একটু শুনুন...

আব্দুল মোতালেব মুন্সী হলেন এলাকার অত্যন্ত পুরাতন বাসিন্দাদের একজন।সংগ্রামের সময়ের আগে থেকেই তিনি এই এলাকায় বাসা কিনেছেন।তখনকার সময় আশপাশটা জংলা হলেও বর্তমানে তার বাড়ির সামনে দিয়ে সিটি করপোরেশনের তৈরী পাকা সড়ক চলে গেছে।আশাপাশের সবদিকেই ডেভেলপার কোম্পানির তৈরি চকচকে নতুন নতুন সব দালান।এগুলোয় কোনো কোনোটাতে লিফটও আছে কারণ পাঁচ তলার নিচে এই এলাকায় কোনো দালান নেই বললেই চলে।আব্দুল মোতালেব মুন্সীর বাড়িটাও কম নয়।ছয়তলা দালানে লিফটের ব্যবস্থা না থাকলেও চকচকে টাইলস আর নতুন রঙ করা সবকিছু।সাত বছর হলো তিনি দালানটা নতুন করে তৈরি করেছেন।

এলাকায় তার নামডাকের পাশাপাশি বেশ আধিপত্যও আছে।কোনো বড় ঘটনা ঘটলে তার মতামতের একটা গুরুত্ব মোটামুটি সবাই দেয়।এলাকার বড় মসজিদের কমিটির ম্যাম্বারও ছিলেন একটা সময়। এখনও নিয়মিত সেখানে ডোনেশন দেন।

বেশ কয়েক মাস ধরে পুরো পৃথিবী জুড়ে নতুন একটা রোগের নাম শোনা যাচ্ছে- করোনা ভাইরাস।এই নাম আগে অনেকেই শুনেনি।সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার,এই রোগ যাদের হচ্ছে,তাদের জন্য এই রোগের নির্দিষ্ট কোনো ঔষধ নেই।অর্থাৎ পূর্বে যেমন রোগের ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তার পরে ঔষধের একটা কাজ ছিল,এখন আর তা নেই।মানুষ বড় অসহায় হয়ে পড়েছে।দেশের পর দেশ,প্রযুক্তির পর প্রযুক্তি এই রোগের কাছে পরাজিত হচ্ছে।ধরাশায়ী হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনপ্রণালি,তাদের স্বাভাবিকতা।প্রতিটা এলাকা যেন মানববিহীন বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে।চাইলেও কেউ পারছে না ভাইরাসে তৈরি এক অদৃশ্য দেয়াল ডিঙিয়ে স্বাভাবিক আচরণ করতে।

আব্দুল মোতালেব মুন্সীর এসবে কোনো আসে যাচ্ছে না।কারণ বাংলাদেশের মতো মুসলিম একটা দেশে সে থাকে।শুরু দিকে অন্য সব মুরুব্বীদের সাথে তাল মিলিয়ে বলেছেন,
"চায়নাদের মতো খবিশদের উপর আল্লাহর গজব এইটা! আল্লাহর কালাম নিয়া ওরা তামাশা জুড়াইছে।মুসলিমদের ধইরা ধইরা অত্যাচার করতাছে! আল্লাহ এইগুলা বইসা বইসা দেখব?কোনোদিন না!আল্লাহর আরশ কাঁইপা উঠছে!এইজন্যই এই গজব দিছে!"

এইটুকুই বলেই এরা নিশ্চিন্ত।চীনারা মুসলিমদের উপর অত্যাচার করেছে বলে তারা এটা নিয়ে চিন্তিত নয়।যখন এই রোগ চীন থেকে পশ্চিমায় চলে গেলো,তখন তারা সবাই মিলে আরো নাক সিঁটকালো-
"ওদের মতো অসভ্য জাতি আর আছে নাকি? চিন্তা করতে পারেন পুরুষ পুরষ,নারী নারী বিবাহ বসে?নাউযুবিল্লাহ! মদ গাঁজা সব খায়! তার উপরে এই আমেরিকাই তো বোম মাইরা মুসলিম দেশ গুলো দখল করছে!এই জুলুম আল্লাহ মানবো?আল্লাহর আরশ না কাঁইপা উঠে?উঠে না?"

ধীরে ধীরে করোনার কালো ছায়া সব দেশে প্রবেশ করে ফেলছে।তবুও এই নিয়ে আব্দুল মোতালেব মুন্সীর চিন্তা নেই।সে নিয়মিত মসজিদে নামায পড়তে যায়।কারণ তিনি একজন প্রথম সারির নামাযী।ফযর সহ সব ওয়াক্তের নামায তিনি ইমামের পেছনে আদায় করেন।মধ্য দিয়ে মসজিদে নামায পড়তে দুবেলা যেতে পারেন নি।এতে ইমাম সাহেব তাকে ফোন দিয়ে অনুরোধ করেছেন সেখানে উপস্থিত হতে। আব্দুল মোতালেব বাসার সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন,
"মক্কা মদীনার জামাত ওহাবী,আহলে হাদীসরা বন্ধ করতে পারে; আল্লাহর ঘরে তাওয়াফ করা ওরা বন্ধ করতে পারে; সব দেশের মসজিদ বন্ধ হইতে পারে; কিন্তু আমাকে মসজিদে যাওয়া থেকে দমায়া রাখতে পারবা না!!"

আব্দুল মোতালেবের বড় মেয়ে কিছুদিন হলো তার কাছে এসেই থাকে।বিয়ের আগে তাকে এক ছেলে পছন্দ করত এবং পারিবারিকভাবে প্রস্তাব নিয়ে আসে।যথেষ্ট নামাযী এবং ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও সেই ছেলের সাথে তিনি বিয়ে দেননি।ছেলের একটাই সমস্যা ছিল,ঢাকায় নিজেদের বাড়ি নেই।তার মেয়েকে অমন ভাড়ায় চলা পরিবারের কাছে বিয়ে দিবেন?অসম্ভব! অপমানের সাথে তাদের বের করে অনেক টাকাওয়ালা ছেলের কাছে মেয়ের বিয়ে দেন।তবে টাকা থাকলেই যে মানুষ মানুষ হয় না,তার প্রমাণ তার একমাত্র মেয়ের জামাই।মেয়ের তাই শারীরিক মানসিক অত্যাচারের অভাব হয় না।দুইদিন আগে অত্যাচারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মেয়ে তার ছোট্ট পরীকে নিয়ে বাবার আশ্রয়ে চলে এসেছে।তবে সে এখানেও বেশিদিন টিকতে পারবে না জানে।বাবার কাছে মেয়ের অত্যাচারিত হওয়ার চেয়ে তালাক্ব হয়ে মেয়ের ঘরে ফেরত আসাটা বেশি অপমানজনক।তাই নির্দিষ্ট কিছুদিন ব্যতীত সে বাবার বাড়ি থাকার অনুমতি পায় না।

মেয়ে বেড়াতে এসে বাবাকে বারবার মসজিদে যেতে,বাহিরে বাজারে যেতে নিষেধ করে।তবে আব্দুল মোতালেব তার তোয়াক্কা না করে জবাব দেন,
"মসজিদে নামায পড়তে গিয়ে যদি মইরা যাই,তবে মইরাই যাওয়াই ভালো"

তার একমাত্র ছেলের ঘরেও দুটো জমজ বাচ্চা আছে।বাহির থেকে এসেই নাতি-নাতনীদের তিনি কোলে নেন।তবে অনেক বুঝানোর পর সে হাত পা ধুয়ে বাচ্চাদের ধরে।না তাকে মাস্ক পরানো যায়,না ঘরে রাখা যায়।

দেশ জুড়ে একটা সময় সরকারি নিষেধাজ্ঞা আসে।কেউ মসজিদে জামাত করতে পারবে না।আব্দুল মোতালেবের মুখ থেকে গালির তুবড়ি ছোটে।এরপরও সে যাবে মসজিদে।যদি জামাতে ৫ জন থাকে,তবে ৫জনের একজন সেও হবে।তার স্ত্রী ইনিয়ে বিনিয়ে মানা করলেও এই বয়সেও সবার সামনে তাকে অকথ্য কথা শুনিয়ে দেন।তার আর মসজিদের মাঝে কোনো বাঁধা তিনি মানবেন না।অবশ্য তার স্ত্রীর কাছে এমন ব্যবহার কোন পার্থক্য তৈরি করে না।তার সন্তানেরা ছোট থেকেই মাকে বাবার কাছে হেয় হতে দেখে আসছে।আর এটাই নাকি নারীদের প্রকৃত অবস্থা হওয়া উচিত!

সময় যায়,পরিস্থিতি আরো বিগড়ায়।এক সময় তার মেয়ের ঘরের নাতনী কাশতে কাশতে নানার কাছে আসে।
"নানাভাই,আমার খুব কাশি,জানো?"
"কি রে বইন,তোর তো গায়ে জ্বরও আছে! এই আমেনা! তোর মেয়ের যে জ্বর,এই খবর তোর আছে?"
মেয়ে কাজের মধ্য থেকে মুখ তুলে চায়।
"আব্বা,জ্বর তো দুইদিন ধরে।ওষুধ খাচ্ছে,কমে না।সাথে বমিও করল"
আব্দুল মোতালেবের শরীর কেঁপে উঠে।এই নাতনীকে একটু বেশিই আদর করেন উনি।ইতোমধ্যে বাসার দুই নাতিসহ তার স্ত্রীরও যে জ্বর,তা টের পান।ছেলেকে ঘরে রেখে মেয়ে,স্ত্রী আর বাচ্চা তিনটাকে নিয়ে নিজের গাড়ি করে হাসপাতালে রওনা দেন।

পরদিন ওদের সবার রিপোর্ট আসে।যদিও আব্দুল মোতালেব টেস্ট করাতে চাচ্ছিলেন না,তবুও তার টেস্ট করানো হয়।সবার করোনা পজেটিভ।ইতোমধ্যে নাতনীর অবস্থা খারাপ, আইসিইউতে নেয়া হয়েছে।বাকি দুজনকে অক্সিজেন দেয়া হয়েছে।তার স্ত্রীর অবস্থাও খারাপ।পুরো হাসপাতাল জুড়ে এজাতীয় রোগীর অভাব নেই।নাতনীর জন্য আইসিইউর সিট জোগাড় করতেও চার-পাঁচজন এর সুপারিশ এর দরকার হয়েছে তার।

একদিনের মাঝেই একেবারে ভেঙে পড়েছেন আব্দুল মোতালেব।কেউ কাউকে দেখতে পারছে না।একেকজনকে একেক যায়গায় রাখা হয়েছে।তার স্ত্রী আর নাতি নাতনীদের খবর জানতে চেয়েছেন।নার্স দুবার দায়সারাভাবে জানিয়েছে,তারা এখনো অসুস্থ, তবে চেষ্টা চলছে।

সাতদিন পার হয়ে গেছে।আব্দুল মোতালেব অল্পের মাঝে বেঁচে ফিরে এসেছেন।ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে জানিয়েছেন,তিনি দ্রুত উন্নতি করছেন।তবে বাড়িতে ফিরে যেন একা একা থাকেন আরো ১৫ দিন।এই ১৫ দিনে যদি বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সাথে মেলামেশা করেন,তবে তারাও আক্রান্ত হবে।নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ নিয়ে আব্দুল মোতালেব বাড়িতে ফিরে আসেন।তার মন বড় অবসন্ন।

আসার আগে জানতে পারেন,তার স্ত্রী এখানে আসার পরদিনই মারা গেছেন।তবে তিনি নিজেও অসুস্থ থাকায় জানানো হয়নি।তৃতীয় দিন মেয়ের ঘরের নাতনীটা চলে গেছে।আর গতকাল মারা গেছে জমজ নাতিদের মাঝে একজন। এত কিছুর মাঝেও কি করে সে বেঁচে গেলো,আর বাকি মানুষগুলো আক্রান্ত হয়ে চলে গেলো,তা সে বুঝতেও পারছে না।

বাড়িতে পা রাখার পর ছেলে দরজা খুলে দিল।মুখে মাস্ক আর গ্লাভস পরে আছে।দূর থেকে নিজেদের শোবার ঘরের দরজায় মেয়ে আর ছেলের বউ দাঁড়িয়ে আছে।ছেলের বউ বোধহয় একটু আগে কান্না করা থামিয়েছে।আর মেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে বলছে,
"আব্বা,কয়টা দিন একটু কথা শুনতেন,একটু শুনতেন! সারা জীবন তো আমরা আপনার কথা শুনলাম,একটা বার আমাদের কথা শুনতেন! আজকে আম্মা নাই,আমাদের বাচ্চাগুলা নাই!আব্বা!ও আব্বা!আমার বুক খালি হয়া গেল!আমার মাথা রাখার কোলটাও চইলা গেল! ভাবীর দুই বাচ্চা শেষ!আব্বা! কয়টা দিন ঘরে থাকতেন!মাত্র কয়টা দিন আল্লাহরে ঘরে বইসা ডাকতেন!আড্ডা না দিতেন!আল্লাহ কি ঘরে বইসা ডাকলে শুনে না?শুনে না আব্বা??"

মোতালেব সাহেব হাঁটু কেঁপে মাটিতে বসে পড়েন।ছেলে এক হাতে ধরে বাবাকে।ধীর কন্ঠে বলে,
"এখন আমরা বেঁচে আছি আব্বা।ডাক্তার যতদিন বলছে,একা একা থাকেন।আমাদেরও বাঁচতে দেন,আপনেও বাঁচেন"

আব্দুল মোতালেব শূন্য দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকান।তার চোখে অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখতে পান যেখানে তার ধুকে ধুকে মরার দৃশ্য দৃশ্যমান।

#একটু_শুনুন
লেখনীতে, #AbiarMaria

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top