১ম পর্ব

মায়ের কথার অবাধ্য নিঝুম একেবারেই নয়, কিন্তু পানি এখন ওর ধারনার চাইতেও অনেক উপর দিয়ে বইছে আর সেটা যথেষ্ট ঘোলাও বটে। চুপিসারে সটকে পড়তে পারলে ভালো হতো কিন্তু এখন আম্মু দেখে ফেলেছে, কাজেই সেটাও এখন আর সম্ভব না।

অনেক ভেবে অদীয়াকেই একটা ফোন দিলো নিঝুম। যে কোনভাবেই হোক ওকে আজ এই ভেজাল থেকে উদ্ধার পেতে হবে। মনে মনে ভীষন রাগ হচ্ছে নিঝুমের, ভাবে আজকের বিকেলটা যদি কোনরকমে বাইরে কাটানো যায় তাহলেই কেল্লাফতে। হাতি ঘোড়া চেপে বিয়ে করার শখ তোর উড়ে যাবে ব্যাটা।

"নিঝুম আজ ভার্সিটি না গেলে তোর হবে না?" রুমানা মেয়ের কাছে জানতে চাইলেন।

"না মা, আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস আছে। না গেলে স্যার খুবই রাগ করবেন। গত ক্লাসে স্যার বার বার করে সবাইকে বলে দিয়েছিলেন আজকের ক্লাসে উপস্থিত থাকার জন্য।"

নিঝুম নিজের  মাথার সিঁথিটা আয়নায় দেখে আগের চেয়ে আরও একটু ডানে কাটে। ওর চুলগুলো মোটামুটি ভালই লম্বা। সমুদ্রে আছড়ে পড়া উত্তাল ঢেউয়ের মতোই সেগুলো ওর সরু কটিদেশ ছাড়িয়ে আরো নিচে নেমে গেছে।

মেয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রুমানা।

"কিন্তু তোর বড়ো ফুপু ফোন করে জানালো ছেলে পক্ষ নাকি আজই তোকে দেখতে আসবে।"

কথাটা বলে রুমানা অসহায়ের মতো মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মেয়ে তো নিজের মতো বাইরে যাবার জন্য রেডি, ওদিকে বড়ো ননদ যে এসেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করবে তার কি হবে?

আসলে নিঝুমের বড়ো ফুপু নিজে ছেলের বাবার সাথে বিশেষ ভাবে পরিচিত। উনি নিজে একসময় সড়ক ও জনপথ বিভাগে চাকরি করতেন। ছেলের বাবাও ওইখানে চাকরি করতেন। সেই ভাবেই বোধহয় পরিচয়। ছেলে তিনবছর হলো চাকরিতে ঢুকেছে। এখন ওনারা ছেলে বিয়ে দেবেন দেখে ভাল মেয়ে খুঁজছেন। নিঝুমের ফুপু শুনে আর দেরী করেননি, নিঝুমকে দেখার জন্য ওদের কে সোজা বাসায় আসতে বলে দিয়েছেন। মেজাজ রুমানারও একটু হচ্ছে এখন ননদের উপর। হুট করে এভাবে মেয়ে দেখানো যায়? কতোকিছু গোছানোর থাকে, অন্তত একদিন আগে তো বলা উচিত ছিল। কিন্তু এখন শাহেদকে কিছু বললে আবার উল্টো ঝাড়ি খাওয়া লাগবে। আর মেয়ে তো তার সেই রকম লক্ষ্মী... একটা কথাও শোনেনা।

"মানা করে দাও। "

নিঝুম কাঁধে ব্যাগটা ঝুলায়... এটা কাল নিউমার্কেট থেকে কিনেছে ও আর শাইনি মিলে। আজ সময় পেলে একটু চাঁদনীচকেও যাবে ও। কয়েকটা গজ কাপড় ভীষন পছন্দ হয়েছিল গতদিন। আজ তার দুইটা কিনবে। নীল রঙের কাপড়টার সাথে ওর একটা জামদানী ওড়না আছে, খুব ভালো ম্যাচ হবে। আর একটা ফুলকারি ওড়না দেখেছে নীলার কাছে গাঢ় নীলের মধ্যে, ওরকম পেলে ওটাও একটা কিনবেই কিনবে।

"নিঝু..." রুমানা জোরে একটা ধমক দিলেন মেয়েকে।" তোর কাছে কি সব কিছুই ছেলেখেলা মনে হয়?"

মেয়ে যে তার কথা একান দিয়ে শুনে ওকান দিয়ে বের করছে, ওর চেহারা দেখেই সেটা বেশ বুঝতে পারছেন রুমানা।

"আশ্চর্য আমি কি করলাম।" নিঝুম ব্যাগে কলম খুঁজতে খুঁজতে বললো।" তোমাদের যখন যা ইচ্ছা করবা আর আমার উপর চিল্লাবা। এটা কি ঠিক? আমার মতামতের তো কোনো দাম নাই তোমাদের কাছে?"

"এটা কেমন কথা... ছেলে ভালো হলে দেখবো না? ছেলেটার রেকর্ড ভালো, দ্রুত প্রমোশন পেয়ে যেতে পারে," রুমানা বিরক্ত হন। সব দোষ শাহেদের, বাপের আহ্লাদ পেয়ে পেয়েই মেয়ে তার এমন মাথায় উঠেছে।

"এত ভাল হলে রোজি আপুকে দেখাও, আমার এত বড় অফিসারের বউ হওয়ার শখ নাই। আমি পাইলট বিয়ে করবো তারপর খালি বাইরে বাইরে ঘুরবো, মাঝে মাঝে রান্না করলেই হবে," নিঝুম ফট করে বলেই জিভ কামড়ালো। আল্লাহই ভালো জানে কপালে আজ ওর স্যান্ডেলের বাড়ি আছে কিনা এখন?

"রোজি! রোজিকে কেন দেখাবো, তুই হঠাত করে রোজির কথা কেন বললি, রোজি কি কিছু বলেছে তোকে ?" রুমানা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চান।

মায়ের একসাথে এতো প্রশ্ন, নিঝুম এবার বিপাকে পড়লো। নেও এবার ঠ্যালা সামলাও। কি দরকার ছিলো রোজি আপুর নাম নেয়ার..  মনে মনে ঠাস করে নিজেকেই একটা থাপ্পর কষায় নিঝুম। বেশ হয়েছে... এখন মায়ের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকো আর ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলো বজ্জাত মেয়ে।

"কি হলো.. বল?"রুমানা মেয়ের উত্তরের অপেক্ষা করতে থাকেন।

রোজি হচ্ছে নিঝুমের একমাত্র খালাত বোন। রোজি আপু একটা প্রাইভেট ব্যাংকে জব করে আর রোজি আপুর এক ব্যাবসায়ীর সাথে ইটিশ পিটিশ চলছে কিন্তু নিঝুম ছাড়া বাসার কেউ এখনও সেটা জানেনা।

"আরে এমনি বললাম, রোজি আপুর সিরিয়াল তো আমার আগে তাইনা? " মাথাটা যথাসম্ভব নিচু করে স্যান্ডেলের ফিতাটা বাঁধে নিঝুম। মা যে কি করতে এখন এলো.. উগগ।

"কিন্তু বড়পা তোর কথা বলেছেন ওদেরকে, এখন আরেকজনকে কি দেখান যায়? মানুষ ঠগ বলবে না?"

" বলবে তোমার বোনেরই মেয়ে হয়," সহজ সমাধান করে দেয় নিঝুম।

" কিন্তু বড়পা ওদের তোর ছবি দেখিয়েছে... আর ওরা পছন্দও করে ফেলেছে মোটামুটি। এখন আর তোর বদলে অন্য কাউকে দেখানোর কোন সুযোগ নেই।"

" কিন্তু আম্মু," নিঝুম বিরক্ত হয়ে মুখটা বেঁকিয়ে পাঁচের আকৃতি করে ফেলে।

" লাভ নেই, ওরা বিকেলে আসবে তার আগে যেভাবে হোক বাসায় ঢুকবি, " রুমানা, মেয়েকে সোজাসাপটা উত্তর দেন।

"কিন্তু মা আমার শেষ ক্লাসটাই ইম্পর্টেন্ট বেশি।"

নিঝুমের বড় ফুপির উপর খুব রাগ হয়। ওনার নিঝুম ছাড়া আর কারও কথা মনে পড়লো না। সেঝো চাচার দুই মেয়ে শিউলি আর শিবলি দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে আর কোরবানি দেওয়ার জন্য ওনার ওকেই মনে ধরল। নিঝুমের সামনে মাষ্টার্স পরীক্ষা, কয়েক মাস পরেই আর বড়ফুপি ওকে দেখলেই শুধু বিয়ে বিয়ে করতে থাকে।

"আমি ওসব জানিনা। যেভাবে হোক চারটার মধ্যে আমি তোকে বাসায় চাই," রুমানা বলে হাটতে শুরু করলেন। মেয়েটা বুঝতে চায়না কেন? তার না বলার রাস্তা নেই। ছেলের কোয়ালিফিকেশন ভাল। শাহেদের খুব পছন্দ হয়েছে। আর তারচেয়ে বড় কথা সম্বন্ধটা নিঝুমের বড় ফুপু এনেছে, রুমানার কথা এখানে খাটবে না।

"আমার সাড়ে চারটার আগে শেষ হবে না। "

নিঝুম মুখ অন্ধকার করে উত্তর দেয় । এই ভ্যাজাল না থাকলে ও আজকেই কি সুন্দর শাইনির সাথে দর্জির দোকানে যেতে পারত। লোকে বিয়ে করার আর সময় পায় না...অসহ্য, ব্যাটার মাথায় লাগান উচিত একটা গাট্টা, শাদী বরাবাদী হয়ে যেতো তখন।

নিঝুম বিরবির করে বলে উঠে," তোর ব্যাটা মাথায় গরুর মতো দু দুটো শিং হোক।"

"আমি ওসব জানিনা, আমার কথা শেষ।তোর ফুপুর খুব পছন্দ হয়েছে ছেলে। ছেলে আর ছেলের বাবা- মা আসবে বিকেলে পাঁচটায়। টাইম তোর ফুপুই দিয়েছে, তার একঘন্টা আগে যেভাবে পারিস বাসায় ঢুকবি। তা না হলে তোর একদিন কি আমার একদিন।"

মার কথায় নিঝুমের মেজাজ ভয়ংকর খারাপ হলো। আজকে না গেলে যদি কাপড়টা শেষ হয়ে যায়। ইশশ... এত সুন্দর কাপড়টা। ধুর... ওই আসলে কপাল পোড়া।

" আম্মু, ফুপুর পছন্দের ছেলে ফুপুকেই দিয়ে দাও," বলেই আর দাড়ায় না নিঝুম, নিচে দৌড়ায়। মা এবার হাতে যা আছে তাই ছুড়ে মারবে জানে ও।

"ও আল্লাহ আজকে যেন বিরোধী দল হরতাল দেয় আমি বাসায় ফেরার পর। আর সরকার যেন টানা সাতদিন কারফিউ দেয়। বউ খোঁজা একদম বের হয়ে যাবে ব্যাটার। ও আল্লাহ রিকশা, গাড়ি, বাস সব নষ্ট করে দাও। আমি দরকার হলে পায়ে হেটেই চাঁদনী চক থেকে ফিরব," নিঝুম বিরবির করতে করতে গেট দিয়ে বের হয়ে সামনে একটা সিএনজি পেয়ে  তাতেই উঠে বসল। শেষ ক্লাসটা না করেই বের হয়ে পড়লো ও আর শাইনি। শেষের ক্লাসটা করতে গেলে জন্মেও ওর পাঁচটায় বাড়ি ফেরা সম্ভব না। তার চেয়ে বরং আগে আগে কাপড় কিনে বাসায় ফেরত যাওয়াই ভাল।

শাইনির সাথে চাঁদনী চক থেকে কাপড় কিনে  অবশেষে বাসে উঠে নিঝুম । বাস থেকে নেমে রিকশায় উঠে মনে পড়ে ওর চানাচুরের ডিব্বা খালি। আর চানাচুর না হলে ও মুড়িমাখা খাবে কি করে?

নাহ্... তাহলে তো ওর পড়াও হবে না। চানাচুর দিয়ে মুড়িমাখা  নিঝুমের ফেভারিট। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছোট্ট একবাটি হলেও ও চানাচুর মাখা খাবেই খাবে। রিং রোডের সামনে পরিচিত এক দোকানের সামনে রিকশা থামায় নিঝুম।

চানাচুর কিনে আর রিকশা নেয়না নিঝুম, হাঁটতে থাকে। এখান থেকে মাত্র পনের মিনিটের পথ ওদের বাসা, আরামসে হাঁটতে হাঁটতেই বাসায় চলে যেতে পারবে ও।

রাস্তায় এক জায়গায় একটা লোক কিছু চারা গাছ বিক্রি করছিল। নিঝুম তাই দেখে একটু দাঁড়াল। পলিব্যাগে একটা গোলাপের চারা দরদাম করছিল ও, হঠাত কে যেন ওর হ্যান্ডব্যাগটা ধরে জোরে একটা টান দিল। নিঝুম বোঝার আগেই চোরটা ওর ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে । নিঝুমও চোর চোর বলে লোকটার পেছনে পেছনে ছুটল। কিন্তু চোরটা ততক্ষণে হাওয়া। নিঝুম ব্যাগ হারিয়ে বোকার মত রাস্তা পার হতে যাচ্ছিল আর তখনই হঠাৎ করে একটা গাড়ি এল সামনে থেকে আর তারপর কি হলো নিঝুমের মনে নেই।

-------------------------------------------------------

অরণ্য বুঝতে পারছেনা এখন ওর আসলে কি করা উচিত ? রাস্তায় মেয়েটা হঠাৎ দুম করে কোথা থেকে ওর গাড়ির সামনে এসে পড়ল আল্লাহই ভালো জানেন। মেয়েটার এখন সেন্স এসেছে কিন্তু ভেতরে ভেতরে মারাত্মক কোনো ক্ষতি হলো কিনা বোঝা যাচ্ছে না। এখানে অরণ্যের তো কোনো দোষ নেই, তারপরও মেয়েটাকে ওভাবে রাস্তায় ফেলে রেখে আসে  কি ভাবে? তাই মাকে যে হসপিটালে ডাক্তার দেখাবে সেখানেই মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে ও। তাছাড়া তখন মুহূর্তের মধ্যে একগাদা লোক এসে হাজির, গাড়ি ভাঙ্গে প্রায়। শেষে ওর পরিচয় দিয়ে গাড়ি ছাড়িয়ে নিতে হয়েছে।

অরণ্য মেয়েটার কেবিনের বাইরে দাড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে। ওর এবার বেশ একটু ভয় ভয় করছে। কোন ক্ষতি হয়ে গেল নাতে মেয়েটার। ও অবশ্য মেয়েটাকে দৌড়াতে দেখেই জোরো ব্রেক করেছে, কিন্তু ফুল স্পীডের গাড়ি থামতেও তো সময় লাগে। ভাগ্যিস আম্মু পিছনে বসেছিল। সামনে থাকলে ঠিক জোরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নাক ভাঙ্গতো।

একটু পরে ডক্টর অনুমতি দিলেন যে, ইচ্ছে হলে ও দেখা করতে পারে পেশেন্টের সাথে। অস্বস্তির সাথে কেবিনে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ল মেয়েটার বড়ো বড়ো সুন্দর দুটো চোখ । চোখ সরিয়ে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল না অরণ্যর। কিন্তু এভাবে তাকানোটা অশোভন। তাই সরাতেই হলো।

"কেমন আছেন? " অরণ্যর কথায় ভড়কে গেল মেয়েটা। বড়ো বড়ো চোখদুটো আরও বড়ো বড়ো করে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকাল। অরণ্যর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল চোখদুটো ছুঁয়ে দেবার। মেয়েটা
ওর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে মাথা দোলাল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অরণ্য নিজেই বলল, "আমি কি আপনাকে বাসায় পৌছে দেব?" মেয়েটা উত্তর না দিয়ে প্রচন্ড অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। অরণ্য সেই দৃষ্টির সামনে অসহায়। কিছু একটা হচ্ছে ভয়ংকর ভাবে, ঝড়ো হাওয়া বইছে, পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টাচ্ছে। কিছু একটা তো আছে এই মেয়ের চাহনিতে, ওর বুকের কোথাও কাঁপন ধরছে।

আচ্ছা মেয়েটা কি ওকে খারাপ মনে করল? ওর কিন্তু কোনো খারাপ মতলব নেই। যাকগে ভদ্রতা মনে করে বলেছে। গেলে বাসায় নামিয়ে দেবে, নইলে না। আম্মুর ডাক্তার দেখাতে আরো একটু সময় লাগবে। ততক্ষণে মেয়েটা যদি মত পাল্টায় তাহলে বাসায় ড্রপ করে দিবে। আসলে ওর অপরাধ বোধ হচ্ছে কেমন একটা। ইচ্ছে করে হোক আর অনিচ্ছায়, অ্যাকসিডেন্টটা তো ওর গাড়ির সাথেই হয়েছে। মেয়েটা অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছে কিন্তু তারপরপও বড়ো ধরনের কোন  বিপদও তো হতে পারত। কিন্তু অরণ্য কি চলে যাবে না দাঁড়াবে মেয়েটার জন্য? কিছুই তো বলছে না।

এরপর হঠাৎ করে মেয়েটা ওর কাছে ফোন চাইল। তারপর বাবার সাথে কথা বলেই আবার ওর ফোনটা দিয়ে দিল। মেয়েটার বাসা সম্ভবত টোকিও স্কোয়ারের আসে পাশে। ভীষন সন্দেহপ্রবন তো। এই অবস্থায় বাসায় না গিয়ে টোকিও স্কোয়ারে নামতে চাইল। সরাসরি বাসার ঠিকানাটা দিলে কি ওর বাসা দখল করে বসবে নাকি অরণ্য? যাকগে যা মনে করে করুক। কিন্তু তারপরও কি মনে করে নিজের আইডি কার্ডটা বের করল ও। নাহ্ মেয়েটার এরকম সন্দেহ সন্দেহ দৃষ্টিটা ওর গায়ে বেশ লাগছে। কার্ডটা তাই বাড়িয়ে দিল মেয়েটার দিকে।

কার্ডটা দেখে মেয়েটার চোখে মুখে একটু স্বস্তি আসল সেই সাথে ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠেই মিলিয়ে গেল। তারপর ওকে কার্ডটা ফেরত দিয়ে...  মেয়েটা নিজেই হঠাৎ বলে বসল, ওর হবু স্বামীও নাকি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। কথাটা শুনে, নামটা ভদ্রতা করেই জিজ্ঞেস করল অরণ্য। তবে সেই সাথে মনটাও বেশ খারাপ হলো। অলরেডি অ্যানগেজড। ধুর.....।

নিঝুম ফট করে কথাটা বলে লজ্জা পেয়ে গেল। কি দরকার ছিল হবু বরের কথা বলার ? ছেলে পক্ষ এখনও দেখেইনি ওকে। যদি না বলে দেয়। ছি... এই মার ক্যাচালের চোটে ওর আজ এই অবস্থা। লোকটা নাম জিজ্ঞেস করাতে নিঝুম কি বলবে, যা মনে আসে একটা বলতে যাচ্ছিল। লোকটার মা এসে ওলে বাঁচিয়ে দিল... ভাগ্যিস মিথ্যা বলতে যেয়েও বলেনি । পরে মনে হল সর্বনাশ... ব্যাটা পুলিশ।

তবে নিঝুমের মনে হলো ওনারা যথেষ্ট ভদ্রলোক। ওকে টোকিও স্কোয়ারের সামনে নামিয়ে দেওয়ার পরও জিজ্ঞেস করছিল... ওয়েট করবেন কিনা ওর বাবা না আসা পর্যন্ত। নিঝুম প্রায় জোর করেই না করেছে। বাবাকে ও আসতে বলেছে নাকি? ফোন তো করেছিল আশুকে.. ওর ছোটবোন। বাবা শুনলে নিঝুমকে এখনি আবার হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করাবে। তাই বুদ্ধি করে আশুকে ফোন দিয়েছিল।

বাসায় ঢোকার সাথে সাথে শুরু হলো ফাইটার প্লেনের মত বোম্বিং। একটার পর একটা প্রশ্ন, নিঝুম উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।ঘড়ির কাটা প্রায় চারটা ছুঁই ছুঁই করছে। বাবারে বাবা, বড় ফুপু কি রাগটাই না হয়েছে। নিঝুম মার দিকে তাকাতেই মা চোখের ইশারায় ওকে রুমে চলে যেতে বলল। নিঝুম চুপচাপ ঘরে চলে এল। এখন অ্যাকসিডেন্টের কথা কিচ্ছু বলা যাবে না। নইলে কালকে থেকে ওর ভার্সিটি যাওয়াও বন্ধ করে দেবে আম্মু। সাথে তো বড়ফুপুর ভাষন বোনাস।

নিঝুম ভালো দেখে একটা থ্রিপিস পরতে চাচ্ছিল। কিন্তু বড় ফুপুর পিড়াপিড়িতে তা আর হলোনা। শেষ পর্যন্ত নিঝুম শাড়িটাই পরা শুরু করল। ওর আর সহ্য হচ্ছিল না। এই ছেলেরা দেখে বিদায় হলে ও একটু শোবে। হাতের কনুইতে বেশ জোরে ব্যাথা পেয়েছে। ডাক্তার ব্যাথার ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছে। তারপরও লাগছে। গাড়ির সাথে ভালোবাসাটা আরেকটু বেশি করে হলেই ভবলীলা সাঙ্গ হতো ওর। আচ্ছা লোকটা ওকে গাড়িতে তুলল কি করে? ওর তো সেন্স ছিলনা কিছুক্ষণ। সর্বনাশ লোকটা কোলে তুলে নাই তো ওকে? কথাটা চিন্তা করে নিজে নিজেই লাল নীল হচ্ছিল নিঝুম।

হসপিটালে ইনজেকশন দিতে গিয়ে বেশ একটু লজ্জাজনক পরিস্থিতিতেই পড়তে হয়েছে নিঝুমকে। ওর ইনজেকশন দিতে খুব ভয় করে। প্রথমেত ও দিতেই চাচ্ছিল না। পরে ডাক্তার যখন বললেন, ব্যাথার ইনজেকশন না দিলে সারারাত ব্যাথায় ছটফট করতে হবে, তখন ভয়ে ভয়ে রাজি হল। সিরিঞ্জ দেখেই ওর হাত পা ভয়ে পেটের মধ্যে সেধিয়ে আসছিল। ও যে কখন অজান্তেই পাশে দাঁড়ান লোকটার হাত চেপে ধরেছিল নিজেই জানেনা। ইনজেকশন দেওয়া শেষ হলে দেখে লোকটা দুই হাত দিয়ে ওর ডান হাতটা মুঠিতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওই মুহূর্তে নিঝুম খুব লজ্জা পেয়েছিল। কিন্তু লোকটা খুব সিরিয়াস মুখ করেই ওকে অভয় দেওয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার লোকটার চোখেমুখে উৎকন্ঠা ছিল... মনে হচ্ছিল ওর ফ্যামিলির কেউ। কিন্তু লোকটার চোখে মুখে এতো উৎকন্ঠা ছিল কেন? লোকটা খুব যত্ন করে ধরে রেখেছিল ওর হাতটা। ওই কেয়ারিংটা খুব ভালো লাগছিল নিঝুমের।হাতটা ওর মোটেই ছাড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু সেটা তো আর বলা যায়না।

কিন্তু সাধারনত এরকম গায়ে পড়া আচরনে  বিরক্ত হয় নিঝুম। কিন্তু আজ ভাল লাগছিল। লোকটা ওর হাত ধরে আছে অসহায় একটা চেহারা করে দাঁড়িয়ে আছে, ওই দৃশ্যটা মনে হতেই কেমন মন খারাপ হলো নিঝুমের। লোকটার নামটাও তো ভাল করে শোনা হয়নি। ওই সময় আসলে ওর মাথা কাজ করছিল না। অরন, অরুন কি একটা যেন বলে ডাকছিল ওনার মা। কিন্তু এখন তো ঠিক মনেও আসছে না। এখন কি হবে?

ফোন নাম্বারও তো জানে না। শুধু.... ইশসস... কার্ডটাও তো ভালো করে দেখেনি, একঝলক কি যেন দেখেছিল রহমান ধরনের কিছু , সাথে এ.এস.পি টাইপ কিছু একটা। অরন না... অরণ্য ছিল বোধহয়।

"কি রে? কি এত ভাবছিস?" মা ওর কোমরে শাড়ির কুচি গুঁজতে গুঁজতে জিজ্ঞেস করলেন।

"কিছু না। আচ্ছা মা এই লোকের কি অনেক বয়স? মানে বুড়ো টাইপ? " নিঝুম জিজ্ঞেস না করে পারলই না। বড় ফুপি বলার সাথে সাথেই ওনারা রাজি হয়ে গেলেন.... ব্যাপার কি? নাকি ব্যাটার আগে বিয়ে ছিল। তা না হলে শিওর পাত্রের মাথায় টাক আছে।

"তোর যত আজগুবি কথা। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। ওদের আসার সময় হয়ে আসল। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। আর হাতের ওখানে কি হয়েছে? " মার কথায় তাড়াতাড়ি হাত ঢাকল নিঝুম। এখন কিছু বলা যাবে না, সর্বনাশ...

"কিছু না মা। রিকশার হুডে জোরে ঘষা লেগেছে নামার সময়।"

মেয়ের কথায় রুমানা চোখ গরম করে তাকালেন। মেয়েটা এত কেয়ারলেস। ছোট মেয়েটা যতটা চালাক চতুর, বড়টা হলো তার একদম উল্টো। একদম ল্যাবেন্ডিস একটা।

রুমানা নিচে নেমে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলেন।। বড় ননদ রান্নাঘরে যেয়ে ঢুকেছেন, ফিরনী বানাচ্ছেন মেহামানদের জন্য।  রুমানা তাড়াতাড়ি যেয়ে ওতে হাত লাগালেন।

চারটা বাজার ঠিক দশ মিনিট আগে হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ঢুকলেন শাহেদ। হাতে ফলের প্যাকেট। ঢুকেই রুমানাকে বললেন সব ঠিক আছে কিনা দেখতে। কাস্টার্ড না কি যেন বানাবে বলেছিলে।

"তুমি যেয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও। ওনাদের আসার সময় হয়ে আসল," রুমানা ফলগুলো বের করতে করতে বললেন। শাহেদের মুখ দেখে ওর টেনশন বেশ বুঝতে পারছে রুমানা। নিঝুম হচ্ছে শাহেদের দুর্বলতা। মেয়েটার সামান্য জ্বর আসলেও সারারাত ঠিকমত ঘুমায় না এই লোক। শাহেদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওরা নিঝুমকে নয়, শাহেদকে দেখতে আসছে। রুমানারও একটু টেনশন হচ্ছে, কিন্তু অতটা না।  ওর চাচাত বোনের ছেলে ফাহিম... রুমানার  ওকে খুব পছন্দ। ছেলেটা ডাক্তার। সমস্যা হল ছেলেটা এখন বিয়ে করতে চাচ্ছে না। বাইরে যাবে ডিগ্রী করতে। ডিগ্রী শেষ করে তবে বিয়ে করবে। এজন্য ফাহিমের কথাটা বলতে পারছেনা রুমানা সকলের সামনে।

একটু পরেই মেহামানরা চলে আসলো। তার খানিক পরেই নিঝুমের ডাক পড়ল নিচ তলায়। নিঝুমকে এর আগে একবার এক ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছিল। ছেলের বাবা, মা, ভাবি সবাই খুব পছন্দ করল ওকে। কিন্তু ছেলে সাথে আসেনি। ছেলের বাবা পারলে তখনই ছেলে ধরে নিয়ে এসে বিয়ে দিয়ে দেয়। কিন্তু সে বেচারার টিকির খোঁজও পাওয়া গেল না।

পরে এক মেয়ে কোথ থেকে ফোন দিয়ে বলল, "নিঝুম... আপনি প্লিজ এই বিয়েতে রাজি হয়েন না। ও আপনাকে বিয়ে করতে চায় না। ওর বাবা- মা জোর করে ওকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। আপনি এই বিয়েতে রাজি হলে ঔ বিয়ে করতে বাধ্য হবে হয়ত, কিন্তু কোনোদিন আপনাকে ভালোবাসবে না।"

নিঝুম ফোন রেখে সাথে সাথে মাকে জানিয়েছিল। ওর তখন সামনে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ারে ওঠার ফাইনাল পরীক্ষা। মেজাজ এমনিতেই গরম ছিল, আরও খানিকটা হলো। ব্যাটা তুই বিয়ে করবি না খুব ভাল কথা, তা এ কথাটা নিজে বাপ মাকে না জানিয়ে ওকে কেন? তাও আবার নিজে ফোন করার মুরোদ নেই, বোনলেস ক্যারেকটার। তবে ওই কয়দিনের ঝামেলায় ওর এমনিতেই পড়ার যথেষ্ট ডিসটার্ব হচ্ছিল। মেয়েটা ফোন করাতে সেই পরীক্ষাটা খুব শান্তিতে দিতে পেরেছিল নিঝুম। তারপর আর কেউ এই কয় বছরে বিয়ে নিয়ে অশান্তি করে নাই। কিন্তু বড় ফুপির ওর এই শান্তি বোধহয় সহ্য হচ্ছিল না... আবার ভ্যাজাল নিয়ে এসেছে। জানা কথা ছেলে পক্ষ পেট পুরে খেয়ে তারপর গড়িমসি করতে করতে বলবে, আমরা একটু ভেবে দেখে বলি,যত্তসব।

ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই একগাদা লোক। নিঝুম বুঝতে পারছিল না কোনদিক দিয়ে ভেতরে ঢুকবে। ছেলে কি গুড়িগুষ্ঠী সব নিয়ে এসেছে... আল্লাহ মাবুদ জানে।

নিঝুমকে দেখতেই বড় ফুপি ভারি গলায় বললেন, " সবাইকে সালাম করো।"

নিঝুম সবাইকে 'আসসালামু আলাইকুম' বলল। কিন্তু বড় ফুপি চোখের ইশারায় ছেলের মাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে বললেন। এই হলো এক বিরক্তি। সালাম দেওয়ার সাথে পায়ে হাত দেওয়ার কি সম্পর্ক? কি যে সব উদ্ভট নিয়মকানুন। নিঝুম দাঁড়িয়েই ছিল। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করাতে ওর ভীষন আপত্তি। আগে না বুঝে ঈদের সালাম করার সময় এটা করত। কিন্তু এখন এত বড় হয়ে গেছে, এখন এটা করতে ওর খুব বিরক্ত লাগে। 

কিন্তু বড় ফুপি এবার বলেই বসলেন, "নিঝুম ওনাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করো।"

নিঝুমের ইচ্ছে হচ্ছিল বলে পারবো না... কিন্তু তারপর আম্মুর উপর দিয়ে একচোট কাল বৈশাখী ঝড় বয়ে যাবে।

অগত্যা নিঝুম আর কি করে? বসতে যাচ্ছিল অনিচ্ছা সত্ত্বেও। হাত যতবার নাড়াচ্ছে ততবারই মনে হচ্ছে কিছু একটা ভেতর থেকে টেনে ধরছে বঁড়শির মতো। ব্যাথায় হাতটা কুঁকড়ে আসছে।

কিন্তু ছেলের মা তাড়াতাড়ি ওকে থামিয়ে নিজের পাশে টেনে  বসালেন। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, "কেমন আছো মামনি? তোমার ব্যাথা কি কমেছে? "

ওনার কথায় নিঝুম চোখ তুলে তাকাল। ব্যাথা কমেছে মানে? আর স্বরটাও তো পরিচিত।

এরপর নিঝুমের মুখটা দেখতে কেউ যদি পটকা মাছের বলতো সেটাও বোধহয় অত্যুক্তি হতো না।

আরে এতো সেই আন্টি। সেই পু... লিশের মা!
নিঝুমের তো আক্কেল গুড়ুম। নিঝুম সাথে সাথে  পাশ ফিরে তাকাল। ওর বুকটা তখন ড্রামের মত বাজছে । ওই তো সেই চোখদুটো। কি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মোটা মোটা ভ্রু দুটো একটু কুঁচকে আছে। নিঝুমের মনে হলো ওর কান পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে। একেবারে.. পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে!

আল্লাহ এই লোকের সামনে ও বলে এসেছে,ওর  হবু বর পুলিশ। ও এখন কোথায় লুকাবে নিজেকে। এই হলো বেশি ফটফট করার শাস্তি। কিন্তু লোকটার দৃষ্টিতে কিছু একটা আছে যেটা  নিঝুমকে অস্বস্তিতে ফেলল। হসপিটালের  ওই চোখদুটিতে খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখেছিল ও।

এই চোখ দুটোতে সেই মুগ্ধতা নেই। আছে কেবল একরাশ কৌতুহল। কেন? ওকে কি তবে পছন্দ হয় নি?

চলবে......

গল্পটি ভাল লাগলে ভোট আর কমেন্ট করার অনুরোধ রইল।

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top