4.

সন্ধ্যেবেলায় কোথা থেকে একরাশ কুয়াশা এসে ঝুপ ঝুপ করে চারিদিক তার চাদরে ঢেকে নিয়েছে।

আশেপাশে কোথাও একটা পাখি কু গাইছে। গুনগুন করে  প্রত্যাশার কোর-আন তেলাওয়াত, পাখির ডাক সাথে হালকা হিমেল হাওয়া এক অন্যরকম অনুভূতির বিপক্ষে আয়েত্রী  দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ের কথা চিন্তা করেও পারছে না। বিনা নোটিশে আউট হয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো আয়েত্রী।কবরস্থান স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

আজ সকালে সেই লোক কে এখানে দাফন করা হয়েছে।
কুয়াশার জন্য কবর ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে না।

মাটি দেওয়ার আগে যখন লাশ নিয়ে আশা হয়েছিলো
আয়েত্রী এখানে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো।বাঁশ, বাঁশের তালাই দিয়ে মাটি ঘরে যখন শেষ  বিছানা পাতছিলো আয়েত্রীর দৃষ্টি তখন লাশের খাটিয়ার দিকে।

মানুষ চুপচাপ থাকলে না কি কিছু একটা চিন্তা করে কিন্তু লাশের খাটিয়ার দিকে তাকিয়ে আয়েত্রী সত্যি কিছুই চিন্তা করছিলো না।
অনুভূতিগুলো কেমন একটা শূন্যের নিচে ধীরে ধীরে মাইনাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো।

পাশে থাকা ফোন বার বার শব্দ করে জানান দিচ্ছিলো কেউ একজন আয়েত্রীকে কল করছে কিন্তু সে শব্দ হয়তো কান অবধি পৌঁছাতে পারছিলো না। বাড়ির পাশে দাফন হচ্ছে, তাই আয়েত্রীর নানু দুই নাতনীকে সে পাশের ঘর থেকে সরে অন্য ঘরে যেতে বলেছিলেন। প্রত্যাশা যথারীতি চলে আসলেও আয়েত্রী ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো।

মেয়েকে না দেখে আয়েত্রীর মা ঘরে ঢুকে দেখেন আয়েত্রী জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। স্পর্শ করতেই বুঝতে পারলেন অসম্ভব তাপদাহে পুড়ে যাচ্ছে আয়েত্রীর শরীর।

দ্রুত মেয়েকে সেখানে থেকে নিয়ে এসে দুয়ারের মাঝ বরাবর আসতেই মায়ের ডান হাতের উপর জ্ঞান হারায় আয়েত্রী। দ্রুত ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় আয়েত্রীকে।

ঘরে নিয়ে ঘাড়,গলা থেকে চুল সরিয়ে বিছানায় শোয়ানোর সময় বেশ খানিকটা আঁতকে ওঠেন প্রত্যাশার মা।
কারণ আয়েত্রীর ঘাড়ের দাগে আরো একটা দাগ যুক্ত হয়েছে।

দাফন কার্য সম্পন্ন হবার কয়েক মিনিটের মাথায় ঘাম দিয়ে আয়েত্রীর শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। দুই মিনিটের মধ্যে আয়েত্রীর শরীরে এমন পরিবর্তন আসে যেনো তার কিছুই হয়নি।

প্রত্যাশার কোর-আন তেলাওয়াত শেষ হলে সে এসে আয়েত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে কাধে স্পর্শ করে।
আয়েত্রী মুচকি হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করে

"কি?"

প্রত্যাশা কিছু না বলে খুব শক্ত করে আয়েত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলল,

"যে যাই বলুক না কেনো! তুই কখনো ভয় পাসনে যেনো। আমরা সবাই আছি। আল্লাহ্ দ্রুত শেফা দান করবেন। "

দুইবোন নানুর সামনে সামনে হেটে চলেছে। উদ্দেশ্য মসজিদ। নানার সাথে দেখা করবেন নানু।
মসজিদের কাছাকাছি আসতেই অনুভব করলো মিষ্টি গন্ধে যেনো চারিদিক ভরে উঠেছে।
আয়েত্রী প্রত্যাশার কানে কানে বলল,

"কি যে রান্না করছে?  আল্লাহ্ মালুম। এত সুন্দর গন্ধ!  মনে হয় পায়েশ। "

প্রতি উত্তরে প্রত্যাশা বলল,

"আয়েত্রী মোটেও তুই সেখানে খাইতে চাসনে যেনো আবার!"

"দেখা যাক। "

মসজিদের সামনে আসতেই ওদের নানাভাই আসেন। দুই  নাতনীর হাতে চারটে খেজুর দেন।

মসজিদের মওলানা সাহেব বৃদ্ধ লোক। তিন কূলে কেউ নেই।উনি এখানে থাকেন। খাবার সব আয়েত্রীর নানার বাড়ি থেকে আসেন।ভদ্রলোক কে এলাকার সবাই সমীহ করে চলেন। ছোট-বড় সবার বিপদে ভদ্রলোক ডাকার আগেই চলে যান৷ প্রত্যাশা,আয়েত্রীকে ডেকে পাশের চেয়ারে বসতে বলেন। ইয়েমেন হতে আগত যুবক দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য এগিয়ে এসে কুশলাদি বিনিময় করেন ওদের সাথে।
আয়েত্রী কিছু বলার আগেই মসজিদের খাদেম এক বাটিতে পায়েস এনে আয়েত্রীর হাতে দিয়ে বললেন,

"তোমাদের দুই বোনের জন্য। বাড়ি নিয়েও যেতে পারো। সমস্যা নেই। পরে এক সময় আমি গিয়ে বাটি নিয়ে আসবো।"

এদিকে আয়েত্রীর নানু উনার স্বামীকে সবটা বললে উনি বলেন,

"আমিই উনাকে আসতে বলেছিলাম। কারণ বাড়িতে আর পুরুষ মানুষ নেই।তোমদের সুরক্ষার ব্যপারে উনি কোন দ্বিমত করেন নি। চিন্তা করো না। আজকে শুধু উনি উপস্তিতি জানান দিয়েছেন। বিপদে আপদে তোমার ডাকতে হবে না। উনি নিজ থেকেই তোমাদের রক্ষা করবেন।"

নানার থেকে বিদেয় নিয়ে, নানুর হাতে পায়েসের বাটি দিয়ে এগিয়ে আসছিলো দুই বোন। হঠাৎ বাঁশ ঝাড়ের পাশে আসতেই দমকা বাতাসে  গা শিউরে উঠলো প্রত্যাশার। কিছু না ভেবেই উল্টো পথে নানুর দিকে এগিয়ে যায় সে।
এদিকে আয়েত্রী আপন মনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছে।

"মিস.আয়েত্রী!  আপনি একা এখানে কেনো? "

কারো ডাকে পাশ ফিরে তাকিয়ে আয়েত্রী শাওন কে দেখতে পেলো। হাসি মুখে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

"তার আগে আপনি বলুন,আপনি এখানে কেনো?"

"এদিকটায় আমার বাড়ি তাই। ওই যে আমাদের বাড়ি।"

"আমাদের না!  বলুন আমার। যদি বাড়ি টা আমার এবং আপনার দুজনের হতো তাহলে আমাদের বাড়ি হতো। যাই হোক মসজিদে গিয়েছিলাম। নানাভাইয়ের কাছে।"

"একা? "

"উঁহু!  নানু আর প্রতী আছে।"

"কোথায়?  আপনি একা। দেখুন। "

আয়েত্রী পিছন ফিরে কাউকে না দেখে বেশ ঘাবড়ে যায়।শাওন আশ্বস্ত করে বলল,

"ভয় নেই। আমি আছি। বাই দি ওয়ে। আজ ভুলেও রাতে বের হবেন না। নদীর পাড়ে তো মোটেও আসবেন না।"

বিস্ময়ের সাথে আয়েত্রী জিজ্ঞেস করলো,

"কেনো?"

"আজ নদীর পাড়ে পুলিশ টহল চলছে। সারা রাত উনারা ওখানে থাকবেন। আপনি মেয়ে মানুষ। তাই ভুলেও না।"

"আচ্ছা, আসবো না।"

কথা বলতে বলতে শাওন আয়েত্রীকে ওর নানুর কাছে পৌঁছে দেয়।হাত পাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে আছেন উনারা।

"আসি তাহলে। মনে রাখিয়েন কিন্তু। কারণ আজ আমি থাকবো না।"

কথা বলেই ক্ষেতের আইলে নেমে যাচ্ছিলো শাওন। আয়েত্রী বাধা দিয়ে বলল,

"ওদিকে কেনো?"

শাওন মুচকি হেসে উত্তর দেয়,

"শর্টকাট।"

আজ এক ঘরেই রয়েছে সবাই। আয়েত্রী, প্রত্যাশার মা, মামী, নানু। নিচে বিছানা পেয়ে শুয়েছে পল্লবী বেগম,আরাধ্যা বেগম আর আয়েত্রীর মামী। খাটে আয়েত্রী,প্রত্যাশা আর ওদের নানু।

ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে রাত বারোটা বাজে। রুমের সাথে ওয়াশরুম হওয়ায় দুই বোন ফ্রেশ হয়ে এসে প্রথমে চুলে তেল দিয়ে বেনুনি করে নিলো,এরপর আয়েত্রী ডান হাত বাড়িয়ে বসে আছে। কোলের উপর বালিশ রেখে আয়েত্রীর হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছিলো প্রত্যাশা।

হঠাৎ আয়েত্রী অনুভব করলো ভিষণ খারাপ লাগছে তার। চোখ জ্বলছে, নাক জ্বলছে। হাত কাঁপছে। মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা করছে। এক হাতে বিছানায় তিন বার বারি দিয়ে গড়গড়িয়ে বমি করে দিলো প্রত্যাশা আর নিজের হাতের উপর।
বমিতে অন্য কিছুনা। শুধুমাত্র টাটকা রক্ত। প্রত্যাশার চিৎকারে ততক্ষণে সবাই উঠে বসেছে। আয়েত্রী না থাকতে পারছে বসে না পারছে শুয়ে থাকতে। নাক দিয়ে অনবরত চুইয়ে চুইয়ে রক্ত আসছে।

করুণ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল,

"মা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। "

প্রত্যাশার মা, মামী বিভিন্ন দোয়া-দরুদ পড়ছে। আয়েত্রীর মা,নানু আর প্রত্যাশা আয়েত্রীকে সামলানোর চেষ্টা করছে।

হঠাৎ বাহিরে থেকে দরাজগলায় কারো কোর-আন তেলাওয়াত এর শব্দ শোনা যাচ্ছিলো।
কোর-আন তেলাওয়াত থামিয়ে এক সময় কেউ একজন বাহির থেকে বললেন,

"আপনারা কেউ বাহিরে আসবেন না।আয়েত্রীকে দরজার পাশে রাখুন। পবিত্র হয়ে এসে কোর-আন পড়ুন।"

প্রত্যাশা দ্রুত আয়েত্রীকে নিয়ে দরজার পাশে বসলো। এদিকে সবাই দ্রুত ওযু করে এসে কোর-আন তেলাওয়াত শুরু করেছে।

দূর থেকে আজানের শব্দ আসছে। হঠাৎ বাহিরের তেলাওয়াত বন্ধ হয়ে গেলো।পুনরায় বাহিরে থেকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করে,

"আয়েত্রীর মা!  মেয়ের ঘাড়ে দেখুন, কোন চিহ্ন আছে কি না! থাকলে আমাকে এক্ষুনি বলুন।"

আয়েত্রীর মা দেখলো একটা চিহ্ন আছে। সাথে সাথে জবাব দিলো,

"হ্যাঁ "

"খুব গভীর?"

"জ্বী না। অনেক টা হালকা। "

"শোকর আলহামদুলিল্লাহ্। নামাজ আদায় করে নিন আপনারা।আমি আসছি।"

সকাল হতে না হতেই দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। আয়েত্রীর নানু দরজা খুলে দেখেন আয়েত্রী নানা দাঁড়িয়ে আছেন। কাল রাতে কে কোর-আন তেলাওয়াত করেছেন বুঝতে বাকী নেই কারোর। উদ্বিগ্নতা সহিত আয়েত্রী নানা জিজ্ঞেস করলেন,

"আয়েত্রী কোথায়? "

ইশারা করতেই উনি রুমে প্রবেশ করে প্রথমে আয়েত্রীর ঘাড়ের দাগ দেখলেন।
দাগ দেখে চমকে উঠেছে বলে মনে হলো না কিন্তু গম্ভীরমুখে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,

"গত কালের আয়েত্রীর মুখের কথা সত্যি হয়েছে। নিরুর পুরো শরীরে চামড়া নাই।লবণ মরিচের গুঁড়ো লাগানো সারা গায়ে। ওর চিৎকারের শব্দে আকাশ-পাতাল এক হচ্ছে তবুও ওর প্রাণ যাচ্ছে না।

আয়েত্রীর মা! তোমার মেয়ের শরীরকে নির্ভর করে কেউ একজন প্রেত সাধনা করতেছে। গত কাল রাতে যদি তোমার মেয়ের ঘাড়ের এই দাগ আরো গভীর হয়ে যেতো তাহলে আজ তোমার মেয়ের রুহ্ তার কাছে বন্দী থাকতো। "

To be continued...

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top