১
শ্রাবণ আবারো নিজের হাতঘড়িটা দেখল। সোয়া পাঁচটা বাজে প্রায়। অথচ এখনো পর্যন্ত কারো আসার নাম গন্ধ নেই।
অনেকক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছে ও। মার কথা মতো আজকে রোগীর সাথে অ্যাপয়েনমেন্টও কম রেখেছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অনেক বড়ো বোকামি হয়েছে এটা ওর। ফালতু কাজে রোগীদের আসতে না বলাটা চরম গাধামীই হয়েছে এক রকমের। আজকের দিন বাদ দিয়ে বরঞ্চ শুক্রবার বাইরে কোথাও দেখা হলেই ভাল হতো।
ধুর, এই একমাত্র ছেলে হওয়ার চেয়ে আপদের আর কিছু নেই। কিছু হলেই খালি ব্লাকমেইল করে মা। কথা শুনবি না, ওকে খাওয়া বন্ধ। সাথে সাথে অ্যালার্মের মতো খালাদের ফোন আসা শুরু হবে। কিরে শ্রাবণ কেমন ছেলেরে তুই? তোর বাবা নেই, তুই হলি শাহানার একমাত্র অবলম্বন। আর সেই ছেলে যদি কথা না রাখে মায়ের, অমন ছেলের মুখে ঝ্যাটার বারি।
তখন শ্রাবণের কাজ হচ্ছে হাসি মুখে বসে বসে গালি গুলো খাওয়া। ছয় খালা ওর। একবার করে বললেই যথেষ্ট, কান শেষ।
আর কিছু হলেই মনিখালা বলতে শুরু করবে, "তোর মায়ের দিকে তো তাকান যাচ্ছে না রে, লক্ষী ছেলে বিয়েতে রাজি হয়ে যা।"
যুক্তিতে না পেরে শ্রাবন রাজি হয়েছে শেষমেষ। সারা বাড়িতে সাজ সাজ রব পরে গেছে, বিড়াল গলায় ঘন্টি বাঁধতে রাজি হয়েছে।
কনে মায়ের বান্ধবীর মেয়ে। ধানমন্ডির সেন্ট্রালরোডে ওদের বাসা। মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কেমিষ্ট্রিতে পড়ে। শ্রাবণকে নাকি খুব পছন্দ আন্টির। মেয়ের বাবা মারা গেছেন। আর্থিক অবস্থা ভালই। নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকে। তিন ভাই বোন। বড়ো বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, ভাইটা এখনো পড়ছে।
পারভীন আন্টির সাথে শ্রাবণের পরিচয় হয়েছে অল্প কিছুদিন হলো। উনি আসলে ওর পেশন্ট।। কিন্তু তাই বলে সুযোগ বুঝে নিজের মেয়ে গছিয়ে দিতে চাইবেন ওকে বুঝতে পারেনি শ্রাবণ। এখন মনে হচ্ছে দোষটা ওরই। মায়ের বান্ধবী বলেই খুশিতে আটখানা হয়ে অতিরিক্ত ভক্তি করার ফল এটা।
আবারো ঘড়ি দেখল শ্রাবণ। সময় তো পেরিয়ে যাচ্ছে।
"স্যার চা দেব? " ওর অ্যাসিসটেন্ট রতন আবারো জানতে চাইল। একটু আগেও একবার জিজ্ঞেস করেছিল বেচারা চায়ের কথা, শ্রাবণ তখনো না করেছিল।
"আর একটু পরে দাও রতন , দুজন মেহমান আসার কথা।"
শ্রাবণ হাত ঘড়িটা দেখল আবার। নিজেরাই টাইম দিয়ে এখন পাত্তা নেই। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে অলরেডি তিনটা ওটি সেট করা রয়েছে ওর। উনারা না আসলে এতক্ষনে শুরু করে দিতে পারত ও। এভাবে বসে বসে বিরক্ত ধরে যাচ্ছে শ্রাবণের।
আন্টি মেয়ে নিয়ে কখন আসবেন আল্লাহই জানে। দুটো ওটি শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আজ রাত হবে। মা কে একটা ফোন দেবে কীনা ভাবছিল শ্রাবণ, ঠিক তখনই রতন এসে জানাল দুই জন মেহমান এসেছেন।
এই প্রথম শ্রাবণের মনে হলো, এই রঙের শার্ট পরাটা কি ঠিক হয়েছে? মাথার চুলটা কি আঁচড়াবে আবার? কপাল কেন ঘামছে? আশ্চর্য তো!
মেয়ে দেখে ওর পছন্দ হলেই তবে বিয়ে হবে, কথা দিয়েছে মা। কাজেই টেনশন করার ওর কিছু নেই। পরীক্ষা ওই মেয়ে দেবে, শ্রাবণ না।
"ওনাদের আসতে বলো, " বলেই নিজের মুখটা রুমাল দিয়ে একবার মুছে নিল শ্রাবণ। যতই বলুক অস্বস্তি কিছুটা লাগছে। যত সময় যাচ্ছে ততই পরীক্ষা দেওয়ার মতো টেনশন কাজ করছে নিজের ভিতরে। প্রথম প্রথম যতটা কনফিডেন্স ছিল নিজেকে নিয়ে, সেখানে কিসের একটা অভাব ঠেকছে। নিজের জন্য পাত্রি দেখা যত সহজ মনে হয়েছিল ,ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়।
পারভীন আন্টি রুমের দরজায় এসে দাঁড়াতেই শ্রাবণ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। আন্টি রুমে ঢুকেলেন। ঢুকে মেয়েকে ডাকলেন। কিন্তু মেয়েটির এদিকে তেমন মনোযোগ নেই। ফোনে কারো সাথে কথা বলছে মনোযোগের সাথে।
এক ঝলক দেখেই মনে হলো মেয়েটা বেশ লম্বা। মা বলছিল ওর পাশে নাকি দারুন মানাবে।মেয়েটা তখনও দরজায় দাঁড়িয়ে, মুখ ঘুরিয়ে নিচু আওয়াজে কথা বলে যাচ্ছে।
"আর বলো না বাবা... দুনিয়ার বান্ধবী তার। সারাক্ষণ ওই ঘন্টাটা কানে লেগেই থাকে।"
শ্রাবণ কিছু না বলে একটু হাসল। এছাড়া কী বলবে? মেয়েতো বাবা তাকাচ্ছেই না এদিকে।
"পিউ এখন ওটা রেখে এদিকে আয়, আমার এক্সরেটা শ্রাবণকে দেখাই।"
কথা শুনে ওই ভঙ্গীতেই হাতে রাখা এক্সরের বড়ো ফাইলটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিল পিউ নামের মেয়েটা। চুলগুলো খোলা। মাথা নাড়াচাড়ার সাথে সাথে চুলগুলোও দুলছে। মুখটা পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না...সে অবস্থায় মেয়েটা সামান্য হেসে উঠল। এরকম ভাবেও কেউ হাসতে পারে শ্রাবণের জানা ছিল না। মনে হচ্ছে উচ্ছল পাহাড়ি এক ঝর্ণা পথ ভুলে আজ ওর গলি পথ ঢুকে পড়েছে। আচ্ছা মেয়েটার হাসিটা কি আসলেই এত মিষ্টি নাকি ওর কান গেছে? মা এই মেয়ের এত প্রশংসা করেছে যে, ওর ব্রেন ওয়াশ হয়ে গেছে শিওর। আর তাই এত ভালো লাগছে।
কিন্তু সত্যি খুব ভালো লাগছে শুনতে। মেয়েটা আর কতক্ষণ কথা বলবে কে জানে।
শেষ অব্দি দয়াময়ীর দয়া হলো। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে মায়ের পাশে এসে বসল পিউ।
শ্রাবণের হার্ট বোধহয় একটা বিট মিস করল। এক সেকেন্ডের ভিতরে তিনশ ষাট ডিগ্রী ঘুরল ওর দুনিয়াটা। গলা শুকিয়ে আমসত্ত্বের মতো লাগছে।হাতও একটু একটু কাঁপছে। সামনে থাকা পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল শ্রাবণ।
"পিউ ও শ্রাবণ। তোর শাহানা আন্টি আছেনা ওর ছেলে। খুব ভদ্র আর ব্রিলিয়ান্ট। খুব ভাল ডাক্তারও। আমি তো ওর কাছ থেকে একটা ওষুধ নিয়ে খাই আর ঠিক," পারভীন পরিবেশেটা সহজ করতে চাইছেন। মেয়েকে কিছু বলেননি তিনি, জানলে মেয়ে তার সাথে আসতেই চাইত না।
পিউ এসব শুনে ভদ্রতা করে একটু হাসল। "আপনি কোন মেডিকেল থেকে পাশ করেছেন, ঢাকা মেডিকেল? "
শ্রাবণের মনে হলো গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না। কী মেয়েরে বাবা? শ্রাবণ কিছু জিজ্ঞেস করবে কী, এত উল্টো ওর ইন্টারভিউ নিচ্ছে।
বহু কষ্টে হ্যাঁ বলতে পারল শ্রাবণ। গলা যেন কোলা ব্যাঙের বাসা হয়ে গেছে ওর।
"কিছু মনে করবেন না আসলে আমার দুই বান্ধবী ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ে তো তাই জিজ্ঞেস করলাম। "
পিউয়ের কন্ঠে টেনশনের লেশমাত্র নেই। বড্ড স্বাভাবিক সবটা।
"না না কিছু মনে করব কেন।"
শ্রাবণ ভদ্রতা করে বলে উঠল।
জবাবে পিউ একটু হাসল কেবল।
শ্রাবণের খুব ইচ্ছে হচ্ছে একটা ফটো তুলে রাখতে। কী মিষ্টি দেখতে মেয়েটা। ওর বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা লাগছে। এটা কেমন অনুভূতি বুঝতে পারছে না শ্রাবণ। ওর চেম্বারটা কেমন একটা যেন লাগছে, আলোয় আলোকিত। মনে হচ্ছে মেয়েটা এদিক ওদিক কেন তাকাচ্ছে? ওর তো দেখতে সমস্যা হচ্ছে। সোজা এদিকে তাকালে ঠোঁটের কোনের হাসিটা স্পষ্ট দেখতে পেত। মাথা নিচু করলে চিবুকটা যেয়ে পিউয়ের গলার নিচটা ছুঁয়ে গেল। লাল রঙের জামার গলাটা হার্ট শেপের। লাল জর্জেটের ওড়না দিয়ে ঢাকলেও এক চিলতে সাদা মসৃণ চামড়া শ্রাবণের বুকের ধুকপুকানি বাড়িয়ে দিচ্ছে হাজার গুন। ডাক্তারী বিদ্যা আজ খুব একটা কাজে কেনো দিচ্ছে না বুঝতে পারছে না শ্রাবণ।
"মেয়ে আমার ইউনিভার্সিটিতে কেমিষ্ট্রিতে পড়ে। তোমার মতো মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষাও দিয়েছিল কিন্তু ঠিক সেই সময় হঠাৎ ভীষন জ্বর হলো। না হলে কিন্তু বাবা ওর মেডিকেলে চান্সটা হতো। "
"জি তা তো বটেই।"
শ্রাবণ তালে তাল মেলাল। হয়নি ভাল হয়েছে। নইলে এতদিনে এই মেয়ে আমার কপালে জুটত না।
শ্রাবণের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল জিজ্ঞাস করে," আন্টি সে তো আমি জানি বাট আপনার মেয়ের কি আমাকে পছন্দ হয়েছে? আপনার মেয়ে ফ্রি আছে না এনগেজড? বিয়েতে রাজি হলে কতদিন পর ডেট ফেলবেন। আমার আর কিছু শোনার নেই, আমি ক্লিন বোল্ড। আপনার মেয়ের হাসিতে কোনো গন্ডগোল আছে, কেমন নেশা ধরে গেছে আমার । এখন ওই অফুরন্ত হাসির ফোয়ারাটা আমার চাই। "
মায়ের কথায় মেয়েও অস্বস্তি নিয়েই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। অল্প অল্প হাসছেও। নেও ঠেলা.... শ্রাবণ তলে তলে ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে আর ওর বউ দেখো থুক্কু বিয়ের কনে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে।
হাসো হাসো... একবার বিয়ে যদি ঠিক হয়তো দেখো। আমার সামনে মুখ কালো করলে তার শাস্তি কেমন দেই।
রতন চা নিয়ে আসল। সাথে মাঝে মাঝে গেস্ট আসলে যে বিস্কিট দেয় সেটা। বিস্কিটের দিকে তাকিয়ে এবার সত্যি একটু অসহায় লাগল শ্রাবণের। ভুল হয়ে গেছে, ভালো কিছু একটা আনানো উচিত ছিল একদম। ইস এই বিস্কিট ওর বিয়ের চৌদ্দটা না বাজায়। মনে মনে নিজেকেই একটা গালি দিল ও।
বের হয়ে যাবার সময়, মেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে আন্টি আস্তে করে বললেন, "আসলে পিউকে কিছু বলে নিয়ে আসিনি। ও কিছু জানেনা। তুমি বাবা আবার কিছু মনে করো না। বললে আবার দেখা গেল আসল না তাই ডাক্তার দেখানোর ছুতোয় নিয়ে এসেছি। তুমি বাবা কোনো প্রেশার নিও না৷ ভাল না লাগলে কোনো চাপাচাপি নেই। দরকার হলে আমকেই বলো সরাসরি, না বলতে তোমার মা লজ্জা পেতে পারে।"
শ্রাবণ কী উত্তর করবে বুঝতে পারছে না? ভালো লাগেনি?
শ্রাবণ ওদের পিছু পিছু নেমে আসল। ওর চেম্বারের নিচে দু একটা বেকারী আছে। সেখান থেকে অস্বস্তির সাথে একটা বড় ক্যাডবেরি চকলেট কিনল। এর চেয়ে ভাল কিছু নজরে আসল না। ওর জানামতে মেয়েরা সাধারনত চকলেট আর পুতুল খুব পছন্দ করে। ওর ক্লোজ যে কয়টা বান্ধবী আছে সেগুলোকে একটা লজেন্স দিলেও ফকিরের মত কাড়াকাড়ি করতে থাকে।
পিউয়ের দিকে চকলেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, "এটা আপনার জন্য। "
পিউ বেশ অবাকই হলো। আর কিছু পেল না লোকটা! ওর জন্য কিনেছে চকলেট! লোকটা পাগল নাকি? এরকম চকলেট গিফট ও সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পেয়েছে অনেক। পরে বন্ধুরা যখন বুঝে গেল চকলেট ও তেমন একটা খায় না, তারপর থেকে আর চকলেট গিফট হিসেবে দেয়নি।
অবশ্য এই লোককে পাগল বলাটা দু:সাহসের পর্যায়ে পরে। দেখতে রীতিমত নায়ক, লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবান। তার ওপর ডাক্তার। হয়ত লোকটা বুঝতে পারেনি। যাকগে, প্রিয়ন্তিটাকে দিয়ে দিলেই হব। ওর বড়ো বোনের পাঁচ বছরের মেয়েটা খুব আদুরে বুড়ি একটা।
চকলেটটা নিয়ে ব্যাগে রেখে দিল পিউ।
-------------------------
তিন দিন পর শ্রাবণ আননোন নাম্বার থেকে পর পর চারটা মিসড কল দেখে কলব্যাক করল। ও এতক্ষন ওটিতে ছিল। ফোন ধরতে পারেনি। রোগীর লোকগুলো ফোনে না পেলে অস্থির হয়ে যায়। কলব্যাক করে বড়সড় একটা শক খেল শ্রাবন। ওপাশে পিউ। এতো দেখছি মেঘ না চাইতেই জল।
"আপনি কি বিরক্ত হলেন?"
"নাতো। বলুন কি বলবেন?"
অস্বাভাবিক হাত কাঁপা ঠেকাতে শ্রাবণের গলার স্বরটা তখন এলোমেলো, একাকার। পিউ কেনো ওকে ফোন করেছে?
"একটু দেখা করতে চাই।"
ওপাশের কন্ঠস্বর সেদিনের মতোই স্বাভাবিক।
"আমি চেম্বারে আছি, আপনি চলে আসুন।"
"না, আপনার চেম্বারে না। "
"তাহলে?"
"বাইরে কোথাও?"
"আপনি এখন কোথায়?"
"ধানমন্ডিতে আছি। "
"আচ্ছা তাহলে সাতমসজিদ রোডের নূর স্কোয়ারে চলে আসুন, ক্যাফে রিওতে। আমি দুটোর মধ্যে আসছি।"
শ্রাবণ যখন পৌছাল পিউ তখনও এসে পৌছায়নি। একটু নার্ভাস লাগছে। কী বলবে ওই মেয়ে আল্লাহ জানে। ও তো সেই দিনই হ্যাঁ বলে দিয়েছে মাকে ডেকে। মা ওর কথায় খুব খুশি।
আরও পনের মিনিট বাদে রাজকন্যার আবির্ভাব ঘটল। সুন্দর গাঢ় নীল রঙের একটা শাড়ি পরেছে , চুড়িও পরছে সেই সাথে ম্যাচ করে।সবচেয়ে মারাত্মক হলো কপালের ছোট্ট টিপটা। পিউ কি আজকে ওকে মেরে ফেলতে এসেছে? ঢোক গিলল শ্রাবণ। পুরো নীল পরী লাগছে একটা।
কিন্তু পিউ যা বলল, সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না শ্রাবণ। মেয়েটা ওকে বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার অনুরোধ করতে এসেছে।
শ্রাবণের মনে হলো দিনটা একেবারে ধুসর হয়ে গেছে। এরকম করে মন ভাঙে কেউ? মনটা সবেমাত্র আঁকিবুঁকি কেটে একটা স্বপ্নের তানপুরাতে সুর তুলেছিল, বেরসিক মেয়েটা একদম খন্ড খন্ড করে দিল ওর মনটা।
শ্রাবণ নিজের ব্যাপারে মোটামুটি কনফিডেন্ট ছিল যে, তাকে দেখলে মানুষ একেবারে দূরছাই করবে না। কিন্তু এ মেয়েতো ওর কনফিডেন্সের বারোটা বাজাল। বুকটা বড্ড খচ খচ করছে। উহ্ দুদিন ধরে এই মেয়ে মোটে চোখের সামনে থেকে যাচ্ছে না। আর এখন কী শুনতে হচ্ছে। জীবনে প্রথমবার কোনো মেয়েকে দেখে সিরিয়াসলি ক্রাশ খেল, আর মেয়ে মুখের ওপর মানাও করে দিল।
"আপনি কি রাগ করলেন?"
"বুঝতে পারছিনা। তবে মনে হচ্ছে একটু অপমান লাগছে।"
"না মানে দেখুন আমি আসলে সেদিন জানতাম না যে আম্মু আমাকে আপনার সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে আমার সাথে কোনো আলাপই করেনি বিয়ের ব্যাপারে।
"আপনার তাহলে বয়ফ্রেন্ড আছে? "
পিউ মাথা নেড়ে সায় দিল।
"কী করেন উনি? "
"আমার টিচার। "
"মানে!"
"মানে আমার টিচার ছিল এক সময়।"
পিউয়ের কথাটা শুনে অত্যন্ত বাজে অনুভূতি হলো শ্রাবণের।
"ওহ! তা এখন কী করেন উনি?"
" আসলে ও এখনও ভালো কিছু করে না। আপনি প্লিজ আমার কথাটা রাখুন। বিয়েটা ভেঙে দিন। বলবেন যে আমাকে আপনার একদম পছন্দ হয়নি।"
"উল্টো বলতে বলছেন?"
"মানে? "
"মানে এটা আপনার কথা, আমাকে বলতে বলছেন।"
"দেখুন আমি তো সরি বললাম।"
"না এখানে সরির কিছু নেই। আপনি তো সেদিন জানতেন না।"
"তাহলে আপনি বিয়েটা ভেঙে দেবেন তো?"
"কী আর করা, আপনি এত করে রিকোয়েস্ট করছেন।"
শ্রাবণের উত্তর শুনে পিউ মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। লোকটাকে অপমান করার ইচ্ছে ওর ছিলনা। ওরও আসলে লজ্জা করছে, সাথে ভয়ও।
"আসুন কিছু খাই।"
"না প্লিজ আমি বাসায় যাব।"
"সে যাবেন আর এখন এই ভরা দুপুরে না খাওয়ার তো কোনো কারন নেই। বিয়েটা না হয় না হলো, বন্ধুত্বটা তো করাই যায়, নাকি? "
পিউ শেষ পর্যন্ত না করতে পারল না। ক্ষুধাও লেগেছিল খুব। সবটা খেয়ে নিল ও।
পিউ বাসায় ফিরেই দ্রুত একটা ফোন করল।
"শ্রাবণকে বলেছি বিয়েটা ভেঙে দিতে। শ্রাবণ রাজিও হয়েছে। "
ওপাশ থেকেও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল।
খুব শান্তি লাগছে এখন পিউর। কাল যখন শ্রাবণদের বাড়ি থেকে জানাবে যে শ্রাবণ এই বিয়েতে রাজি না, তখন পিউয়ের মুক্তি।
পরদিন সকালে উঠেই ভার্সিটিতে দৌড়াল পিউ। সামনা সামনি মানুষটাকে জানাতে হবে যে পুরো ব্যাপারটা ঠিক হয়ে গেছে। না হলে মনটা খচখচ করতে থাকবে। লোকটাও অস্থির হয়ে থাকবে।ফোনে সবটা বলা হয়নি।কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটা বেজে গেল পিউয়ের। কিন্তু তারপরও মনে আজ ওর লাড্ডু ফুটছে।
আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে...
ঘরে পা দেয়ার সাথে সাথে পিউয়ের খুশিটা গায়েব। ওর ছোট ভাই অপু জানাল কালকে শ্রাবণদের বাসা থেকে লোক আসবে ওকে আংটি পরাতে।
"মানে কী? "
"মানে ওদের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিয়েছে। "
শ্রাবণ ছেলেটা এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করবে বুঝতে পারেনি পিউ। এখন কী হবে? রাগে ওর গা জ্বলে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকে সাথে সাথে শ্রাবণকে কল করল পিউ কিন্তু উত্তরে কেবল সেই একই কথা বারংবার বাজতে লাগল, সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়।
"মিথ্যুক, শয়তান একটা লোক, আমি কী করি এখন?"
পিউয়ের রাগে নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে এখন। একটুও উচিত হয়নি লোকটাকে বিশ্বাস করা।
পরদিন শ্রাবণদের বাসা থেকে দুই গাড়ি ভর্তি করে লোক এল। পিউ বুঝতে পারল না এক আংটি পরাতে এত লোক কেন আসতে হবে?
"হ্যালো "
"শুনছি বলো।"
"শ্রাবণ তো লোকজন সহ এসে হাজির।"
"কী? "
"হুম, আমি কিন্তু খুব চেষ্টা করেছিলাম। বাট এখন মনে হচ্ছে শেষ রক্ষা হবেনা। বাসার সবাই তো আগে থেকেই রাজি, সরি।"
পিউ কান্না জড়ান গলায় বলল। চোখদুটো কী ভীষন ছলছল করছে ওর। কত দিনের একটু একটু করে বুনে চলা স্বপ্নটা এক টানে মাটিতে আছড়ে ফেলল দিল লোকটা। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর।
মা যখন আলমারি খুলে একদম নতুন একটা শাড়ি পিউয়ের হাতে তুলে দিল, ও মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।
"মা তুমি আমার ভালবাসা, আমার স্বপ্ন সব জানো, তারপরও এই বিয়ে করতে বলছ?"
"তোর কি আমার উপর বিশ্বাস নেই? আমি ওই ছেলের সাথে তোর বিয়ে দিব না। "
পিউ মায়ের দিকে কান্নাভেজা চোখে তাকিয়ে রইল।
"বিশ্বাস আছে বলেই তো জিজ্ঞেস করলাম। "
"তাহলে এই বিশ্বাসটার উপর বিশ্বাস রাখ। আমি তোর খারাপ চাই না। "
পিউ আর কথা বাড়াল না।চুপচাপ শাড়িটা পরে আসল। আসলে যে মেয়েদের বাবা থাকে না, তাদের বিয়ে নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়। তখন হয় তাদের মাথার উপর কেউ থাকে না আর তা না হলে সবাই তার উপর অধিকার ফলাতে আসে। মায়ের উপর সে কারনে বেশিক্ষণ রাগ ধরে রাখা সম্ভব হয় না পিউয়ের। কিন্তু অভিমান একটু হয়েই থাকল। পিউ যে একটা মানুষ, ওরও যে নিজস্ব কিছু চাওয়া পাওয়া আছে, ভালোলাগা আছে সেটার কথা আর কেউ না জানলেও মা তো খুব ভাল করে জানত। বড় বোনের সাথে এ নিয়ে কখনো আলোচনা করেনি পিউ আর এখন বলে খুব একটা লাভ হবে না।
বরপক্ষ রেডি হয়েই ছিল বোধহয়। আংটি পরানোর খানিক পরেই ছেলের খালা বলে বসল ,আমি বলি কী দুজনেরই যখন বাবা নেই, তখন অত ধুমধামেরও দরকার নেই। একটা কাজী ডেকে আজকেই বিয়েটা দিয়ে দাও। পিউয়ের বুকের মধ্যে যেন হাজারটা কামান দাগার মতো শব্দ হলো। বলে কী এরা! আজকে বিয়ে! ও সোফাতেই এতক্ষন ঘাড় নিচু করে বসেছিল। এবার সোজা আম্মুর দিকে তাকাল। কিন্তু আম্মু অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সাথে সাথে পিউয়ের বড়ো চাচাও বলে উঠলো, এটা তো খুব আানন্দের কথা। এখন কাবিনটা হয়ে থাক, আমরা না হয় পরে অনুষ্ঠান করে তুলে দিব।
সাথে সাথে শাহানা উঠলেন, "না ভাইজান আপনাদের অনুমতি থাকলে আমি আমার মামনিকে আজকেই নিয়ে যেতে চাই। বিয়ের অনুষ্ঠানে আপনাদের যাদের না বললেই নয় তাদের বলুন, বৌভাত আমরা বড়ো করে করব।এখন শুধু আপনারা রাজি হলেই হয়। "
পিউয়ের মনে হলো গলা ছেড়ে কাঁদে। কী সাংঘাতিক খারাপ ছেলেটা। ওর লাইফটা শেষ করে দিল। রিদমের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। কথা দিয়ে কথা রাখতে পারল না পিউ।
"কিন্তু শাহানা, এরকম ভাবে আমার মেয়েটার বিয়ে দেই কী করে বলতো? কোনো কিছুতো বানাইনি ওর বিয়ের জন্য। সামান্য কিছু টুকটাক গয়না আছে শুধু, তাও ওগুলো পিউ স্কুল, কলেজে পরে পরে পুরোনো করে ফেলেছে।"
কথাটা পারভীন না বলে পারলেন না। আসলেই কিছু করা হয়নি পিউয়ের বিয়ের জন্য।
"শুধু এই যদি কারন হয়, তাহলে তো আমি আমার পিউকে এখুনি নিয়ে উড়াল দেব। কিন্তু তোর যদি অন্য কোনো আপত্তি থাকে তাহলে আলাদা কথা।" শাহানা হাসলেন।
"নারে আর আপত্তি কিসে, মেয়ে যখন বিয়ে দিতেই হবে তখন আজকে আর কালকে কী... একই কথা। "
"আচ্ছা পিউয়ের কি আমার শ্রাবণকে পছন্দ হয়েছে?"
শাহানা আন্টির কথার উত্তর না দিয়ে পিউ মাথা নিচু করে বসে রইল। কী বলবে? উত্তরটা দেওয়া যদি এত সহজই হত। কিন্তু ও সত্যি সত্যি এই ছেলেটাকে ছাড়বে না। ওকে দেওয়া ওয়াদা সে রাখেনি। কাজেই ওকে বিয়ে করলে পিউয়েরও কথা রাখার কোনো দায় নেই।
চলবে...........
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top