#5 রাশেদ

রাশেদ

#ছোটগল্প

#

সারাজীবন ধরে হীরা জহরত পাহারা দিয়ে শেষ দিকে সব যখন ডাকাত এসে নিয়ে যায়,তখন ঐ পাহারদারটাই হল রাশেদ!

বুঝলেন না?বুঝিয়ে দিচ্ছি।

যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছিল,তখন ওর ক্লাসের এক মেয়েকে ভালো লাগে ভীষণ,রুমকি।ওকে দেখলেই লাজুক ভাবে হাসি দিত,রাশেদেরও নাকের আগা লাল হয়ে যেত।মাঝে মাঝে ওকে মিমি চকলেট কিনে দিত।চকলেট কিনে চুপিচুপি রুমকির ব্যাগে রেখে দিত।রুমকি যখন চকলেট দেখত,পেছন ফিরে রাশেদের দিকে চেয়ে একটা ফোক্লা হাসি দিত,আর তা দেখে রাশেদের নাকের আগা লাল হয়ে যেত।চকলেট, কখনো ফুল দিত,আর স্কুলে আসা যাওয়া দুই সময়ে লাজুকলতার মত চাহনী বিনিময়।এরকম করতে করতে দুজনেরই প্রাথমিকের গন্ডি পার হয়ে যায়।মাধ্যমিকে পা রাখার পর রাশেদের সাহসের পরিমাণ খানিকটা বাড়ে,ভাবে,রুমকির সাথে কথা বলতে হবে!চকলেট আর ফুল দেয়া ছাড়া জীবনে আরও কত কি,কথা না বল্লে কিভাবে হবে?

যেদিন কথা বলতে যাবে,সেদিন দেখে পাশের পাড়ার হাসিবুর ওর হাতে ধরে রেখেছে,রুমকির অন্য হাতে মিমি চকলেট! রাশেদের মনে হয়েছিল কেউ ওর কলিজায় কামড় দিয়ে ঝুলে আছে। হাসিবুরের হাত ধরে রাখার দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে বেচারা এক দৌড়ে স্কুলের পুকুরের মাঝখানে গিয়ে লাফ দেয়।ওর দৌড়ে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে ওদের পিয়ন চাচা দৌড়ে ওকে ধরে।যদিও রাশেদ সাঁতার জানে,তবুও তাকে পানি থেকে উঠানো যাচ্ছিল না কিছুতেই।কারণ সে উঠবে না,আর শুধু "না,না না না,না না,আমি যাব নাআআআআ" বলে কান্না জুড়ে দিয়েছিল।ওর এই পাগলামির কারণ কেউ জানল না,যার জন্য করল,সেও না,কিন্তু ফলাফল ঠিকই পেতে হয়েছিল।বাড়ি ফেরার পর বাবার হাতের জংলা কাঠের বাড়ি আর মায়ের থাপ্পড়।দিবে নাই বা কেন বলেন?দুনিয়াতে কোন গাধারা এভাবে মনের দুঃখে পুকুরের মাঝখানে লাফ দেয়??

মাধ্যমিকের শুরুতে রাশেদ আর কোন মেয়ের দিকে তাকায়নি,ঘাপটি মেরে শুধু পড়ালেখা করত আর দুচারটে গল্পের বই জোগাড় করে পড়ত।যদি কোন প্রেমের বই জুটে যেত,ঐ বইটাকে পারে না ছিঁড়ে পাশের বাসার কুকুরটাকে খাওয়ায়!আহা বেচারা!সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর কোন দিন বিয়ে করবে না।পুকুরে ডুবে মরতে পারেনি যেহেতু,দেবদাস তাই হয়ে ওঠা হয়নি,কিন্তু চিরকুমার তো হওয়াই যায়!প্রেমের নাম শুনলেই তাই সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত।ওর এত "জ্বলে ওঠার আপন শক্তি" দেখে বন্ধুরা ভাবত,এই ছেলের ক্যাচালটা কোথায়!তবে বেঁচে গিয়েছিল বন্ধুরা কিছু জানে না বলে,নাহয়...!

উচ্চমাধ্যমিকে উঠার পর এক মেয়ে ওর নজর কাড়ল, মানবিক বিভাগের ছাত্রী।দেখতে শুনতে বেশ।দীঘল কালো চুল,টানা দুটি চোখ,মিষ্টি করে হাসে,চোখ দুটো চাতুরতায় পরিপূর্ণ,বলতে গেলে একেবারে খাপে খাপ!চিরকুমার রাশেদের মনে বসন্ত কাল যেন রঙ ছুঁয়ে দেয় আবার।মেয়েটিকে মাঝে মাঝে ফলো করত,ওর বাসার আশেপাশে ঘুরঘুর করে ভাবত,ইশ,যদি এক পলক দেখা যায়!কত কী চিন্তা করত ওকে বলবে বলে,কিন্তু মেয়েটা সামনে আসতেই ভ্যাব্লার মত চেয়ে থাকত।সে সময় একটা চলন ছিল,ছেলেরা বেশ শখের বশেই নাকের নিচে গোঁফ রাখত,মেয়েরাও সেটা বেশ পছন্দ করত।রাশেদও ঐ মেয়েকে মনে ধরার পর থেকে গোঁফ রাখতে শুরু করে,কিন্তু কে জানত এই গোঁফ তার জন্যে কাল হ্যে দাঁড়াবে?
সাহস করে একদিন রাশেদ ওর সামনে চলে যায়।মেয়ে তখন কোন একটা ইংরেজি ব্যাকরণ বুঝতে পারছিল না।রাশেদকে সামনে পেয়ে চোখ গুলো আলুর মত করে মুখে বা্ল্ব আলো জ্বালিয়ে বলে,
-আজ আকাশের চাঁদ পেয়েছি গো!রাশেদ,আমায় এটা একটু বুঝিয়ে দিবে?

রাশেদ ইংরেজিতে ভালো বলে ক্লাসে বেশ সুনাম ছিল,তার উপর এই সুন্দরীর মুখে নিজের নাম শুনে ওর তো হার্টবিট দুটো মিস হয়ে গেছে!খুশিতে ক্যাংগারুর মত নাচতে নাচতে একটা না সবগুলো নিয়ম বুঝিয়ে দেয়।মেয়ে তো মহা খুশি, আকাশের চাঁদ পেয়েছে না? এভাবেই রাশেদের কাছ থেকে পড়া বুঝত,আর রাশেদের তো মনে মনে প্রতিদিন লাড্ডু, রসগোল্লা, দই বড়া,সন্দেস কিচ্ছু ফুটতে বাকি নেই।

এভাবে মাস তিনেক পেরুনোর পর এক সন্ধ্যায় রাশেদ বেরোয় দুধ কিনতে। দুধ কিনে আসার সময় একটা গলি পার হতেই দেখে,তিন বিল্ডিং পরে যে নতুন বডিবিল্ডার ছেলেটা আছে,তার সাথে খুব হাসাহাসি করছে।দেখেই রাশেদের মাথায় আগুন ধরে যায়,এত হাসাহাসির কি আছে?মেয়ে মানুষ যার তার সাথে কেন হাসবে,হুম?!

পরদিন কলেজে গিয়ে তাই ওকে জিজ্ঞাসা করে,
-কাল সন্ধ্যায় দেখলাম বেশ খুশিতে ছিলে!কোন খুশির খবর আছে নাকি!
-কাল সন্ধ্যায়?কোথায়?
-কেন?অপুদের বাড়ির ঐ নির্জন গলিতেই তো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তোমাকে।ছিলে না ওখানে?
-অহ!ঐটা?ও তো আমার বড় ফুফুর ছেলে,ওর সাথে কথা বলছিলাম।
-ফুফুর ছেলে,নাকি অন্যকিছু?
মেয়েটা যেন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে।
-ঐ!কি বলতে চাও,হ্যাঁ?আজেবাজে কথা বলতেছ কেন?
-আজেবাজে না।তুমি বুঝো না যে আমি তোমার পছন্দ করি?

এবার তো ফাটল বোম!মেয়ে রেগেমেগে বলে,
-তুই?আমার সাথে?আমাকে পছন্দ?ফাজলামি করিস?হ্যাঁ,ঐ ছেলে আমার ফুফুর ছেলে না,আমার প্রেমিক,তো?? তুই ওর ধার দিয়ে যাস,হ্যাঁ? চেহারা তো মাশাল্লাহ, কিন্তু নাকের নিচে রাখছিস সিরাজুদ্দৌলার মত ফিনফিনে গোঁফ!মোটা হলেও কথা ছিল! তোকে দেখতে চোরের মত লাগে!ফের যদি এই পছন্দের কথা শুনি,তোর ঐ গোঁফ আমি ছিড়ে ফেলব!

অপমানে লজ্জায় সেদিন বাসায় গিয়েই রাশেদ গোঁফ ফেলে দেয়,দুদিন কলেজে যায় না,আর নাকে ধরে পণ করে,আর কোনো দিন আমি গোঁফ রাখব না!!!

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসব কারণে আর ও প্রেমের দিকে এগুনোর চিন্তাও করে না।তবে চারপাশে,পার্কের চিপায় চাপায় প্রেম দেখে ও শুধু মুখ থেকে থুতু ফেলে আর ভাবে,"দেশটা একটা লঙ্গরখানা হয়ে গেল!!"

মাস্টার্স শেষ করে সে যখন চাকুরিতে ঢোকে,তার বছর দুয়েক পর হঠাৎ একদিন বৃষ্টির দিনে ভীষণ ঝামেলায় পড়ে।যখন ছাতা মাথায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল,তখন,ঠিক তখনই একজনের সাথে ধ্রিম করে খায় ধাক্কা,আর এক ধাক্কায়ই চিৎপটাং! ওদিকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ে রাশেদের অলিভ শার্ট ভিজিয়ে একাকার করে দিয়েছে।যেন মুখ ভর্তি গালি নিয়ে মুখ খুলল,ওম্নি দেখে সামনে একটা মেয়ে,ওর সাথে বিপরীত দিকে মেয়েও চিৎপটাং হয়ে গেছে!মেজাজ খারাপ হয়ে গেলেও মুখে কারোরই কিছু বলা হয় না,কি দরকার ঝামেলা বাড়ানোর?এমনিতেই অফিসে লেট হয়ে যায় যায় অবস্থা।উঠে দাঁড়িয়ে দুজই একসাথে দুজনকে সরি বলে উঠে,কিন্তু দুজনের চেহারাতেই ভাবখানা থাকে, "অন্ধ একটা,দেখে চলতে পারিস না?"

কোনমতে উঠে খেয়াল হয়,সে অফিসের সাম্নেই চলে এসেছে।তাকিয়ে দেখে, আরে!এই মেয়েও দেখি ওর অফিসের! আজকে যদি বস কিচ্ছু বলে,এই মেয়েকে একদম তুলোধুনো করে ফেলবে সে,ওর দিনটাই শেষ এই অন্ধ মেয়ের জন্য!

ওয়াশরুমে গিয়ে সব মুছে কেবিনে বসে পাশের কেবিনে উঁকি দিয়ে সুমাইয়াকে জিজ্ঞাসা করে,
-এই যে আপা,ঐ বেগুনি জামা পড়া মেয়েটা কে?নতুন এসেছে নাকি অফিসে?
-ওর নাম নিম্মি,একাউন্টসে নতুন জয়েন করেছে,তাও তো ৪দিন হয়ে গেল।তুমি ওকে দেখ নাই আগে?
-ধুর আপা,মেয়েমানুষের দিকে আমার তাকানোর টাইম নাই
-হাহাহা,তাইলে কি ছেলে মানুষের দিকে তাকাও তুমি?
-উফ,আবার শুরু করলা?
-হা হা হা হা,সে যাই বল,তোমাকে এই ভেজা কাকের মত দেখতে কিন্তু ভালোই লাগতেছে,
বলেই চোখ টিপে দেয়।রাশেদের গা জ্বলে যায়।মেয়েদের জাতটাই কি এমন যে শুধু জ্বালায়???

চলবে...

লেখনীতে, #Abiar_Maria

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top