দ্বিতীয় অংশ (নূপুর)
সেদিন দুপুরে অনেক লোকজন একসাথে দেখল নূপুর। জীবনে প্রথম এত লোক দেখল সে, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ সেই যন্ত্রের মতো চলন্ত লোকজনের দিকে। কিছু বুঝতে পারছে না সে। মাথায় খুব যন্ত্রণা করছে তার। কোথায় এল সে! এরকম জায়গা তো আগে দেখেনি নূপুর! এত লোক, সবাই নিজের মত হাঁটছে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছে, আবার অনেকে বসেও আছে। কিন্তু নূপুরকে কেউ দেখছে না। নূপুর একবার ভাবল, কেউ কি ওকে দেখতে পাচ্ছে না? ও কি অদৃশ্য হয়ে গেছে! কই না তো, ও তো দিব্যি নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ ওর ভয় করল, কিসের ভয় সেটা ও বুঝতে পারছে না, কিন্তু ভয় করছে। মা কোথায়? বাবা কোথায়? এদিক ওদিক হন্যে হয়ে দেখতে লাগল নূপুর! কই, কেউ নেই তো! কোথায় মা?
তারপর ওর মনে পড়ল, ওরা তো তিনজনে বেরিয়েছিল ঘুরতে যাবে বলে! সন্ধ্যে বেলায় মা নূপুরকে সুন্দর করে গুছিয়ে সাজিয়ে দিল। প্রথমবার ও মা বাবার সাথে ঘুরতে যাবে, খুব মজা হচ্ছিল তার। দাদুর দেওয়া নতুন পিংক গাউন টা পড়ার জন্য বায়না করেছিল সে, আর মা সেটাই পড়িয়ে দিয়েছিল। গাড়িতে বসিয়ে মা বাবাও উঠে বসল, জিনিসপত্র সব উঠল। গাড়ি চলল। এখানে এসে বাবা নূপুর কে আর মা কে বসতে বলে পিছন দিকে কোথায় চলে গেল। নূপুরের খিদে পেয়েছিল। মা বলল বাবা এক্ষুনি খাবার নিয়ে আসবে। বাবা এল। সেদিন প্রথম নূপুর বাইরের খাবার খেল। খুব ভালো লাগছিল নূপুরের।
তারপর? তারপর কি হল? কিছু মনে পড়ছে না তো।
এদিক ওদিক তাকাল নূপুর, দিনের আলো। সকাল হয়ে গেছে। তার মাথার উপর থেকে বেশ খানিকটা ছাউনি কিন্তু বাকি টা পুরো ফাঁকা, রোদ পরে আছে। নূপুরের খুব তেষ্টা পেয়েছে, খিদেও পেয়েছে। কিন্তু ও কি করবে? ও তো কাউকে চেনে না! এভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ তার খুব কান্না পেল।
নূপুর কাঁদছে। হঠাৎ পিছন থেকে এক মহিলা বলে উঠল "এই! তুই কে রে? এখানে বসে কাঁদছিস কেন?" নূপুর তাকাল তার দিকে, বেঁটে, ফর্সা এক মহিলা। এ তো মা নয়, তাহলে ইনি কে!
মহিলা আবার জিজ্ঞেস করলেন, "কিরে! বোবা নাকি? কথা বলতে পারিস না?
নূপুর এখনও তাকিয়ে আছে তার দিকে, কিন্তু ও যে কিছু বুঝতে পারছে না। কিকরে বুঝবে? পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটা তো না পারে শুনতে, না পারে বলতে আর না পারে ভালো করে হাঁটতে চলতে।
ওর আবার কান্না পেল। এবারে আরও জোরে কাঁদতে শুরু করল সে! মহিলা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে স্টেশন মাস্টার কে খবর দিলেন যে ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে একটি ছোটো বাচ্চা মেয়ে বেঞ্চে বসে খুব কাঁদছে। স্টেশন মাস্টার ছুটে এল। এসে নূপুরকে জিজ্ঞেস করল তার কথা, কিন্তু সে বেচারির বলার ক্ষমতাই দেয়নি ভগবান। কিকরে বলবে সে নিজের কথা? স্টেশন মাস্টার বুঝতে পারল, সে নূপুর কে তুলে অফিসে নিয়ে গেল। অফিসে এসেই সঙ্গে সঙ্গে সে পুলিশে খবর দিল। তারপর সে বেয়ারা কে দুধ আনতে বলল। বেয়ারা দুধ এনে দিলে সে নূপুর কে সেটা দিল। কিন্তু নূপুর যে নিজে হাতে খেতে পারে না। ওর কান্না থামছে না দেখে স্টেশন মাস্টার নিজেই তাকে দুখ খাওয়াল। এবার নূপুরের কান্না থেমেছে। সে চুপ করে স্টেশন মাস্টারের দিকে তাকিয়ে আছে। স্টেশন মাস্টার অনেক চেষ্টা করেও ওর বাড়ির সম্পর্কে কিছুই জানতে বা বুঝতে পারল না।
কিছুক্ষন পর পুলিশ এল। তারা প্রথমে স্টেশন মাস্টারের সাথে কথা বললেন এবং নূপুরকে কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। থানায় পৌঁছে একজন ডাক্তার এলেন। তিনি নূপুরকে দেখলেন এবং ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো লাভ হল না। এবার কি হবে? নূপুরের বাড়ি খুঁজে বের করতেই হবে ঠিক করলেন থানার বড় বাবু।
অন্য দিকে নূপুরের খুব ভয় করছে। নিজের জন্য না, বাবা মায়ের জন্য। ও তো মায়ের কোলেই ঘুমিয়ে ছিল, তাহলে মা হারিয়ে গেল কেন? মা কি রাগ করেছে, তাই সামনে আসছে না! হ্যাঁ, আগের দিন মা খুব কাঁদছিল। কিন্তু কেন, নূপুর তো সেটা জানে না। ওর মায়ের জন্য খুব মন কেমন করছে। খুব ভয় করছে ওর।
পুলিশ স্টেশনের ক্যামেরায় লাগানো ভিডিও ফুটেজ দেখে খুঁজে বের করলেন নূপুরের বাবা মায়ের মুখ। কিন্তু ওরা যা দেখলেন তাতে অবাকই হলেন।
নূপুরের মা নূপুরকে খাওয়ালেন, এরপর নূপুর ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমন্ত নূপুরকে ওখানে ফেলে ওরা ব্যাগ নিয়ে স্টেশনের বাইরে চলে গেলেন। এই ভিডিও দেখার পর বড়বাবুর মুখ থেকে একটাই কথা বেরোলো "এরা মানুষ!"
নূপুরের বাড়ি খুঁজে পেতে ওদের বেশি সময় লাগল না।
নূপুরকে নিয়ে ওর বাড়িতে গিয়ে ওরা দেখল বাড়ির সামনে তালা ঝুলছে। প্রতিবেশী রা বললেন, ওরা তো নূপুরকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোথায় গিয়েছিলেন কেউ জানে না। নূপুর ঝুলন্ত তালাটার দিকে তাকিয়ে রইল। আবার চোখ দুটো জলে ভরে এল।...
***
এই খবর টা অনেক কাগজে বিজ্ঞাপন হিসেবে বেরোলো। কিছুদিন লোকমুখে চর্চাও হল। তারপর জ্বলন্ত দেশলাই নিভেও গেল।
পাঁচ বছরের ছোটো পঙ্গু মেয়েটা রোজ কাঁদে আর ভাবে মা বাবা এত রাগ কেন করল যে এখনও আসছে না?.......
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top