#2
#প্রতীক্ষার_প্রহর
#২
প্রান্ত হল সাবিহার মত আমার জীবনের একমাত্র ভালো ছেলে বন্ধু যার সাথে কাটানো ছোটবেলার সময় গুলো অদ্ভুত রকমের সুন্দর ছিল। আমি অনেক বেশি মিস করি ছোটবেলার সেই প্রান্তকে। স্কুলে ভর্তি হবার ৬ মাস পর প্রান্তের আর্বিভাব ঘটে।প্রান্ত যেইদিন স্কুলে এসেছিল সেই দিন সে আমার আর সাবিহার পাশে বসেছিল।যদিও সাবিহা তাকে কিছুতেই বসতে দিতে চায়নি,কিন্তু আমার কারণে তাকে বসতে দেয়।সাবিহা সবসময় আমার পেন্সিল ইরেজার নিয়ে টানাটানি করত,তাই একদিম আমার প্রিয় গাজরের ইরেজারটা গায়েব করে দিলে প্রান্ত তার পকিমনের ইরেজারটা আমাকে দিয়ে দেয়।সেই থেকে আমারা খুব ভাল বন্ধু।
কিন্ত সাবিহা সেটা দুচোখে দেখতে পারত না।কারন প্রান্তকেও আমি সাবিহার মতই সমান গুরুত্ব দিতাম।এই নিয়ে প্রান্তের সাথে সাবিহার অনেক বেশি মন কষাকষি সেই ছোটবেলা থেকেই ছিল! আমাকে নিয়ে প্রায়ই দুজনে টানাটানি করত, সত্যি বলতে তখন নিজেকে একটা ইরেজার মনে হত!! সাবিহা ছিল বেখেয়ালি যার জন্যে আমাকে যেকোনো সময় বেকায়দায় পড়তে হত,আর প্রান্ত সবসময় আমাকে সেখান থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসত। সাবিহা আর প্রান্ত ছিল টম অ্যান্ড জেরির মত,সারাদিন একজন আরেক জনের পিছে লেগে থাকত কিন্তু দিনশেষে ২ জন একসাথেই থাকত। ওদের ঝগড়া আর মনকষাকষি পুরাটাই ছিল আমাকে ঘিরে, কে আমার কাছে বেশি গুরুত্ব পাবে!
তবে ব্যাপারটা আমার কাছে যতটা না মজার ছিল তার থেকে বেশি বিরক্তের ছিল।আমাকে ওদের এত গুরুত্ব দেয়া যতটা না আমার ভালো লাগতো তার থেকে বেশি বিরক্ত লাগত,আমাকে নিয়ে এত টানাটানির কি আছে?? প্রান্তকেই বেশি বিরক্ত লাগত কারণ প্রান্ত আমার সব বিষয়েই খুব বেশি খবরদারি করত আর সবসময় অধিকার খাটাতো।প্রান্তের এই বিষয়টা মনে করতেই আমার মুখে একচিলতে হাসি ফুটল, সেইসাথে চোখ থেকে মনের অজান্তে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরতে থাকল।
উফ,ইরেজারগুলো রেখে একটু থামলাম, আমার একটু বিশ্রাম প্রয়োজন।এই মুহূর্তে মা ডাকছে।আমার মা, মিসেস দিলরুবা খানম।প্রচন্ড ভালো মনের মানুষ,নিজের মা বলে বলছি না,মায়ের মন সত্যিই অন্যরকম।আগে পুরোই গতানুগতিক আধুনিক মনমানসিকতার ছিল,কিন্ত এখন এই মানসিকতায় একটু পরিবর্তন এসেছে। তিনি আজ ১০ বছর যাবত practicing মুসলিম যার মানে তিনি ইসলাম নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছেন। আগে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া হলেও ইসলাম নিয়ে তিনি ততটা সচেতন ছিলেন না আর ছিলেন প্রচন্ড ফ্যাশন সচেতন মানুষ। এই ১০ বছরে ইসলামকে ভালো করে আকড়ে ধরতে অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে মাকে।আমাদের যে ভাবে ছোট থেকে তিনি বড় করেছেন তা এখন অনেকটাই বদলে গেছে। ইসলামকে যেদিন থেকে গুরুত্বের সাথে মানতে শুরু করেছেন সেইদিন থেকেই আমাদের সাথে মতামতের অমিল দেখা দিয়েছে,বিশেষ করে আমার সাথে।
তবে আমার ভাইয়া,মাহিন আর আপু, মেহজাবিন মায়ের কথা বুঝলেও আমি কখনোই মায়ের কথা বুঝতে চাইনি।হয়ত এতে আমার দোষ কিছুটা আছে,বা খুব একটা নাই।সে ছোট থেকে দেখেছি মা আমার ভাইবোনকে তাদের জীবনে যথেষ্ট ছাড় দিলেও আমাকে সেই ছাড় দেয়া হয়নি।মায়ের কথা শুনতে আমার খুব একটা ভাল লাগে না,মাঝে মাঝে নিজের ভেতর বড্ড অভিমান হয়।
মা,মিসেস দিলরুবা খানম এক বুক দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়েন মাঝে মাঝে। আমাকে সবার ছোট হিসেবে সবচেয়ে ভালো শিক্ষাই দিতে চেয়েছেন,ইসলামিক অনুশাসনে বড় করতে চেয়েছেন কারণ ভাইয়া আপুর সময় অসচেতন থাকলেও আমাকে বড় করার সময় মা আর সেরকম নেই।মা তখন ইসলাম সম্পর্কে এতো সচেতন ছিলেন না তাই আপু ভাইয়াকে ইসলামি অনুশাসনে বড় করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি কিন্তু পরবর্তীতে ওরা মায়ের পরিবর্তনটা ভালোভাবে মেনে নিয়ে নিজেদের জীবনেও ইসলামকে গুরুত্বের সাথে মানা শুরু করে।শুধু আমারই মেনে নিতে অনেক বেশি সময় লেগেছে। যেমন আমি আপুকে দেখেছি তার বয়সে হিজাব ছাড়া চলতে।কিন্তু আমার বেলায় উল্টো! বুঝ হওয়ার আগেই আমাকে হিজাব পরে থাকতে হয়।
তাছাড়া ভাইয়া আপুর দুজনেরই পছন্দের বিয়ে হলেও আমাকে মা কোনদিনও প্রেম করতে দিতে চাননি, খোলামেলা চলতে দেননি। মা আল্লাহর কাছে সবসময়ই এটা চান,আল্লাহ যেন আমাকে ভাইয়া আপুর মত হেদায়েত দান করে,আমিও যেন তার ভুলগুলো বুঝতে পারে ইসলামকে মন থেকে আকড়ে ধরতে পারি।আমি অবশ্য বুঝি,তবুও সবসময় মন মানে না,নফস বলে একটা ব্যাপার আছে না? আমার সাথের বদমাশ জ্বীন কুবুদ্ধি দেয়,সব এই শালার দোষ!
আমার জীবন নিয়ে মা অনেক বেশি চিন্তা করে,কারণ তার ধারণা এই এক বছরে আমি অনেক খারাপ যাচ্ছি।আমাকে এখন লন্ডনে পাঠাচ্ছে চাচার কাছে পড়তে অনেকটা মতের বিরুদ্ধে আর আমার জেদের কারণে।মায়ের ছেলেমেয়ের কম্বাইন্ড পড়াশোনা কখনোই পছন্দ না।যদিও আমার স্কুল ও কলেজ দুইটাই ছিল কম্বাইন্ড,তার কারণও আমার জেদ।আমাকে হাজার বার বলেও কাজ হয়নি,বন্ধুরা সব কম্বাইন্ড স্কুল কলেজে ছিল,আমিও ছিলাম।আমার আর বাবার জেদের কাছে মাকে হার মানতে হয়েছে।অবশ্য মায়ের মতে আমাকে যেটা বেশি মানা করা মেয়েটা সেটাই করি!মেয়ে আর তার বাবার জিদের কাছে কিছুই করার ছিল না মিসেস দিলরুবা খানমের,মানে মায়ের,হা হা হা!
বাবার মতে,মেয়েকে আস্তে ধীরে ধৈর্য ধরে বুঝানো উচিত,তাই আমাকে সামলানোর দায়িত্বটা বাবা,আনিসুর আবছার করে থাকেন।বাবাও মায়ের মতই ধারণা পোষন করেন, তিনিও চান আমি ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলি। কিন্তু আমরা ছোট থাকতেই মা বাবা ইসলাম সম্পর্কে সচেতন না থাকায় আজ আমাদের সাথে মানিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে,বিশেষ করে আমার সাথে!
অবশ্য বাবা এই চিন্তা থেকে অনেকটাই ভিন্ন।আমার উপর বাবার বিশ্বাস রয়েছে যে, জোর না করে আস্তে ধীরে বুঝালে একদিন আমি ঠিকই ইসলামের সব অনুশাসন সবকিছু মেনে চলব।বিগত ৬-৮ মাস ধরে বাবা আমার মধ্যে পরিবর্তন দেখেছে।যেমন - আমি আগের মত সব কিছুতে ঘাড় তেড়ামি না করে বুঝার চেষ্টা করি। আমাকে তিনি লন্ডনে পড়তে পাঠাচ্ছেন যেখানে চাচ্চুর বাসায় থেকে পড়াশুনা করব।ছেলেমেয়ের একসাথে পড়াশুনা করাটা শরীয়ত সম্মত না এইটা বাবা নিজেও জানেন এবং মানেনও।কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।পড়ালেখা করতে গেলে এখন ঘর থেকে বের হতে হয়,পুরুষদের সাথে তাল মেলাতে হয়,গ্রুপ ওয়ার্ক করতে হয়,কিছু করার নেই!তবে বাবার বিশ্বাস থেকে তার ধারণা,আমি সব ম্যানেজ করে পড়াশুনা করতে পারব।বাবার মতে,আমার এই সিদ্ধান্তই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিবে।এ নিয়ে মা চিন্তিত হলেও বাবা বেশ গর্ববোধ করে!
যখন খাওয়ার টেবিলে বসলাম,ঠিক তখনই মা...
চলবে...
লেখনীতে, #Abiar_Maria
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top