২৫


তরীর সকাল থেকেই মন খারাপ, থেকে থেকে চোখ জ্বালা করে অশ্রু ঝরছে। বাচ্চাদের কোনোমতে খাইয়ে গুছিয়ে রেখে এসেছে। অন্যান্য দিন যেমন গাড়িতে বসে জিসানের সাথে টুকটাক কথা হয়, হাসিঠাট্টা হয়, কোনোটাই হয়নি। তরী মন খারাপ করে সারারাস্তা সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বুঁজে পড়েছিল। জিসান যখন অফিসের সামনে এসে থামালো, তরী আস্তে করে নেমে গেল। জিসান জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিল তরীর মন খারাপের কারণ, কিন্তু বারবার ওর চোখে পানি দেখে আর করে নি। ও নিশ্চিত তরীর ইমরানের কথা মনে পড়ছে।

জিসান অফিসে বসে কাজ করতে করতে যখন খেয়াল হলো আজকের তারিখ, তখন চমকে উঠল। আজ ইমরানের জন্মদিন। এই জন্মদিন নিয়ে কত শত স্মৃতি আছে ওদের! নিশ্চয়ই তরীর একারণে মন খারাপ। জিসানেরও এসব ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল। অফিসের কাজে বিচ্ছিন্নভাবে বারবার ভুল করতে লাগলো। কি অদ্ভুত মানুষের মন! ভাইয়ের জন্য কষ্ট হয়, আবার ভাইয়ের স্মৃতিতে স্ত্রীকে কাতর হতে দেখেও কষ্ট হয়! হোক তার ভাইয়ের স্মৃতি, কিন্তু তরীর জন্য সে তো এক্স হাজবেন্ড, আর জিসানের জন্য ভাই এবং স্ত্রীর প্রাক্তন। তরীর জন্য না, তরীর কাতরতা দেখে ওর খারাপ লাগছে।

শেষ অব্দি বিকাল হতে না হতেই কলিগের কাছে কাজ চাপিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসলো। পকেট থেকে ফোন বের করে তরীকে কল দিল।

"অফিসে খুব ব্যস্ত তুমি?"
"না, আজকে একটু কাজ কম"
"আমি এখন আসলে বের হতে পারবা?"
"এখন? স্যার দিবে কিনা কে জানে"
"বলে দেখো?"
"আমি জানাচ্ছি"

কিছু সময় পর তরী ওকে জানালো, আধাঘন্টার মাঝে বের হতে পারবে। জিসান তৈরি হয়ে ওর অফিসের নিচে এসে অপেক্ষা করতে থাকলো। তরী পনের মিনিট পর নেমে এসে দেখল, জিসান গাড়ি পার্ক করে হাঁটাহাঁটি করছে, তরীকে দেখে সে এগিয়ে  আসলো। তরী ব্যাগ কাঁধে তুলতে তুলতে বলল,
"অনেকক্ষণ আগে এসেছেন মনে হয়?"
"বেশিক্ষণ না"
"আমি তো বলেছিলাম আধাঘন্টা লাগবে"
"আমি কি কিছু বলেছি তোমায়? ইচ্ছা করেই আগে আগে এসেছি। ভালো লাগছিল না অফিসে। হাতে এগুলো কি?"
"ফাইল। আগে আগে চলে এসেছি, তাই কিছু কাজ নিয়ে আসলাম"
"কিন্তু কাজ করার সময় পাবে? আমরা তো একটু ঘুরব"
"ঘুরবেন? কোথায়?"
"এই তো, এদিক ওদিক"
"বাচ্চারা?"
"সমস্যা নেই, আম্মা, নিসা, নেহা বাসায়। দুপুরে নাকি নিপা আপু এসছে। চলো"

তরী গাড়িতে উঠে বলল,
"আপনার কি শরীর খারাপ?"
"না তো! কেন?"
"কেমন যেন বিবর্ণ লাগছে, মনে হচ্ছে রক্তশূন্যতা হয়েছে"
"ও কিছু না। ওয়েদার ডিমান্ড। তোমার কেমন লাগছে এখন? সকাল থেকে খুব আপসেট দেখলাম"
"তেমন কিছু না, এমনিই"

তরী সাবধানে ইমরানের কথা এড়িয়ে গেল, জিসানও ঘাটালো না। ইমরানের জন্য ও কাঁদছে- ব্যাপারটা ওর হজম হচ্ছে না। ও জানে সব, মাত্র দু বছরও পার হয়নি। তরীর ইমরানের স্মৃতি আর আবেগ থেকে নিজেকে সরাতে সময় লাগবে। কিন্তু জিসানের মন মানে। মানুষ মনের কোণে কোনো এক অংশে সবসময় অযৌক্তিক। এই অংশকেই হয়ত আবেগ দিয়ে তারা বলে 'হৃদয়' বা 'মন'। জিসান তরীকে নিয়ে কয়েক যায়গায় ঘুরলো। তরী শ্রিম্প আর চিকেন খুব পছন্দ করে, তাই নতুন একটা রেস্টুরেন্টে আসলো যেখানে এই আইটেম গুলো ভালো হয়। তরীকে নিয়ে খেলেও তরীর মন যে এখনো ইমরানের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটাই জিসানের ভালো লাগছে না, কিছুতেই সে চাচ্ছে না তরী অতীতে ইমরানের সাথে ছুটে বেড়াক। বেয়ারা মন হয়রান হয়ে যাচ্ছে তরীর হাতে নিজের হাতের অস্তিত্ব অনুভব করতে, তরীর জীবনে নিজে ছুটে বেড়াতে। না চাইলেও ইমরানের প্রতি ঈর্ষা বাড়ছে।

খাওয়া শেষ হতেই তরী বলল,
"একটা অনুরোধ রাখবেন?"
"কি অনুরোধ?"
"আজ আমাকে এক যায়গায় নিয়ে যাবেন?"
"প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখন কোথায় যেতে চাও?"
"আমি ইমরানের কবর জিয়ারত করতে চাচ্ছিলাম"
"এখন? সন্ধ্যার সময় কিন্তু খুব একটা ভালো সময় না"

তরী অন্যমনস্ক হয়ে টেবিকে আঁকিবুঁকি করছে আঙুল দিয়ে। জিসান বলল,
"একটা আইডিয়া আছে আমার কাছে। চলো, গরীব বাচ্চাদের কিছু খাবার আর কাপড় দেই"
তরীর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
"তাহলে চলুন, পরে আবার বেশি অন্ধকার হয়ে যাবে"

ওরা দুজন কিছু খাবার আর কাপড় কিনে একটা বস্তির পাশে গিয়ে বাচ্চাদের হাতে তুলে দিল। ইমরানের জন্য দুয়া করতে বলতে গিয়ে গলায় কান্না পেঁচিয়ে গেল। কি বলবে? আমার স্বামীর জন্য দুয়া করো? পাশে তাহলে কে দাঁড়িয়ে আছে? সেও তো স্বামী! তাহলে? তরী এমন এক সমস্যায় পড়ে আছে, যেই সমস্যায় বোধ করি খুব কম মেয়েই পড়ে।

বাসায় ফেরার পর সকালের মত না হলেও কিছুটা ভালো লাগছে তরীর, বিশেষ করে জিসান ওকে গরীব বাচ্চাদের কিছু একটা দেয়ার আইডিয়া দেয়ার জন্য। কিন্তু জিসানের ভালো লাগছে না। তরী ওর পাশে বসে ওর প্রাক্তনকে ভাবে- এটা ওর মেজাজের যাচ্ছেতাই অবস্থা করে ফেলছে। পৃথিবীতে নারীরা তার স্বামীকে শেয়ার করতে যত কষ্ট পায়, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পায় ছেলেরা। মেয়েরা ক্ষমা করতে জানে, ছেলেরা ক্ষমা দূরে থাক, কোনো যুক্তিই বুঝতে পারে না।

বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তরী খেয়াল করেনি জিসানের দিকে। রাতের খাবার খেয়ে জিসান চিলেকোঠায় চলে আসলো। বেশ কয়েকদিন পর ও আবার সিগারেট ধরাচ্ছে। সেদিন তরীকে বলার পর আর একটাও ধরায় নি। যতবার সিগারেট জ্বালাতে গেছে, ততবার তরীর সিগারেট ধরা মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে৷ আজ আবার এটার কাজ লাগলো, কারণ সারাদিন চেষ্টা করেও তরীকে নিজের প্রতি ঘোরাতে পারেনি। তরী সারাদিন অতীতেই ছুটেছে, অথচ বর্তমান যে ওকে একটা মানুষ উপহার দিয়েছে, তা ওর চোখেও পড়েনি।

সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে ডায়রি বের করল। কলম তুলে নিয়ে লিখলো-

আজও তুইই তরীকে নিয়ন্ত্রণ করছিস। অন্ধকার কবরে চলে গেছিস চিরতরে, তবুও তুই দাপিয়ে বেড়াচ্ছিস এই পৃথিবীতে, তরীর ভেতরে বসে। অথচ আমি সেই কবে থেকে ওর পেছনে খেটে মরছি, দিন রাত একটু ওর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কি না করছি! তবুও তরীর মাঝে আমার সামন্য ছোঁয়া নেই, না আছে ওর ছোঁয়া আমার উপর। তোকে প্রচন্ড ঈর্ষা হয়, বুঝলি। পৃথিবী থেকে চলে গিয়েও কি করে একটা মানুষ বেঁচে থাকে, তা তোকে দেখে বুঝতে পারছি! আমার সেই ভাগ্য হলো না রে, আমি পারলাম না ভালোবাসার মানুষের মাঝে এত বাঁধাহীনভাবে সাঁতরে যেতে! আমি তোর যায়গা নেয়া দূরে থাক, নিজের যায়গাটাও করে নিতে পারব না বোধহয়।

ঠিক এ সময় দরজায় কেউ একজন কড়া নাড়ছে৷ ওকে ছাদে খুঁজতে কে আসবে? তরী নাকি? জিসান দরজা খুলে দেখলো তরী দাঁড়িয়ে আছে। ঘড় ভর্তি ধোঁয়া, তাই জিসান বেরিয়ে আসলো। গরমের কারণে ওর পরনে একটা ট্যাঙ্কটপ আর শর্ট প্যান্ট। তরী সেদিকে কোনো নজর না দিয়ে বলল,
"আপনি কি সিগারেট খাচ্ছিলেন?"
জিসান ওর পেছনে দরজা টেনে আটকে দিল।
"হ্যাঁ। কেন, তোমারও কি খেতে ইচ্ছা করছে নাকি?"
"নাহ, ওসব কিছু না। আপনাকে খুঁজতে আসলাম"
"খোঁজার কিছু নেই!"

জিসানের কন্ঠে রুক্ষতা, আর তরীর মনে আশংকা।
"আপনার কি হয়েছে বলেন তো? শরীর খারাপ? অফিস থেকে আসার পর থেকে অসুস্থ লাগছে"
"আমার দিকে মনোযোগ দেয়ার সময় আছে তোমার?"
তরী জিসানের এই কথার মানে ঠিক বুঝতে পারলো না। ও ভাবলো, বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এই কথা বলছে।
"আসলে অফিস থেকে আসার পর ওরা আমাকে এমনভাবে ধরে যে ছেড়ে আসতে পারি না। সারাদিন তো মাকে কাছে পায় না"

আচমকা তরী কপালে, গালে হাত দিল।
"নাহ, আপনার তো জ্বর নেই। আপনি এসব ছাইপাঁশ না খেয়ে নিচে আসুন, এক গ্লাস দুধ দিচ্ছি, খেজুর খাবেন। এগুলো খেলে ভালো লাগবে আশা করি"
জিসান কোনো জবাব দিল না। তরী ওর দিকে মনোযোগ দিয়েছে, এটা জানার পরও অশান্তি লাগছে, কারণ অবচেতন মনে নিজেকে ইমরানের সাথে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। ও ভাবছে, কি করে তরীকে বোঝাবে, আসলে কেন ওর এত সমস্যা হচ্ছে?

তরী ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল,
"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার মাথায়ই আসেনি ইমরানের জন্য কিছু একটা দান করার আইডিয়া। আপনি যদি না বলতেন, তাহলে আজকে সারাদিন মন খারাপ থাকত। থ্যাঙ্কিউ"
জিসান ম্লান হাসি দিল মাটির দিকে চেয়ে। মনে মনে বলল, তোমার এই শুকনো ফর্মাল ধন্যবাদ দিয়ে আমার কোনো কাজ হবে না। তরী যেন সেটা শুনেই ওর কাছে এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। জিসানের মনে হলো এতক্ষণে ওর কলিজা ঠান্ডা হচ্ছে! তরী আলতো করে জিসানের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। ফিসফিস করে বলল,
"থ্যাঙ্কিউ ফর এভ্রিথিং, আজ সারাদিন আমার মন ভালো করার চেষ্টা করার জন্য"

জিসানও ওকে জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে চেপে ধরল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তরীর ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। এক সেকেন্ডের ঐ সময়টায় তরী কিছু ভাবার আগেই এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল। তরী জিসানের চোখের দিকে চেয়ে আছে। কোনো এক অজানা কারণ বশত ওর একটুও খারাপ লাগলো না এজন্য। তরীর মনে হলো, সময়টা এক সেকেন্ড এর বেশি হলে মন্দ হতো না।

কিন্তু পরের সেকেন্ডেই চমকে উঠল। কিভাবে ও জিসানের সান্নিধ্য চাইতে পারে! কিভাবে জিসানের স্পর্শ ভালো লাগতে পারে?! তরী নিজেকে ছাড়িয়ে দ্রুত পায়ে নিচে চলে আসলো। বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেছে তাই তরী ছাদে গিয়েছিল জিসানকে আনতে। তার বদলে এটা কি করে আসলো? স্বামী হওয়া সত্ত্বেও সমস্ত শরীর জুড়ে একটা পাপবোধ জড়িয়ে ধরছে ওকে। এটা কেমন বিশ্রি অনুভূতি? কেন এমন হবে? জিসানের অধিকার তো এরচেয়েও বেশি! অথচ ও কেন তার অধিকারের এক কোণাও দিতে রাজী করতে পারছে না নিজেকে? আর কত ভোগাবে জিসানকে?

কান্না চলে আসলো ওর। মুখে হাত দিয়ে কেঁদে কেঁদে ইমরানকে বলল,
"তোমার দখলকৃত ঠোঁটেও আজ অন্য কেউ রাজত্ব করতে যাচ্ছে। যে আমাকে তুমি রেখে গেছ একান্ত নিজের করে, সেই আমি আজ আরেকজনের মাঝে হারাতে বসেছি। আর আমার শরীর জুড়ে জঘন্য কষ্ট। কেন ছেড়ে গেলে? বেঁচে থাকলে কি আজ আমার এত কিছু ফেস করতে হত? তুমি একটা স্বার্থপর ইমরান। আই হেইট ইউ, আই হেইট ইউ, আই হেইট ইউ টু দ্যা ইনফিনিটি!"

তরী মাটিতে বসে বিছানায় মাথা রেখে কাঁদছে। ও জানে, জিসান এখন নিচে এসে ওকে ভালোবাসতে চাইবে। আর তরী কিছুই করতে পারবে না।

জিসান কিছুই করল না। বরং ঘরে ঢুকে আবার ধোঁয়ার রাজ্যে ডুবে গেল। একটা মোম জ্বেলে ডায়রিতে আবার লিখলো,
"আজ তরীকে প্রথম চুমু খেলাম। ও বোধহয় পছন্দ করেনি তোর অধিকারে থাকা ঐ পরম যত্নের স্থানে আমার অনুপ্রবেশ। কি ভয়াবহ বাস্তবতা! আমি না পারছি ওর কাছে নিজেকে, না পারছি তোকে ওর কাছ থেকে সরাতে। ভাই আমার, তুই প্লিজ ওর মন থেকে সরে যা। কারণ তুই যতই রাজত্ব করতে চাস, তুই এখন আর কিচ্ছু করতে পারবি না। আমিই ওর বর্তমান, আর বেঁচে থাকলে ভবিষ্যত। ওকে আমি ছোঁবো, ওর জীবনে আমি একটু একটু করে প্রবেশ করব। একদিন তোকে আমি ঠিক সরিয়ে দিব দেখিস। সেদিন ওকে আমি বলব, আমাকে তোর চাইতে বেশি ভালোবাসতে। তরীকে আমাকে ভালোবাসতেই হবে। মরে গিয়েও ও তোর হতে পারে না। তরী শুধু আমার, কেবল আমার। আজ না হলেও কাল ও আমার!"

চলবে...

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top