তৃতীয় অংশ (কথা)

অনেক কষ্টে চোখ খুলল কথা. কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে.. এত অন্ধকার কেন চারদিকে!! হাত নাড়ানোর চেষ্টা করল সে, পাড়ল না. কেন? কিছু বুঝতে পারছে না কেন সে? কিছু অনুভবও করতে পারছে না.. হঠাৎ মাথায় আর ঘাড়ের দিকটায় খুব যন্ত্রণা করে উঠল. এতক্ষন সে যন্ত্রণা টা অনুভব করতে পারেনি. এবার একটু যেন চেতনা ফিরল তার. সে বুঝতে পারল যে তার হাত নাড়তে না পাড়ার অক্ষমতার কারন আর কিছুই না তার হাত দুটো পিঠের দিকে খুব শক্ত করে দঁড়ি দিয়ে বাঁধা. পা দুটোও মনে হয় বাঁধা. সে বুঝতে পারল সে পিছনে ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে. তবে পিছনের দেওয়াল টা নড়ছে কেন! আর চারদিকে এত অন্ধকারই বা কেন! অন্ধ হয়ে গেছে নাকি কথা!? আর মাথায় এত যন্ত্রণা করছে কেন? কিছুই মনে করতে পারছে না সে. খুব কষ্ট হচ্ছে তার. বড় অস্থির লাগছে.. এসব কি হচ্ছে? সব থেকে বড় কথা তার কিছু মনে পড়ছে না কেন! এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কি একটা শুনে ওর সীড়দাঁড়া সোজা হয়ে গেল.. ভয় করছে তার.. কথা হঠাৎই বুঝতে পেরেছে যে ওর পিঠের পিছনে দেওয়াল টা ক্রমাগত নড়ার কারন কি. ও কোনও গাড়ির মধ্যে রয়েছে. গাড়ির শব্দই পেয়েছে ও. হর্নের শব্দও শুনল ও স্পষ্ট, ট্রাক! হ্যাঁ ট্রাক. ট্রাকে ও আগে চড়েচে, এই শব্দ ওর খুব চেনা. কিন্তু এই অবস্থাতে ও এই ট্রাকে এল কিভাবে! এতক্ষণে অন্ধকারে চোখ একটু ধাতস্ত হলে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল কথা. কিন্তু একি!! ওর মত কত মেয়ে ওরই পাশে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছে. খুব ভয় করতে লাগল কথার. এত ভয় সে কখনো সন্ধ্যে বেলায় গ্রামের ন্যাড়া মাঠ পার হওয়ার সময়ও পায়নি.. কিন্তু এমন কিকরে হল! মনে করার চেষ্টা করছে সে, কথা বলবে কি সে? কথা বলা কি ঠিক হবে? একবার চেষ্টা করল কিন্তু নাহ. গলা দিয়ে শব্দ বেরলো না. ভয় ক্রমশ বাড়ছে কথার. এদিকে আবার সে মনে করার চেষ্টা করল আগের কথা. কি করচিল ও? ও তো ইস্কুলমাঠে জয়া মণিশার সাথে খেলা করছিল. লুকোচুরি খেলছিল ওরা. শেষ বারে কথা হয়েছিল চোর আর ওর দুই বন্ধু লুকিয়েছিল. কথার কাছ থেকে লুকোচুরি খেলায় কারুর পার পাওয়ার যো নেই. সব সময় ও সবাইকে ধরে ফেলে. ওর মত ছুটতে পুরো পাড়ায় আর কেউ পারে না. সাঁতারে কথার জুরি মেলা ভার! কিন্তু আজ কি হল? ও তো জয়া আর মণিশা কে খুঁজছিল. হঠাৎ মাথায় খুব জোরে লাগল. আর তো কিছু মনে নেই! তারপর কি হল! আর একবার চেঁচানোর চেষ্টা করবে সে? চেঁচিয়ে লাভ হবে কি কিছু? ও এখানে কেন!? যাচ্ছেই বা কোথায়! কটা বাজে এখন? দিন নাকি রাত? রাত হয়ে গেলে তো মা চিন্তা করবে, ও তো বাড়ি ফেরেনি এখনও. আচ্ছা ও কি আর বাড়ি ফিরতে পারবে? ওর যে বড় খিদে পেয়েছে. মা নিশ্চয়ই খাবার নিয়ে বসে আছে. এতক্ষণে নিশ্চয়ই মা ওকে খুঁজতে শুরু করেছে. মাথায় বড় যন্ত্রণা করছে যে! এই সব চিন্তা করতে করতে ১২ বছরের ছোট্ট মেয়েটা আবার ঘুমিয়ে পড়ল.
ঘুম ভাঙল ট্রাকের খুব জোরে ঝাঁকানি তে! ট্রাক থেমেচে. ওই যে লোকের হাঁটার শব্দ. আর ওটা কী! খুব জোরে ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হচ্ছে. ওরকম আওয়াজ কথা আগে শুনেছে. কিন্তু কোথায়! আবার চেষ্টা করল কথা, কিন্তু নাহ. এবারেও গলা থেকে শব্দ বেরোলো না. কাল থেকে কিছু খায়নি মেয়েটা.. হয়তো কেউই খায়নি. ওরই মত করে হয়তো মাথায় ব্যাথা দিয়ে এনেছে সবাই কে. দরজা খুলে গেল আর আলো চোখে লেগে চোখ ধাঁধিয়ে গেল কথার. কয়েক সেকেন্ড পর সে দেখল ৩টে লোক. এক এক করে সবাই কে টেনে হিঁচড়ে নামাচ্ছে গাড়ি থেকে. তাকেও সেই ভাবেই নামানো হল. ঠিক ভাবে দাঁড়াতে পারছে না সে.. তবুও তাদের দাঁড়াতে হবে.  পায়ের দঁড়ি খুলে দিয়েছিল ওরা কিন্তু হাত একই ভাবে বাঁধা.. খুব কষ্ট হচ্ছে ওর. বড় তেষ্টা পেয়েছে. কিন্তু বলতে পারল না. ভাগ্য হয়তো ভালো ছিল কথার তাই জল সবাই পেল একটু পরে. তারপর ওর চোখ গেল সামনের খোলা সমুদ্রের দিকে. কত জাহাজ দাঁড়িয়ে! এরই ভোঁএর শব্দ এতক্ষণ পাচ্ছিল সে. অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কথা. কিছুই সে বুঝতে পারছে না. চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছে তার? কি হচ্ছে এখানে আর তাদের বেঁধেই বা রেখেছে কেন! কি করবে তাদের দিয়ে!
কথা গ্রামের মেয়ে. স্বভাবতই একটু ডানপিটে প্রকৃতির. কিন্তু খুব ভালো মেয়ে. ইস্কুলে যায়, লেখা পড়ায় ভালো, দৌড় আর সাঁতারে তো ভালোই, বাড়ির কাজেও পটু. কিন্তু বাস্তব দুনিয়ার পরিচয় তার একেবারেই অজানা.. সে জানে না ওর মত মেয়েদের হাত মুখ বেঁধে অন্য জায়গায় কি জন্য নিয়ে যাওয়া হয়. হ্যাঁ! ওর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই. পাচার করার জন্যেই এই মেয়ে গুলো কে জাহাজের ডকে নিয়ে আসা হয়েছে. আরবে এক ক্ষরিদ্দার, মেয়ে কিনবে. তার জন্য অনেক টাকা দেবে. কিন্তু এসব বিষয়ে ১২ বছরের ছোট্ট মেয়ে টা কিকরে জানবে!
জল খেয়ে একটু বল এসেছিল শরীরে তাই দিয়েই হয়তো সে বলে বসল " কে তোমরা!! আমাকে বেঁধে রেকেচো কেন ‌? আমি বাড়ি যাব! আমায় ছেড়ে দাও" ঘুরে বেড়ানো অনেক লোকের মধ্যে ২ জন এগিয়ে এল কথার দিকে. একজন ওর চুলের মুঠি ধরে গালে এক চর বসিয়ে দিল. আর আরেকজন বলল "বাড়ি যাবি তো! আমরা যেখানে নিয়ে যাব সেটাই তো বাড়ি! এখন চুপ করে বসে থাক. নাহলে তিমির মুখে ফেলে দেব " কথা ভয় পেল! কিন্তু মনে জোর এনে আবার বলল "আমি মায়ের কাছে যাব, বাবার কাছে যাব, আমায় যেতে দাও না" বলে সে কাঁদতে আরম্ভ করল. কিন্তু লোক দুটো একই ভাবে হাসতে হাসতে যে কথা টা বলল তাতে কথার পায়ের নীচের মাটি সরে গেল. ওরা বলল" বাপের কাছে যাবি!! তোর বাপই তো টাকা নিয়ে তোকে বেচেছে!তুই এখন আমাদের সম্পত্তি, আর তো কোথাও যাওয়া হবে না তোর! আমরা যেখানে নিয়ে যাব সেখানে তো যেতেই হবে তোকে." বলে ধাক্কা মেরে কথাকে ফেলে ওরা যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিক দিয়েই চলে গেল. কথার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে. সারা শরীর জ্বলছে তার. বাবা! বাবা তাকে বেচেছে! টাকা নিয়ে বিক্রি করেছে! কেন! কিছু ভাবতে পারছে না সে. সব গুলিয়ে যাচ্ছে কথার. সে তার বাবা কে ভালোবাসে, তার বাবা তাকে ভালোবাসে তাহলে কেন! কীভাবে! কি দোষ করেছিল কথা? আজ পর্যন্ত তো বাবা মা যা বলেছে, কথা তাই করেছে, অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে তাদের সব কথা. তাহলে কেন? খুব কান্না পাচ্ছে কথার. খুব রাগও হচ্ছে. একবার মনে হল আর বাঁচবে না সে. আর বেঁচে কিই বা হবে! আর তো কিছুই নেই তার জীবনে শেষ! কোথায় যাবে সে? কিই বা করবে! তারপর হঠাৎ মনে হল কিছুই কি করার নেই তার? কেন মরবে সে? কেনই বা অন্য লোকের জন্য অন্য লোকের কাছে বিক্রি হবে সে? সে কি পুতুল নাকি! তাকে নিয়ে খেলার অধিকার কে দিয়েছে অন্য কাউকে? সে মরবে না. সে বাঁচবে, অন্তত বাঁচার চেষ্টাটুকু করবে! কিন্তু কিভাবে? এখান থেকে, এদের মধ্যে থেকে কিভাবে পালাবে সে? কিছুই তো চেনেনা! হঠাৎ মনে হল! সাঁতারে ওর মত আর কেউ নেই. একবার যদি জলে নামতে পারে ও! তাহলে ও বাঁচতে পারে. কিন্তু ওর হাত যে বাঁধা. আর চেষ্টা করেও সে হাত সে খুলতে পারেনি!
সুযোগ একটা পেল সে, জাহাজে তোলার আগে সবার আঙুলের টিপছাপ দিতে হবে একটা কাগজে, কিসের কাগজ জানে না কথা কিন্তু তার জন্য হাত খোলা হল প্রত্যেকের! মেয়েদের মধ্যে কারুর পালাবার কোনো অভিসন্ধি ছিল না. এমনকি কথা ওদের রাজি করাবার চেষ্টাও করল! কিন্তু পারল না! কিন্তু সে হাল ছাড়ার মেয়ে নয়. তাকে পালাতেই হবে! হাত খোলা হলে যেই একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে ছাপ দেওয়াতে গেছে কথা ওমনি পিছন দিকে প্রান পনে দৌড়ে ডকের ধারে এসে এক লাফ মারল সমুদ্রের জলে.  লোক গুলো দেখতে পেয়ে পেছনে ছুটলো জলে ঝাঁপও দিল কিন্তু কথার সাথে দৌড়ে আর সাঁতরে পারার ক্ষমতা ওদের ছিল না. সেই যাত্রায় কথা ওদের হাত থেকে বেঁচে গেল. মাথায় চোট হোক বা পেটে কিছু পড়েনি বলেই হোক, মাঝ রাস্তা সাঁতরে কথা অজ্ঞান হয়ে গেল আর ভাষতে ভাষতে জেলে পাড়ায় গিয়ে পড়ল. জেলেরা ওকে উদ্ধার করল আর সব কথা ওর থেকে জানতে পারল. তারপর পুলিশ স্টেশনে সব জানিয়ে কথা কে পুলিশের হাতে তুলে দিল.
                   *****
অনেক দিন পর সেই লোকগুলো ধরা পরে এবং কথার বাবার শাস্তিও হয়, কিন্তু সবকটা মেয়েকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি তবে কিছুজনকে উদ্ধার করা হয়েছিল. আর কথা! সে আবার তার গ্রামে ফিরে যায়. কিন্তু খেলা আর তার হয়ে ওঠে না. বন্ধুরা আসে, খেলে, চলে যায়, ও যায় ঠিকই, কিন্তু খেলে না! চুপচাপ বসে দেখে ওদের. হাসি চলে যায় তাকে ছেড়ে. শুধু সারাদিন একটাই কথা ভাবে সে!'
কি দোষ ছিল তার?'

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top