ডিভোর্সড
#ডিভোর্সড
লেখনীতে #AbiarMaria
সামিয়া আজ চার বছর যাবৎ ডিভোর্স নামক তকমা নিয়ে ঘুরছে।বয়স খুব বেশি না,গত মাসে সাতাশ শেষ হলো।ওর বয়সী অনেকেই এখনো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি,অনেকে বিয়ে শাদী মাত্র করছে।
অথচ সামিয়ার অবস্থান ওদের কাছাকাছি তো নয়ই,বরং মনে হয় তার বয়স চল্লিশের কোঠা পেরিয়েছে।না তার বিয়ে হচ্ছে,না তাকে বিয়ে করতে কেউ আগ্রহী হচ্ছে।যখনই পাত্রপক্ষ জানতে পারে সামিয়ার আগে ডিভোর্স হয়ে গেছে,তখনই তার হাত গুটিয়ে নেয়।হয়ত তারা অন্য কারো গার্লফ্রেন্ডকেই বিয়ে করে যে কিনা আগেও আরও কয়েকজনের গার্লফ্রেন্ড ছিল।আবার তারা নিজেরাও কয়েকটা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়েছে।কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে তাদের নববধুই লাগবে যে কিনা আগে ধর্ম এবং সামাজিক নিয়মের বাইরে গিয়ে যাইই করুক,এর মাঝে কিছুই করেনি।কি অদ্ভুত নিয়ম,তাই না?
সামিয়া দেখতে অন্য কোন মেয়ে থেকে পিছিয়ে নেই।গায়ের রঙ,উচ্চতা,রান্নার কাজ- সবদিক থেকে পটু।তবুও তার ডিভোর্সটা আটকানো গেল না।
ঘটনাটা খুব স্বাভাবিক। অনেক বড় ঘরে বিয়ে বসেছিল সে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে।বড় ঘরে বড় বড় ব্যাপার। তাদের ঈদে অনেক কাপড় লাগে,রমজান মাসে অনেক ইফতার খেতে হয়,মৌসুমি ফল না খেলে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে,মাসে মাসে উপহার না পেলে চলে না।সামিয়ার বাবারও অভাব নেই।তাই মেয়েকে হাত ভরিয়ে দিয়েছে সবসময়।
কিন্তু কিছু জিনিস থাকে যারা এইসব হিনমন্যতায় ভোগা মানুষেরা বোঝে না।এই যেমন- ছেলের বউ কাজের মানুষ নয়,তারও আত্মসম্মান আছে।আবার একজন পুরুষও বুঝে না,মেয়ে মানুষ মাত্রই রেস্টুরেন্টের শেফ নয়,কিংবা বিছানায় শুয়ে থাকা নরম মাংসপিন্ড নয়।এই মাংসপিন্ডের ভেতরও অনুভূতি থাকে; সেও চায় কামনার চাইতে ভালোবাসা জীবনে বেশি দরকার।নাহ,কেউ বুঝে না।
সামিয়া যথেষ্ট পড়ালেখা করেছে।যথেষ্ট বলতে ঠিক যতটুকু করলে একটা স্কুলের চাকরি করা যায়।সামিয়া বাসার কাছের একটা স্কুলে শিক্ষকতা করে।সেখানকার বাচ্চারা তাকে খুব ভালোবাসে।শিক্ষকরাও তার প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। আর তাই সুযোগ পেলেই তারা সামিয়ার জন্য পাত্র নিয়ে আসে।তাদের পাত্রদের বর্ণনা এভাবে দেয়-
"সামিয়া! আমার ভাসুরের বন্ধু।এক বছর হলো ডিভোর্স হয়েছে।খুব ভালো মানুষ!এই দেখো ছবি"
"আমার ফুফাতো বোনের ছেলে।একেবারে ফার্স্টক্লাস মানুষ!দুই মাস আগে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে বউটা মারা গেল।ছোট বাচ্চা,বুঝোই তো এখন বউ লাগবে।এই দেখ ছবি।পছন্দ হয়?"
"আমার ভাই।ডিভোর্স হলেও ওর কোনো সমস্যা নেই।আগের বউটা অনেক খারাপ ছিল জানো না!আমার মায়ের খেয়ালই রাখতে চাইতো না!আমার ভাই আর মা-বাবা সংসারে।বেশি কিছু চেয়েছে নাকি?সহ্য হয়নি।এখন তোমার মতো মিষ্টি মেয়ে পেলেই হয়।এই দেখ ছবি।একেবারে রাজপুত্র। না?!"
ডিভোর্সি সামিয়ার জন্য ডিভোর্সি পাত্র,বউ হারানো পুরুষ ছাড়া আর কেউ যেনো নেই।সামিয়ার এসবে সমস্যা নেই,কিন্তু সামিয়া ভাবে,ওরা কি জানে বাঁচতে গেলে একটা নিজের মানুষ লাগে?বাঁচতে গেলে একটা নিজের উড়ার আকাশ লাগে?ওরা কি জানে বাঁচতে গেলে একটা হাত ধরে চোখ বুঝে ভর ছেড়ে দেয়া লাগে?ওরা কি জানে এসব?জানে না বোধহয়।
সামিয়া কারও মাঝে নিজের মানুষ পায় না।সবার শরীর থেকে একটা পর পর গন্ধ আসে,এমননি বাবা-মা ভাইয়া বোনের শরীর থেকেও।ভুরভুর করে পর পর গন্ধ এসে দম আটকে দেয়।পঁচা লাশের থেকেও সেই গন্ধ সামিয়ার কাছে জঘন্য লাগে।
ওর ডিভোর্সের ব্যাপারটা মোটেও সহজ ছিল না।অনার্স শেষ করতেই বিয়ের পিঁড়িতে ও বসেছিল।শুরুটা কষ্টকর হলেও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল।রান্না পাগল সামিয়া রান্না আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকত।বছর দুই পরে তার ভেতর নতুন অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করে।প্রতি দিন,প্রতি ঘন্টা,প্রতি মিনিটে নিজের ভেতর বেড়ে ওঠা অস্তিত্বের চিন্তায় বিভোর থাকত।
এই অস্তিত্ব ধীরে ধীরে ওর কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিল।সারাদিন রান্না করে আবার সেসব গুছিয়ে স্বামীর খেদমত করতে পারছিল না।এদিক সামলালে ওদিক নষ্ট হয়,ওদিক সামলালে এদিক।এর মাঝে সবাই অসন্তুষ্ট।অনেক দিন ধরে দুধ দেয়া গাই যদি দুধ দেয়া বন্ধ করে দেয়,তবে সেই গাইকে সবাই জবাই করে খেয়ে ফেলে।সামিয়া ওর সংসারের দুধেল গাই ছিল।এখন সে অসুস্থ।
হয়ত সকলের সাহায্য পেলে আবারও সব ঠিক হতো।কিন্তু না।যাদের প্রতি মৌসুমে এত এত খাবার লাগে,যাদের শরীর ঢাকতে হাজার হাজার টাকার কাপড় লাগে,তারা কি এত ভাবে? শুরুতেই তো সবার বোঝার কথা ছিল এরা আসলে মানুষ নাকি রাক্ষস!
কেউ বোঝে নি,তাই সামিয়াও একদিন থমকে গেল।ভয়াবহ উদর প্রদাহে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালের বিছানায় স্থান নিল।তার ভেতরের অস্তিত্ব এতটা সইতে পারেনি,ছেড়ে চলে গেল।আর সামিয়া?আবার ফিরে গেল সেই ঘরে যেই ঘরে তার কষ্টের দিনগুলোর শুরু হয়েছিল।
সামিয়ার অযত্নের নতুন অধ্যায় তখন রচিত হতে শুরু হলো।অযত্ন তো শুরু থেকেই হচ্ছিল,শুধু সবাই দেখেও না দেখার ভাণ করত।সামিয়ার স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করল, ঠিক যতটা না শারীরিক যন্ত্রণায়,তার চেয়ে বেশি মানসিক যন্ত্রণায়।ঐ যে,নরম মাংসের ভেতরও একটা অস্তিত্ব আছে যে!তার আবার ভালোবাসা,যত্নের প্রয়োজন হয়।সামিয়ার সামনে খাবার থাকলেও সে খেতে পারত না,পরার কাপড় থাকলেও তা শরীরে লাগত না।ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি তার পরিবারের চোখে শেষ পর্যন্ত চোখে পড়ল।তারা না চাইলেও তাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে বাধ্য হলো।কিংবা বলা যায় তারা আর এই বোঝা রাখতে চাইছিল না।তাই পাঠিয়ে দিল।কাগজের উপর এক দলা কালি ছিঁড়ে দিল তিন বছরের সংসারের সুতো।কারো কিছু আসলো না,গেল না।শুধু সামিয়ার সমস্ত দেহে লেগে গেলো কাগজের সেই কালি "ডিভোর্সি"।
আজকাল সামিয়া প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শরীরে সব কাপড় ফেলে দেয়।তারপর খুঁজে " ডিভোর্সি" লেখা ছাপ।কিছু খুঁজে পায় না।তবে কি আইনত কুমারিত্ব হারালেই সব দোষ?কুমারিত্ব কি তবে আইনের কাগজে লিপিবদ্ধ একটা সামাজিক মারপ্যাঁচের নাম?
আজ এগারোতম বারের মতো এক পাত্রকে সে দেখতে এসেছে।এর আগের কারো সাথেই মনের মিল হয়নি।ঐ যে,বড্ড পর পর গন্ধ আসে!এবারের পাত্র বেশ অদ্ভুত।সে আগে কখনো বিয়ে করেনি।কেন সামিয়াকেই সে চায়,এই প্রশ্নের উত্তর জানতেই ও অপেক্ষা করছে।অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এক ভদ্রলোক ওর সামনে এসে বসে।ঢিলেঢালা সবুজ পাঞ্জাবীতে তাকে ভালোই লাগছে।মুখে কিছু দাঁড়ি আছে,তাতে লেগে আছে শুভ্র স্নিগ্ধ হাসি।
সামিয়া চোখ তুলে এই প্রথম কাউকে দেখে।অদ্ভুতভাবে তার নাকে এসে বেলী ফুলের সুবাস ধাক্কা দিচ্ছে।সামিয়া হিজাবটা মুখের উপর কিছুটা টেনে আনে।সামনের মানুষটাও ওকে শুধু এক নজর দেখে নিচে তাকিয়ে আছে।ওয়েইটারকে ডেকে খাবার অর্ডার করে বলে,
"আপনি নিকাব পরেন জানার পরও মুখ খোলা রাখতে বলেছিলাম বলে দুঃখিত।তবে আমি আপনাকে একবারের বেশি দেখিনি,সত্যি।এইটুকু নিয়ন্ত্রণ আমার নিজের উপর আছে।তবে ভালো হয় আপনি যদি মুখ ঢেকে ফেলেন।আচ্ছা,খাবার খেতে সমস্যা হবে না তো?"
"নাহ।আমি ম্যানেজ করতে পারব"
"আপনি আমার বায়োডাটা পড়েছেন?"
"জ্বী"
"আপনার সেখানকার কোনোকিছুতে আপত্তি আছে?"
"আপত্তি নেই,প্রশ্ন আছে"
"জ্বী,করুন?"
"আপনার শখ বলেছেন রান্না করা।পুরুষরা বিয়ের পর তো রাঁধে না।তাহলে এই কথা লিখলেন কেন?"
মানুষটা হাসে।
"ওটা শুধু শখ তাই না,ওটা আমার ভালোবাসাও বলতে পারেন।আমি নিশ্চিত আপনার সাথে রান্নার প্রতিযোগিতায় নামলে আপনাকে আমি হারিয়ে দিব"
সামিয়া হাসে।
"আরেকটা প্রশ্ন আছে"
"বলুন"
"কেন একটা ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করতে চান?"
মানুষটা শব্দ করে আঙুল ফোটায়।মুচকি হেসে বলে,
"ছোট থেকে আঘাতপ্রাপ্ত পশুপাখির প্রতি আমার ভালোবাসা অত্যাধিক ছিল।আমি কোনো কুকুর বিড়াল,পাখির কষ্ট সইতে পারতাম।কত পশুপাখি যত্ন করে ছেড়ে দিয়েছি তার হিসেব নেই।এই সময় আবিষ্কার করলাম, জীবনসঙ্গী নির্বাচনেও আমার একই অবস্থা।আমি কোনো এমন মেয়েকে মানতে পারছি না যার আগে থেকে বিয়ে হয়নি।সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগতো ডিভোর্সি মেয়েদের জন্য। আমরা ছেলেরা তো এই পরীক্ষায় উৎরে যাই,কিন্তু মেয়েদের পা ডিভোর্স নামের ফাঁদে আটকে যায়।তাদের কেউ পছন্দ করে না"
"এটাকে কি করুনা বলে?আপনি করুনা থেকে এটা করছেন যেমনটা পশুপাখির সাথে করতেন?"
"না,একেবারে না!করুনা করে জীবনসঙ্গী নির্বাচন হয় না,বরং সাময়িক সাহায্য করা যায়।আমি চাই যে মানুষটাকে অন্য কেউ আইনত আঘাত করে গেছে,আমি আইনত তাকে ভালোবাসব"
"কিন্তু কেন আমি?আরও অনেকেই তো আছে"
"আছে। এই ডিভোর্সিদের মাঝেও ফাঁক আছে জানেন।অনেক মেয়ে নিজের দোষ ঢাকতে বিয়ে ভেঙে দেয়।আজকাল অনেক মেয়ে বিয়েকে খেলার মতো ভাঙতে জানে! এত এত মানুষের মাঝে আমার আপনাকে ভালো লেগেছে।কেন লেগেছে জানি না।হতে পারে তা আপনার বিশুদ্ধতা,কিংবা মাঝরাতে কেঁদে কেঁদে ফোলানো চোখ জোড়া!"
"আর আপনার পরিবার?তারা মানবে?"
"আমি ডিভোর্সি হলে কি আপনার পরিবার আমাকে মানত না?"
সামিয়া থমকে বসে থাকে।এই প্রথম সে পর পর ঘ্রাণ পাচ্ছে না।সামনে বসে মানুষটাকে তার নিজের মানুষ লাগছে।তার নিচু হওয়া দৃষ্টিতে নিজেকে নতুন করে দেখতে ইচ্ছে করছে।ইচ্ছে করছে সমস্ত বাঁধা ভেঙে তাকে স্পর্শ করে দেখতে,সে কি সত্য?
এক সপ্তাহ পর দুজন মানুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে হতভম্ব করে দিয়ে সামিয়া শরীরের সমস্ত কাপড় খুলে ফেলেছে।তার সামনে এক বার ঘুরে বললো,
"আমার শরীরে কোন ডিভোর্সি ছাপ দেখতে পাচ্ছো?"
মানুষটা মুচকি হেসে লাল শাড়ি মাটি থেকে তুলে নিল।সেই শাড়িতে ওর নগ্ন দেহ এক প্যাচে ঢেকে দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
"না।তবে একটা ছাপ এখন থেকে প্রতিদিন বসাবো পুরো শরীরে।ছাপটা হবে 'সাফাতের বউ'। এত বেশি করে বসাবো যে তুমি জীবনের শেষ সেকেন্ড পর্যন্ত দেখতে পাবে সেই ছাপ।শরীরের প্রতিটা কোষে কোষে আমার নাম লিখে দিব"
সামিয়া অবাক হয়ে মানুষটাকে দেখে।শরীরে যে ডিভোর্সি না লিখে অন্য কোনো মানুষের নামও লেখা যায়,তা আগে জানতে পারেনি। সামিয়ার আর পর পর গন্ধ লাগছে না,বরং আপন আপন ঘ্রাণে ওর সমস্ত ইন্দ্রিয় অবশ হয়ে গেছে।
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top