১১
আমি আবার, আর একটা বার
লেখা #AbiarMaria
১১
জিসান হাসপাতাল থেকে বের হয়েছে বাইশ মিনিট আগে। বাহিরে এসে ওর কাছে মনে হচ্ছে, এভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি। একটা মানুষ এমনিতেই এখন নাজুক অবস্থায় আছে, তার সাথে এমন ভাবে খোঁচা মারা ঠিক হয়নি। কি হত তাকে কথা শুনিয়ে না আসলে? পরের মুহূর্তে মনে হলো, যা হয়েছে, বেশ হয়েছে। তরী ডিজার্ভস ইট। এত ভালো ব্যবহার করার কিছু নেই। বিয়ে হলে ওকে সব দিক থেকে জিসান প্রোটেকশন দিত, ওর হয়ে সব যুদ্ধ করত। বিয়ে করেনি কেন? নিজে নিজে যখন জীবন যুদ্ধে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন ওকে এভাবে একা ফেলে দেয়াই উচিত। অতি মাত্রায় পন্ডিত। কি মনে করে এই পৃথিবীকে সে? এত সহজ সিঙ্গেল মাদার হয়ে বেঁচে থাকা? হয়ত সে টিকে যাবে, কিন্তু যে কষ্ট সে পুরো সমাজের কাছ থেকে পাবে, সেটা কি? টাকা কোথা থেকে আসবে? ইশতির যে পা ভাঙলো, এখন ওর সেবা করবে কে? কাজের মেয়ের কাছে বাচ্চা রেখে দশ ঘন্টা ধরে অফিসে পড়ে থাকতে পারবে? থাক, পারলে পারুক, না পারলে নেই। জীবন তরীর, কষ্টও ওকে করতে হবে।
জিসানের প্রস্থানের বেশ কিছু সময় পর ইমরানের বাবা মা আর বোন কেবিনে প্রবেশ করল। নাজনীনের কোলে ছিল তন্দ্রা, ও খুব দাদী ভক্ত হয়েছে। তবে এত সময় পর মাকে দেখে সে কান্নাকাটি লাগিয়ে দিল। ইশতির দাদা-দাদী কিছুক্ষণ নাতিকে দেখে চোখের পানি ছেড়ে যখন শান্ত হলেন, তখন আজমল বললেন,
"তরী, তোমাকে কিছু বললে তো আর শোনো না, মুরুব্বিদের কথা মানতে চাও না। যেইজন্য আজকে এই অবস্থা। এখন আমি বলি, চাকরি থেকে কয়দিন ছুটি নাও"
"কিন্তু আব্বা, আমার তো একমাসও হলো না চাকরির"
নাজনীন মুখ খুলেন,
"তোমার ছেলের এই অবস্থা। এখন চাকরি নিয়ে চিন্তা করার দরকার আছে? ছেলের চেয়ে চাকরি জরুরি?"
"কিন্তু আমার হাতে টাকা পয়সা নেই একদম"
আজমল উঠে দাঁড়ালেন।
"তাতে কি? আমরা কি মরে গেছি নাকি যে আমাদের নাতি নাতনী টাকার অভাবে থাকবে? এইসব চাকরি বাকরি বাদ দাও মা। বাচ্চাদের বাপ নাই, মা তুমি। তুমিও যদি অফিসে পড়ে থাকো, ওরা থাকবে কার সাথে?!"
নাজনীন বললেন,
"কয়েক দিন আগে আমি গোসলের জন্য গরম পানি রাখছিলাম বাথরুমের সামনে। কি একটা হাতের কাজ ছিল, খেয়াল করি নাই। নীলুকে ডেকে যে বলব পানি ঢেলে দিতে, ভুলে গেছিলা। ইশতি এসে ঐ পাতিলে আরেকটু হলে উল্টায়া পড়ত! আমি সময় মত ধরে ফেলছি দেখে বাঁচছে! তুমি আমাদের কাছে রেখে যাও ঠিক আছে, কিন্তু বাচ্চাদের চোখে চোখে রাখা লাগে। আমরা কি এত কিছু পারি? তার উপর ঘরে কি কম কাজ থাকে? আর তরী, তুমি থাকতে ও কিভাবে সিঁড়ি থেকে পড়ে? মা থাকতে যদি বাচ্চার হাত পা ভেঙে যায়, তাহলে না থাকতে কি অবস্থা হবে? কিভাবে ওকে রেখে অফিস করবা তুমি?"
তরী মাথা নিচু করে আছে। সবার কন্ঠ শুনে ইশতি উঠে গেছে৷ সে সবাইকে দেখছে। ইকরা এগিয়ে আসে।
"এই বান্দরটার দোষ সব। আমি তো জানি! কি রে, তোর স্পাইডারম্যান হওয়ার খুব শখ,না? এরকম ধুরুম ধুরুম হাত পা ভেঙে ফেললে স্পাইডারম্যান হবি কি করে?"
ইশতি এখনো ওষুধের ঘোরে আছে। তার মাঝে থেকে হাত দিয়ে নিজের দুদিকে দেখিয়ে জবাব দিল,
"আমার পা ভেঙে এদিক দিয়ে আরও দুইটা পা লাগাবো। তারপর স্পাইডারম্যান হয়ে যাবো"
ইকরা দাঁত বের করে তরীকে বলল,
"দেখছেন ভাবী, আপনার ছেলের কত শখ?"
তরী ছলছল নয়নে ছেলের দিকে চেয়ে আছে।
জিসান যখন ঘরে ঢুকলো, তখন জোছনা ছেলের আগমন টের পেয়ে ওর ঘরের দিকে এগিয়ে আসলো। জিসান ঘামে ভেজা শার্ট খুলতে খুলতে মাকে দেখে বলল,
"কিছু বলবা আম্মা?"
"এতক্ষণ কই ছিলি তুই?"
"জানোই তো"
"ইমরানের ছেলের কি অবস্থা এখন?"
"ভালো, তেমন সমস্যা নেই। একটু খেয়ালে রাখতে হবে, বাচ্চা মানুষ তো"
জোছনা চুপচাপ ছেলেকে দেখছেন। ধীর পায়ে বিছানার এক কোণায় বসলেন।
"তরী এত মানুষ থাকতে তোকে কল দিল কেন?"
"কারণ কারো ফোনে কল যাচ্ছিল না। আর কিছু বলবা তুমি?"
জোছনা বিরক্ত হয়ে ছেলেকে বলেন,
"এমন করতেছিস কেন? আমি কি তোর সাথে দুইটা কথা বলতে পারি না?"
"আম্মা, তুমি কাজের কথা না বলে অপ্রয়োজনীয় কথা বলতেছ। কাজের কথা বলো"
"তোরা আজকালকার ছেলে মেয়েরা কি হচ্ছিস, আমি জানি না! কাজের কথা শুনবি? কি কাজের কথা শুনবি? আমরাই তো তোদের কাছে অকাজের হয়ে গেছি। আমার সব কথাই তো তোদের কাছে অকাজের মনে হবে!"
জিসান হাল ছেড়ে দিয়ে মাকে বলল,
"তুমি তরীকে ছাড়া অন্য কিছু বলো। ইমরানের ছেলের এক্সিডেন্ট হলো, আমার সেখানে যাওয়া দায়িত্ব না? এজন্য গেছি, আর কিছু না। এখন অন্য কিছু বলো"
জোছনা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। দুই সেকেন্ড পর আবার ছেলের দিকে মুখ ঘোরালেন।
"এভাবে যে উঠে গেলি মেহমান ফেলে, উনারা কি মনে করল?"
"কি মনে করল ওনারা শুনি?"
"তুই বুঝিস না কি মনে করল?"
"বুঝলে কি জিজ্ঞসা করতাম? মানুষের বিপদ কি বলে কয়ে আসে? বাসায় মেহমান আসলেই যে বিপদ হতে পারবে না, হলেও মেহমান ফেলে যাওয়া যাবে না, এসব কোথায় আছে বলো তো আম্মা?"
"উনারা এখন যদি মানা করে দেয়?"
জিসান একটা লুঙ্গি পরেছে। অনেকে ট্রাউজার পরলেও ওর কাছে লুঙ্গিটাকে খুব আরামদায়ক মনে হয়। লুঙ্গি পরে মায়ের পাশে বসে বলল,
"ওরা কি মানা করেছে?"
"না, করেনি। কিন্তু কেমন যেন একটা ভাব নিয়ে বের হলো"
"ঠিক আছে, দেখো ওরা কি বলে"
জিসান বলতে চেয়েছিল, ওর মা যেন মানা করে দেয়, বলতে পারেনি। কে যেন ওর কথা আটকে দিয়েছে। কয়েকদিন আগে নিজেই বলেছে বিয়ে দেখতে, এখন আবার যদি বলে মানা করে দিতে, তখন ওর মা রেগে যাবেন। মাকে কি জবাব দেবে সে? তরীর জন্য সে কাউকে বিয়ে করবে না? আর তরী? তরী যে ওকে বিয়ে করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? তার চেয়ে চুপচাপ থাকা ভালো। তরীর যা জেদ, বিয়ের কথা তুললেই ঝামেলা লাগাবে। কিসের এত জেদ ওর? কি আছে ওর? একা একা যুদ্ধ করার মত শুধু ইচ্ছাশক্তিটাই কি সব? ওর কি মানসিক শক্তি আছে আদৌ? জিসানের বিরক্ত লাগছে, সে উঠে চলে গেল বাথরুমে।
তরী বসে আছে ছেলেকে কোলে নিয়ে, তখন দেখলো ইমরান এসে ওর সামনে দাঁড়িয়েছে।
"তরী, আমার ছেলে মেয়েদের তুমি দেখে রাখতেছ না?"
"কেন এভাবে বলতেছ? আমি তো ওদের জন্য সব করতেছি"
"না, তুমি সব করতেছ না। তুমি যা করতেছ, নিজের জন্য করতেছ"
"না ইমরান! তুমি ভুল বুঝতেছ!"
"না। তুমি ওদের খেয়াল রাখলে ইশতি এই অবস্থা কেন হলো?"
"আমি তো ওকে ধরেই রেখেছিলাম!"
"তাহলে পড়ল কেন? তরী তুমি স্বীকার করো, তুমি আমার বাচ্চাদের খেয়াল রাখতে পারছ না! তুমি অযোগ্য!"
ইমরানের কন্ঠে উপরে উঠছে। তরী চোখের পানি ছেড়ে বলল,
"সব মিথ্যা! আমি ওদের সব খেয়াল রাখছি, সব! আমি মোটেও অযোগ্য না!"
ইমরানের কথাগুলো দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে তরীর কানে বাজতে থাকলো। তরী ডুকরে কেঁদে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে সে ধপ করে বিছানা থেকে উঠে বসলো। ইকরা ওকে উঠে বসতে থেকে ছুটে আসলো।
"ভাবী, খারাপ কিছু দেখেছেন স্বপ্নে?"
তরী কাঁদতে কাঁদতে ইকরাকে জড়িয়ে ধরলো। কেঁপে কেঁপে কেঁদে চলেছে সে।
"তোমার ভাইয়াকে দেখলাম। তোমার ভাইয়া বলছে আমার জন্যই ইশতির এই অবস্থা হলো। ইকরা, আমি কি করব? মা হওয়ার অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে৷ আমি কোথায় যাবো? আমার খুব অসহায় লাগছে! আমি কি ওদের জন্য যথেষ্ট না? আমি পারছি না কেন?"
ইকরার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করছে, তবে এটা উপযুক্ত সময় নয়। তরীর জন্য খারাপ লাগছে। অনেকেই যখন বলেছে, মা থাকতে ছেলের এক্সিডেন্ট কি করে হয়, তখন থেকে ওর খারাপ লাগছে। এই সমাজে সিঙ্গেল মা হওয়া কি দোষের?
চলবে...
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top