প্রথম অংশ ( মোহনা)

মনে অনেক দ্বন্দ্ব নিয়ে মোহনা আজ বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। ভাবনাচিন্তা সব লোপ পেয়েছে তার। সত্যি নাকি খুব কঠিন হয়, ছোটবেলায় শুনেছিল সে। সে বোঝেনি তখন এর অর্থ। তখন তো এটাই জানতো না যে সত্যি কাকে বলে! কিন্তু আজ সে জানে। আজ নিজে সত্যি মিথ্যের শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সে বোঝে সত্যে কতটা কষ্ট!
বাড়ি থেকে বেরোবার সময় সে কিছু বলে আসেনি। সে জানতো না যে সে কি করবে। তার যে বড় কষ্ট, সে বলতে পারেনি কাউকে। চোখের জলও যে অচেনা শত্রুর মত যুদ্ধ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। কান্নাও তার সঙ্গ দিল না।
বাস স্ট্যান্ডের পাশের ঝোপ জঙ্গলে এসে দাঁড়ালো সে। বোধবুদ্ধি তখনও আবছা, মাথা কাজ করছে না তার। মনের সমস্ত ক্ষোভ যেন পাগল করে তুলেছে তাকে। আজ অভিমান শব্দটাও ফিকে হয়ে গেছে। তার খুব রাগ হচ্ছে.. কিন্তু কার ওপর? নিজের ওপর?  কিন্তু কেন?
তার একবার মনে হয়েছিল, তার জন্মানোটাই উচিৎ হয়নি। কেউ তো তাকে চায়নি!  পরক্ষণেই তার মনে হয়, না!  একজন চেয়েছিল। আর সে তাকে চাওয়ার ফলও পেয়েছে!
আজ মোহনাও মায়ের কাছে যাবে ঠিক করেছে। গত তিন বছরে মা কে দেখতে তার খুব ইচ্ছে করত। তার মা বলত, মানুষ মারা গেলে নাকি আকাশের তারাদের মাঝে চলে যায়, সেও ভাবতো হয়তো মাও ওখানেই আছে। তাই সে সারাদিন রাত হওয়ার অপেক্ষা করত, মা কে দেখবে বলে।  কিন্তু প্রতি রাতেই ওই ছোট্ট মেয়েটার সব আশা ব্যর্থ হত।
আজ তার খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই সে ঠিক করল মায়ের কাছে সে যাবেই। জঙ্গলের মাঝে দাঁড়িয়ে সে চিন্তা করছে মায়ের মুখ টা। কতদিন দেখেনি সে! হঠাৎ কানে যেন কি একটা শব্দ এল! তার নাম ধরে কেউ ডাকলো?  হ্যাঁ!  ঠিক মনে হল যেন মায়ের গলা। সে জোরে ডাকলো মা বলে, কিন্তু কই!  কাউকে তো দেখতে পেল না সে! হঠাৎ সে থমকে গেল। মোহনার হাতের বিষের শিশিটা হাত থেকে আচমকা পড়ে গেল। সে পরিষ্কার ভাবতে পারছে, তার চিন্তা শক্তি ফিরে এসেছে! ১১ বছরের মেয়েটা তার জ্ঞানত কাটানো সম্পূর্ণ জীবন চোখের সামনে দেখতে পেল।
দুরে বাস স্ট্যান্ড দেখা যাচ্ছে। দুপুরের শেষ বাসটা এসে দাঁড়িয়েছে। যেকজন লোক ছোটখাটো একটা ভীড়ের সৃষ্টি করেছিল তারা সকলে ঠেসেঠুসে বাসটিতে চেপে গেলেন.  বাস চলে গেল। মোহনা ফাঁকা বাস স্ট্যান্ডের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। ফাঁকা রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আছে সে। স্ট্যান্ডের ছাউনি দেওয়া বেঞ্চগুলোর একটাতে এসে বসল সে। প্রথমবার তার চোখে জল এল। কান্না পাচ্ছে তার। চোখ থেকে জল তারও পড়ে? আজ জানলো সে। কড়া পড়ে যাওয়া ছোটো দুটো হাত তুলে চোখ মুছলো সে। সে প্রশ্ন করল নিজেকে, কেন সে মরতে যাচ্ছিল! কি দোষ তার? সে মেয়ে, এটাই কি তার দোষ? তাতে কি আদৌ তার কিছু করার আছে! কোনো উত্তর নেই।
তাহলে কেন ওরা তার মাকে কেড়ে নিল?  মায়ের জ্বলন্ত দেহ টার উন্মাদ চিৎকার তার কানে এখনও বাজে, এখনও সে দেখতে পায় তার মায়ের জ্বলন্ত দেহটা উন্নত্তের মত ছটফট করছে!  সে চোখ বুজলো, সহ্য করতে পারে না সে। আচ্ছা ওদের যদি মোহনাকে নিয়ে সমস্যা ছিল তবে ওরা মা কে কেন কষ্ট দিল!  আর মোহনাই বা বেঁচে আছে কেন!! যদিও মোহনা না থাকলে বাড়ির সব কাজ কে করত!
আজ ৩ দিন  জল ছাড়া আর কিছু তার পেটে পড়েনি। কাল সে জানতে পেরেছে যে তার নাকি বিয়ে। আচ্ছা বিয়ে টা কি?  তা তো সে জানে না। বড় জেঠুর মেয়ের নাকি বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু তা সে দেখতে পায়নি। সে তো অপয়া! সে থাকলে যে শুভ কাজে বাঁধা পড়বে, ঠাকুমা বলেছেন, অথচ এসব কথার অর্থও সে বুঝতে পারেনি। সে শুনেছে ওপাড়ার মাস্টার মশাইয়ের সাথে নাকি বাবা তার বিয়ে দেবে, তাতে বাবা অনেক টাকা পাবে।
মোহনা আজ পর্যন্ত সব মেনে নিয়েছে। খানিকটা যেন যন্ত্রের মত হয়েগেছিল সে। কথা বলা ছেড়ে দিয়েছিল প্রায়। আজ হঠাৎ তার খুব রাগ হল, রান্নাঘরে রাখা বিষের শিশিটা নিয়ে সে ছুটে বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে।
কিন্তু হঠাৎ তার কি হল? রাগে সে জ্বলছে এখন। কেন মরবে সে! কেন সহ্য করবে সব!? সে বলতে চায়, সব তাকে বলতেই হবে! কিন্তু কাকে বলবে সে? কেই বা শুনবে তার কথা?
একটা শব্দে তার জ্ঞান হল। দুরে সে দেখল একটা লোক অনেক জিনিস কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসছে।  এমন লোক মোহনা আগে দেখেছে! এদের ফেরিওয়ালা বলে সে শুনেছে!
উঠে দাঁড়ালো মোহনা।সে জানে তাকে কি করতে হবে। সে লোকটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল "কাকু! পুলিশকাকু রা থাকে যেখানে, ওই জায়গাটা কোথায় আমাকে একটু বলবে গো?" লোকটি অবাক হয়ে বলল "কেন মা? তুমি থানা খুঁজছো কেন?" মোহনা জবাব দিল "চুপ করে ছিলাম যে কাকু! দোষ করেছি, শুধরাতে হবে না!" লোকটি আরও অবাক হয়ে থানার পথ বলে দিল।
ছোট্ট মেয়েটা ধন্যবাদ বলে চলতে শুরু করল.........................

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top