৭. কলেজে হাত ধোওয়া দিবস উদযাপন
আঁখি, মিলন, সাদিয়া, সান সবাই কলেজের মাঠের মাঝখানে বসে গল্প করছে। মিলনের দাঁড়ি কেন ওঠেনা এটা নিয়েই আলোচনা ও তীব্র সমালোচনা চলছে! যদিও মিলন তাতে মহা বিরক্ত, তার দাড়ি উঠুক বা না উঠুক তা নিয়ে সবার এতো মাথা ব্যথা এতো আলোচনা সমালোচনা করার কি হল এটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা।
তবে সে যে বিরক্ত, তা কিন্তু সবাই বুঝতে পারছে। অবশ্য তা নিয়ে কারোরই মাথা ব্যথা নাই। ছোট খাটো বিষয়ে বন্ধুকে সামান্য হ্যারেসমেন্ট না করলে বন্ধুত্বের কি মূল্য থাকে?
"ঐ দেখ আবীর আসছে" মাঠের দিকে তাকিয়ে বলল সাদিয়া। " হাতে বালতি নিয়ে আসছে কেন? ব্যাগ কই ওর, কি আশ্চর্য!"
কাছে এসেই আবীর বলল,
"নে চল"
"চল মানে? কই চলবো! তোর ব্যাগ কই? এই বালতি মগ আনছিস কেন কলেজে? কাপড় ধুবি? ধোপার নতুন চাকরী পেয়েছিস?" সাদিয়া প্রায় ডজন খানেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফেলল এক নিঃশ্বাসে।
" কই চলবো জানিস না? আজকে ১৫ ই অক্টোবর না? আজকে বিশ্ব হাত ধোওয়া দিবস জানিস না তোরা? "
"হাত ধোওয়া দিবস হয়েছে - তো?"
"হাত ধোওয়া দিবসে প্রথমে তোরা হাত ধুবি, তারপর আমরা রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করবো, সবাইকে হাত ধোওয়ার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিবো, এবং সামনে যাকে পাবো তারই হাত ধুইয়ে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ"
সান সঙ্গে সঙ্গে ফোঁস করে উঠল,
"হালায় কুত্তায় কামড়াইছে নাকি! কে শুনবে আমাদের কথা? পাগল ছাগল বলে তাড়িয়ে দিবে না? কোন হালায় রাজি হবে এই আকামের জন্য?"
আবীর চোখ ছোটো করে বলল,
" রাজি হবেনা মানে? ওর বাপ-মা, বোন-ভাস্তি রাজি হবে, সোজা কথায় রাজি না হইলে বাড়ি দিয়া পশ্চাৎ দেশের টিংগেরীর হাড্ডি ছুটায়ে দেয়া হবে। আঁখি আর আমি সুন্দর ভাবে বোঝাবো, যদি কাজ না হয়, তাহলে তুই খড়ি দিয়া বাইড়ানি শুরু করবি।"
সবাই হো হো করে হেসে উঠল কিন্তু মাইর দেয়ার কথা শুনে সান পুরোপুরি উত্তেজিত হয়ে গেল। তার বাতিস্তার মত এনিমেল বডি কবে কাজে আসবে? তার বডি এখনই ফোর প্যাক থেকে সিক্স প্যাক হতে চলেছে।
"জোস আইডিয়া, তোরা থাক আমি সব ব্যবস্থা করে আনছি এখনি"
সান প্রচণ্ড উত্তেজিত অবস্থায় উঠে চলে গেল। এবং পনেরো মিনিটের মাথায় আরো লোকজন সহ হাতে আর্ট কাগজের ব্যানার নিয়ে ফিরে এলো! আঁখি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
আবীর ব্যানার নেড়েচেড়ে সন্তুষ্টির মত মুখ করে বলল,
" ডায়ালগ লেখ এখন তাহলে, একটাতে লেখ,
হাত ধোওয়া দিবসে
হাত ধোব একসাথে!
আরেকটায় লেখ,
এসো সবাই হাত ধোব
হাত না ধুলে চড় দেবো
পরেরটায় লিখবি,
হাত না ধুলে আমরা,
তুলে নেবো চামড়া!
লেখ লেখ, জলদি লেখ!"
কয়েকজন নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া চাওয়ই করে তারপর লেখা শুরু করে দিলো।
আঁখি কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে আবীরের দিকে ঘুরে চোখ বড় বড় করে বলল, " তোরা কি সিরিয়াস? এগুলি কি সত্যি সত্যি লিখবে নাকি!!"
" অবশ্যই সিরিয়াস। লিখবেনা মানে? দেশ ও জাতির প্রতি আমাদের কিছু কর্তব্য আছেনা? " আবীর বিরক্ত মুখে ঘাস চিবুতে চিবুতে সামনের দিকে হেঁটে যেতে লাগলো।
আঁখি চোখ কপালে তুলে বলল, "কর্তব্য !!! "
প্রায় আধঘণ্টা পর,
বহু নাটক সিনেমা হবার পর কলেজের গেট দিয়ে একদল তরুণ তরুণী উদ্ভট কিছু ব্যানার নিয়ে 'হাত ধোওয়া দিবস' এর আজগুবি স্লোগান নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল রাস্তায়!
সবার সামনে আবীর আর আঁখি, হাসিমুখে বিনয় ভাব ফুটিয়ে রেখেছে। তার পিছনে সাদিয়া, রচয়িতা হাতে গামছা, বালতি- মগ নিয়ে এগিয়ে আসছে। মিলন সানগ্লাস চোখে দিয়ে মাঝখান থেকে স্লোগান দিচ্ছে। সানগ্লাস চোখে তাকে একটু একটু গরুচোর ভাব লাগছে, কেউ অবশ্য তাকে এ কথা বলে নাই। মিলন বজ্র কণ্ঠে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে...
'ক' 'খ' বগের ঠ্যাং
হাত ধোওয়ার পানি নেন!
হাত ধোওয়ার পানি নেন
'ক' 'খ' বগের ঠ্যাং!
কিছুদূর যেতেই একটা পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চা পাওয়া গেলো। গায়ে জামা নেই। নাকে একটু পরপর সর্দির বাবোল ফুটছে। প্যান্ট অনেক নীচে পড়া, দড়ি দিয়ে গিটঠু দেওয়া উপরটা। প্যান্টের বোতাম ছেঁড়া, হুর হুর করে বাতাস ঢোকার কথা সে পথে।
প্রথম দায়িত্ব হিসেবে আবীর এগিয়ে গেলো বিনয়ী অভিবাদন জানাতে,
" আসো বাবু তোমার হাতটা ধুয়ে দেই, কেমন?"
ছেলেটা বিরস মুখে উত্তর দিলো,
" ধুমুনা, আমি হাত ধুমু না"
" তোমার হাতে ময়লা বাবু, আসো হাত ধুয়ে পরিষ্কার করে দেই"
" আমার হাতে ময়লা নাইক্কা " এই বলে বাচ্চাটা হাত দিয়ে নাক মুছতে গিয়ে সারা মুখ সর্দিতে গেদরে দিলো।
" ময়লা না থাকলেও আজকে হাত ধুতে হবে, এটাই নিয়ম"
বাচ্চাটা এবারে আবীরের কথার উত্তর না দিয়ে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সামনের দিকে হাঁটা দিলো।
আবীর ধৈর্যচ্যুত হয়ে সানের দিকে তাকিয়ে বলল, "ধর হালারে, ওরে পানিতে ডুবায়া ছয়বার চুবান দে"
বাচ্চাটা কথাটা শুনতে পেয়ে ঝেড়ে দৌড় দিলো। আর সানও তৎক্ষণাৎ দৌড় শুরু করলো পিছন পিছন।
সবাই মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত মিছিল ফেলে ওদিকেই ছুটা শুরু করল, নাটকের চূড়ান্ত কি হয় দেখার জন্য।
যতক্ষণে তারা সেখানে পৌঁছেছে, ততক্ষণে কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে। একটা পুস্কুনীর পাশে ছেলেটা পুরোপুরি ভেজা অবস্থায় মাটিতে বসে ঢুলছে। তার আধা নেংটা শরীর এখন পুরোপুরি নেংটা। তার পাশেই সান যুদ্ধজয়ের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
আবীর এগিয়ে যেতেই সান বলল,
"দোস্ত! একদম জন্মের শিক্ষা দিয়া দিছি।"
আবীর অবাক হয়ে বলল, "তুই কি করেছিস ওকে!"
সান গর্বের সাথে উত্তর দিলো,
" কেন, পানিতে চুবান দিছি!! অবশ্য সরি দোস্ত তুই ছয়বার চুবান দিতে বলছিলি। কিন্তু ছয়বার চুবান দেয়ার পর দেখি বাচ্চাটা চিল্লাফাল্লা শুরু করছে, এইটা তো প্রবলেম, তাই আরো সতেরোবার চুবান দিছি। "
আঁখি পাশ থেকে প্রায় চিৎকার দিয়ে,
" হোয়াট দা হেল!! তুইতো বাচ্চাটাকে আধমরা করে ফেলেছিস রে!!"
সান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
" আরে ধুর ধুর! একটা কইস্যা চড় লাগাইলেই দেখবি উঠে দৌড় লাগাবে। "
কথাটা শেষ করতে না করতেই সান সজোরে একটা চড় বসিয়ে দিলো।
বাচ্চাটা চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালো। তারপর সত্যি সত্যি সবাইকে অবাক করে দিয়ে অলিম্পিক দৌড় শুরু করল।
আঁখি কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মিলন সবাইকে থামিয়ে দিয়ে চশমা মুছতে মুছতে বলল, "রুলজ আর রুলজ! সোজা কথা না শুনলে সবারই এরকম হাল হবে।"
মিলনকে খুব সুন্দর লাগছে এখন। কিন্তু কথা শেষ করেই সে চশমা পড়ে আবার চোর হয়ে গেলো।
মিছিল চলতে থাকলো। পথে কিছু মেয়ে পড়লো। আবীর আন্তরিক ভঙ্গীতে বুঝিয়ে বলতেই ম্যাজিকের মত কাজ হল। আবীরের কথায় মেয়েগুলি এতটুকুও আপত্তি না করে সুন্দর মত হাত ধুয়ে ফেললো। তাদেরকে বেশ উৎসুকই মনে হয়েছিল। যেভাবে তাকিয়েছিল যেন তারাও এর অংশ হয়ে মজা করতে চায়।
কিন্তু আরো আধা ঘণ্টার মাথায় সত্যিকারের একটা অঘটন ঘটলো। হাত ধুতে ঘাড় ত্যারামী করায় সান উত্তেজিত হয়ে সিভিল ড্রেসে থাকা এক পুলিশ কমিশনারকেই খড়ি দিয়ে বাড়ি লাগিয়ে দিয়েছে।
অতএব সানকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো পুলিশ কাস্টোডিতে। সান অনুনয়ের স্বরে উনাকে বলতে লাগলো, "আংকেল! ভুল হয়া গেছে আংকেল, ছাড়ি দেন আংকেল, নইলে কিন্তু পিডায়ালামু আংকেল।"
" কি কইলি রে হারামজাদা? তুই খালি চল আমার সাথে আজকা"
সানকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল থানায়। দুই ঘণ্টার মাথায় তাকে পুলিশ গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে গেলো বাড়িতে। শুধু তাইনা, তাকে স্যার সম্বোধন করতে করতে একেবারে মুখে ফেনা তুলে ফেললো তারা।
সানের মা নার্স! বাবা মারা গেছে। তার মায়ের পক্ষে তাকে ছাড়ান অসম্ভব। তিনিতো জানেনই না, তার আদরের দুলাল এক পুলিশকে ঠেঙিয়ে এসেছে। একটু আগে তাকে পুলিশ কাস্টোডিতে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তার চামড়া ছিলে লবণ দেয়ার জন্য।
সব ঝামেলা চুকে যাওয়ার পর আবীর হাসি মুখে বাড়ির দিকে রওয়ানা হল। তার উদ্ভট আইডিয়ার জন্যই যে এতো কাহিনী সে ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র দুঃখবোধ নেই।
আঁখির জন্য আজকে বড় একটা ঝামেলা হতে রেহাই পাওয়া গেছে। আঁখি তার বাবার একজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে থানায় গিয়ে কি যেন বলল, আর কোন এক মন্ত্রীকে ফোন দিয়ে পুলিশ কমিশনারকে ধরিয়ে দেয়ার পর থেকেই উনি খাবি খাওয়া শুরু করলেন।
রাস্তার হলুদ বাতি আবীরের খুব পছন্দ। পথে পথে হাটতে থাকা আবীর, আর উড়ন্ত পোকাদের আবর্তনে প্রকৃতিতে যে হলুদ আলোর গোলক ধাঁধার সৃষ্টি হয় তার রহস্যাবৃত ইন্দ্রজালে, তন্দ্রা কাটে সব ঘরমুখো মানুষের।
Continued to next part..
৮- সৃষ্টি রহস্য
পরের পৃষ্ঠায়>>>>>
ভোট করতে ভুলবেননা
:)
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top