১৯
জিসান দুকাপ চা হাতে করে ঘরে ঢুকলো। ও স্যুট টাই খুলে রেখে এসেছে। এক কাপ তরীর দিকে এগিয়ে দিল।
"আজ খুব যন্ত্রণাময় একটা দিন গেল। চা খাও, ভালো লাগবে"
তরী চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল,
"কে বানিয়েছে চা?"
"আগে বলো কেমন হয়েছে?"
তরীর লেবু চা খুব পছন্দের। এই চা মুখে দিলে মনে হয়, সব ক্লান্তি চায়ের সাথে গিলে ফেলা যাচ্ছে। কি সুন্দর লেবুর ঘ্রাণ আসছে! তরী একবার ঘ্রাণ নিয়ে চুমুক দিল। যদিও চিনি একটু বেশি হয়েছে, তবুও ওর ভালো লাগলো।
"ভীষণ ভালো হয়েছে। কে বানিয়েছে? নিপাপু?"
জিসান মাথা নাড়লো।
"তাহলে?"
"যিনি বানিয়েছেন, তিনি সামনেই দাঁড়িয়ে আছে!"
তরীর ঠোঁটে হাসি ফুটলো।
"আপনি এত ভালো চা বানান, তা তো জানতাম না আগে!"
"মাত্রই তো শুরু হলো আমাকে জানা। চলো, তোমাকে এক যায়গায় নিয়ে যাবো"
"এখন? এই অবস্থায়?"
"হুম! চাও নিয়ে নাও। কাম অন!"
তরী জিসানের পেছন পেছন বেরিয়ে আসলো। সবাই শুয়ে পড়েছে। জিসান এর মা জোছনা কাজের মেয়েকে নিয়ে খাবার গোছাচ্ছেন। জিসান ওর মাকে দরজা আটকাতে নিষেধ করে তরীকে নিয়ে ছাদের দিকে রওনা দিল। জিসানদের ছাদ জিসান নিজের হাতে গুছিয়ে রেখেছে। বিশাল ছাদের চার কোণায় বড় বড় চারটা গাছ, আর দুপাশে কিছু ছোট ছোট টব আছে। ডান কোণায় একটা চিলেকোঠা ঘর যার বাইরে নানারকম আঁকিবুঁকি করা। চিলেকোঠার বাইরে লাল নীল কয়েক রকম লাইট ঝোলানো। চিলেকোঠার বিপরীতে৷ বাম পাশে একটা দোলনা রাখা। তরী স্নিগ্ধ আলোকসজ্জা দেখে মুগ্ধ হয়ে বলল,
"এই প্রথম আমি একটা ব্যাপার রিয়েলাইজ করলাম, আপনাদের বাসার ছাদে কখনো আসিনি আমি!"
"হুম। ইনফেক্ট, আমি তেমন কাউকে এখানে আসতে দেইও না। এটা আমার ব্যক্তিগত স্পেস বলতে পারো। কাজ থাকলে আম্মু মাঝে মাঝে আসে, আমার বোনরাও আসে। কিন্তু বাহিরের কেউ কিংবা মেহমানরা, কাউকে এলাউ করি না। তুমি কি বলতে পারবে তোমাকে নিয়ে এখানে আসার উদ্দেশ্য কি?"
"আমি কি করে বলব?"
"তোমাকে এজন্য এখানে এনেছি যে, এই ছাদে এখন থেকে আমার মত তুমিও আসতে পারবে। তবে একটা শর্ত আছে!"
"ছাদে আসব, এতে আবার শর্ত কিসের?"
"শর্ত হলো, ঐ যে চিলেকোঠায় কখনো যেতে পারবে না"
তরী জিসানের চোখের দিকে তাকালো।
"কেন?"
"আমার একান্ত ব্যক্তিগত যায়গা এটা। আমি চাই না এখানে কেউ আসুক। আজকে বিয়ের রাত, তাই আজই ক্লিয়ার করলাম"
তরী দুষ্টুমি করে বলল,
"ওখানে কি আছে? আপনার প্রেমিকার সাথে কাটানো স্মৃতি?"
"হ্যাঁ!"
তরীর মুখের হাসি মুছে গেছে।
"আর ইউ সিরিয়াস?"
"সিরিয়াস না হওয়ার কি আছে?"
"তাহলে আমাকে বিয়ে করেছেন কেন?"
জিসান হেসে দিল।
"কারণ সে আমার পাস্ট, এজন্য"
"একতরফা ছিল?"
"হ্যাঁ, একতরফা"
"কোথায় এখন সে?"
"আমার সাথে!"
"কি?"
"মানে আমার মনে আছে"
"আমি রিয়েল লাইফের কথা বলছি"
"রিয়েল লাইফে সে তার যায়গায় আছে!"
"তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করলেন? কি অদ্ভুত মানুষ আপনি! আমি ভাবলাম আপনি আমাকে পছন্দ করেন বলে আমাকে বিয়ে করেছেন!"
জিসান হেসে ফেলল।
"তুমি মনে হয় মজা বোঝো না, তাই না?"
তরী না বুঝতে পারার মত চেয়ে থাকলো।
"আরেহ, এতক্ষণ মজা করলাম তোমার সাথে। এত সিরিয়াস কেন তুমি সবসময়?"
তরী দোলনায় বসতে বসতে বলল,
"সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে কেউ এসব মজা করে বলে?"
"স্ত্রী বোকা হলে বলে!"
জিসান এসে ওর পাশে বসে দোলনা দোলাতে বলল,
"প্রেমিকা টেমিকা কিছু না, ওখানে আমি থাকি যখন একা একা থাকতে ইচ্ছা করে খুব। সবারই একটা নিজস্ব স্পেসের প্রয়োজন হয় জীবনে। তোমারও লাগবে, আমি জানি। আমি কখনো তোমার পার্সোনাল স্পেস ভায়োলেট করব না, তুমিও করবা না। ডিল?"
জিসান ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। তরী মেলানোর জন্য হাত বাড়াতে জিসান বলল,
"এভাবে না, হাতে থুতু দিয়ে হাত মিলিয়ে ডিল করতে হয়, আইরিশদের মত!"
তরী সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিল।
"ইয়াখ!"
জিসান দাঁত বের করে হাসছে।
"আপনি যে এত দুষ্ট!"
"তোমার জন্য দুষ্টুমি করছি। এত সুন্দর সাজ দিয়েও এমন একটা চেহারা বানিয়ে রেখেছ যেন কেউ তোমাকে জোর করে করলা খাইয়ে দিয়েছে"
"করলা ইজ গুড। ভালোই তো লাগে!"
"আচ্ছা! প্রিয় খাবার মনে হচ্ছে? এজন্যই আজকাল চেহারা করলার মত করে রাখো। তোমাকে এখন থেকে করলা রানী ডাকব, কেমন?"
তরী হাসছে। জিসান মাথা ঝুকিয়ে কোমল কন্ঠে বলল,
"ক্যান আই হোল্ড ইউর হ্যান্ড?"
তরী কিছু বলল না, কেবল কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে হাত এগিয়ে দিল। জিসান ওর হাত ধরে বসে থাকলো। তরী সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ শুধু জিসানকে অবজার্ভ করবে। কিছুক্ষণ পর জিসান হাত ধরে টেনে বলল,
"চলো, নিচে গিয়ে ফ্রেশ হই। অনেকক্ষণ জ্বালিয়েছি। তোমার বিরক্ত লাগছে না এত ভারী কাপড় পরে এভাবে ঘুরে বেড়াতে?! আমার তো অসহ্য লাগছে!"
"কি আশ্চর্য! আপনিই তো বললেন ড্রেস চেঞ্জ না করতে! এখন আপনিই আবার অভিযোগ করছেন?!"
"কি আশ্চর্য! আমি যা বলব, তাইই করবা নাকি?"
"কেন, করব না?"
"নাহ, করবা তো। অবশ্যই করবা। সবসময় করবা
"
তরী কনফিউজ হয়ে জিসানের দিকে তাকিয়ে আছে। জিসান ওর মুখোমুখি দাঁড়ালো। আলতো করে দুই গালে হাত রেখে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। তরী আশা করেনি এমনটা, ও চোখ বন্ধ করে ফেলল। জিসান ওর দুই হাত চেপে ধরল।
"ইচ্ছে করছে সারারাত তোমাকে জ্বালাই। কিন্তু তুমি তো এত যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবে না! তবুও আরেকটু জ্বালাবো। একটু দাঁড়াও!"
জিসান তরীর বেশ কয়েকটা ছবি তুললো। তারপর নিজের সাথে সেলফি তুললো। সেলফি তোলার সময় তরী হাসছিল না বলে জিসান সুড়সুড়ি দিল। তরী রীতিমতো লাফিয়ে উঠেছিল। জিসান আজকে ভালোভাবেই জ্বালাবে ওকে, বোঝা যাচ্ছে। তরী ভাবছে, ভোর হতে আর কত দেরী, পাঞ্জেরী?!
তরীকে নিয়ে যখন ও নিচে নেমে এসেছে, তখন আর কেউ জেগে নেই। ঘরে ঢোকার পর জিসান বলল,
"তুমি দেখো কোন ড্রেস পরবে, আমি দুই মিনিটে ফ্রেশ হয়ে আসছি"
জিসান টয়লেটে ঢোকার পর তরী দেখল, ওর হাত লাল হয়ে গেছে। কি সমস্যা এই লোকের? এমন ভাবে হাত ধরে রাখে যেন আর জীবনেও হাত ধরতে পারবে না। তরী হাত ডলতে ডলতে আয়নার সামনে গিয়ে গয়নাগাটি খুলে ফেলল। তারপর তাকালো চুলের দিকে। কয়েক হাজার ববিপিন নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে এই খোপার মধ্যে। মাথা ব্যথা করছে ওর। হাত দিয়ে এক এক করে চুল থেকে ক্লিপ খুলতে শুরু করেছে। ফুল গুলো সহজেই ছাড়ানো গেছে, কিন্তু চুল ছাড়াতে গিয়ে চুলের বারোটা বেজে যাচ্ছে ওর। চুল নিয়ে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে জিসান ওয়াশরুম থেকে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বেরিয়ে আসলো। তরী বিরক্ত হয়ে বলল,
"এটা কি ধরনের কাপড়?!"
"কম্ফোর্টেবল কাপড়!"
"কেমন লাগে এভাবে লুঙ্গি পরে ঘুরতে?"
"সবার কম্ফোর্ট জোন তো আর এক রকম হয় না!"
তরী ভাবছে, ইমরান জীবনেও লুঙ্গি পরে ওর সামনে ঘুরেনি। ছিঃ, কি ক্ষেত লাগে! ও আবার নিজের চুলের দিকে নজর দিল। হুট করে ইচ্ছা করল চুলে আগুন ধরিয়ে দিতে, অথবা কেচি দিয়ে কেটে ফেলে দিতে। এক দিনের জন্য এই টর্চার সহ্য করা যায় নাকি?! আশ্চর্য?!
তরীকে চুল নিয়ে টানাহেঁচড়া করতে দেখতে জিসানের মজা লাগছে। তরী আয়নাতে পেছনে বসে বসে জিসানকে হাসতে দেখে রেগে গেল।
"মন চাচ্ছে আপনার গলা টিপে ধরি! একটু হেল্প তো করতে পারেন, নাকি?!"
জিসান আরও হাসতে শুরু করল।
"মেয়েদের চুল আমি কখনো ঠিক করে দেইনি। পরে দেখা যাবে তোমার সব চুল কেটে ফেলে দিতে হবে আমার জন্য!"
তরী মুখে বিরক্তভাব ফুটিয়ে চুলে এবার তেল দিতে থাকলো। চুলে তেল দেয়া শেষে কাপড় খুঁজতে শুরু করল। জামা কোনটা পরবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এত অসহ্য লাগছে যে সামনে যেটা পেলো, সেটা নিয়েই বাথরুমে চলে গেল। মেকাপ তুলে চুল ধুয়ে বের হতে হতে ওর আধাঘন্টার বেশি সময় লেগে গেল। শেষ কবে এত সময় নিয়ে গোসল করেছে, সেটাই মনে করতে পারছে না। গোসল ছেড়ে ঝরঝরে ভাব নিয়ে বেরিয়ে আসার পর দেখল জিসান বালিশে মাথা ঠেকিয়ে মাথার নিচে দু হাত দিয়ে পা নাচাতে নাচাতে ওকে দেখছে। তরী একটা ঢোলা গেঞ্জি আর স্কার্ট পরে বেরিয়েছে। বেশিরভাগ সময় ও নিজের ঘরে এভাবেই থাকতে পছন্দ করে। জিসানকে তাকিয়ে থাকতে খেয়াল হলো, কোনো ওড়না আনে নি সে। ঝট করে নিচু হয়ে লাগেজ থেকে ওড়না খোঁজা শুরু করল। একটা ওড়না টেনে গায়ে জড়িয়ে কাপড়চোপড় নিয়ে বারান্দায় গেল। সেখান থেকে আসার পর জিসান বলল,
"তুমি কি বাথরুমে ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?"
"ছিঃ, বাথরুম কি ঘুমানোর যায়গা?"
"তাহলে এত সময় ধরে কি করলা?"
তরী স্পষ্ট বুঝতে পারছে জিসান ওকে জ্বালানোর চেক চেষ্টা করছে। ওকে পাত্তা না দিয়ে বিছানার অন্য পাশে গিয়ে বালিশ ঠিকঠাক করে শোয়ার আয়োজন করছে। জিসানকে নড়তে না দেখে বলল,
"আপনি কি এখন ঘুমাবেন না?"
"না, ভাবছি, তোমাকে আরেকটু জ্বালাবো"
"এক কাজ করেন। কয়লা এনে জ্বালিয়ে তার উপর আমাকে বসিয়ে দিন। একদম জ্বলজ্বল করতে থাকেব আমি! এত উলটপালট শখ কেন আপনার?"
জিসান হাসছে।
"রেগে গেলে তোমার নাক লাল হয়ে যায়, খেয়াল করেছ কখনো?"
তরী ওদের দুজনের মাঝখানে দুটো বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়ল। জিসান সেটা দেখে বলল,
"এত অবিশ্বাস করো আমাকে? এত অবিশ্বাস নিয়ে আমাকে বিয়ে করা ঠিক হয়নি তোমার"
"চিন্তার কোনো কারণ নেই। বিয়ে যেহেতু করেছি, একদিন বিশ্বাসও করব"
"বিশ্বাস সম্পর্কের শুরু থেকেই আসে। বিশ্বাস না থাকলে কখনো একটা সম্পর্ক শুরু হয় না"
"আমি আপনার সাথে একমত না। একটা সম্পর্কের শুরু থেকেই বিশ্বাস থাকে না। সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে বিশ্বাস তৈরি হয়"
"তুমি আমার কাছে সময় চেয়েছ, আমি বলেছি দিব। তাহলে এরকম বালিশ দিয়ে রাখার মানে কি?"
"বালিশ দিলাম যেন আমি ঘুমের মাঝে আপনার কাছ চলে না যাই। বালিশ না থাকলে পরে দেখা যাবে আপনার উপর হাত পা তুলে ঘুমিয়ে থাকব। আমার বদঅভ্যাস আছে!"
আলো নিভিয়ে ওরা দুজন শুয়ে পড়েছে। তরী ঘুমাতে পারছে না, কেবল এপাশ ওপাশ করছে। জিসান সেটা খেয়াল করে বলল,
"ঘুমাতে কষ্ট হচ্ছে? মাথা টিপে দিব?"
তরী জিসানের দিকে তাকালো। নিচু কন্ঠে বলল,
"আমার আর ইমরানের মাঝে আমিই সবসময় ওর মাথা টিপে ঘুম পারাতাম। সরি, আসলে সারাদিন ইমরানের স্মৃতি মাথায় ঘুরছে। ওকে খুব মনে পড়ছে"
"মিস করছ?"
"ওকে সবসময় মিস করি। তার মাঝেও আপনাকে বিয়ে করতে রাজী হলাম। ঠিক বুঝতে পারছি, আপনি ঠকেছেন"
"ওর কথা আমারও আজ সারাদিন অনেক মনে পড়েছে। ওকে মনে পড়া মানে আমাকে ঠকানো না, আমাকে যদি কখনো ভালো না বাসতে পারো, তাহলে ঠকানো হবে"
"যদি কখনো ভালো না বাসতে পারি?"
"তাহলে তুমি যা চাইবে তাই হবে। তবে একদিন তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবাসবে"
"আচ্ছা, একটা মানুষ এক জীবনে কয়বার প্রেমে পড়ে?"
"সময় আসলে উত্তর পাবে"
অন্ধকারে জিসানের হাসি তরী দেখতে পেলো না, কেবল ওর হাতের স্পর্শ চুলের গোড়ায় পেয়ে ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল।
চলবে...
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top