8
মালিয়াতে কষ্ট হচ্ছে, প্রচন্ড কষ্ট। শেষমেষ কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে পড়েছে। দুচোখ উপচে পানি পড়ছে। আয়েত্রীকে যে বড্ড বেশি ভালোবাসে কিন্তু ইশরাক নামের ক্ষণিকের মোহে পড়ে কতবড় ভুল না করতে যাচ্ছিলো।
মেয়েটা বাঁচবে কি না ঠিক নেই তার সাথে কিসের হিংসে? আঠারো বছরের সম্পর্ক, আয়েত্রীর এত স্নেহ-ভালোবাসা কিভাবে সে কয়েক মূহুর্তের ব্যবধানে ভুলে গিয়েছিলো এসব ভেবেই কান্না পাচ্ছে।
দশ মিনিট আগেও এসব মনে হয়নি একবারের জন্য। উদ্ধতস্বভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলো সবার সামনে সবটা বলতে। ঠিক মুহূর্তে আয়াতের কন্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে যায় সে।
"আন্টি কিছু মনে করবেন না। আসলে আমরা এখনো আয়েত্রীর বিয়ের কথা ভাবছি না।"
আয়াতের কথায় বেশ গম্ভীর হয়ে ভদ্রমহিলা বললেন,
"তুমি কে বাবা?"
প্রতিউত্তরে আয়েত্রীর বাবা বললেন,
"আমার ছেলে, আয়েত্রীর ছোট ভাই, আয়াত। আসলে আপা, একমাত্র বোন তো! তাই বোনের বিয়ে সম্পর্কে....."
"বুঝেছি ভাই সাহেব। আয়াত বাবা শোন! মেয়ে যেহেতু বিয়ে তো দিতেই হবে। আমার ছেলে পাত্র হিসেবে কিন্তু খারাপ নয়। "
"আন্টি কিছু মনে করবেন না। অবশ্যই উনারা যোগ্য বলেই আমার অন্য বোনের জন্য আপনাদের সমন্ধকে আমরা গ্রহণ করেছি কিন্তু আন্টি আমার বোন অসুস্থ। আমরা জানি না আমার বোন আদৌও বাঁঁচবে কি না। সত্যি আমরা জানি না।"
শেষের কথাগুলো বলার সময় আয়াতের কন্ঠস্বর বেশ পাল্টে যায়।
উদ্বিগ্ন কন্ঠে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন,
"কি হয়েছে? কোন বড় ধরনের অসুখ?
মৌনতা ভেঙে আয়েত্রী নানা বললেন,
" হ্যাঁ, একটু অসুস্থ। আশা রাখছি আয়েত্রী জলদি সুস্থ হয়ে উঠবে। তাছাড়া আয়েত্রীর চাচাদের অধিকার রয়েছে এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার।
আয়েত্রী স্বাধীনচেতা মেয়ে। ওর মতামত ব্যতীত আমরা আপনাকে কথা দিতে পারছি না।"
"বেশ তবে তাই হোক। আসলে কিছুক্ষণ আগে
আমার বড় ছেলে কানে মুখে ইশরাকের জন্য আয়েত্রীর কথা বলতে রিকুয়েষ্ট করেছে।ভাইয়ের দৃষ্টি হয়তো এড়াতে পারেনি। আমার ছোট ছেলের মনের খবর বড় ভাই তার আগেই বুঝতে পারে। আমার নিজের কাছেও আয়েত্রী কে ছোট ছেলের জন্য পছন্দ হয়েছে। তাই মনে কোন কথা না রেখে বলে ফেললাম।"
আলোচনার মাঝে হঠাৎ সামিউলের রুম থেকে চিৎকারের শব্দ আসে। দ্রুত সবাই বাহিরে এসে দাঁড়ালে দেখতে পায় আয়েত্রী নাক মুখ,গলা,হাত সব লাল হয়ে আছে।
আয়েত্রীর মা দ্রুত মেয়ের কাছে গিয়ে নাক, মুখ দেখতে লাগলেন। রক্তের রঙ নয় এগুলো। আলতার রঙ। পরপর রুম থেকে প্রতীক্ষা, মানহা বেরিয়ে এলো। তিনজনের অবস্থা একই।
ভীত কন্ঠে প্রতীক্ষা বলল,
"ফুপুর বিয়ের আলতা ভেঙে গেছে। কিভাবে ভেঙেছে আমরা জানি না। আমরা তো বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ করে আলতার সিশি আত্রীর মাথায় পড়েছে। ভাগ্যিস কাটেনি। ওটার ছিটা লেগেই আমাদের এ অবস্থা।"
"আচ্ছা ব্যপার না। তোমরা ফ্রেশ হয়ে নাও। আয়েত্রী তুমি প্রতীকে এবং ইশরাক,ইস্তিয়াক কে গ্রামের ওদিকটায় ঘুরে এসো। "
প্রতীর বাবার এ কথায় সম্মতি দিয়ে ওরা চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ে ওরা। কিন্তু বিষয়টা আয়েত্রীর নানুকে বড্ড ভাবাচ্ছে। কারণ যেখানে আলতার বোতল ছিলো সেখানে থেকে হুটহাট আয়েত্রীর মাথায় কেনো, কারো মাথায় পড়ার কথা নয়।
প্রতী-ইস্তিয়াককে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ইশরাক, আয়েত্রী মন্থর গতীতে হাঁটছিলো। অথচ দুটো মানুষ এখনো জানে না, তাদের বিয়ের ফুল ফোটাতে পুরো বাড়ি সুদ্ধ লোক সব তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে।
আয়েত্রী ইশরাকের পাশাপাশি হাটছিলো। আয়েত্রীর থেকে বেশ খানিকটা লম্বা। উনার বউ বেচারির জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে আয়েত্রীর। বেচারি কখনো স্বামীর চোখে চোখ রেখে ঝগড়া করতে পারবে না। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো আয়েত্রী।
"প্রিয় রঙ?"
ইশরাকের হঠাৎ প্রশ্নে আয়েত্রী জিজ্ঞেস করলো,
"আমাকে বলছেন?"
"আপনি ছাড়া আর কেউ আছে না কি? "
"না! আমার প্রিয় কোন রঙ নেই। নেই কোন প্রতিচ্ছবি। "
"কেনো?"
"চোখ বন্ধ করলে যেমন চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়, আমি সেই অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি।"
এদিকে প্রতী ইস্তিয়াকের সাথে কথা বলছিলো। হঠাৎ খেয়াল করলো ঝুপ করে একদল কুয়াশা চারপাশ ঢেকে দিচ্ছে। অজানা ভয়ে ফেটে যাচ্ছে প্রতীর ভিতর ভিতরে।
কিছুটা দূরেই আয়েত্রীকে দেখতে পেলো ইশরাকের সাথে। কোমর ছাড়িয়ে চুল গুলো খোলা,হালকা বাতাসে উড়ছে। আয়েত্রীর অবস্থা মোটেও ভালো লাগলো না প্রতীর। কারণ ওরা হাটতে হাটতে নদীর পাড়ের দিকে চলে এসেছে।
প্রতী দ্রুত পায়ে হেটে আয়েত্রীর কাছে এসে ওর হাত ধরে ইশরাকের কাছ থেকে খানিক দূরে নিয়ে যায়। আয়াতকে ততক্ষণে কল দিয়ে আসতে বলেছে প্রতী।
আয়েত্রীর চুল বেধে ওর মাথায় কাপড় তুলে দিয়ে প্রতী আয়েত্রীকে নিজের সাথে জড়িয়ে বিরবির করে কোর-আন শরীফের কিছু আয়াত পড়ছে। ততক্ষণে আয়েত্রীর নাক দিয়ে ফোটা দুয়েক রক্ত চলে এসেছে।
ইশরাক,ইস্তিয়াক দ্রুত ওদের কাছে এসে এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও যায় না। কারণ ক্যারিয়ারের এমন সব লাশ দেখেছে সেখানে এসব নগন্য।
তবুও ইশরাকের মাথায় চিনচিন ব্যথা হচ্ছিলো এসব দেখে। আয়েত্রীর পুরো ভর তখন ইশরাক সামলেছে। শীতের প্রকোপে আয়েত্রীর হাত নীলচে হয়ে যাচ্ছে। তবে এতটা ঠান্ডাও না।
আয়াত দ্রুত এসে বাইকে বসিয়ে বোনকে নিয়ে যাচ্ছিলো।
আয়েত্রী চলে যাওয়ার আগে এক পলক নদীর পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো শাওন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে, চেহারায় বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট।
বাড়ি আসার পর আয়েত্রী অনেকটা সুস্থবোধ করছে। নানাভাই অবশ্য খানিকটা রাগারাগি করেছে। কারণ এ অবস্থায় আর যাই হোক ভর সন্ধ্যেবেলা বের হওয়া ঠিক হয়নি।
এদিকে প্রতী এসে বিয়েতে মত দেওয়ায় বাড়িতে যেনো এক প্রকার অনাবিল আনন্দ টুপটুপ করে ঝড়ছে। কিন্তু মন খারাপ হয়ে গেলো যখন আয়েত্রী শুনতে পেলো হয়তো আজকেই আকদ হবে। দ্রুত ইশরাকের মায়ের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে বলল,
"আন্টি! আজকেই আকদ না করলে হয় না? আমি জানতাম প্রতীকে আপনাদের পছন্দ হবে কিন্তু আমরা আকদের প্রিপারেশন নেইনি। আমাদের ওর বিয়ে নিয়ে অনেক প্ল্যান। আন্টি প্লিজ।"
আয়েত্রীর এমন অনুনয়ে হেসে উঠলেন প্রতীর হবু শ্বাশুড়ি।
আয়েত্রীর মাথায় হাত রেখে বললেন,
"তিন দিন। হবে তো? এর বেশি সময় নেই কিন্তু।"
উচ্ছ্বসিত কন্ঠে আয়েত্রী উত্তর দেয়,
"হয়ে যাবে। আগে তো আমার একমাত্র দুলাভাই কে মিষ্টি মুখ করিয়ে আসি। "
চার চারটে শালিকা পেয়েছে ইস্তিয়াক। হাসবে না কাঁদবে সে বুঝতে পারছে না।এরা রুপে যেমন আগুনরুপী এদের কুকর্মের বুদ্ধিও তেমন দুঃসাহসী।
ইস্তিয়াককে ছেড়ে হঠাৎ আয়েত্রী ইশরাকের দিকে ফিরে একটা মিষ্টি নিয়ে ইশরাকের মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
"আহা! বেয়াই মশাই যে। বুড়ি বেয়াইন পছন্দ হলো না বুঝি? কিছুই করার নেই গো। এই বুড়ির হাতেই তোমাকে মিষ্টি খেতে হবে।"
বলেই এক প্রকার জোড় করে পুরো মিষ্টি ইশরাকের মুখে ঢুকিয়ে দিলো আয়েত্রী।
মিষ্টির আঠালো রসে ইশরাকের গাল চটচটে ভেজা। শক্ত হাতে আয়েত্রীর হাত ধরে অন্য হাতে ওড়না নিয়ে মুখ মুছে ইশরাক বললেন,
"আই জাস্ট লাভ বুড়ি মাইয়্যা। বিশেষ করে নানী-দাদীরা তো আমার বেশ ভক্ত। আশা করছি তুমিও জলদি আমার ভক্তের তালিকায় নাম লেখাবে। "
প্রতিউত্তরে আয়েত্রী মুখ ভেংচিয়ে প্রস্থান করে।
মওলানা সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন। হয়তো কয়েক মুহূর্ত কিছু ভাবলেন। তারপর আয়েত্রীর নানার উদ্দেশ্যে বললেন,
"হাজী সাহেব, আপনার বাড়ির বান ছুটে গেছে। সে আপনার বাড়িতে প্রবেশ করেছে। এতদিন পারেনি বাড়িতে ঢুকতে কিন্তু আজ যেকোন সময় সে আসছে, যাচ্ছে। এটা ভালো বিষয় না।পূর্ণ চন্দ্র উঠবে তিনরাতে তারপর চাঁদ ক্ষয় হবে।চাঁদ ক্ষয়ের দ্বিতীয় দিন আয়েত্রীর রুহ্ সে নিয়ে যাওয়ার সর্বচ্চো চেষ্টা করবে। তোড়জোড় শুরু করেছে অনেক আগেই। হয়তো আয়েত্রীর সময় ফুরিয়ে এসেছে। "
To be continued...
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top