#6 Introvert
Introvert
#ছোটগল্প
#৬
"তোমার মা তো অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে চলে গেছে।ঐটা তোমার বাবা না,একটা আংকেল।তোমার বাবাকেও আমরা বিয়ে করিয়ে দিব,ঐ আন্টিকে তখন তুমি আম্মু ডাকবে।এখন তোমার আপাতত কোন আম্মু নেই"
কেমন লাগবে এই কথা গুলো যদি কোনো মানুষ চার বছর বয়সে শুনে?
কি হবে তার মনে অবস্থা?
বাবা মাকে নিয়ে সে কি ভাব্বে?
"বাবা" আর "মা", এই দুইটা শব্দের ব্যাখ্যা কেমন হবে তার কাছে?
প্রশ্ন গুলো অনেক জটিল।এরকম জটিলতার সম্মুখীন হয়নি,এমন মানুষদের এই প্রশ্ন করলে এরা সন্তুষ্টজনক কোনো উত্তর দিতে পারবে না।
তবে আমাকে যেদিন এই প্রশ্ন দ্বিতীয়বার করা হয়েছিল,আমি সেদিন বলেছিলাম,
"মনে হবে,মা হচ্ছে একটা মানুষ,যে মানুষের কাছে আমি একটা বিড়ালের বাচ্চার চেয়েও নগণ্য কিছু। আর বাবা হচ্ছে আরেকটা মানুষ যার আমার দিকে খেয়ালের চাইতে বিয়ের দিকে খেয়াল বেশি"
স্যার আমার দিকে চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। আমাদের সমাজ স্যার সমাজ পড়াতে গিয়ে সামাজিক সম্পর্কগুলো পড়াচ্ছিলেন।তখন "ব্রোকেন ফ্যামিলি" প্রসঙ্গ আসে,আর সে পরিপেক্ষিতেই কোন এক অজানা কারণে স্যার আমাকেই দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করলেন।জানি না জবাবটা স্যারের মনপূত হয়েছিল কিনা,কিন্তু স্যার এই টপিকে আর কথা বলেননি।
এই কথাগুলো আমি ছোটবেলা অনেক শুনেছি।অনেক মানে অনেক।আমার যখন চার বছর বয়স,তখন মা আমাকে বাবার কাছে রেখে অন্য কারো হাত ধরে চলে যায়।মায়ের আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না,কিংবা আমাকে নিয়ে এত চিন্তা বলেই আমাকে ফেলে চলে গেছেন,কিংবা আমার আর বাবার চাইতে ঐ লোকের দরকার তার জীবনে বেশি ছিল,আসলে যে কি ছিল তা আমি আজো বুঝিনি।
আমি যখন পৃথিবীর মুখ দেখি,তখন নাকি বাবা মায়ের জীবনে ছন্দ নিয়ে এসেছিলাম।আমার যে বাবা কাজের চাপে বাসায় সময়মত পৌঁছাত না,সে ঠিক সময়েই বাসা চলে আসত আমাকে নিয়ে খেলতে।আমি ছিলাম ছোট্ট পুতুল,তারা আমার নাম দিয়েছিল "নিম্মি"।খুব ভালোবাসত আমাকে সবাই।ভালোবাসাটা একটু আমার প্রতি বেশি হয়ে যাওয়াতেই কিনা জানি না,মায়ের সাথে বাবার দূরত্ব অনেক বেড়ে যায়।বাবা আমাকে ভালোবাসত,আর মা ভালোবাসতে শুরু করল অন্য কাউকে।আমার বুঝ হবার পর থেকে দেখতাম বাবা আর মা ঝগড়া করছে।তাদের ঝগড়া গুলো এক সময় ডাল ভাত মনে হত।দেখা যেত উনারা গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করে যাচ্ছেন,আর আমি দাদীর সাথে বসে ছোট ছোট হাত দিয়ে ডাল দিয়ে ভাত মাখিয়ে খাচ্ছি।দাদী আমার দিকে করুণভাবে তাকিয়ে থাকত,যেন আমার কত কষ্ট,আমি তখন দাদীর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিতাম,আমি তো বুঝতেই পারতাম না কষ্ট আসলে কি।এই কারণে বা যে কোন কারণেই হোক,দাদী ছাড়া আমার কোন বন্ধু হয়নি,পাশের বাসার সুমন মামার ছেলেও না।কারো সাথে না মেশায় বাবা মা কেমন হয়,তারা ঝগড়া করে কিনা,ঝগড়ার সময় ভাংচুর করেন কিনা,মাঝে মাঝে মেয়েকেও মারেন কিনা,এসব আমি জানতামই না।আমার জীবন ছিল দাদী আর টিভি নিয়ে।সাদাকালো টিভির সামনে সুযোগ পেলেই বসে থাকতাম।
দাদী আর বাবা মিলে আমাকে পড়াত যেগুলো আমি পারতাম না,বাকিটা আমিই নিজে নিজে পড়তাম।দাদীর সাথেই ঘুমোতাম,একা ঘরে ঘুমাতে ভয় লাগত বলে।বাবা আর মা আমাকে কখনও তাদের সাথে ঘুমোতে দিত না।আমি আমাদের ক্লাসের কারো সাথে মিশতাম না,দরকারে দুচারটে কথা হয়ত বলতাম,এর বেশি না,আমার কারো সাথে মিশতে ভালো লাগত না।সবাই পিকনিকে কত মজা করত,এক সাথে ঘুরত,আমি যেতাম না এসবে।প্রতি পিকনিকেই নিম্মি অনুপস্থিত থাকত,এসবের প্রতি আসলে আগ্রহই জন্মায়নি।
যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি,তখন থেকে বাসার সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করে।প্রায়ই ভাংচুর হত বাসায়,মাই এসব করত।আগেরবছর যাও কাছে নিত আমায়,আদর করত,খাবার রান্না করে দিত,সেবছর তাও দেয়না।আমাকে সহ্যই করতে পারত না মা।আমি কাছে গিয়ে কিছু চাইলেই ধাক্কা দিত,ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলত তার কাছে যেন আর না আসি।দাদীকে দেখতাম প্রায়ই শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে।কাজের মহিলা রান্না করত আর দাদী সেসব দেখিয়ে দিত,মা এসবের ধার দিয়েও আসত না।শেষের দিকে মাকে কবে বাসায় খেতে দেখেছি,সেটাই মনে নেই।
যখন আমার বার্ষিক পরীক্ষা চলে,তখন একদিন সকালে আমি নাস্তা করছিলাম।দাদী আমাকে নাস্তা দিয়ে কি একটা নামায পড়ছিল।আমি পা দুলিয়ে দুলিয়ে রুটিতে কামড় দিতে দিতে দেখলাম মা ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে,আমি তাকিয়ে থাকি।মা আমার দিকে জুতা পড়ার সময় একবার তাকিয়েছিল,কিন্তু এরপরে আর তাকায়নি।তখনো বুঝি নি কলিজায় কতটা লেগেছিল দৃশ্যটা,কিন্তু সেদিন থেকে আজো দুঃস্বপ্নে দেখি,আমার মাও আমার দিকে ফিরে তাকায়নি চলে যাবার সময়!
মায়ের প্রতি অসীম ঘৃণা নিয়ে আমি বড় হয়েছি।এর কারণ শুধুই আমাদের ছেড়ে যাওয়া নয়,আমার মা যেদিন চলে যায়,সেদিনই মা ঐ লোকের সাথে মিলে বাবাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে ছিল,আর এটা শুনেই দাদী স্ট্রোক করে মারা যায়।মা আর দাদীকে একত্রে হারানো,তাও আবার মায়ের কারণে,তার কিছুদিন পর মায়ের বিয়ের খবর শোনা,সব কিছু আমাকে একজন "ইন্ট্রোভার্ট" মানুষ বানিয়ে ফেলেছিল।বাবাও আমার কাছে আসতেন না,কারণ আমি আসতে দিতাম না,একা একা থাকতাম।
ক্লাস থ্রি এর বার্ষিক পরীক্ষার সময় মা চলে গিয়েছিল,অনেক ঝামেলা চলছিল,তবু আমি পরীক্ষা দিতাম।একাই যেতাম,একাই ফিরে আসতাম।এইটুকুন মেয়ে একা একা স্কুলে যাচ্ছে,পড়ছে,পরীক্ষা দিচ্ছে,তবু আমার দিকে তাকানোর সময় কারো হয়নি।মাঝে মাঝে সুমন মামার বাসায় গিয়ে মামীকে বলতাম,"আমাকে আব্দুল্লাহর সাথে স্কুলে দিয়ে আসা যাবে?" মামী খুব করূণভাবে আমার দিকে তাকাত।আমি তবুও বাসার কাউকে কিছু বলিনি,বল্লে যে কেউ শুনতে পেত না।যেদিন আমার রেজাল্ট দিয়েছিল,সেদিন আমি একাই গিয়েছিলাম।বাবাকে একবার বলেছিলাম,বাবা মনে হয় শুনে নি,বেরিয়ে গিয়েছিল কাজে।ক্লাসে ফোরে উঠার কিছুদিন পর শুনতে পাই আমার বাবাকে আবার বিয়ে করানো হবে,ফুফু চাচারা এ নিয়ে কথা বলছে।আমি মানুষ ছোট ছিলাম,কিন্তু অনেক বেশিই গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলাম।বাবার বিয়ের দিন আমার চাচাত,ফুফাত ভাই বোনদের মত এত আয়োজন, এত আলোকসজ্জা,এত আনন্দের ব্যবস্থা ছিল না,তবে অনেক মানুষ ছিল।আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রায় পুরোটা দিন পার করে দিয়েছিলাম।রাতের দিকে সবাই মিলে এত ডাকাডাকি আর ধাক্কাধাক্কি করল যে বাধ্য হয়ে খুলেছি।সবাই আমাকে ঠেলে একজন মহিলার কাছে নিয়ে বলল,সে আমার মা। আমি তাকে দেখে একটুও পছন্দ করিনি,বরং নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলাম।
নতুন মা আমার খাওয়ার দাওয়ার খুব খেয়াল রাখত,আমার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করত।কিন্তু আমি সেসব খেতাম না।যেগুলো আমার জন্যে না,সেসব খাবার আমি খেতাম।উনি আমাকে ডাকলে আমি কখনো তার কাছে যেতাম না,তার সাথে কথা বলতাম না,তাকে মাও ডাকিনি।তার মন খারাপ হত বুঝতাম,কিন্তু প্রচন্ড অভিমান ছিল বাবার উপর, ভেবেছিলাম তার সবটা জুড়ে শুধু আমি থাকব,কিন্তু সেখানে নতুন মা এসে ভাগ বসাবে,তা আমি আশা করিনি।
নতুন মা আসার বছর দুয়েক পর একদিন আমার ফুফাত বোন আমাকে বলল,
-নিম্মি!তুই তো আমার মত আপু হবি!তোর একটা আপু হবে!
আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম।আমার আপু মানে?তখন সে বুঝিয়ে বলল,আমার নতুন মায়ের একটা বেবি হবে।আমি মুখ গোঁজ করে বলেছিলাম,
-তারমানে সে আম্মু হবে,আমি কেন আপু হব!সে তো আর আমার মা না।আমার মা তো আমাকে ফেলে চলে গেছে।
সেদিন থেকে খেয়াল করতাম,নতুন মায়ের পেট ফুলে গেছে,সে মোটা হয়ে গেছে।শুধু তাই না,সে প্রায়ই অসুস্থ থাকে,বমি করে,কাঁদে,উঠতে চলতে কষ্ট হয়।তখন ক্লাস সিক্সে পড়লেও মা হওয়ার কষ্টগুলো বেশ ভালোভাবেই বুঝতাম।তার এসব কষ্ট দেখে বুকের ভেতর অভিমানের পাহাড় আরও ভারী হত,মনে হত,আমাকে জন্ম দিতেও তো মায়ের এমন কষ্ট হয়েছে,এত কষ্টের পরও আমাকে কিভাবে ছেড়ে গেল?
ধীরে ধীরে নতুন মায়ের কষ্ট আরো বাড়তে লাগল। একদিন দুপুরে হঠাৎ পুরো বাসা কাঁপিয়ে নতুন মা কেঁদে উঠেছিলেন। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যাই।ঘরে গিয়ে দেখি মা মাটিতে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে,সারা শরীর ঘেমে গেছে,চুল গুলো ঘেমে মাথা আর চেহারার আশেপাশে লেপ্টে আছে,মুখ হাল্কা খুলে শ্বাস নিচ্ছে,তার চোখের নিচের কালিগুলো আরো বেশি গাঢ় দেখাচ্ছিল।আমাকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকলেন।আমি গেলাম।খুব আস্তে বললেন,
-তোমার বাবাকে ফোন দাও মা,বলো,মা অনেক কষ্ট পাচ্ছে,আপুর বাহিরে আসার সময় হয়ে গেছে।
আমি দৌড়ে লেন্ড ফোন থেক বাবার অফিসে ডায়াল করি।বাবা ফোন ধরতেই বলেছিলাম,
-বাবা,মায়ের পেট ব্যথা।তুমি আসো।
বাবা কি বলেছিল জানি না,কিন্তু আমার মুখে মা ডাক শুনে উনি পেছন থেকে কেঁদে ফেলেছিলেন।আমি ফোন রেখে সুমন মামার বউকে ডেকে নিয়ে এসেছিলাম।কিছুক্ষণের মাঝেই নতুন মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।কয়েক ঘন্টা পর এক নার্স বাবাকে বলে তার মেয়ে হয়েছে,বাবা যেন ভেতরে আসে।কিছুক্ষণ পর বাবা বেরিয়ে এসে আমাকে ওখানে নিয়ে যায়।ভেতরে ঢুকে দেখি,খুব ছোট্ট একটা বাচ্চা,পাশে নতুন মা,তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো।বাচ্চাটাকে দেখে খুব আদর আদর লাগছিল,ইচ্ছে করছিল ছুঁয়ে দেই,কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম।মায়ের দিকে তাকিয়ে খুব ভয় লাগছিল।ডাক্তার গম্ভীরভাবে বাবাকে কি কি যেন বলছিল।আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম,নতুন মা বাঁঁচবে তো?
মা সুস্থ হয়ে গিয়েছিল।জ্ঞান ফিরে প্রথমেই সে আমাকে ডেকেছিল,মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল,
-এটা তোমার ছোট আপু,তোমার ছোট বোন।ওকে কিন্তু তোমারই আদর করতে হবে,ওর নাম তোমার রাখতে হবে,ওর জামা পছন্দ করে দিতে হবে,ও বড় হলে ওকে তোমার সাজিয়ে দিতে হবে,ও যখন হাঁটতে শিখবে তোমার ওকে হাত ধরে হাঁটাতে হবে।আর...ওর মা কে মা ডাকতে হবে...মাঝে মাঝে ডাকলেই হবে...ডাকবে না?
মা আমার দিকে চোখে পানি নিয়ে তাকিয়ে ছিল।জানি না কত দিনের অভিমান জমেছিল,লাফ দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আমি কেঁদে সব অভিমান ভাসিয়ে দিয়েছিলাম।আমার হাউমাউ কান্নায় ছোটো বোনটাও কান্না জুড়ে দিয়েছিল,সাথে মা আর বাবাও। সেদিনের পর থেকে আমার মনে হয়নি আমি "ব্রোকেন ফেমিলি" এর মেয়ে,মনে হয়নি মা আমার আপন মা না,মনে হয়নি বাবা আমাকে ভালোবাসে না,মনে হয়নি এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই।
মা,আমি কৃতজ্ঞ,তুমি আমাকে একটা মা দিয়েছ যা আমার ছিল না,একটা বোন দিয়েছ এত কষ্ট করে যে কষ্ট গুলো আমার নিজের মাও করেনি।আসলে...তুমিই আমার মা,যে আমাকে ইন্ট্রোভার্ট থেকে এক্সট্রোভার্ট করেছে।কখনো বলিনি,আজ বলছি বড় বেশি ভালোবাসি তোমাকে মা।
কথাগুলো বলে দশম শ্রেনীর ছাত্রী নিম্মি থামল।মা দিবসে স্কুলে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগটা ও নিয়েছিল শুধুমাত্র কিছু কথা বলার জন্য।মঞ্চের সামনে বসা প্রতিটা মানুষের চোখে পানি,সবাই কমবেশি কাঁদছে।কিন্তু সবচেয়ে বেশি চোখের পানি ফেলা এক কোণায় বোরকা পড়ে বসে থাকা মানুষটার দিকে নিম্মি তাকিয়ে হাসছে।নিম্মিও কাঁদছে,সেও কাঁদছে,সবাই কাঁদছে।তবে এই দুটো মানুষের কান্নায় অন্য কিছু আছে...
চলবে...
লেখনীতে, #Abiar_Maria
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top