#৪. "ভ্যাসোভেগাল সিনকোপ"
"এ-একি, রাইমা? আপনার পা কাটলেন কিভাবে? আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?'' স্যার ভয়ার্ত সুরে আমাকে প্রশ্ন করলেন।
আমার খুব করে বলতে ইচ্ছা হলো যে, হ্যাঁ স্যার, আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, অনেক। মরে গেলে যদি এই কষ্টটা একটু কমতো।
কিন্তু আমি এর কিছুই বললাম না। আমার মধ্যে কেমন যেন একটা অস্থিরতা বোধ করলাম। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। গলায় আটকে গেলো সম্ভবত। তার দিকে আরো একবার তাকালাম। স্টিল সেই আগের ভঙ্গিতেই বসা। সে আর রঞ্জিত বাদে সবার চোখ যে আমার দিকে চেয়ে আছে তা বুঝতে আর বাকি রইলো না আমার। সেই এক ফোঁটার পর আর জল বের হয়নি আমার চোখ দিয়ে। আমার মনের ভেতর বোধ করলাম কেউ যেন অনেক চাপ দিচ্ছে। চোখের সমস্ত জল বের করতে চাইলাম। সেই চেষ্টা বিফলে গেলো। আমার অস্থিরতার কষ্টটা ক্রমেই বাড়তে লাগলো। কিছুক্ষণ পর মনে হলো, কানে আর কিছু শুনতে পারছি না। আপনাতেই চোখ বন্ধ হয়ে মাথাটা কেমন ভারী হয়ে উঠলো।
__________________________________________________________________________
চারদিকটা অন্ধকার। কোথাও কারোর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। আমার গলার নিচের দিকটায় বেশ খানিকটা শীতল একটা কিছু অনুভব করলাম। ডান হাতটা একটুর জন্য নাড়াতে চাইলাম। পারলাম না। আমার দুটো হাতই ভীষণ ভারী মনে হচ্ছে। এবার আমার ঘাড়ের পেছনের দিকটায়ও একটু একটু ঠান্ডা মতোন কিছুর উপস্থিতি টের পেলাম। তবে সে যা-ই হোক না কেনো, এই রকম শান্তি এর আগে কবে পেয়েছি ঠিক মনে করতে পারলাম না। চেষ্টা করলাম আমার শরীরটা একটু নাড়াতে, তাতেও নিজেকে মনে হলো একটা ইটের বস্তা। একেবারেই নাড়াচাড়া করা যাচ্ছেনা। শুধুই ইচ্ছা করলো ঘুমাতে। অনেক করে ঘুমাতে। যেন এই ঘুম থেকে কোনোদিন আর না উঠি।
"আংকেল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি আছি রাইমার সাথে। এখানে কোনো অসুবিধা নেই। রাইমার জ্ঞান ফেরা মাত্রই আমি আপনাকে ইনফর্ম করবো,'' শুভ্রর পরিচিত গলার স্বর শুনে আমি চমকে উঠি।
ওয়েট আ মিনিট, হোয়্যার অ্যাম আই?
এতোক্ষণে আমার জ্ঞান ফিরলো। আমি বোকাচন্দ্রের মতো চোখ বন্ধ করেই ভেবে নিয়েছি যে চারদিকটায় কোনো আলো নেই। কিভাবে চোখ খুললাম জানিনা। আমার ডান দিকে রঞ্জিত বাচ্চা ছেলেদের মতো মলিন মুখে বসে আছে। শুভ্র দরজার কাছে ওপাশ ফিরে দাঁড়িয়ে।
""রাইমা, আর ইউ ওকে? রঞ্জিত বেশ এক্সসাইটেড হয়ে গেলে একটু জোরেই কথাবার্তা বলে।'' ওর কথা শুনে শুভ্র দৌঁড়ে ছুটে এলো।
"রাইমা, এভরিথিং ইজ ফাইন, ওকে? অ্যাম হিয়ার। রঞ্জিত ইজ হিয়ার টু,'' শুভ্র আমাকে আশ্বস্ত করে।
আমি এবার উঠে বসতে বসতে বললাম, "অ্যাম টোটালি ফাইন।''
"আরে, পাগল নাকি? উঠছিস কেনো?'' রঞ্জিত চেঁচিয়ে ওঠে।
"লিস্টেন রাইমা, ডাক্তার আসুক, এরপর পাওয়া যাবে,'' আমার গলার কাছে আইসব্যাগটা ঠিক মতো বসিয়ে দিয়ে শুভ্র বলতে থাকে।
রঞ্জিত মনে হয় আমার জ্ঞান ফেরা মাত্রই সুইচ প্রেস করে নার্সকে ইনফর্ম করেছে। সিনেমার মতো করে মধ্যবয়স্ক একজন নার্স হাতে একটা বোর্ড নিয়ে এলেন। আমাকে চেক করে আশেপাশের কম্পিউটার-টাইপ স্ক্রিনেও যেন কি কি করলেন। ওই মুহুর্তে নিজেকে এ লেভেলস্ সাইন্সের স্টুডেন্ট আর বায়োলজির ফ্যান ভেবে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছা করলো কারণ সেসব যন্ত্রপাতির কোনোটারই নাম আমার জানা ছিলোনা। খানিকবাদেই ডাক্তার এলেন। ডাক্তারকে একটু চেনা-চেনা লাগলেও ঠিক মনে করতে পারলাম না যে কোথায় দেখেছি।
ডাক্তার আপু আমার কাছে আসলেন। হাসপাতালের ওষুধের গন্ধের পরিবর্তে ওনার কাছ থেকে কোনো ফুলের হালকা সুঘ্রাণ আসলো। কপালে হাত রেখে বেশ নরম স্বরে তিনি বললেন, "রাইমা, তোমার একটু জ্বর আছে তবে তুমি তো দেখছি পুরোই ফিট। তুমি কি খুব বেশি টেনশন করো?''
এর উত্তরে কি বললে ঠিক হবে বুঝতে পারলাম না। সোজাসাপ্টা ভাবেই বললাম, "মাঝেমধ্যে হয়। হয়ে যায় কোনোভাবে।''
ডাক্তার আপু বললেন, "হুম, এটায় আমাদের একটু হলেও কন্ট্রোল আছে। আচ্ছা, তুমি কি বেশ অন্যমনস্ক হয়ে থাকো? তোমার কপালে ফ্রেশ কাটা দাগ, আজকে পায়েও কেটেছো। ইজ এভরিথিং ট্রুলি ফাইন?''
এমন প্রশ্নে আমি শুভ্রর দিকে তাকাই। ও কঠিনভাবেই আমার দিকে তাকালো। ওর যে আজকে আমার জন্য অনেক হ্যাসেল ফেস করতে হয়েছে সেটা আমি বুঝতে পারছি। তা-ও আমার লেইম কাহিনীতে। ও আজকে একটা টি-শার্ট আর থ্রী-কোয়ার্টারস্ পড়েই বেরিয়ে পড়েছে।
আমি এরপরও সহজসরল ভাবে উত্তর দিলাম, "আসলে, কপাল কাটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। আর পা বোধহয় আজকে কোচিংএ যাওয়ার সময় রোড ক্রস করতে গিয়ে কেটেছে। অ্যাই থিংক অ্যাই ওয়াস নট পেয়িং অ্যাটেনশন।''
"যাক গে, যেটা বলতে চাই সেটা হলো তুমি একদমই ঠিক আছো। পায়ের কাটা বেশি সিরিয়াস না তবে রোড ক্রস করতে গেলে আরো সাবধান হতে হবে ফার্দার ড্যানজারাস কোনো অ্যাকসিডেন্ট প্রিভেন্ট করতে হলে। আর তুমি ক্লাসে সেন্সলেস হয়েছো কোনো স্ট্রেসফুল ইভেন্টের কারণে। যার ফলে তোমার ব্লাড প্রেশার হাই হয়ে গেছে। ডাক্তারি ভাষায় বলতে গেলে যাকে বলে ভ্যাসোভেগাল সিনকোপ। কোনো কারণে স্ট্রেস নিয়ো না, রাইমা। দিস ইজ নট হেলথি ফর ইউরসেল্ফ অ্যান্ড ইউর স্টাডিজ।''
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
"তা যা-ই বলো না কেনো দিদি, আমি কিন্তু আজকে খুব ভয় পেয়েছিলাম। শুভ্র ডেকেছে আল্লাহকে আর আমি ডেকেছি ভগবানকে। রাইমার ভালো না হয়ে কোনো উপায় ছিলো না।''
আমার তখন একটু মনে পড়লো। এই আপু রঞ্জিতের দূর-সম্পর্কের কোনো এক দিদি হয়। কিছুদিন আগেই এই আপু চাকরি পায়, তখন সেই পার্টিতে আমরা ইনভাইটেড ছিলাম। আজকে মেকাপ ছাড়া প্লাস আমার অসুস্থতায় তাকে ঠিক চিনতে পারিনি।
"এনিওয়ে, রাইমা শুড বি টেকিং রেস্ট। ও বাড়ি যেতে চাইলেও ঠিক আছে আর না হয় হাসপাতালে স্টে করতে পারে। যেটা ওর ইচ্ছা।''
আমি সঙ্গেই সঙ্গেই বললাম, "আমি বাড়ি যাবো, প্লিজ।''
______________________________________________________________________________
রাত তখন প্রায় সাড়ে নয়টা। সুস্মিতা দিদি তার গাড়ির ড্রাইভারকে বলেছে আমাকে আর শুভ্রকে ড্রপ করে দিতে। আমি গাড়িতে ওঠার আগেই বাবার সাথে ফোনে অল্প করে কথা বললাম। বাবা ঢাকা গেছে দুই দিনের জন্য কোর্টের কাজে। সেটা আগেই জানতাম। আর আমার মা গেছে চিটাগং নাচের ইভেন্টে। মাকে নাকি আজকে বিকালে লাস্ট মোমেন্টে কল করেছে, গাড়িও পাঠিয়ে দিয়েছে আগামী কালকের শোয়ের জন্য। ভাগ্যিস মা কোনো কিছুই জানেনা। না হলে ফোন কলে গালি খেতে হতো। আর বাবা শুধু জানে আমি একটু সিক হয়ে গেছি।
আমি শুধু ভাবছি গাড়িতে থেকে নামার পর শুভ্রর ঝাড়ি খাবার কথা। প্লাস কেমন যেন লাগছে, শুভ্রর আম্মুর কাছ থেকে আমাদের ফ্ল্যাটের চাবি নিতে যাওয়ার কথা ভাবতেই। আমি আর কাউকে ফেস করার শক্তিটাই পাচ্ছি না। শুভ্ররা আমাদের পাশের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং এ থাকে তাই আমার মা হুটহাট কোথাও গেলে ওদের বাড়িতে আমাদের ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে যায়।
এর খুব অল্প সময় পরই বাড়ির কাছে পৌঁছে গেলাম। হাসপাতালটা ঠিক আমাদের কোচিং এর পাশেই। এখান থেকে বাড়ির দূরত্ব পায়ে হাঁটা ৭-৮ মিনিটের মতো।
"চাবি নে, কালকে সকালে টেক্সট দিবি। সি ইউ লেটার।" বাড়ির কাছে এসে শুভ্র এই বলে চলে গেলো। আমি কেবল আমার মাথা নাড়লাম। আর কিছু বললাম না। হি ওয়াজ ক্লিয়ারলি আপসেট উইথ মি।
ড্রেস চেন্জ করে সবার আগে আমার ফোন হাতে নিলাম। মা আমার ফোনে চার্জ দিয়ে রেখেছিলো। রঞ্জিতের একটা টেক্সট এই রকম: "হে রাইমা। প্লিজ টেক্সট সুস্মিতা দি হয়েন ইউ আর ফ্রি। হিয়ার ইজ হার নাম্বার। শি সেড শি ওয়ান্টেড টু টক টু ইউ ইন প্রাইভেট।''
*****
লেখিকার কথা
এই চ্যাপটারটি পড়ে সাথে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার মূল্যবান মতামতটি অবশ্যই জানাবেন। আশা করছি আগামী চ্যাপটারগুলোতেও এই একই পাঠকদের আমি পাশে পাবো।
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top