...এবং মুহুর্ত

তখন ১৯০৫ সাল। দেশ জুড়ে বয়ে চলেছে আন্দোলনের ঝড়। এমন সময়ে কলিকাতার এক নামি ব্যাবসায়ী অরুণেন্দ্র রায় তার কনিষ্ঠ পুত্র অনীশ-কে বিলেত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন স্নাতকোত্তর পড়াশোনার উদ্দেশ্যে।

বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে অনীশ যথেষ্ট মেধাবী। স্কুল বা কলেজ কোথাওই কখনো দ্বিতীয় হয়নি সে। বাবার আদেশে তাই মহোৎসাহেই সে রাজি হয়ে যায় বিলেত যেতে।

ওর জাহাজটা যখন প্রথম লন্ডনের ডকে এসে নোঙর ফেলে, তখন যেন প্রান ভরে নিঃশ্বাস নেয়  অনীশ... এই শহরের হাওয়ায় যেন অবাধ স্বাধীনতার গন্ধ খুঁজে পায়। আর, এই স্বাধীনতা যেন তার পদবী ও পিতৃপরিচয়ের সঙ্গে বয়ে বেড়ানো ভারের থেকে মুক্তির উল্লাস।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে ওর নির্দিষ্ট কামরাটিতে প্রবেশ করার পর অনীশ দেখে, ঘর অন্ধকার করে একটা বেডের পাশের স্টাডি টেবিলে টেবিলল্যাম্পের আলো জ্বালিয়ে বইয়ের মধ্যে ডুবে আছে জনৈক পুরুষ। অনীশের বুঝতে অসুবিধে হলো না এই মানুষটিই তার সম্ভাব্য রুমমেট। তাদের করোর মুখই আলো আঁধারিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।

"তোমার কোন ডিপার্টমেন্ট ?" নিরবতা ভেঙে হঠাৎই প্রশ্ন করে ওঠে এই দ্বিতীয় মানুষটি।

"আপনি জানলেন কি করে যে আমি বাঙালি?" তাকে বাংলায় প্রশ্ন করতে দেখে, হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করে অনীশ।

"অন্ধকারেও তোমার দোহারা চেহারা দেখে ওটা আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না। নমস্কার, আমি শশাঙ্ক দত্ত। জীববিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের ছাত্র। রুমমেট হিসেবে তোমারও পরিচয় পেলে ভালো লাগবে।" ঘরের বিজলিবাতি গুলো জ্বালতে জ্বালতে নিরলিপ্ত ভাবে কথাগুলি বলে চলে শশাঙ্ক।

বৈদ্যুতিক আলোয় এই মানুষটিকে দেখে কেমন যেন ঘোর লেগে যায় অনীশের। শশাঙ্ক নামটা সত্যিই সার্থক। এ যেন রাতের আকাশের বুকে ঔজ্জ্বল্যের প্রতিমা।

দেখতে দেখতে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস। শশাঙ্ক বেশ অন্যরকম মজার মানুষ, ওর সঙ্গে অনীশের বন্ধুত্বটাও বেশ জমে উঠেছে এই ক'দিনে। ওরা দুজনেই স্নাতকোত্তর জীব-বিজ্ঞানের ছাত্র এবং বেশ মেধাবী, তাই একসঙ্গে পড়াশোনা করতে বেশ সুবিধাও হয়।

এদেশের পরিবেশের সঙ্গে এখন বেশ মানিয়ে নিয়েছে অনীশ। এতে অবশ্যই শশাঙ্কর অবদান অনস্বীকার্য। পড়াশোনা থেকে শুরু করে খেলাধুলা সব বিষয়েই ও অনীশকে সাহায্য করেছে‌।

আজকাল শশাঙ্ককে ছাড়া এখানে জীবনটা কল্পনাও করতে পারে না অনীশ। প্রতিদিনের পড়াশোনা শেষ করে শশাঙ্ক-র সঙ্গে সন্ধ্যেবেলা একটা গল্পের আসর না বসলে যেন দিনটাই অসম্পূর্ণ লাগে ওর।

বাড়ির আভিজাত্যের ঘেরাটোপের বাইরে অনীশের দিনগুলো এখানে কাটতে থাকে স্বপ্নের মতো।

একদিন ক্লাসের শেষে অনীশের এক সহপাঠী এসে ওকে খবর দেয়, ক্রিকেট খেলতে গিয়ে মাথায় বল লেগে আহত হয়ে এখন শশাঙ্ক মেডিকেল হলে আছে।

দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অনীশ দৌড়োয় মেডিকেল হলের দিকে। ওর মনে হয়, গোটা পৃথিবীটাই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। ওর চারপাশটা পূর্ণিমার রাতে চাঁদের অনুপস্থিতির মতোই ভয়ংকর মনে হয়।

মেডিকেল হলে পৌঁছে ও দেখে একটা বেডে শশাঙ্ক বসে আছে এবং ডাক্তার তার মাথার ক্ষতে ড্রেসিং করে দিচ্ছে। ডাক্তার অনীশ-কে জানায় যে চিন্তার কোনো কারণ নেই, শশাঙ্কর শুধু কপালে সামান্য কেটে গেছে।

প্রেসক্রিপশনে ওষুধপত্র লিখে দিয়ে ডাক্তার মেডিকেল হল থেকে বেরিয়ে গেলে, অনীশ ছুট্টে গিয়ে জড়িয়ে ধরে শশাঙ্ককে, তারপর এতক্ষণের জমিয়ে রাখা কান্নায় ভেঙে পড়ে।

শশাঙ্ক অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, "আরে বাবা এতে কান্নার কি হল? সামান্যই তো কেটে গেছে..."

"ওটা মোটেই সামান্য নয়..." কাঁদতে কাঁদতে অভিমানের সুরে বলে অনীশ।

শশাঙ্ক হেসে বলে, "আবার অভিমান কেন?"

"যদি বলি ভালোবাসি বলে?" দৃঢ় স্বরে জানায় অনীশ।

এই আকস্মিক স্বীকারোক্তিতে অবাক না হলেও চমক লাগে শশাঙ্কর। চোখের কোণে অজান্তেই জমে ওঠে শিশির বিন্দু।

"এই ভালোবাসা কখনো পূর্ণতা পাবে না জেনেও ভালবাসিস?" কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে শশাঙ্ক।

"ভালোবাসার তো পূর্ণতা পাওয়ার দরকার পড়ে না। ভালোবাসা তার সৃষ্টির সময় থেকেই সহজাতভাবে সম্পূর্ণ। আমি এখন ভালোবাসি, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ভালোবাসি। আমার কোনো চিরন্তনের আশ্বাসের প্রয়োজন নেই।" এক নিঃশ্বাসে বলে যায় অনীশ।

ঠোঁটের কোণে যেন একটা স্বস্তির হাসি নিয়ে অনীশের গালে আলতো করে চুম্বন করে শশাঙ্ক।

"তাহলে চল... এরকম যে অনেক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।"

একে অপরের হাত ধরে মেডিকেল হল থেকে বেরিয়ে যায় ওরা। বর্ষার হাওয়ায় ঘরের পর্দা গুলো দুলে চলে এলোমেলো।

©️ ঈপ্সিতা মিত্র পুপু

**এই গল্পে ব্যবহৃত সমস্ত ছবিগুলি Pinterest থেকে সংগৃহীত **

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top