এক টুকরো জীবন (১)

আমি আমার সন্তানকে কোলে নিয়ে কয়েক সহস্র শব্দ ভেবে ফেললাম। কেন জানি না, আর দশজন মায়ের মত আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার বদলে আমার সমস্ত শরীরে একটা শিহরণ জেগে উঠল, বাম ভ্রু কয়েক মিলি কুঁচকে গেল। আমার সন্তানের জন্ম হয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি, অথচ সে এমন ভাবে চেয়ে আছে যেন অনেক যুগ আগে থেকে তার সাথে আমার পরিচয়। ওর চোখের ভাষা আমি পড়তে পারছি, সবার চোখের ভাষাই আমি নিমেষে পড়তে পারি। ওর চোখে কৃতজ্ঞতা ওকে পৃথিবীতে আনার জন্য, আমাকে দেখার সুযোগ দেয়ার জন্য, শরীরের বাহির থেকে স্পর্শ দেওয়ার জন্য। অথচ আমি ওর মত খুশি হতে পারছি না।

আমার সন্তানকে নিয়ে আমার প্রথম চিন্তা জাগ্রত হলো, ও কেমন মানুষ হবে বড় হয়ে? নাকি অমানুষ হবে?

প্রতিটা মা চায় তার সন্তান পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থানে থাকুক। অথচ আমি চাই কেবল মানুষ হোক, মানুষ। এক জীবনে এত বেশি অমানুষ দেখে ফেলেছি যে এখন মানুষ খুঁজি, মনে প্রাণে একটা মানুষের মা হতে চাই।

যখন ও আমার গর্ভে আসে, তখন থেকেই আমি সৃষ্টিকর্তা, আল খালেকের কাছে হাত তুলে বলতাম, "মানুষ হলে যেন থাকে, না হলে যেন মরে যায়। এই আত্মার জন্ম আমি দিতে চাই না। আমায় মরণ দিও, সাথে ওকেও। তবুও মানুষ না হলে পৃথিবীতে এনো না।" সৃষ্টিকর্তা একটু একটু করে ওকে আমার ভেতর সৃষ্টি করেছেন, রিযিক প্রদান করেছেন আমার খাদ্যনালী, পাকস্থলীর মাধ্যমে। আমি খাবার সামনে নিয়ে প্রার্থনা করে আর-রাযযাক এর কাছে, "মানুষ হলে এই রিযিক তার শরীরে নসীব করিও। না হলে তোমার নামের এই নেয়ামতের রিযিক যেন তার শরীরে এক বিন্দুও না যায়"

সন্তানকে দ্বিতীয় চিন্তা এলো- ও কি আমার প্রতি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে? নাকি আমাকে ওকে জন্ম দেয়া নিয়ে প্রশ্ন করবে? আমাকে অভিশাপ দিবে, অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে?

আমার জীবনে আমার বাবা মায়ের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। কারণ আমার বাবা মা আছে কিনা সে তথ্যই আমার জানা নেই। বেড়ে ওঠা হয়েছিল এক হতদরিদ্র অনাথাশ্রমে। একটু বড় হওয়ার পর এর ওর কাছে শুনলাম, আমি নাকি বাবা মায়ের পাপের ফসল। আমাকে মরার জন্য ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দিয়েছিল। কার যেন দয়া হলো, কুকুরের খাবার হওয়া থেকে বাঁচাতে এখানে এনে দিল। ঐ সময় প্রচুর অভিমান হতো। যে এসব বলত, মেরে মেরে তার নাক মুখ ফাটিয়ে দিতাম। একারণে আমার তার তিন গুণ মারও খেতে হয়েছে। ততদিনে দাঁতে দাঁত চেপে অত্যাচার সহ্য করতে শিখে গেছি। একটু বড় হতে সেখান থেকে পালিয়ে চলে গেলাম। রাস্তায় রাস্তায় ময়লা কাপড়ে ঘুরতাম আর ময়লা টোকাতাম। কেউ কেউ আমার মায়াবী চেহারা দেখে টাকা দিত। সেটা আমার ইদের দিন ছিল। এছাড়া আর সবগুলো দিন একই। ময়লা টুকিয়ে বিক্রি করো, কিছু কিনে খাও, আর যেখানে স্থান পাও, ঘুমিয়ে নাও।

এক দুপুরে আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো।

এক মেয়েকে রাস্তা পারাপারের সময় গাড়ির নিচে পড়া থেকে বাঁচিয়ে ফেললাম। ওর মা কেঁদে কেটে অস্থির। ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে দিতে গিয়ে বোধহয় মনে হলো, এই ঋণ টাকায় শোধ হবার নয়। আমাকে নিয়ে গেলেন তার বাসায়। এতিম আমার যায়গা হলো তাদের বাসায়। আমার নাম তখন- কাজের মেয়ে। আমার মন্দ লাগছিল না। ম্যাম আমাকে খুব আদর করতেন। মেয়ের সাথে আমাকেও পড়াতে শুরু করলেন। আমি অবশ্য বড় স্কুলেই পড়তাম, কিন্তু ম্যামের বোন বাঁধ সাধলেন। আমাকে বড় স্কুলে পড়ালে নাকি আমি মাথা কিনে নিব, ধরাকে সরা জ্ঞান করব। আমি প্রতিবাদের মাঝে গেলাম না। ম্যাম আমাকে একটা সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। তবে বাসায় আমার অবস্থান বদলালো না। ঘরের প্রায় সব কাজের ফাঁকে আমি পড়তাম।

অদ্ভুত এক কারণে আমার পড়াগুলো খুব দ্রুত মুখস্থ হতো, ক্লাসে ভালো করতে শুরু করলাম। আমার পড়ালেখার উন্নতির ব্যাপারে ম্যাম যখন জানলেন, তখন উনি ভীষণ খুশি হলেন। খুশি হলেন না তার বোন। তার ধারণা, আমি তার বোনকে কোনো জাদু করেছি।

সময় গড়াতে গড়াতে কখন আমার মাঝে যৌবনের স্রোতধারা বইতে শুরু করল, টের পেলাম না। ম্যাম আর তার মেয়ে মুমু আমাকে বোঝাতে এভাবে এভাবে চলতে। আমার অদ্ভুত সব পরিবর্তন খেয়াল করতে থাকলাম। মুমু খুব ভালো মেয়ে। ও আমাকে এক এক করে সব বোঝালো। আমার জীবনে এই দুজন ছিল এঞ্জেল, মাই এঞ্জেলস। আমি বেড়ে উঠতে শুরু করলাম। কিন্তু বুঝতেই পারলাম না, আমার মালিক আমার মাঝে কত বড় সম্পদ আমানত দিচ্ছেন। এই আমানতের রক্ষা করব কি করে, সেটাও আমি জানতাম না।

জানতে পারলাম যেদিন স্যার আমার ঘরে আসলেন।

স্টোর রুমের এক পাশে ফ্লোরে আমি থাকতাম। বিছানার মাথার কাছে আমার সব বই খাতা। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। রাতে পায়ের কাছে স্যারের স্পর্শ পেলাম। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে উনি আমার মুখ চেপে ধরলেন। আমি বুঝতে পারলাম, যা হতে যাচ্ছে, তা মোটেও শুভ কিছু না। রাস্তায় কয়েকবার এমন ভয়াবহ দৃশ্য চোখে পড়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, পুরুষগুলো বোধহয় মেয়েগুলোকে মেরে ফেলে। পরদিন সকালে তাদের দিব্যি ঘুরে বেড়াতে দেখে অবাক হতাম। রাতে তাহলে কি হত?

আমার সাথে এমন যখন হতে শুরু করল, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলল। আমি হুট করে হাতের কাছে থাকা লাঠি নিয়ে উনার মাথায় মেরে বসলাম। উনি 'আহ' শব্দ করে উঠে দাঁড়ালেন। আমাকে ফিসফিস করে শাসিয়ে গেলেন, আমাকে তিনি দেখে নিবেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ছোট্ট আমাকে এত এত ভালোবাসা মানুষটা কেমন করে এক রাতে তার অমানুষিক রূপ দেখিয়ে গেল।

পরদিন সকালে কাজ করতে করতে হঠাৎ চুলে হেঁচকা টান অনুভব করলাম। কিছু ভাবার আগেই আমি মাটিতে আছড়ে পড়লাম। মাটিতে শুয়ে দেখলাম, মুখের উপর ফোঁসফোঁস করতে থাকা মুমুর খালার মুখ। তিনি চিৎকার করে বললেন, "তুই যার তার সাথে বিছানায় যাবি, এটা তো আগে থেকেই আমি জানতাম! আমার বোন তো বিশ্বাস করেন নাই! দেখ, তোর বিশ্বাসের কত মর্যাদা রাখছে এই মেয়ে! দেখ তুই!"

দেখলাম ডাইনিং এ তাদের ড্রাইভার মুনির ভাই। মাথা নিচু করে সে বলছে কি করে আমি রাত বিরাতে শরীর দেখিয়ে তাকে কুপ্রস্তাব দেই। আমি অবাক হয়ে দেখলাম। মুনির ভাইয়ের কয়েক মাস আগেও জ্বর হয়েছিল খুব। আমি নিজে কত কি রান্না করে উনাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দিয়েছি। উনার মনের দুঃখগুলো আমাকে বলতেন। ম্যাম যত ভালো, তার বোন ছিল তত খারাপ। তাদের বাসার সবার খারাপ ব্যবহারে মুনির ভাইয়ের মন ভেঙে যেত। মলম খুঁজতে তিনি আমার কাছেই আসতেন। অথচ আজ কেমন অকপটে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে যাচ্ছেন। আমি অবাক হয়ে তাদের ভেতরকার অমানুষদের দেখি। শুধু মুমু আর ম্যাম একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদছিল। আমি ম্যাম আর মুমুর দিকে করূণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পেরেছিলাম কিছু সময়, এর বেশি আর সুযোগ পাইনি। ওদের দুজনের চোখে ছিল অসহায়ত্ব, আর আমার চোখে ওদের জন্য করূণা। আমাকে তক্ষুনি এক কাপড়ে বের করে দেয়া হলো।

দরজার বাইরে কিছু সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম। নাহ, আমি কাঁদিনি। আমার কান্না পায় নি, কেবল মনে হয়েছে, রাস্তার মানুষ তার রাস্তাতেই ফিরে এসেছে। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পেছনে মুনির ভাইয়ের কন্ঠ শুনলাম। তিনি মাথা নিচু করে আমার জিনিসপত্র আমাকে ধরিয়ে দিলেন। তার চোখের দিকে চেয়ে একটাই প্রশ্ন করলাম, "কেন?"

মুনির ভাই উত্তর দিতে পারেন নি। আমি জানি, হয়ত টাকা নিয়েছেন, কিংবা চাকরি হারাবার ভয়ে এমন করেছেন। কি হবে শুনে? তার চোখের ভাষায় সবটা আছে। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে হাঁটতে শুরু করলাম।
কোথায় যাব?
কি করব?
কি খাবো?
যে সমাজে ঘরে ঘরে এমন অমানুষ থাকে মানুষের চামড়ার আড়ালে, সেই সমাজে রাস্তাঘাটে অমানুষের চামড়ায় অমানুষেরা ঘুরবে বেড়াবে, এ আর অবাকের কি আছে!

জামার খুট থেকে কিছু টাকা বের করে খেয়ে নিলাম কলা আর রুটি। লাইনের পানি খেয়ে পেট ভরিয়ে ভাবতে থাকলাম, কি করা যায়। আমার স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে আদর করেন খুব। উনার কাছে যাব? স্থান না দিলেও একটা উপায় হয়ত বলবেন। স্কুলের পাশেই তার কোয়ার্টার। সেখানে পৌঁছানোর পর উনি আমাকে এক নজর দেখেই বুঝলেন, আমার মাথার উপরের ছাদ টুকু নেই আর। নরম কন্ঠে প্রশ্ন করলেন, "কি করতে চাচ্ছিস এখন?" উত্তর দিলাম, "মাথার উপর একটা ছাদ দরকার। আর কিছু খাবার। এই দুটো হলেই বাকিটুকু যোগাড় হবে"

স্যারের চোখে আমার জন্য শ্রদ্ধা ছিল। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "আমার ঘরেই থাক। তোর আন্টি অসুস্থ, একা একা কাজও পারেন না, কথা বলার মানুষও পায় না। আমার একমাত্র ছেলেটা এ বছরই ক্যাডেটে চলে গেল। একেবারে খালি ঘর। কোনো গতি হওয়ার আগে পর্যন্ত এখানেই থেকে যা"

স্যারের চোখের ভাষা পড়তে পারলাম বলে থেকে গেলাম। আমি জানি, মানুষের মুখে মিথ্যা থাকতে পারে, চোখে থাকে না। চোখ মিথ্যা বলতে জানে না।

আন্টি আমাকে পেয়ে বিরক্ত হলেন। বিড়বিড় করে বললেন, "ক'দিন পর পর উটকো ঝামেলা নিয়ে আসেন আপনি। কে বলেছে আমার মানুষ লাগবে? আমি একা পারি না? এর আগেরটা চুরি করে ভেগেছে, এবারেরটা ডাকাতি করে ভাগবে!" স্যার আমার কানে কানে বললেন, "মাথায় একতু গন্ডগোল আছে। সময় দে, ঠিক হয়ে যাবে। রাস্তেঘাটের চাইতে এই বকাগুলো ঢের ভালো, জানিস তো?"
স্যারের মুখের শব্দগুলো শুনে মায়া লাগলো। উনার জন্যও করুণা হলো আমার।

কি অদ্ভুত আমি! যেখানে পুরো পৃথিবীর আমার প্রতি করুণা করার কথা, অথচ উল্টোটা হচ্ছে। আমি মাথা নেড়ে স্যারের দেখিয়ে দেয়া ঘরে চলে গেলাম। রচনা শুরু হলো আমার নতুন জীবনের।

আমার সন্তান কাঁদছে। ওকে খাওয়াতে হবে। অথচ সি-সেকশন হওয়ায় ওকে ঠিক ভাবে ধরতেও পারছি না। মনে হচ্ছে শরীরের হাড় গুলো কেউ ভেঙে দিয়েছে, বিশেষ করে মেরুদন্ডের দিকে। আমি নার্সকে ডেকে ওর কোলে সন্তানকে দিয়ে দিলাম। খাবারের ব্যবস্থা হবে, কোনো না কোনো ভাবে। আমি চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে রইলাম। এই মুহূর্তে ইকবালের কথা মনে পড়ছে খুব। একবার ওর হাত ধরতে পেতাম, একবার!

চলবে।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)

#এক_ফোঁটা_জীবন
লেখা #AbiarMaria

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top