40

চোখ মেলতেই অনেক দিন পর বুকটা খুশিতে বাক বাকুম করে উঠল অরণ্যর। কতদিন পর ঝুমকে এরকম বুকের মধ্যে কুন্ডুলী পাকিয়ে ঘুমাতে দেখলো ও। বউটার গায়ে হাত বুলাতেই কাপড়ের নিচের সরু সরু হাড়গুলো হাতে বাজতে লাগল অরণ্যর।

মেয়েটা একদম হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে, কিছুই বোধ হয় খায়না। অবশ্য সব দোষ ওর। বাচ্চা পেটে নিয়ে নিঝুমকে এরকম মানুষিক অত্যাচার করাটা একদম উচিত হয়নি ওর। ডাক্তার বলেছে ঝুমের ওজন আরো বাড়াতে হবে, নাহলে বাচ্চাটার বাড়তে অসুবিধা হতে পারে। আসলেই তো.. মা না খেলে বাচ্চা পুষ্টি পাবে কোথা থেকে? নিজের উপরই এখন ভারী রাগ হয় অরণ্যর, ওর এক ভুলের জন্য সমস্ত কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। না ও ঝুমকে দেখার জন্য পাগল হতো আর না অয়নের মৃত্যুটা হতো, যদিও বাবা বলে, মানুষের মৃত্যু নির্ধারিত। তবু ওর ভুলেই অয়ন দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে আর সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চায় না অরণ্য। সবচেয়ে বড়ো কথা..  ঝুম আর বাচ্চাটার কিছু হলে নিজেকে এবার আর কোনভাবেই মাফ করতে পারবেনা অরণ্য... বেঁচে থাকাটাই তখন সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়ে যাবে।

"তোমার কি মন খারাপ? " ঘুম ঘুম চোখে অরণ্যকে জিজ্ঞেস করল নিঝুম। গায়ে হাত পড়াতে ঘুমের আবেশটা কেটে গেছে ওর, তবে চোখের পাতা এখনও পুরোপুরি মেলতে পারছেনা নিঝুম। বেশ কয়েকবার চোখ খোলা বন্ধ করার পর কিছুটা স্বাভাবিক বোধ করল ও।

"না.. বরং অনেকদিন পর আজ আমার আকাশে সূর্য উঠেছে , অন্ধকারটা কেটে গেছে," নিঝুমের কানের উপর নাকটা আলতো করে ঘষে দিল অরণ্য। আদর পেয়ে আবারো অরণ্যর বুকের গভীরে ডুবে গেল নিঝুম। ওদের চারপাশে কেমন শীতের সকালের আমেজ। ঢাকার আশেপাশে সব জেলাতেই শীতটা অনেক তাড়াতাড়ি জুড়ে বসে। আসলে বড়ো বড়ো দালান কোঠা আর যন্ত্রদানবের অত্যাচার কম তো... নিঝুমের মনে হলো এখন একটা লেপ হলে বেশ হতো। ওর আবার কম্বলের চেয়ে লেপ বেশি পছন্দ।

"ঝুম তুমি প্লিজ হরতালটা উঠিয়ে নাও না," নিঝুমের ঘন চুলের অভয়ারণ্যে নিজের ধারাল নাকটা ডুবিয়ে দিল অরণ্য। নিঝুমের থোকা থোকা  চুলের মাঝে ছাতিম ফুলের বুনো গন্ধ ভেসে আসে, বেশামাল লাগে অরণ্যর।

নিঝুম অরণ্যর কথার ধার কাছ দিয়েও গেল না, উল্টো ওর বুকের মধ্যে নাক ঠেসে দিয়ে মটকা মেরে শুয়ে রইল।

"ঝুম তুমি ওর নাড়াচাড়া টের পাও?" ঝুমের স্ফীত পেটটায় আলতো করে হাত বুলাল অরণ্য। কেমন অদ্ভুত লাগল, গোলুমোলুটা ওখানে কী করে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে কে জানে? ও দেখতে কার মতো হবে সেটাই বা কে জানে? ওর মতো চঞ্চল না অয়নের মতো শান্ত। অয়নের কথা মনে হতেই চিন্তার ঘুড়িতে রাশ টানল ও। নাহ একটু পর পর কী করে যেন অয়নটা ওর মাথার মধ্যে ঢুকে যায়... জোর করে ওই নামটা মাথা থেকে নামাল অরণ্য।  ও মনে হয় খুব দ্রুত পাগল হয়ে যাবে। লম্বা করে  শ্বাস টেনে উঠে আসা কান্নাটাকে গিলে ফেলল অরণ্য।

মনে মনে নিজেকেই নিজে ধমকে উঠে বলল এখন থেকে ঝুমকে নিয়ে বেশি বেশি ভাববি অরণ্য।একেত ঝুমের প্রতি মনযোগ দেওয়াটা আসলেই জরুরি আর ওর নিজের মানসিক অবসন্নতা থেকে বাঁচার জন্যও নিঝুমের দিকে ওর মন ঘুরানো দরকার। ভিতরের ব্যথাগুলো বরফের চাইয়ের মতো ওর মনের উপর ক্রমাগত অপরাধের বোঝা কেবল বাড়াচ্ছে আর বাড়াচ্ছে, এই বরফগুলোকে পানির মতো বইয়ে দিতে না পারলে ওর এই অস্থিরতা কোনদিন শেষ হবে না।

নিঝুমকে বার বার একই আবদারে করে ব্যাতিব্যাস্ত ফেলল অরণ্য কিন্তু নিঝুমের ওই এক উত্তর... উহু। ধুর হতাশা তো রাক্ষসের মতো খেয়ে ফেলল ওকে। সেই সাথে ঝুম কতদিনের জন্য হরতাল ডাকল কে জানে, দুনিয়ার ঝগরুটি একটা বউ... একরত্তি মায়া নেই স্বামীর উপর।

চোরের মতো ঝুমের ঢোলা পোশাকের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একটু আদর করতে গেলে অরণ্য, অমনি ওর সুন্দর নাকটা দুই আঙ্গুলে চেপে ধরল কিপটুস বউটা," উহু এ কায়দা ও কায়দা কোন ভাবেই চুমু দেওয়া যাবেনা।"

"আরে আমি তোমাকে না আমার প্রিন্সেসকে চুমু খেতে যাচ্ছিলাম।"

"প্রিন্সেস! তোমাকে কে বলল ও প্রিন্সেস?"

"বলব কেন? এটা আমার আর আমার প্রিন্সেসের সিক্রেট।"

"বলো না? "

"কেন বলব ?"

"কারন ও আমারো বেবি।
অরণ্য প্লিজ বলনা... ডাক্তার বলেছেন বুঝি?" নিঝুম অধীর আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়।

"উহু আগে হরতাল উঠাও তারপর বলব। "

"মোটেও না।"

"তাহলে তোমার বেবিকে তুমি জিজ্ঞেস করে শুনে নাও।"

"আশ্চর্য ওকে কী করে জিজ্ঞেস করব?"

"তার আমি কূ জানি?"

অরণ্য খাট থেকে নেমে যাচ্ছিল কিন্তু নিঝুম তাড়াতাড়ি পিছন থেকে ওকে আঁকড়ে ধরল।

"আচ্ছা... আচ্ছা... কিন্তু তোমাকেও কথা রাখতে হবে তাহলে। "

"ঠিক আছে... কিন্তু আগে আমাকে একটা সুন্দর,  অথেনটিক উপায়ে আদর দিতে হবে।"

"ইশশ... কত শখ, আমি তোমাকে চুমু কেন খাবো, আমি কী বলেছি যে আমি চুমু খাওয়ার জন্য মরে যাচ্ছি।"

"অবশ্যই।"

"কী! "

"আরে চেঁচামেচি করছ কেন? তুমিই না বললা একটা ছেলেকে তুমি একদম ডুব দিয়ে চুমু খাবা, একেবারে মাছরাঙার মতো।"

"আরে ওটা তো... আর অন্য একজনকে ওভাবে চুমু খাবো বলছি, তোমাকে খাবো তা তো বলিনি।"

"হ্যাঁ, তো ওকে এতো আগ্রহ করে তুমি চুমু কেন খাবা সেটাই আমি এতক্ষন ধরে চিন্তা করলাম ? কারন তারপর তুমি আমাকে চুমু খেতে পারবা," বলেই চোখ টিপল অরণ্য।

"ইহ্ বললেই হলো," মুখ বাঁকাল নিঝুম। কী হাস্যকর উৎকট একটা বুদ্ধি খুঁজে বের করেছে জনাব।

"আর আমি ঠিক করেছি তোমাকে এতো কষ্ট দেওয়ার চেয়ে, আমি তোমার চুমু খাওয়ার জন্য বরঞ্চ একটা ছেলে ঠিক করে দিব।"

"মানে? " নিঝুম এবার সত্যি ভয়ে আঁতকে উঠল। এ পাগল বলে কী?

"হুম আর এটা আমার একটা নৈতিক দায়িত্ব। আমার বউ আমার উপর রাগ হয়ে শাস্তি সরূপ একজনকে ডুবে ডুবে সরি সরি চুবিয়ে চুবিয়ে চুমু খাবে সেক্ষেত্রে যাকে তাকে চুমু খেতে তো আর দেওয়া যায় না। তা তোমার কেমন ছেলে চাই বলো? দেখতে সুন্দর লাগবে,এডুকেটেড হবে, আর কী কী থাকতে হবে? কোন রোগবালাই আছে কিনা ওটা অবশ্য আমি নিজ দায়িত্বে দেখে নিব, বাকিটা তুমি বলো," একদম ক্লোজআপ অ্যাডের  হাসি উপহার দিল নিঝুমকে অরণ্য।

"অ্যাই একদম ফাইজলামি করবে না বলে দিলাম। উনি আমার দালাল হয়েছে যে চুমু খাওয়ার লোক ঠিক করে দিচ্ছে, যত্তোসব।"

"সে আমাকে যা বলো তা বলো, চুমু খাওয়ার ক্ষেত্রে আমি মনে করেছি ওইদিন একটা পার্টি দিব ঘরোয়া। তুমি কতক্ষণ ব্যাপী ব্যাপারটা ঘটাবা তার একটা ভিডিও করে রাখব যাতে ভবিষ্যতে বাচ্চাকাচ্চাদের দেখাতে পারি যে তাদের মা কত সাহসী আর জেদী ছিল দেখ। "

নিঝুম অবিশ্বাসের সাথে তাকিয়ে রইল অরণ্যর দিকে। এই লোক কী সত্যি সত্যি এসব করবে নাকি?

অরন্য তখন ফোনে কাকে যেন চারশো লোকের খাবারের ব্যবাস্থা করার কথা বলল। নিঝুমের মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অরণ্যকে কী পাগলে ধরল! ও অরণ্যকে জব্দ করার জন্য ওই কথা বলেছে, আর... আর ওই লোক সেটাকেই সত্যি ভেবে নিল নাকি?

"আচ্ছা তাহলে ওই কথাই রইল, তোমার ওই চুবে চুবে চুমু খাওয়ার অনুষ্ঠান শেষ হলে তুমি আমাকে একটা চুমো খাবে আর সেটাও সবার সামনে খেতে হবে।"

"কি? "

"হ্যাঁ... দুটো চুমোই একদম লোকজন মানে সাক্ষীদের সামনে হবে। তাতে তোমার কথারও কোন নড়চড় হলো না আর আমার অপরাধেরও শাস্তি হলো। একদম একঢিলে দুই পাখি, পারফেক্ট না? "

"একদম না, আমি... আমি অন্য কোনো ছেলেকে চুমু কেন খাবো? একদম না, ওই সব আজেবাজে কিছু করলে আমি একদম মাথা ফাটাবো  তোমার।"

"মাথা ফাটাবা... কিন্তু মাথায় জায়গা মতো আঘাত লাগলে কিন্তু মরেও যেতে পারি ঝুম," অরণ্য দুষ্টামির ছলেই কথাগুলো বলল। কিন্তু নিঝুমের দিকে চোখ পড়তেই ওর হাসি উধাও হলো।

প্রথমে নিঝুমের মুখটা কাল বৈশাখীর মেঘের রঙ ধরলো, তারপর বানের পানির মতো হুড়মুড় করে ধেয়ে এল।

নিঝুমের চোখ দুটো পরিনত হলো বর্ষার নতুন পানিতে উপচে পরা হ্রদের মতো।  কিছু একটা খচ করে বিঁধল অরণ্যর বুকের মধ্যে। ইশশ... দুষ্টুমি করতে করতে নিজের অজান্তেই আবার নিঝুমের দুর্বল জায়গাতে খোঁচা দিয়ে ফেলেছে ও। একদম উচিত হয়নি অরণ্যর। কিন্তু ততক্ষণে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়া শুরু হয়ে গেছে নিঝুমের দু'গাল বেয়ে।

"ঝুম প্লিজ... আচ্ছা এই কান ধরছি আর কক্ষনো ওই কথা বলব না, সরি।"

কথাটা ভাল করে শেষ হবার আগেই অরণ্যর গলটা প্রবল ভাবে জড়িয়ে ধরল নিঝুম। তারপর এলোপাতাড়ি চুমু খেতে লাগল পাগলের মতো। অরণ্য এত ভড়কে গিয়েছিল যে প্রথম কয়েক সেকেন্ড বুঝতেই পারেনি কী হচ্ছে। যখন বুঝল তখন লম্বা চওড়া একটা হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটের কোনে। যাক হরতাল তাহলে অবশেষে ভাঙল ম্যাডাম! অবশ্য দিল্লি এখনো বহুদূর।

........................

"বউ সরি... আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছি, আর কক্ষনো বলবো না। তোমাকে এরকম বিপদে রেখে আর কক্ষনো যাবো না।"

"এটা কতদিনের জন্য?"

"উমম পরের বার বাবাই হওয়ার আগ পর্যন্ত।"

"আস্ত একটা বদমাইস মার্কা লোক, আবার বলে কোনদিনও যাব না।"

"আমাদের কাছে দুইবছরও অনেক দিন ঝুম।"

"দুই বছর! তুমি দুই বছর পর আবার বাবা হবা? "

"তো কী.. বাচ্চা হতে মাত্র ন'মাস লাগে, সেক্ষেত্রে দুবছর অনেক সময়। "

"কক্ষনো না। একটার ছয় বছর হবে তারপর পরেরটার কথা ভাববা।"

"আরে ততদিনে তো তিন নাম্বারটার সময় চলে আসবে।"

"তিন নাম্বার... না? তিন নাম্বার। দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা তিন নাম্বারের," বলেই মাথার বালিশ তুলে অরণ্যর গায়ে কয়েকটা বারি দিল নিঝুম।

"ঝুম... প্রিন্সেস আছে বলে অসহায়ের মতো মার খেলাম, না হলে তোমার খবর ছিল," অরণ্য বালিশ দুহাতে ঠেকাতে ঠেকাতে বলতে লাগল।

"আস্ত পাঁজি একটা লোক।"

অবশেষে মেঘ কেটে গিয়ে একটু একটু করে সোনালি পালকের মতো ঝলমলে আলোতে চকমক করতে লাগল নিঝুমের মুখ। অরণ্য মুগ্ধ চোখে সেটা দেখতে লাগল,নিঝুমকে জরিয়ে ধরে ওর হাতের আঙুল নিয়ে খেলতে লাগল।

"কী ব্যাপার... আজ এত আদর সোহাগ পর্ব চলছে কেন? কী পাকাচ্ছো ওই পেটের মধ্যে," নিঝুম  জানতে চাইল।

"আরে আমি তো এখনো সংসারই শুরু করতে পারলাম না... তার আগেই তুমি আমার কাজ শুরু করে দিলা কেন?"

অরণ্য কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলনা নিঝুম। অরণ্যর কী কাজ করল ও? আর এই লোক শুধু প্যাচ মেরে মেরে কথা বলে, যার অর্ধেকেই ওর মাথার উপর দিয়ে চলে যায়।

নিঝুমের ড্যাব ড্যাবে চোখের দিকে তাকিয়ে অরণয়র খুব মজা লাগল," কী বুঝতে পারছনা? "

"উহু "

"বউ তুমি একটু বোকাই থাকো। চালাক মানুষের দুনিয়ায় কষ্ট বেশি, সব মুখোশগুলো এক সময় ধরা পরে যায়।"

নিঝুমের হাতের উল্টোপিঠে আদর করে একটা চুমো খেল অরণ্য।

"হুমম... বোকা বউ হলে অহনার কথা জানতে পারলেও, আমার স্বামী ধোয়া তুলসীপাতা মনে করে চায়ের সাথে গুলে খাবো তাইতো?"

"হুমম... ঠিক তাই।"

অরণ্য নিঝুমের নাকের মাথাটা নিজের নাক দিয়ে একটু ছুঁয়ে দিল। আচ্ছা সময়ের সাথে সাথে নিঝুমকে এতো করে চাওয়াটা কী ওর পুরনো আর বর্ণহীন মনে হবে? অন্য কাউকে এমনি করে চাইবে? কিন্তু অরণ্যতো সেটা চায় না কোনদিন। নিঝুমের কিছু হলে ওর ঠিক বুকের পাঁজরে এসে লাগে। ও যদি নিঝুমকে নাই ভালবাসত তাহলে এরকম টনটন করে কেন? আসলে অহনাকে নিয়ে যতবার নিঝুম কথা বলছে ওর কেমন অভিমান হচ্ছে, অথচ সেটা হওয়ার অধিকার ওর একেবারেই নেই। কিন্তু ওর উপর অনেক বড়ো দায়িত্ব ছিল যে।

"ঝুম একটা কথা "

"কী?"

"আমি তোমার কাছে একটা ওয়াদা চাই।"

"বলো।"

"তুমি ওই অহনাকে নিয়ে, আমার সাথে প্যাচিয়ে আর কখনো কথা বলবেনা কোনরকম। আমি ওর ঠিক ততটুকু কাছে গিয়েছিলাম যেটুকু তথ্য জানা আমাদের জন্য জরুরি ছিল। আর উপর থেকে আমাকে প্রয়োজনে আরো এগুতে বলা হয়েছিল," কথাট বলেই জিভ কাটল অরণ্য।

নিঝুম কী বলবে বুঝতে পারলনা, আরো এগুতে বলেছিলো প্রয়োজনে! এরা তো ওর সংসার না ভেঙ্গে ছাড়বেনা। এই পুলিশের চাকরির নিকুচি করে ও, কত্তবড় সাহস ওর বরকে বলে অন্য মেয়ের সাথে আরো কিছু করতে।

"তা কত পানিতে এগুতে বলল? আমাকে সতীনের সংসার করিও না দয়া করে। শেষকালে সতীনের হাত পা টিপে দেওয়ার কাজে লাগাবা তুমি আমাকে দিয়ে ছোট বউয়ের ভালোবাসার ঠেলায় ।"

"ছি ঝুম... বি সিরিয়াস। আমি বড়ো বাধ্য হয়ে ওই কাজ করেছি। মনে করো জলে ডোবা মানুষকেও তো মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে কিছু দেয়, তারাও তো প্রয়োজনে মুখ..."

"ওহ... হো..  মিস্টার  তুমি মোটেই তা করছিলে না, চোখ মুখ বন্ধ করে শয়তান মেয়েটাকে জাপটে ধরে অত্যন্ত নোংরা একটা কাজ করছিলে। এখন একমাত্র আল্লাহই জানো কোন সরকারি কাজের পিন্ডি চটকাচ্ছিলে তুমি। আগে অয়নের খুনীকে খুঁজে বের করো তারপর তোমার পুলিশের চাকরি আমি করাচ্ছি। "

"ঝুম তুমি... ব্যাপারটাকে খামোখা, দেখ ওটা বরং আমরা ভুলে গেলেই.. "

অরণ্যর কথা পুরো শেষ হবার আগেই নিঝুমের মোবাইল ফোনটা জোরে বেজে উঠল। এই এক সুযোগ, অরণ্য তাড়াতাড়ি উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। নিঝুমের সামনে থেকে এখন সরা দরকার ওর নইলে ঝুম কেবল সুতো প্যাচাতেই থাকবে।

নিঝুম ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে আশুর গলা  ভেসে এলো,"আপু আশু বলছি।"

"বল... তোর আবার আমার কাছে পরিচয় দেয়ার মতো ভদ্রতা কবে থেকে শুরু হলো?  "

"না মানে, আপু আমরা কাল তোদের ওখানে দুইদিনের জন্য বেড়াতে আসতে চাচ্ছি।"

"আমরা মানে! আমরা কারা?"

"আমরা মানে, আমি আর ফাহিম ভাই। ফাহিম ভাই কাল রাতে হুট করে এসে হাজির। এখন তোর সাথে কী সব যেনো কথা বলতে চায়। আমরা কি তোদের ওখানে আসব?"

আশুর কথায় ভাল বিপাকে পড়ল নিঝুম। এ আবার কেমন জ্বালা হলো। অরণ্য তো শুনলেই  যন্ত্রনা শুরু করবে কিন্তু পর মুহূর্তে মনে হলো বেশ হবে। নিঝুম তো আর সত্যি সত্যি অন্য কাউকে কিছু করতে যাবে না কিন্তু অরণ্য যা করেছে তাতে সামান্য একটু জ্বলুক। নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সাথে ওরকম অবস্থায় দেখলে কেমন লাগে তার একটু জবাব তো অরণ্য রহমানের পাওনা।

"আপু কিছু বলো? আসব না ফাহিম ভাইকে মানা করে দিব? "

"এই না না, তোর মাথা খারাপ। মানা করলে কী না কী ভাববে।"

"তাহলে আপু কাল আমরা আসছি, ভাইয়াকে বলিস। "

"আচ্ছা।"

"আপু? "

"কিরে?"

"অয়ন ভাইয়া তোর সাথে কথা বলে এখন? "

"অয়ন!"

"আপু জিজুকে তুই তোর মনের আলমারিতে তুলে রেখে দে, না হলে ভাইয়ার সাথে সংসার করতে পারবি না।"

নিঝুম কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। না আশুকে এখন বলা ঠিক হবে না।

" তুই এত চিন্তা করিস না আশু, আমরা ভাল আছি।"

ওপাশ থেকে আশুরও মনে হলো নিঝুম অনেক দিন পর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে ওর সাথে। মনে হচ্ছে এই শ্রীমঙ্গল বেড়াতে যাওয়াটা ভাইয়া আর আপুর মধ্যে একটা বন্ধন তৈরী করে দিবে। স্বস্তি লাগলো আশুর... কিন্তু ওর মনের মানুষতো ওর মনের খবরই রাখে না।

............................................

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নিঝুমকে ঘরে না পেয়ে নিচে নামল অরণ্য। ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে খুশিতে বত্রিশটা দাঁত বের হয়ে গেল ওর। এত ভাল ভাল নাস্তা মানে আজ ঝুমের মনটা অনেক ভাল।

"উফফ ঝুম... আমার তো এখনই জিভে পানি চলে আসছে। সুজির হালুয়ার ফ্লেভারটা কী দারুন!  আমি তো মনে করলাম তুমি মনে হয় রান্নায় লবডঙ্কা কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে আমার সমীকরনে ভুল ছিল। নিঝুম কথা না বাড়িয়ে তিনটা পরোটা আর ডিম ভাজি একটা থালায় করে অরণ্যর সামনে এনে রাখল। এ বাড়িটায় বড়ো বড়ো দুটো মাটির চুলা আছে। আশুরা আসলে একটা ছোটখাটো পিকনিক করা যেতেই পারে অনায়াশে। এখন ফাহিম ভাইকে দেখে মিস্টার অরণ্য না চেতলেই হলো। 

নিঝুম খবরটা অরণ্যকে বলবে তাই আগে থেকেই মনটা ভাল করার ব্যবস্থা করছে। অরণ্য সুজির হালুয়া খুব পছন্দ করে শাশুড়ি বলেছে ওকে। নিজে একদিন করে শিখিয়েও দিয়েছেন। অরণ্যর সুজিতে একটা ডিম ভেঙে দিলে তার ফেভারিট সুজি হয়ে যায়... সাথে কেবল একট খাঁটি ঘি হলেই হবে।

"কিন্তু ঝুম, আমি এটা বুঝলাম না তুমি কিচেনে কেন গিয়েছ? এখানে রান্নার জন্য তো ভালো রাধুনি আছে।"

"হ্যাঁ কিন্তু আমি তাকে অনুরোধ করে একটু বাজারে পাঠিয়েছি।"

"বাজারে কেন? " অরণ্য খানিকটা পরোটা ছিড়ে সুজি দিয়ে প্যাচিয়ে নিঝুমের মুখের সামনে ধরতেই নিঝুম একটু অবাক হলো, সাথে খুশিও।

"আরে এটা তোমার। আমি আমারটা বানিয়ে আনছি।"

"সেটা পরে হবে, আগে আমাকে আল্লাহকে খুশি করতে দাও। বউকে খাইয়ে দিলে আল্লাহ খুশি হন। আর এখন তো আমার বোনাস পাওয়ার কথা, তোমার সাথে আমার প্রিন্সেসও তো কুট্টুস করে একটু খাবে।"

প্রিন্সেসের কথা মনে হওয়াতে নিঝুমের মনে পড়ল  অরণ্য তখন ওর কথার সোজা উত্তর দেয়নি।

"অ্যাই তুমি আমাকে বাবুইটার ব্যাপারে বললে না কেন? তুমি তো কথা দিয়েছিলে যে আমাকে বলবে।"

"কিন্তু সেই স্পেশাল আদরটা তো এখনো তুমি আমাকে দাওনি ঝুম।"

"কী? তখন অত্তগুলো চুমো খেলাম। "

"আরে ওগুলোতো সব নাকে, গালে,চোখে। ওগুলো কি শর্তেরটা ছিলো বলো?"

উত্তর শুনে নিঝুমের ইচ্ছে হলো জগের পানি সব এই লোকের মাথায় ঢালে। কী দুর্দান্ত পাঁজি একটা মানুষ বাপরে। কিন্তু নিঝুম এবার রাগল না। খুব হাসি হাসি মুখ করে অরণ্যকে জানাল, "তোমার জন্য একটা ভালো খবর আছে।"

"আমার জন্য, কী খবর?"

"কাল না আশু আসছে আমাদের এখানে বেড়াতে।"

"আশু হঠাৎ! কার সাথে আসছে?"

" ফাহিম ভাইয়ের সাথে। উনি নাকি কী সব কথা বলবেন আমাকে।"

নিঝুম দেখল অরণ্যর মুখটা বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে, তারপর ধীরে ধীরে ওটার রঙ বদলাতে লাগল।

সর্বনাশ এ যে অশনী সংকেত।

নিঝুম হাসি চাপতে চাপতে কেবল একটা কথাই অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেল, ফাহিম ভাই.. তা বেশ ভালো তো।

চলবে.........

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top