১২

অরণ্য খুব সাবধানে বালিশ থেকে নিঝুমের ঝুলে যাওয়া মাথাটা আবার বালিশে তুলে দিল। বউয়ের ঘুমটা ও ভাঙ্গতে চায় না। খুব আস্তে করে নিঝুমের মুখের উপর থেকে চুলের গোছাটা সরিয়ে দিল অরণ্য। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওর নরম পদ্মরাঙা ঠোঁট দুটোর সুধা মাতাল হয়ে খানিকটা অনুভব করে। কিন্তু চোরের মতো একাজ করতে আগ্রহী নয় সে।
বিশেষ করে সেটা যখন কেবলই ওর।

তবু আলতো হাতে একটু আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিল অরণ্য কমলার কোয়ার মত নরম ঠোঁট দুটিতে।

নিজের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করছে অরণ্য... আকাঙ্ক্ষাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে। জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস টানল অরণ্য, ভীষন রকমের সংযম দরকার ওর এই মুহুর্তে। না হলে নিঝুমের ভালোবাসার কাছে ছোট হয়ে যাবে ওর ভালোবাসা। কিন্তু নিঝুমের প্রতি ওর ভালবাসাটা মেকি নয়। আর কেউ না জানুক অরণ্য নিজে তো জানে, সেটাই বা কম কি।

"নিজেকে সামলা অরণ্য," নিজেই নিজেকে কষে একটা ধমক দেয় অরণ্য। "আজ জড়িয়ে ধরতে পারছিস... তাতেই খুশি থাক, তার উপর আবার চুমো খাওয়ার সাধ। ঝুম যে বিছানায় একপাশে তোকে বসে থাকার অনুমতি দিয়েছে এই তোর জন্য চাঁদ রাত। "

মুঠোয়া ধরে রাখা নরম তুলতুলে হাতটি নিজের রুক্ষ খসখসে গালের উপর চেপে ধরে অরণ্য।

কি আশ্চর্য না? বউ বউ ডাকতে ডাকতে সত্যি বউ হয়ে গেল ঝুম ওর। কথাটা মনে হতে নিজে একা একাই হাসল অরণ্য। অথচ কাল সকালে ওরা দুজন যখন ঘর থেকে বের হয়েছিল তখন ঘুনাক্ষরেও কেউ জানত না যে, আজ থেকেই ওদের দুজনের জীবনটা এক সুতোয় আটকে যাবে।

এখন থেকে একা আমার বলে আর কোনো শব্দ নেই ওর জগতে, সব আমাদের হয়ে গেছে। অরণ্য অনেকটা সময় অপলক চোখে ঘুমন্ত পরীটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কালকের দুর্ঘটনায় নিঝুমের অনেক স্বপ্নের কবর হয়ে গেছে জানে অরণ্য । কিন্তু ব্যাপারটা আসলে ওর হাতের আওতার মধ্যে ছিল না।

কাল যখন অরণ্যর হুশ হলো তখন মেয়েটা কোনমতে গায়ে কাপড় পেচিয়ে বসে আছে। ঝুমের দুচোখ ভরা পানি আর ওর জন্য একরাশ ঘৃনা। ঠিক ওই মূহুর্তে একবার প্রচন্ড রাগও হয়েছিল অরণ্যর নিঝুমের প্রতি... এত অবিশ্বাস!

কিন্তু নিজেকে দ্রুত সামলেও নিয়েছে অরণ্য। যতই ভালোবাসুক, বিয়ে নামের অধিকার নামাটাই যে নেই ওর আর ঝুমের মধ্যে। ও কি করে বোঝাবে ঝুমকে দেখলে ওর বুকের কানা গলিতেও উৎসবের রং লাগে। হৃদস্পন্দন ভারী হয়ে আসে। চারপাশটা কেমন নতুন সূর্যের মখমলি আলোতে মাখামাখি হয়ে যায়। আর তখন আবার নতুন করে একবার নিঝুমের প্রেমে পড়ে ও।

ঝুমকে দেখার আগ পর্যন্ত অরণ্য নিজেই এই অনুভূতির সাথে পরিচিত ছিল না। না মেয়েদের দেখে ভাল লাগতো না তাও নয়, লাগত। তাদের দেখলে গায়ে পড়ে দুষ্টামিও যে করত না তাও নয়, কিন্তু কাউকে দেখে এরকম ভাবে বুকের ভিতরে রনবাদ্য বেজে উঠেনি কখনো। সেই কাকডাকা ভোরে দু চোখের পাতা মেলে দিতেই মিষ্টি টুলটুলে একটা মায়াকাড়া মুখ দেখে আড়মোড়া ভাঙ্গা এই প্রথম। আসলে হাসপাতালে যখন ঝুম ইনজেকশন দেবার ভয়ে শক্ত করে ওর শার্টের হাতাটা টেনে ধরেছিল, ঠিক তখনই সর্বনাশটা হয়েছে ওর। কি অদ্ভুত নিষ্পাপ চেহারা মেয়েটার, চোখ দুটো ভয়ে কুঁচকে আছে, দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা আলতো করে কামড়ে ধরা। পুরো সময়টা সেদিন অরণ্যর কেমন ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে গেছে। যখন নিঝুমকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিল, তারপর থেকে প্রতিটা সেকেন্ড কি অসহ্য ছিল অরণ্যর জন্য, সেটা বোধহয় এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। অয়ন যখন ঝুমের ছবিটা দেখাল, অরণ্যর মনে হয়েছিল এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটে? ও সত্যিই চাচ্ছিল এমন কিছু একটা ঘটুক।

নিঝুমের হাতের পাতাটা উল্টে, হাতের তোলায় আস্তে করে একটা চুমু খেল অরণ্য। এটুকুতে নিশ্চই পাপ হবে না, ঝুমের অনুমতি ছাড়া দিচ্ছে বলে। এই হাতটাই দায়ী। ক্লিনিকে ওকে অমন ভাবে আঁকড়ে না ধরলে অরণ্য ঠিক এতটা ধরাশায়ী হতোনা নিঝুমের জন্য।

নিঝুমের হাতটা নাকের কাছে ধরতেই কেমন মাতাল করা একটা সৌরভ এসে অরণ্যর বুকটা ভরিয়ে দিল। আজকাল ঝুমের গায়ের গন্ধও ওকে সঙ্গ দেয় কিন্তু সেটা ঝুমকে বলা যাবে না। মনে করবে অরণ্য ওকে খারাপ কিছু বোঝাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। ওটা কেমন একটা ছায়ার মতো আজকাল অরণ্যর চারপাশে বিরাজ করে।

সোজা স্পষ্ট কথায় ঝুম ওর চিন্তা চেতনায় এমন ভাবে নিজের ছাপ ফেলেছে যে, ওই নামটা কোনোভাবে অরণ্যর কান অব্দি পৌছালে ওর সারা স্বত্তা জেগে ওঠে। আর এই অনুভূতি অবর্ননীয়। প্রকারান্তরে একে যদি ভালোবাসা বলে তাহলে, ও নিশ্চিত ভাবে ঝুমের একনিষ্ঠ প্রেমিক। এর থেকে ব্যাতিক্রম হবার কোন পথ ওর জানা নেই।

সেই ঝুমের চোখে ওর জন্য অবিশ্বাস, জিনিসটা কতটা বেদনাদায়ক হতে পারে ওর জন্য। কিন্তু ঝুমেরই বা দোষ কোথায়?

শেষ পর্যন্ত নিঝুমকে শুধু একটা অনুরোধ করেছিল ও। কাছে এসে ওর মাথাটা দেখতে, পেছনে ফুলে ততক্ষণে ছোটখাট একটা আলুর মতো হয়ে গেছে জায়গাটা। দুচোখে অবিশ্বাস আর ঘৃণা নিয়েও মাথায় হাত দিয়েছিলও নিঝুম। এটুকু সহানুভূতি বোধহয় তখনও মরেনি। কিন্তু হাত দিয়ে চমকে গিয়েছিল। মাথার চুল সরিয়ে দেখে শুধু ফোলা না সাথে বেশ খানিকটা জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সাথে সাথে অবিশ্বাসটা ঝরে পড়ে গিয়েছিল নিঝুমের। কিন্তু নতুন করে সমস্যাটা বাঁধল ওরা যখন ঘরটা ছেড়ে বের হলো। দরজার হাতল ধরে টান দিতেই যখন দরজাটা খুলে গেল হাট করে তখনই অরণ্যর বুকটা কেঁপে উঠেছিল ভীষন ভাবে।

দরজার বাইরে পা রাখতেই অজস্র ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বলে উঠেছিল এক সাথে। নিঝুম তখন ওর বুকের সাথে মিশে আছে ভয়ে আর ওর গায়ের পাঞ্জাবিটা তন্ন তন্ন করেও ওই ঘরের ভিতর কোথাও খুঁজে পায়নি ওরা।

অরণ্য তখন ভিতরে ভিতরে তৈরি হয়ে গেছে আসন্ন বিপদের জন্য। প্রফেশনের কারনে এই দিকটা সামাল দেওয়ার অভ্যাস ওর হয়েছে এতদিনে, কিন্তু এভাবে নিঝুমকে সাথে নিয়ে এত বড় জিনিস কিভাবে কি করবে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিল না ও।

বাইরের ঘরে তখন লোক গিজগিজ করছে...সাথে অজস্র ফটোগ্রাফার। যে যেখান থেকে পারছে ওদের দিকে অশ্রাব্য সব মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছে। অরণ্যর তখন মাথা কাজ করছিল না। সবাই ওর সাথে নিঝুমকে জড়িয়ে নানা রকম নোংরা কথা বলে চলেছে।

টেনে ওই লোকগুলোর জিভ ছিড়ে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল অরণ্যর। কিন্তু অরণ্য বুঝতে পারছিলনা পার্থকে ফোন দেওয়ার পরও কেন কেউ ওদের সাহায্যর জন্য আসেনি। অনেকটা সময়তো পার হয়েছে নিশ্চই।

"কি অরণ্য সাহেব, ভদ্রলোক মানুষ আপনি এইগুলা কি করলেন? মেয়ে মানুষ লাগবে বললে তো আমরা আপনাকে ফাইভ স্টারেই ব্যবস্থা করে দিতাম," বিশ্রী শব্দে হেসে উঠলো পাশে দাঁড়ান লোকটা। অরণ্য কড়া চোখে তাকাল লোকটার দিকে।

এতক্ষণে লোকটাকে চিনতে পারল অরণ্য। টোটকা মাসুদ। রাইসুলের কাছের লোক এরা। রাইসুল.. আন্ডার ওয়ার্ল্ডের কুখ্যাত লোক। সব ধরনের খারাপ কাজের সাথে জড়িত ও। হিউম্যান ট্রাফিকিং, ড্রাগ ব্যবসা, কালোবাজারী সবকিছুই আছে এর কাজের তালিকায়। অরণ্যর সাথে শত্রুতাটা পুরানো। কিন্তু ওকে ছেড়ে দিবে না সেই হুমকিটা এখনও বহাল রেখেছে জানোয়ারটা তাহলে?

"কি চান আপনারা? " অরণ্যর প্রশ্নটা যেন ঘরের মধ্যে হাসির ঝর্ণা বইয়ে দিল। যেন কত বড়ো একটা কৌতুক বলছে ও।

"আমরা? আমরা আবার কি চাইব? চাইবেন তো আপনি। না, না ভুল হলো আপনারা। এরকম যেখানে সেখানে এসে মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াবেন আপনি, আবার পুলিশের কাপড় পরে ভাল মানুষ সাজবেন, তা তো হবে না। আমরা আপনার এই নোংরা কাজের বিচার চাই। আপনার মতো জঘন্য অপরাধীকে এভাবে মুক্ত পরিবেশে আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। তা না হলে মা, বোনের রাস্তায় নিরাপদে চলা ফেরা করতে পারবেনা। "

কথাটা বলে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলো জঘন্য লোকটা।

ওদের কথায় নিঝুম অরণ্যর হাতের মধ্যেই মূর্ছা যায় এমন অবস্থা। অরণ্য তাড়াতাড়ি ঝুমকে কানে কানে বলেছিল," ঝুম প্লিজ শক্ত হও। ওরা কিচ্ছু করতে পারবে না। ওরা নিজেরাই হচ্ছে নর্দমার কীট। ওদের একটা কথাও তোমার মগজে ঢুকতে দিও না। ওরা একটা নোংরা খেলা খেলতে চাইছে আর আমরা ওদের জিততে দিতে পারিনা। আমাদের জিততেই হবে সোনা। তুমি আমার সাথে না থাকলে তো আমি হেরে যাবে, ঝুম প্লিজ। "

অরণ্যর এই কথায় তখন খানিকটা কাজ হয়েছিল।

"ম্যাডাম স্যার কি অনেক বেশি মজা দিল? "

কথাটা যে নিঝুমকে লক্ষ্য করেই বলা হয়েছে বোঝার সাথে সাথে আবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল নিঝুম। অরণ্যর খুব খুব কষ্ট হচ্ছিল নিঝুমের জন্য। এত কষ্ট ওর ঝুমকে কেউ দিচ্ছে এটা অরণ্যর সহ্যের বাইরে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওরা দুজন জানোয়ারগুলোর হাতের মুঠোয়। অরণ্যর নিজেকে এখন একটা গিনিপিগ ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। এখন ও একটা ভুল পদক্ষেপ নিলেই অনেক বড়ো সর্বনাশ হবে। কিন্তু ওর সাহায্যে কেউ আসেনি, এমন তো হতে পারে না। পার্থ ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এটা অরণ্য বিশ্বাস করতে পারছেনা।

"তোমাকে বলা প্রত্যেকটা কথার শোধ আমি তুলব ঝুম, আমার উপর বিশ্বাস রাখ। "

মনে মনে ওয়াদা করেছে অরণ্য নিজের কাছেই।

"এত্ত বড়ো অপিসার হয়ে এই রকম নোংরা কামডা এরা করে কেমনে? ছি.. আর মাইয়াডাও তো ভদ্র ঘরেরই মনে লয়। "

একজন দুইজন মহিলাও কোথা থেকে এসে জুটেছিল কে জানে... তবে এদের কথায় আবার হাসির নহর বইল ঘরের মধ্যে। মনে হচ্ছিল এটা একটা সার্কাস আর ওরা দুজন জোকার।

"দেখুন, আপনারা যা ভাবছেন সেটা ভুল। একদম ভুল। আমি এখানে একটা গুরুত্বপূর্ন কাজে এসেছিলাম। আমাকে ইচ্ছে করে ফাসান হচ্ছে। " অরণ্য ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয়। একদম কিছু না বললে এরা পেয়ে বসছে ওদের। অরণ্য খেয়াল করল রাইসুলের লোকের চাইতে এখন ঘরটাতে
সাধারন মানুষ বেশি। এটা একটু সুবিধা, অন্তত এক্ষেত্রে ওদের নাও মরতে হতে পারে।

"হয়... মাইয়া মানুষ লগে নিয়া দেশের কাম করবার আইসে স্যার," টোটকা মাসুদ অনেকক্ষণ পরে আবার কথা বলে উঠেছিল। সুযোগমতো পেলে ওর ছাল চামড়া আলাদা করবে অরণ্য। দাঁতে দাঁত ঘষে নিজের রাগটা তখন গিলেছে ও কি করে একমাত্র আল্লাহ ভাল জানেন।

"দেখুন, বাজে কথা বলা বন্ধ করুন। মেয়ে মানুষ মানে কি? সে আমার স্ত্রী। " এছাড়া অরণ্য অন্য কোনো রাস্তা দেখছিল না। হবু বললে লাভ নেই। এরা ওদেরকে তখনও এই চোখেই দেখবে।

অরণ্যর কথায় এতক্ষণে একটু হকচকিয়ে গেল লোকজন, কিছুক্ষণ এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। এরা অরণ্যর কাছ থেকে এ ধরনের কথার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না।

"কিন্তু আমরা তো জানি সে বাজাইরা মেয়ে, ওই মাসুদ ভাই.. স্যারে কি বলতেছে? "

কে একজন তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠে।

"স্টপ ইউর ননসেন্স। "

অরণ্য এইবার আর পারলনা। কিন্তু নিঝুমকে ও ছাড়তেও পারছেনা। নিঝুম এমন ভাবে ওর হাতের উপর পড়ে আছে যে মনে হয় প্রান নেই। তা না হলে ওই লোকের জিভ ও টেনে ছিড়ে ফেলত এখন।

অরণ্যর কথায় তখন ঘরের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। মেয়েটা ওর বউ হলে ব্যাপারটার উপভোগ্যতা কমে যায়। এতক্ষণ বেশ চনমনে ভঙ্গীতে যারা কথা বলছিল তারা যেন একটু দমে গেল।

অবস্থাটা বোধহয় নিজের একটু পক্ষে আসছে, এটা মনে হতেই অরণ্য তাড়াতাড়ি একজনকে নিজের মাথার আঘাতটা দেখিয়েছিল।

" দেখেন ভাই আমার অবস্থা,এই অবস্থা নিয়ে কেউ ফূর্তি করে বলেন? "

ছেলেটার বয়স বেশি না। অরণ্যর মাথায় হাত দিতেই বলে উঠেছিল, "তাই তো... উনি তো মাথায় ব্যাথা পাইছে মেলা, জায়গাটা ফুইলা রইছে।"

কিন্তু আরেক জন আবার বলে উঠেছিল, " দেখেতো মনে হয় জোর করতে গেছিল। এই নামের বউই বারি দিছে কিনা কে জানে?"

পুরো ব্যাপারটার আবার মোড় ঘুরে গেল সাথে সাথে।

শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়াল তা হলো, ওরা স্বামী-স্ত্রী হলেও ওদের এখন শাস্তি পেতে হবে।

অরণ্য পুলিশ অফিসার সেটা উপস্থিত জনতা মোটামুটি জেনে গিয়েছে, কাজেই ওদের থানায় দেওয়ার পক্ষের লোক খুব কম। কাজী ডেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই শেষ পর্যন্ত ওদের জন্য সাবস্ত হলো। অরণয় প্রথমে চেষ্টা করল বিয়ে ঠেকানোর, বললো যে ওরা স্বামী স্ত্রী তারপরও ওদের আবার বিয়ে দেওয়ার কি দরকার? কিন্তু সেই কথা কেউ কানে তুলল না। এরা ওদের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল আর সেটা হচ্ছে এখনি ধরে বেঁধে সবার উপস্থিতিতে ওদের যাত্রাপালার মতো বিয়ে হবে।

নিঝুম মনে হয় কিছু শুনছে না, কিছু দেখছে না। নিজের উপর এত ঘেন্না অরণ্যর লাগেনি আগে কখনও ৷ যে মেয়েটাকে মাথায় করে রাখতে চায়, ওর জীবনে তার আগমনটা এতই লজ্জাজনক করে ফেলল এরা যে অরণ্য এখন এদের সাথে কি করবে, কি বলবে বুঝতে পারছেনা। আন্টির কাছ থেকে কত বড়ো মুখ করে ওকে নিয়ে এসেছিল ও।

পরিস্থিতিটা এমন যে মনে হচ্ছে ও পুলিশ না,চোর। এরা ওদেরকে চোরের মতই ধরে রেখেছে প্রায়। ওর পাঞ্জাবির পকেটে মোবাইলটা ছিল, এখন তো কিছুই পাচ্ছে না। রাইসুল লোক দিয়ে এটা করাল।

রাইসুলের ছোট ভাই জাহাঙ্গীরের যখন ফাঁসি হয় তখন অরণ্যকে দেখে নিবে হুমকি দিয়েছিল রাইসুল। কারন ওই কেসে জাহাঙ্গীরের কুকীর্তির সবচেয়ে বেশি ইনফরমেশন অরণ্য দিয়েছিল। তারই ফিরতি উপহার এটা।

কিন্তু এটা কেবল তার একটা আভাস, সেটা অরণ্য ভালই বুঝতে পারছে। রাইসুল আরও ক্ষতি করবে ওর। কারন অরণ্যর দুর্বলতাগুলো এখন রাইসুলের হাতিয়ার হবে। ভীষন ধূর্ত রাইসুল। ওই কেসটার তদন্তের সময়েই অরণ্য জানতে পেরেছিল যে জাহাঙ্গীর আসলে তেমন কিছু না, মূল অপরাধী আসলে রাইসুল। কিন্তু ওর বিরুদ্ধে কোনো নির্ভর যোগ্য প্রমান এখনও জোগাড় করতে পারেনি অরণ্য, যা পেরেছে তা দিয়ে রাইসুলকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া যাবেনা।

বিয়েটা না করার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও নিঝুম অনেকবার করে ওকে অনুরোধ করেছিল, এভাবে বিয়ে করলে ওর বাবা - মা মরে যাবে শুনলে বলে কাঁদছিলও। অরণ্য সবই বুঝতে পারছিল কিন্তু এই বিশাল জনরোষের মধ্যে ও কিছু করতে গেলে যদি হিতে বিপরীত হয়। যদি ঝুমকে ওরা জোর করে আলাদা করে ফেলে অরণ্যর থেকে... তখন ওরা ঝুমকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।

আসলে অরন্যকে যে ক্ষমতার দাপট ওদের দেখানো দরকার ছিল সেটা দেখানে শেষ। এখন নিঝুম এখানে আর কেনো গুরুত্ব বহন করেনা। আর এটাই ভয়ংকর। তারচেয়ে চুপচাপ বিয়ে করে নিলে ওকে ক্ষানিক গালাগালি দিয়ে থেমে যাবে লোকজন আর নিঝুমও।

বিয়ের মুহূর্তটা মনে পড়াতে এখনও আবেগে গলাটা বুজে এল অরণ্যর। ইশশসস... নিঝুমের অনেক স্বপ্ন ছিল নিশ্চই ওর বিয়ে নিয়ে।
সব ওর বেকুবির কারনে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।

এরমধ্যে কেউ একজন দয়াপরবশ হয়ে অরণ্যর গায়ের পাঞ্জাবিটা এনে দিয়েছিল। এটা যে পুরোটাই একটা সাজানো নাটক সেটা না বোঝার কোনো কারন নেই। অরণ্যও তাই আর কোনো কথা বলেনি। তবে মোবাইলটা তখন ও পায়নি।
ওটা ওরা অরণ্যর গাড়ির পিছনের সীটে ফেলে রেখেছিল।

বিয়ের সময় ওরাই কোথা থেকে একটা কাজী ডেকে এনেছিল। অনুরোধ করে করে এক সময় নিঝুমও চুপ হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছে বাঁধা দিয়ে বা অনুরোধে কোনো কাজ আসলে হবে না। চুপচাপ যন্ত্রের মত ওরা দুজনে সই করে দিয়েছে কাবিন নামায়। স্থানীয় লোকরাই সাক্ষী হয়েছিল। নিজের বিয়েতে নিজের একটা সাক্ষী পর্যন্ত নেই, ওকে এতটা অপদস্ত করে কতটা মজা পেল রাইসুল জানে না অরণ্য।

তবে অরণ্যও মনে মনে শপথ করেছে, রাইসুলকে ছাড়বে না ও। সাপের লেজে পা দিলে তার কামড় যে খেতে হয় সেটা অরণ্যও ওকে বুঝিয়ে দিবে ঠিক সময়ে।

ওই বাসাটা থেকে ওরা যখন ছাড়া পেল, অরণ্য অবাক। এটা সেই বাসাই না। ওর গাড়িও নেই সামনে। একজনকে জিজ্ঞেস করলে বলেছিল, ওই ঠিকানা তো ভাই দুই ব্লক পরে। তারমানে অজ্ঞান অবস্থায় ওদের ওখান থেকে সরিয়ে আনা হয়েছিল।

ঠিকানা খুঁজে গাড়ির কাছে আসতেই দেখে পার্থ কিছু লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। সাথে ফোর্স নিয়েই এসেছে পার্থ।

"কই ছিলেন অরণ্যদা? আপনাকে ফোন না পেয়ে শেষে আমি নিজেই চলে এলাম, এজন্য একটু দেরি হয়ে গিয়েছে," পার্থ অবাক হয়ে বলেছিল।

অরণ্য,পার্থকে আড়ালে ডেকে পুরো ঘটনাটা জানালে পার্থও গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। রাইসুলের বিষয়টা নিয়ে ওর সাথে আগেও আলাপ হয়েছে অরণ্যর।

"আমি এখন নিঝুমকে আগে ওর বাসায় দিয়ে আসি। ওর অবস্থা খুবই খারাপ। পার্থ ভাই তোকে একটা অনুরোধ, যেভাবে হোক আর্জেন্ট ভিত্তিতে কাবিননামাটা ম্যানেজ কর। কোনোভাবেই ওটা যেন লোকের সামনে না আসে। রাইসুলের হাতে পড়ার আগেই ওটা আমার চাই। আর এই খবর যেন কোনো ভাবে না ছড়ায়। ফটোগ্রাফার গুলোকে যেভাবে হোক ম্যানেজ কর। ঝুম আত্মহত্যা করবে শিওর ওরকম হলে...প্লিজ।"

"অরণ্যদা আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, বিয়ের খবর কোন কাক পক্ষীও আর জানবে না আর যারা জানে তারা মুখ খুলবে না।পুলিশে ছুলে কত ঘা সেটা এবার মুখস্থ করাব আমি বাছাধনদের," পার্থ অরণ্যকে আশ্বস্ত করেছে আর অরন্য জানে পার্থ সেটা করবে।

"আর আমার সেই সোর্সের কি অবস্থা.. কেনো এত বড়ো বেঈমানী করল ও আমার সাথে? আমাকে এর উত্তর পেতেই হবে পার্থ, ওরা আমার লাইফটাকে একদম কার্টুন বানায় ফেলল একটা। "

"ওকে, পেয়ে যাবেন। এখন সবার আগে বাসায় যান ভাবিকে নিয়ে, আপনাদের এখন সবকিছুর আগে রেষ্ট দরকার। "

..................................................

লোকটার কষ্ট হচ্ছে না! সারারাতই বোধহয় এরকম করে বসে আছে। ইশশ... নিঝুমও বোকার মত ঘুমিয়ে গিয়েছিল। নিঝুমের এতো মাথা যন্ত্রনা হচ্ছিল যে ও না শুয়ে পারছিল না। ওর শোয়া দেখে অরণ্য মাথায় হাত ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে চেপে দিচ্ছিল। এরকমটা দেখে নিঝুম অরণ্যকে মানাও করেছিল কিন্তু অরণ্য নিজেই বলল,"মানা করোনা। আজকে সুযোগ আছে দিচ্ছি, এমন দিনও যাবে যে সাতদিনে একবারও চেহারা দেখতে পাবেনা। "

এই কথার পরে আর বাঁধা দেয়নি নিঝুম। কিন্তু ওর মধ্যেই কখন যে হু হা করতে করতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল ও, একদমই সেটা টের পায়নি নিঝুম।

আর এখন চোখ মেলে দেখে অরণ্য ওর হাত ধরেই চেয়ারে ঘুমাচ্ছে। মাথাটা চেয়ারের একপাশে কাত হয়ে আছে। মুখটা সামান্য খোলা। নিঝুমের মাথায় হঠাৎ একটা দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চাপল। খুব সাবধানে উড়নার কোনাটা প্যাচিয়ে আস্তে করে অরণ্যর নাকে ঢুকিয়ে দিতেই, ঘুমের মধ্যে হাত দিয়ে নাক ঘষতে লাগল বেচারা। শেষে হঠাৎ হাঁচি দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসল অরণ্য ঘুম থেকে।

নিঝুম এই অবস্থা দেখে কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারেনি,খিলখিল করে হেসে ফেলেছে।

"সরি সরি... "

"উহ্ " হাত দিয়ে নাক তখন ডলেই যাচ্ছে অরন্য।

"বেশি সমস্যা হচ্ছে? " নিঝুম দুই আঙ্গুল দিয়ে আস্তে করে একটু ম্যাসেজ করে দিল অরণ্যর নাকের মাথায়, " আমি রিয়েলি সরি।"

"তোমার কি সত্যি এত সরি বলার অভ্যাস আছে?" নাক টেনে বলল অরণ্য। নাক ইতিমধ্যেই লালচে হয়ে গেছে ওর।

"মানে? "

"কিছু না, বাদ দাও।। কাল আমাদের বাসায় দাওয়াত আছে তোমাদের, শাড়ি পরে আসবে কালকে?"

"আমি যাব না," নিঝুম ঝপ করে বিছানায় বসল।

"মানে... কেন? "

"এমনি আমার ইচ্ছা। "

"আমার বাসায় তোমার যেতে ইচ্ছা করে না? "

"না। "

অরণ্য কথার পিঠে কি বলবে খুঁজে পায়না। নিঝুম এমন কথা কেন বলছে?

"কি হলো? "

"কি হবে?"

"তাহলে থামলেন কেন?"

"তুমিই তো বললে তুমি যাবে না।"

"কোথায় যাব না? "

"আমাদের বাসায়।"

"আমাদের বাসায় যাব না কেন? " আমাদের কথাটা এবার বেশ জোরের সাথে উচ্চারন করল নিঝুম।

অরণ্য এতক্ষণে নিঝুমের আপত্তির কারন বুঝল। তারমানে দুষ্টুমি হচ্ছিল। দাঁড়াও..।

"তাহলে আমাদের রুমে কালকে আসছ? " অরণ্য একদম গোবেচারা মুখ করে বলল।

"হুম.. না.. না,রুমে যাব না। "

"কেন..? "

"এমনি। বিয়ের আগে যাবো না।"

"বিয়ের আগে যাবা না? "

"না...."

" আচ্ছা.. তাহলে এখন উঠি। তোমার ওয়াশরুমটা একটু ইউস করব? "

" নিশ্চই " নিঝুম অনায়াসে অনুমতি দেয়। সেইদিন আর আজকের মধ্যে যে অনেক তফাত।

"ঝুম? "

"হু...."

"আমি তোমার টুথব্রাশটা একটু ইউজ করব?আমার সাথে কোনো ব্রাশ নেই।"

অরণ্যর এমন প্রশ্নে এবার লাল হয়ে উঠে নিঝুমের গাল দুটো। কি মুশকিল... এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবে ও এখন?

চলবে....

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top