#৩. "খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার..."
বারোটা মিস্ড কলস্ নিয়ে আমার সদ্য কেনা নীল নকিয়া লুমিয়ার স্ক্রীন আঁধারে জ্বলজ্বল করে উঠলো। আমার প্রায় নিহত হৃদয় আবারো বেঁচে ওঠার আশায় স্বপ্ন দেখতে লাগলো। তবে সে স্বপ্ন যেনো নিমেষেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। এখন কল করবার সময় নয়। রাত্র সাড়ে এগারোটা বাজে কোনো ছেলে বন্ধু তো দূরে থাক আমি কোনো মেয়ে সহপাঠীকেও কল করার জন্য এলাউড না। তাই টেক্সট মেসেজ করাটাই আমি শ্রেয় মনে করলাম।
"কি হয়েছে?"
"কি হয়েছে মানে? আগে বল তোর বাসায় সব ঠিক আছে কিনা?!"
"কেনো? আমার বাসায় আবার কি হবে?"
"আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমাকে উল্টো প্রশ্ন করবি না! খবরদার বলে দিলাম!"
"..."
"কিহ?"
"কিছু না।"
এরপর প্রায় দুই মিনিট ধরে স্ক্রীনে "টাইপিং" ভেসে রইলো। আমি ফোন ছাড়তে চেয়ে উদ্যত হলেও শেষ পর্যন্ত পারলাম না।
"আমার কথা শোন। ওই ছেলের কথা তোর মাথার থেকে ঝেড়ে ফেল। এই ঘটনার জের ধরে বাসায় কিছু করিস না। ব্যাপারটা শুধু ওই বাসায় জানে, তোর বাসায় না। সুতরাং এই দিকটায় তোর এডভানটেজ আছে; তোর বাসায় তোকে মেন্টাল প্রেশারে রাখবে না। তবুও, তুই একটা মেন্টাল প্রেশারে আছিস আমি জানি। তোর জীবনে এখনো অনেক ব্রাইট ডেজ্ আসা বাকি। আজকের মতো সেইসব দিনেও তোর পাশে আমি থাকবো। আই লাভ ইউ, রাই। আই ওয়ান্ট দ্য বেস্ট টু হ্যাপেন টু ইউ।"
"আই এ্যাম ফাইন, শুভ্র। থ্যাংক ইউ। আমার জন্য কাউকে মাথা ঘামাতে হবে না। যা ঘুমাতে যা।"
এই বলে আমি ফোন সুইচ ওফ করে রেখে দিলাম।
বারবার মনে হতে লাগলো আমার এই দিন দেখার ছিলো না! আমি কি কোনো দিন কারো সাথে খারাপ কিছু করেছিলাম যার কারণে আজ আমার সাথে এমনটি ঘটেছে? জানি না। ঠিক মনে পড়ছে না। আমি জানিই না কিভাবে আমি আগামী দিনগুলো কাটাবো! আমি জানিই না কিভাবে আমি অনিককে ছাড়া আমার স্বপ্নগুলো পূরণ করবো! এতোদিন আমার প্রতিটি ক্ষণ কেটেছে যার সাথে, তাকে ছেড়ে সব কিছু করাটা আমার কাছে অসম্ভব মনে হয়! এরই সাথে জল গড়িয়ে পড়ে আমার চোখ থেকে, বালিশ ভেজে আরো একবার। পর্দার আড়াল থেকে খানিক উঁকি দেয় জোৎস্না, তবে কি এই জোৎস্নাই কোনোদিন আলোকিত করবে আমার জীবন?
পরের দিন
ম্যাথস্ ক্লাসে সে আমার পাশে বসলো না; বসার কথাও না। আমাদের ক্লাস হচ্ছে সিনিয়রদের সাথে। ব্যাচমেটস্ বলতে কেবল আমরাই। সে আমার থেকে বসেছে দুই ডেস্ক সামনে। ক্লাসের অন্য সবাই আড় চোখে তাকাতে লাগলো তা আমি ঢের বুঝতে পারলাম কারণ এর আগে আমরা কখনো আলাদা বসিনি। প্রতিদিনের মতো স্যার আজকেও লেট। লোকটার কষ্ট আছে বলতে হয়: স্কুলের ক্লাসেস্ কোনো মতে শেষ করে সে বাড়ি গিয়ে লাঞ্চ করে এরপর কোচিং এ আসেন।
আমার পেছনের সিটে নিবেদিতা দিদি কাকে যেনো কল করে বললেন আজকে নাকি ইন্টিগ্রেশন বাই সাবস্টিটিউশনের হোমওয়ার্ক জমা দেয়ার দিন। আমি আমার জীবনের সাম্প্রতিক ঝড়ে তা বেমালুম ভুলে গিয়েছি। চটজলদি আমার খাতা বের করে দেখলাম আগে ভাগে সেই এক্সারসাইজ সলভ্ করেছি কিনা। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর তা পেলাম - তারিখ দেখলাম, দুই সপ্তাহ আগের করা। ম্যাথসের এই তুচ্ছ সমস্যার তো সমাধান হলো, হায় যদি জীবনের সমস্যাগুলোর এমনি অবসান ঘটতো তাহলে কি দারুণই তা হতো!
গুড আফটারনুন, স্যার।
স্যার এসে পড়েছেন, সাদা শার্ট পরিহিত, ঘামে ভেজা। আমি তাকে গ্রিট করার সুযোগ না পেলেও সবার সাথে সাথে ঠিকই দাঁড়িয়ে পড়লাম। স্যার বোর্ডে ম্যাথস্ করা শুরু করলেন। তিনিও দেখেছেন যে আজ আমরা একসাথে নই।
পরক্ষণেই বললেন, "রাইমা, তুমি সামনে এসে অনিকের সাথে বসো! আর নিবেদিতা, তুমিও সামনে এসে বসো। সামনে এতোগুলো সিট খালি রেখে তোমরা পেছনে কেনো বসেছো?"
কোনো যুক্তিগত উত্তর আমার মাথায় এলো না। নিবেদিতা দিদি ও দিব্যি সামনে গিয়ে বসলেন। এবার আর আমার কোনো পথ নেই। সামনে যেতেই হবে আমাকে।
বসার আগেই চেয়ারটাকে তার থেকে দূরে টেনে নিলাম। ক্র্যাচ করে মাটিতে একটা বিশ্রী শব্দ হলো। দূরত্বের শুরু না হয় এখান থেকেই হোক।
তার দিকে তাকালাম না। তবে সে যে আজ ওয়াইল্ডস্টোন বডি স্প্রে লাগিয়েছে তার ভুবন ভোলানো সৌরভে আমার পুরোনো দিনের মতো নেশা হতে লাগলো। এই ঘোর থেকে আজ আমার বেরোতেই হবে। আজ থেকে অভদ্র হওয়ার দিন শেষ। আমি অন্য দিকে ফিরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম।
আমি চাই না সে জানুক আমার দূর্বলতার কথা। তাই আমার খাতার দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। মার্ক করা না পারার ম্যাথসের নম্বর স্যারকে বললাম, যেনো সে সেটা সলভ্ করে দেয়।
ম্যাথস্ ক্লাস শেষ হলো। অন্য দিন হলে আজ আমরা একসাথে যেতাম ফিজিক্স ক্লাসে। আমি জানি সে আমার সাথে যাবে না। আমি তাই ইচ্ছে করেই ম্যাথস্ ক্লাস থেকে দেরিতে বের হলাম। রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম সে বেশ এগিয়ে আছে। প্রায় পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ যে আজ আমার কাছে দীর্ঘায়িত মনে হবে তা আমি ভালো করেই টের পেলাম। এই পাঁচ মিনিটের পথই যে আগে কতো সুখকর ছিলো তা ভেবে আমার আফসোস হয়।
সে আজ কালো শার্ট পড়েছে। খুব মন চাইছে তাকে একবার সামনে থেকে দেখতে।
আমার ফোনের ওয়ালপেপারেই তো তার ছবি! একটু দেখি! রাস্তার সাইডে দাঁড়িয়ে আমার ব্যাগ হাতরাতে লাগলাম, কোথায় গেলো আমার ফোন?! কোচিং এ রেখে আসলাম নাকি? ভালো করে মনে করার চেষ্টা করি, কই না'তো আমি কোচিং এ ফোনই বের করি নি! তাহলে গেলো কোথায়?
বাড়িতে ফেলে এসেছি। গতরাতে শুভ্রর সাথে কথা বলেছিলাম। সেই থেকে আজ সারা দিন বিছানাতেই বেহুশ হয়ে আছে আমার ফোন, আমারই মতোন। হাতঘড়ি ও পড়ি নি, কখন থেকে রাস্তায়ই দাঁড়িয়ে আছি। ক'টা বাজে কে জানে! ক্লাস শুরু না হলেই হয়।
আমি পা চালালাম। এখন সাবধানে লিংক রোড ক্রস করতে পারলেই হয়। চাষাঢ়া লিংক রোড হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ভয়াবহতম একটি রাস্তা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই রাস্তা পার হলেও এখনো এইখানটাতে কোনো ফুটওভার ব্রিজ নেই। তিন দিক দিয়ে এইখানে গাড়ি আসে, কতো এক্সিডেন্ট হতে দেখেছি এখানে, তারপরেও প্রশাসনের টনক নড়েনি। আদৌ নড়বে কিনা জানি না। তার সাথে বহুবার এই রাস্তা পার হতে গিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা হয়েছে আমার, তবে আজ তাকে ছাড়া প্রথমবারই পার হতে হবে।
সব কিছুরই প্রথম আছে। আর সবসময় আমার সাথে সাথে কেউ ঘুরঘুর করবে না। নিজেকে কিভাবে একা সামলাতে হয় তা আমাকে শিখতে হবে। এই মুহূর্তে কেউ ক্রস করছে না, মানুষের জন্য আর অপেক্ষা করাটা আমার ঠিক মনে হলো না।
কিছুটা ক্রস করতেই মনে হলো বাঁ পায়ের একটা অংশ জুড়ে ধারালো কি যেনো লাগলো। ব্যথা লাগলো না তেমন, তবে সেসব দেখার এখন সময় নেই।
ফিজিক্স ক্লাসে পৌঁছালাম ক্লাস শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিট পরে।
"রাইমা! আপনি এতো দেরি করলেন কেনো?" স্যার না রেগে স্বাভাবিক কন্ঠেই বললেন।
"স্যার, অন্য ক্লাস ছিলো তো, তাই," আমি ভাঙ্গা গলায় উত্তর দিলাম।
"ওহ্। তা আর দেরি" - "আরে, রাইমা তোর বাঁ পায়ে অমন রক্ত কেনো?" স্যার কথা শেষ করার আগেই রঞ্জিত চেঁচিয়ে উঠলো।
এবার আমি ভালো মতো লক্ষ্য করলাম, সত্যিই বাঁ পায়ের পেছন দিকটায় আমার সাদা সালোয়ার জুড়ে রক্তে রাঙানো। কারো রক্ত এমন টুকটুকে লাল হয় তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না।
তার মুখটা আজ সারাদিনে প্রথমবারের মতো দেখলাম; কালো শার্টে নায়কের মতো অসম্ভব হ্যান্ডসাম লাগছে। সে মুখ গুজে রেখেছে বইয়ের পাতায়।
রঞ্জিত আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চেয়ারে বসালো, কি যেনো করলো আমার পায়ে। আমার অজান্তেই মুখ দিয়ে "আহ্" বের হলো। সে তাকালো না আমার দিকে। আমার বাঁ চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মনে প্রাণে চাইতে লাগলাম আজ কেনো এর থেকে বড় কোনো দূর্ঘটনা ঘটলো না।
নাহ, রাইমা। মনের ভুল ভাঙ্গার সময় হয়েছে। সেই কালো শার্টের হাত হয়তো আর কোনো দিন ধরা হবে না। সেই পাখি আর আমার নেই। খাঁচা ভেঙ্গে সেই পাখি আমার কবেই পালিয়েছে।
*****
লেখিকার কথা
এই চ্যাপটারটি পড়ে সাথে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনার মূল্যবান মতামতটি অবশ্যই জানাবেন।
আশা করছি আগামী চ্যাপটারগুলোতেও এই একই পাঠকদের আমি পাশে পাবো।
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top