় চলে যেত। ইশশ চাইলেই যদি সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়া যেত....
ঘন্টার পর ঘন্টা কারো সাথে যোগাযোগ না রাখার রেকর্ড অরণ্যর আছে। ওর বাসার লোকেরা এখন এতে অভ্যস্ত। কিন্তু নিঝুমের ভীষন কষ্ট হচ্ছে। অরণ্য ওকে বলে নিয়ে যদি যোগাযোগ না করত তাহলে কষ্ট কম লাগত হয়ত ওর। কিন্তু অরণ্যতো ফোন ধরছেই না। আর কতক্ষন এভাবে থাকলে বোধহয় পাগল হয়ে যাবে নিঝুম।
"হৃদয়ে লুকোনো
এ মনে সাজানো
যত কথা হয়নি বলা
স্বপ্ন দেখা সেই স্বপ্নপরীর সাথে
কবে হবে পথচলা"
"খাবারটা খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। আমি আসমা আপাকে ফোন দিয়েছিলাম একটু আগে। অরণ্য আজ ঢাকার বাইরে একটা কাজে গিয়েছে, বাসায় ফিরতে ভোর হয়ে যেতে পারে। সকালে অফিসে গিয়ে জানিয়েছিল আপাকে। কারও ফোন নাকি আজ সে ধরতে পারবেনা আর ফোন একদম সাইলেন্ট থাকবে। দুশ্চিন্তা করতে মানা করেছে আপাকে," রুমানা বাকি খাবারগুলো ফ্রীজে তুলতে তলতে বললেন।
" আর তোমার এখনই এতো দুশ্চিন্তা করতে হবেনা। ওগুলো বিয়ের পরে করো... এখন ওর পরিবার আছে, এটা তাদের দায়িত্ব। "
রুমানা একটু বিরক্তির স্বরে কথাগুলো বললেন। অরণ্য পুলিশ অথচ মেয়েটা সেটা বুঝতেই চাচ্ছে না। সারাদিন ফোন কানে দিয়ে ঘুট ঘুট করতেই থাকে।
নিঝুমের খাওয়ার রুচি এবার পুরোপুরি চলে গেল। ভোরে ফিরবে! এখন মাত্র রাত নয়টা বাজে। আরো সাত আট ঘন্টা মানে ওর জন্য লক্ষ লক্ষ সেকেন্ড। ও আজকে মরে যাবে শিওর। অরণ্য আসলেও ওর মরা লাশই দেখবে আজ।
খাবারটা অসম্পূর্ণ রেখেই উঠলো নিঝুম। আম্মুকে এখন পুরোটা বলে বোঝানো সম্ভব না। অরণ্য শুধু একটা ছেলেমানুষ তো নয় ওর কাছে এখন। অরণ্যর প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে ওর নিজের নিঃশ্বাস আটকে আছে। ও কি করে অরণ্য না ফেরা পর্যন্ত স্বস্তি পাবে। উপর থেকেই নিঝুম শুনতে পেল আব্বু বাসায় ঢুকল। আম্মু সাথে সাথে কি কি যেন সব বলছে। নিঝুমের আর শুনতে ইচ্ছে করলনা সেসব কথা। দরজাটা আটকে দিয়ে, জানালার কাছ ঘেষে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল ও। সকালে ফালতু এক বিষয় নিয়ে ঝগড়া করেছে তারই শাস্তি এগুলো, নিঝুম বুঝতে পেরেছে। শয়তান ব্যাটা আগে আসুক, ওর চুমু খাওয়া একদম সুদে আসলে বুঝিয় দিবে নিঝুম।
..........................................
" নিঝুম "
মায়ের দরজা ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভেঙে গেল নিঝুমের। চোখ মেলতেই দেখে রোদ একদম জানালা দিয়ে ওর বিছানায় এসে পড়ছে। তারমানে তো সকাল হয়ে গেছে! নিঝুম সাথে সাথে ওর মোবাইলটা চেক করল। নাহ একটাও মিসড কল নাই। তারমানে কি? এখনও ফিরে নাই অরণ্য?
ভয়ের একটা ঠান্ডা অনুভূতি নিঝুমের গা বেয়ে শিরশির করে নেমে গেল। অরণ্যর কিছু হলো না তো? নিঝুম কার কাছে খোঁজ নিবে এখন? আন্টিকে জিজ্ঞেস করবে ফোন দিয়ে? নাকি অয়নকে বলবে? ওরা তো নিশ্চই জানবে ওর অরণ্য এখন কোথায়।
কিন্তু অয়নের নাম্বার তো ওর কাছে নেই। চট করে মনে পড়লো অয়নের ফোন নাম্বার আশুর কাছে আছে। আশু প্রথম দিনই নিয়ে নিয়েছিল অয়নের কাছ থেকে। নিঝুমকেও নিতে হবে এক্ষুনি... ও তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নামল। আশুর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে ডায়াল করতেই অয়নের গলার স্বরটা ভেসে আসল। ওর গলাটা শুনে এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো, জানে পানি আসল নিঝুমের। দুই ভাইয়ের গলার স্বরেও মিল অনেক বেশি। তবে অরণ্যর গলার স্বরটা একটু ভারী বেশি।
"কি ব্যাপার ঝুমঝুমি? আজ সূর্য উঠতে যেয়ে দিক ভুলে গেছে নাকি?"
"সরি আসলে অরণ্য ফোন ধরছে না, ওকি বাসায় ফিরেছে?" মিনমিন করে জানতে চাইল নিঝুম। এতোদিনে আজ প্রথম অয়নকে ফোন করল ও,তাও আবার নিজের প্রয়োজনে। খুব অস্বস্তি লাগলো নিঝুমের নিজের কাছেই।
"ভাইয়া? ভাইয়ার সাথে তো লাস্ট কথা হয়েছিল রাত এগারটার দিকে। আমি তো তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর এখন তো ব্যাংকে চলে এসেছি। বাসায় মাকে ফোন দিয়ে দেখো, না পেলে অফিসে চলে গেছে। কিছু একটা নিয়ে খুব ব্যস্ত আছে সে।"
"ওহ.. আচ্ছা, থ্যাংকিউ। আমি দেখছি।
কানেকশনটা কেটে দিয়ে থম মেরে বসে রইল নিঝুম।
অরণ্যর সাথে রাত এগারটায় কথা হয়েছে অয়নের। তারমানে নিঝুমের কলগুলো অরণ্য ঠিকই দেখেছে। কিন্তু তারপরও একটা কল ব্যাক দেয়নি ওকে। কালকে সকালে নিঝুম কি বলেছে, তাই ধরে বসে আছে সে এখনও। সারারাত ওকে শাস্তি দিয়েও অরণ্যর হয়নি। বুকটা অভিমানে ভারী হয়ে এলো নিঝুমের। তারমানে শুধু ওই সব বাজে জিনিসগুলোই ম্যাটার করে অরণ্যর কাছে! আর নিঝুম যে জান দিয়ে ভালোবাসে অরণ্যকে তার কোনো মূল্য নেই... তাই তো?
জানালায় পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কিছুক্ষন কাঁদল নিঝুম।
"চলার পথে পথে
দু'চোখের ইশারাতে
এই মন কাকে খোঁজে
বুঝিনা কেনো তার এই লুকোচুরি
কেনো তার এতো ছলনা
মন আশায় দোলে
তার আশায় আশায়
তবুও সে তো ধরা দিল না"
"না আর কাঁদব না। ওই লোকের কাছে আমার চোখের পানির কোনো দাম নেই। আসতে না পারলো, একটা কল তো করতে পারতো, " চোখের পানি মুছে বিরবির করতে করতে বাথরুমের দরজাটা ধাক্কা দিল নিঝুম। কিন্তু দরজাটা এতো শক্ত হয়ে এটে গেছে যে ওর হাতের সামান্য ঠেলাতে সেটা এক চুলও নড়লো না।
পরপর দুই তিনবার ধাক্কা দিয়েও খুলছে না দেখে এবার সর্বশক্তি দিয়ে একটা ধাক্কা দিল নিঝুম।
শক্তি প্রয়োগের মাত্রাটা এত বেশি ছিল যে নিঝুম তাতে শুধু হুমড়ি খেয়ে বাথরুমের ভিতরে পড়েই গেল না, সাথে সাথে ভয়ে একটা চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
"তুমি কি পাগল?"
নিঝুম ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বক্তার মুখের দিকে। সামনে অরণ্যকেই তো দেখা যাচ্ছে... তাই না ? বার কয়েক চোখ পিটপিট করল নিঝুম। ঠিক অরণ্যই তো। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে ওকে। নাহলে আজ ঠিক কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটত। অরণ্যর মুখ ভর্তি ফেনা, ওই যে ছেলেদের রেজারের বিজ্ঞাপনগুলোতে যেমন থাকে। চারদিকটা গাঢ় নীল আর মুখ ভর্তি মেঘের স্তুপের মতো সাদা ধবধবে ফেনা। আচ্ছা... অরণ্য বোধহয় দাড়ি কাটছিল। পুরো বাথরুম জুড়ে কেমন ছেলেদের পারফিউমের তীব্র গন্ধ।
কিন্তু নিঝুম এতো হ্যালুসিনেশন দেখছে কি করে?
কিন্তু পারফিউমের গন্ধটা! ওটা তো নিঝুমের নাকে মোটামুটি ইঁদুরের নাচ শুরু করে দিয়েছে। নিঝুমের হাঁচি শুরু হলো বলে। আর অরণ্যর হাতের চাপটা... ওটাতো আর মিথ্যা হতে পারেনা।
"আপনি, আপনি কখন এলেন? আর বাথরুমে কি করে এলেন?" নিঝুম বড়ো বড়ো চোখে জানতে চাইল। ওর বিস্ময়ের সীমা তখন নভো মণ্ডলীর কাছা কাছিতেই আছে।
"আমার দুটো পা আছে ঝুম... তাই বিছানা থেকে নেমে পা দিয়ে হেঁটে হেঁটেই এলাম। কেন?"
"তারমানে... তারমানে আপনি রাত্রে এসেছেন?" নিঝুমের এতক্ষণে মনে পড়ল। তাইতো, ও তো রাতে জানালার পাশে বসে কাঁদছিল। বিছানায় এলো কি করে?
"তা আর বলতে। কি ঘুমই যে ঘুমাও। রাত একটার দিকে এসে দেখি ম্যাডাম জানালা ধরেই ঘুমাচ্ছে, " অরন্য বলছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।
অরণ্যর কথায় রাগ দেখাতে গিয়েও রাগতে পারলনা নিঝুম। আসলে ওর একেতো ভালো করে বিশ্বাস হচ্ছে না যে অরণ্য সত্যি ওর সামনে দাঁড়ান। আর লোকটা রাত্রে ওর কাছে চলে এসেছে, রাগ করে আসা বন্ধ করে নি আর সেই আনন্দে ওর চোখের দুকূল ছাপিয়ে পানি আসছে, কিন্তু কান্নাটা ও লুকাতে পারছেনা। টপ টপ করে পানি পড়েই যাচ্ছে।
অরণ্য মনযোগের সাথে মুখ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দাড়ি কাটছে। নিঝুম হা করে সেটা দেখছিল। এই মুহুর্তে অরণ্য শুধু ওর বড়ো তোয়ালটা পেচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাড়ি কাটার জন্য ওর হাতের পেশীগুলো বারবার ওঠানামা করছে। বেশ একটা ছন্দের মতো মনে হচ্ছে। নিঝুম লজ্জার মাথা খেয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল, ওর নড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না।
"কি ব্যপার বউ? তোমার লজ্জা টজ্জা আজকাল কমে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।"
"মোটেই না, আমি তো মুখ ধোব বলে দাড়িয়ে আছি," নিঝুম চোখ সরাল সাথে সাথে। অসভ্য একটা লোক।
"ইশশ... তাহলে আমি এই সরে দাঁড়াচ্ছি, তুমি মুখ ধোও।"
অরণ্য বেশ বুঝতে পারছে বউ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে একভাবে, তাও স্বীকার করবেনা। মিথ্যুক একটা...
"না না আপনি আগে কাজ শেষ করুন। "
"তোমার বিরক্ত লাগবে না তো?"
"না না বিরক্ত কেন লাগবে?"
" ধন্যবাদ "
" ধন্যবাদ... ধন্যবাদ কেন?"
এবার অরণ্য ঘুরে দাঁড়াল। মুখে এক ঝাঁক হাসির পায়রা... শান্তির দূত।
" রাত্রের কিসটায় খুব মজা পাইসি বউ।"
"কিস! কিসের কিস, কে খাইল, কার কাছ থেকে খাইল অরণ্য?"
" মন খারাপ করো না, অন্য কারো কাছ থেকে খাইনি, তুমিও ভাগীদার ছিল।"
নিঝুমের একটু মন খারাপ হলো এবার। ওকে না জানিয়ে ব্যাটা কিস খেয়েও ফেলল। ওর জন্য একটু অপেক্ষাও করা গেল না? ওকি দিত না নাকি? না থাক আজকে নিঝুম কিছু নিয়েই অভিমান করবে না। কথা না বললে শেষে ওরই কষ্ট হয়। ওই লোক দিব্যি থাকতে পারে দেখা হয়ে গেছে নিঝুমের।
"কি মন খারাপ হচ্ছে? আমি কিন্তু কিছু করিনি বউ, যা করার তুমি করেছ।"
কি বলে এই লোক! নিঝুমের চেহারা পলকের মধ্যে ভিজে বেড়ালের মতো হয়ে গেল।
"সত্যি বলছি। আমি বিছানায় নিয়ে তোমাকে শুইয়ে দিতেই তুমি বিরবির করে বললে, আজকে অনেকগুলো কিসি দিব। দশ হাজারটা। কিসি দিতে দিতে মেরেই ফেলব। তো আমরা বোধহয় তিন চারটার বেশি এগুতে পারিনি, তার আগেই মরার মতো ঘুমিয়ে গেছি। "
নিঝুম নাক কান লাল করে কথাগুলো শুনল।
অরণ্যর হাসি মোটে থামছে না। নিঝুম দ্রুত বাথরুম থেকে বেরুবার রাস্তা খুঁজতে লাগল। এই লোক অনেক খারাপ। কিন্তু অরণ্য এসব দাড়ি কাটার জিনিস সাথে নিয়ে ঘোরে নাকি?
দরজার কাছে আসতেই নিঝুমের চোখ ছিটকে বেড়িয়ে আসার যোগাড় হলো। তাড়াতাড়ি দরজার পাল্লা ধরে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করল ও।
আল্লাহ কি বিপদে পড়ল ও এখন। অরণ্য বাথরুমে আর মা খাটের কাছে দাঁড়ান চায়ের কাপ হাতে। আর... মার পেছনের বেতের চেয়ারের উপর অরণ্যর ইউনিফর্মটা ছড়িয়ে রাখা।
"নিঝু তুই অত জোরে চিৎকার করলি কেন? আর তোর বাবা এই বাথরুমও ব্যবহার করে নাকি মাঝে মাঝে ? কেমন একটা আফটার শেভিং লোশনের গন্ধ পাচ্ছি।"
চলবে....
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top