পাঠ- ১ : আমাদের বুলু
আমাদের ঘরের উঠোনের ঠিক পাশে যে ছোটো জন্তুর ছায়া দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন, ওটা কিন্তু একটা বিড়াল।
আসলে আমার বাবার মৃত্যুর আগে থেকে এই বাড়িতে আছে।
বিড়ালটার দিকে হঠাৎ করে চোখ পড়লে যে কেউ চমকে উঠবে। কারণ এর সামনের দুটো পা নেই।
চোখেও মনে হয় ভালো দেখেনা। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এমনভাবে তাকায় যেন কোন কিছুর অবস্থান ট্রেস করতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। গায়ের রঙ একদম কুটকুটে কালো। সাইজেও ছোট। বাচ্চা বাচ্চা ন্যাদা টাইপ।
আপনি আমার কথা শুনে কালো রঙের যে বিড়ালের ছবিটা মনে মনে কল্পনা করতে পারবেন, তার কিন্তু দুটো পা-ই আছে। সুতরাং দুই পা বিহীন একটা বিড়াল দেখতে কতটা অদ্ভুত তা না দেখলে কল্পনা করা বেশ কঠিন।
যা বলছিলাম, .. কি যেন বলছিলাম? ও হ্যা! এই বিড়ালটার দুটি চোখের একটি দেখতে মনে হয় কেউ যেন খাবলে তুলে নিয়ে গেছে। চোখের অন্ধকার গহ্বর অনেক ভিতর পর্যন্ত বিস্তৃত। টর্চ মারলে ভিতরে লাল মাংস দেখা যায়।
আর অন্য চোখের দৃষ্টিও বেশ ঘোলা। ওর একমাত্র কাজ এক দৃষ্টিতে চুপ চাপ তাকিয়ে থাকা অথবা শুয়ে শুয়ে চোখ খোলা রেখে ঘুমানো। ( ও যে আসলেই ঘুমায় সেটা আমি অনেকবার টেস্ট করেছি! চোখের সামনে কাটা কম্পাস নিয়ে ফুটো করে দেবার ভয় দেখিয়েছি, রুটির টুকরা নিয়ে চোখের সামনে নাড়াচাড়া করেছি, চোখের পাত্তিও ফেলে না। মরা মনে করে কেউ লেজ ধরে টান দিলেই ধড়মড় করে জেগে ওঠে।)
আর জেগে থাকলে, উঠোন দিয়ে যে হেটে যায় তার দিকে ঘাড় কাত করে একবার তাকাবেই।
কেউ যদি একটা লাথি দিয়ে চলে যায়, কিংবা লেজে পাড়া দিয়ে চলে যায়, তারপরও সে কোনো শব্দ না করে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে।
প্রতিদিন ভাবতাম সকালে উঠে দেখব বিড়ালটা মরে গেছে। দেখে তাই মনে হয়, কারণ যেভাবে চোখ খোলা রেখে ঘুমায়, যে কারো সন্দেহ হবে, এটা মরা বিড়াল!
এই বিড়ালটা মিউ মিউ করে ডাকতে পারে কি পারে না তাও কেউ জানেনা। প্রথম প্রথম কুকুররা এসে ঘাটাঘাটি করতো, কামড়া কামড়ি করতো, ঘাড় ধরে মটকা মটকি করতো। কিন্তু বিড়ালটার কোনো রকম রিএকশ্যান না দেখে শেষে বিরক্ত হয়ে চলে যেত। এই পাড়ার সব কুকুরই তাকে এক নামে চিনে। কেউ ঘাটেনা তাকে এখন।
ব্যাপারগুলি অন্যদের কাছে আজব মনে হলেও আমাদের কাছে সাধারণ হয়ে গেছে। বাইরের কেউ এলে ব্যাপারটা নিয়ে সাংঘাতিক অস্বস্তিতে থাকে। ঘরে ঢুকতে বের হতে বারবার চোখে পড়ে এমন বিকৃত চেহারার একটা বিড়াল। তাদের জন্য এটা মোটেও সুখকর না।
আমাদের কাছে তো পান্তা ভাত। গত সাত বছর ধরে এভাবেই দেখছি। এখন বরং না দেখলেই অস্বস্তি লাগবে। এমনকি ভয়ও লাগতে পারে।
তবে একটা জিনিস দেখে আমার
গা প্রায়ই কিন্তু শিরশির করে ওঠে। ঘর থেকে কেউ বের হলে সে যখন মাথা তুলে তাকায়, ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে আবার লোকটার পিছনে তাকায়।
দেখে মনে হয়, যেন লোকটার পিছন পিছন আরো একজনকে বাইরে আসতে দেখেছে। যে কেউ সন্দেহ নিয়ে পিছনে তাকাবে, কিন্তু পিছনে কেউ নেই।
সন্ধ্যাবেলা যখন বিদ্ধস্ত শরীর আর হাতে ক্রিকেট ব্যাট আর বল সাথে নিয়ে ফিরি তখন ওর সাথে দুই দন্ড বাক বিতন্ডা হয়।
" বুঝলি রে বুলু! ( বিড়ালটাকে আদর করে বুলু ডাকি! :p) আজকা এমন ঘুরান্টি বল দিছি যে দুইটা নাড়া (স্ট্যাম্প) একসাথে উড়ি গেছে! "
এই কথা শুনে কুলুর মনে কোন ভাবান্তর হয়না। এদিক ওদিক তাকায় শুধু।
বিড়ালটাকে আসলে যে কোন নামে ডাকলেই সে বুঝতে পারে। যেমন- কুলু, কালু, কালুয়া, বুলু, বালু। মুলু, মালু। পিলু, পালু এমনকি আলু ডাকলেও সারা দেয়।
"বুঝলিরে আলু! আমি কিন্তু ব্যাটিং পাইনা একদিনও। প্রতিদিন শুধু বল টোকাই। মাঝে মাঝে এক দুই ওভার বল করতে দেয় আল্লাহ্র ওয়াস্তে।"
কুলু বিরক্তি নিয়ে তাকালো আমার দিকে। আমি বলে চললাম,
"তাও পুরা না। মাঝখানে আম্পায়ার থামায় দিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'কিরে তুমি ব্যাটসম্যানকে ঢিলাচ্ছ কি জন্যে!'
বন্ধুরা বলে আমি ন্যাশনাল টিমে খেললে নাকি ঢিলায় ঢিলায় সবাই কে কানা করে দিবো। তখন তারা নাকি খেলার বদলে গুলিস্থানে রাস্তার পাশে বসে বসেই ভিক্ষা করে কোটিপতি হয়ে যাবে।
ঢিল আবার কি!! নাড়া ফেলাইতে পরলেই হইছে। তাই না রে! "
এ পর্যন্ত বলার পরই আমি লক্ষ্য করলাম বুলু আমার পিছন দিকে ঘুরে তাকিয়েছি। আমার বুক ছেৎ করে উঠলো। কারন আমার পাশে কোনো এক জনের ছায়া দেখা যাচ্ছে। এমন হওয়ার তো কথা না। বাসায় আমি আর বুলু ছাড়া আর কেউ নেই। কয়েক মুহূর্তের জন্য শ্বাস নিতে যেন ভুলে গেলাম।
হয়ত মাথা ঘোরালেই দেখবো সবসময়ের মত পিছনে কেউ নেই। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে চুপ করে থাকলাম। পিছনে ঘুরলাম না এর পর কি হয় দেখার জন্য।
ছায়াটা নড়ছে। ধীরে ধীরে হাত উপরে উঠে যাচ্ছে ছায়াটার। হাতে বাঁকানো কিছু একটা দা'এর ফলার মত লাগছে।
ধীরে ধীরে প্রচন্ড ক্ষিপ্রতায় নীচে নেমে আসছে ওটা, আর এক মুহূর্তের মধ্যে ওটা আমার মস্তিস্ক শরীর থেকে আলাদা করে দেবে। সারা উঠোন ভেসে যাবে রক্তে..
মধ্যরাতের এ অমানিশায় কেউ টের পাবেনা কি হয়েছিলো এখানে। একটি নিথর দেহ ছাড়া আর কোনো চিহ্ন থাকবেনা পড়ে।
ছায়ার কখনো চিহ্ন থাকেনা!
.....
Turn The Page... :)
***Next part revealed ****
vote & comment if you liked the first part :)
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top