১৪. পরা মহাবিশ্বের ঠিকানায় আবীর


গামা রে- এর প্রচণ্ড বিকিরণে আবীরের সমস্ত শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি কোষ একটি একটি করে ধ্বংস হয়ে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে। জাপানে এটম বোমা বিস্ফারণের শিকার হওয়া মানুষের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র রেডিয়েশন সেও অনুভব করতে পারছে। প্রতিটি কোষের ভিতর দিয়ে শিরশির করতে করতে বের হয়ে আসা এক অসহনীয় তীব্র যন্ত্রণায় আবীর গলাকাটা মুরগীর মত ছটফট করছে।

আবীর শুনতে পাচ্ছে প্রলয়ংকারী বাতাসের স্রোতের শব্দ। বাতাসের তীব্র দাপটে সমগ্র মাটি পর্যন্ত কেঁপে উঠছে। দ্বীপের ভিতরে সব লণ্ডভণ্ড করতে করতে টর্নেডোর মত কিছু একটা সোঁ সোঁ শব্দ করতে করতে ছুটে আসছে।

দ্বীপের বড় বড় গাছগুলি আছড়ে পড়ার প্রচণ্ড শব্দে গম গম করে উঠছে বন! সবকিছু ভেঙে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা আসছে। খুব কাছে চলে এসেছে। আকাশ ফেড়ে চিড়চিড় করে বজ্রপাত নেমে আসছে। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ কিংবা তার চেয়ে অনেক বেশি বজ্রপাত চাবুকের মত সমগ্র বনের উপর নিষ্ঠুর ভাবে সপাৎ সপাৎ করে বাড়ি দিচ্ছে।

ঘরের দরজা খোলা। আবীর হামাগুড়ি দিয়ে খোলা দরজার দিকে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে দরজা বন্ধ করার জন্য। কিন্তু অসহ্য যন্ত্রণায় একচুল নড়তে পারেনা। তীব্র ব্যথায় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে আর্তনাদ করতে থাকে সে। তার ভিতর দিয়ে এতো রেডিয়েশন হচ্ছে যে, তার শরীর বৈদ্যুতিক বাল্বের মত জ্বলছে। রাতের সে দ্বীপ, মুহূর্তেই যেন দিনের আলোর মত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে শুরু করেছে।

আবীর চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এ নরকের চেয়ে হয়ত মৃত্যুই শ্রেয়। আচ্ছা? এভাবে সে কতবার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে থেকেছে? কতবার মৃত্যুর সীমাহীন যন্ত্রণায় ছটফট করেছে? মৃত্যুর চেয়ে ভয়ানক কি আছে জগতে? নাকি, মৃত্যুর পর আরো ভয়ংকর কোন যন্ত্রণা তার জন্য অপেক্ষা করছে?

প্রচণ্ড শব্দে আবীরের ঘরটি যেন দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে উপড়ে ফেললো কেউ। আবীরের মনে হল তার শরীরে আগুনের হালকার গরম কিছু একটা বয়ে গেলো। চোখ বন্ধ রেখেও দেখতে পেলো চারিদিকে লাল আর কি তীব্র লালের প্রভার বিচ্যুতি।

আবীরের শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে ধীরে ধীরে।
শরীরের ভিতর দিয়ে হঠাৎ শীতল বাতাসের মত অনুভব করতে শুরু করে। লাল আলোর প্রভা কমে আসতে শুরু করেছে। একটু একটু করে শ্রবণ শক্তি হারিয়ে যেতে থাকে। বজ্রপাতের শব্দ হালকা হতে হতে শূন্যে মিলিয়ে যায়। শরীরের যন্ত্রণা মিশে গিয়ে জড় পদার্থের মত অনুভূতি হতে থাকে তার।

আবীর নিশ্চিত নয়, তবু তার মনে বলতে থাকে, এই বুঝি মৃত্যু! কি অদ্ভুত! মৃত্যুর পরও সে চিন্তা করে যাচ্ছে! শরীরের মৃত্যু আছে। আত্মার মৃত্যু নেই। মানুষ মরে গেলে শরীর ছেড়ে দিয়ে কবরে বেঁচে থাকে। কবর থেকে স্বর্গ বা নরকে চালান হয়ে যাবে, সেখানে অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। শরীর পরিবর্তিত হবে, কিন্তু আত্মা? সে তো একই থাকবে। চিরকাল বেঁচে রইবে সে আত্মা। "দেয়ার ইজ নো কোয়াইট বাটন ফর ইউর সোউল"

**** **** **** ****

আবীর হতবুদ্ধের মত নিজের শরীরের দিকে চেয়ে আছে। নিজেকে তার অনেকটা বাবলের মত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাবলের মত আকার ধারণ করেছে সে, কিন্তু সে স্বচ্ছ বাবলের ভিতরে তার কোন অস্তিত্ব নেই।

মুখে বললে হয়ত কেউ বিশ্বাস করবেনা, কিন্তু সত্যি এটাই যে তার ভিতরটা পুরোপুরি ফাঁপা। তার ভিতরে সে নিজেই নেই।

ডঃ এরিক কার্নেলের মতে, বইয়ের ভাষায় Ghost nature থেকে বাঁচার এটাই একমাত্র জায়গা। নেগেটিভ ইউনিভার্স। ইউনিভার্সের উল্টো পিঠ। এখানে সবকিছুই নেগেটিভ। নেগেটিভ স্পেস, নেগেটিভ ম্যাটার, নেগেটিভ এনার্জি। এমনকি নেগেটিভ গ্রেভিটি। এখানে প্রতিটা কণা একে অপরকে বিকর্ষণ করে। ধোঁয়াটে আচ্ছাদনের মত সবকিছু। কঠিন কোন বস্তু নেই।

আবীর নির্বাক হয়ে তাকিয়ে দেখে রঙ বেরঙের অদ্ভুত দ্যুতির মত বিশালাকার কতগুলি অজস্র আলোক পিণ্ডের মত পিলার লক্ষ লক্ষ মিলিওন বিলিয়ন ট্রিলিয়ন দূর দিয়ে ছড়িয়ে গিয়ে অদ্ভুতভাবে কোন কিছুকে আবর্তন করছে। সুসজ্জিতভাবে একটার পর একটা ধোঁয়াটে আলোর ঝলকানির একটির ভিতর দিয়ে গিয়ে পেঁচিয়ে অপর প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। চোখ ধাঁধানো এক অবিশ্বাস্য পরিক্রমার খেলা। আবীর শ্বাস বন্ধ করে হতবুদ্ধের মত তাকিয়ে থাকে। নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারেনা সে কিছুতেই। এ কোন জগত! সৃষ্টিকর্তার এ কি রকম লীলাখেলা! কি অদ্ভুত! কি মহনীয়! কি সুবিশাল! কি দুর্বোধ্য!

আবীর হেটে চলার চেষ্টা করে সম্পূর্ণ অপরিচিত অদ্ভুত এক মহাবিশ্বের পথ ধরে যেখানে সবকিছু থেকেও কিছু নেই। তার হাতে তার বাবার বইটি মেলে ধরা।

" যদি তুমি এখনো বেঁচে থাকো, তাহলে তুমি মহাবিশ্বের চরম অংশে পৌঁছে গেছো। তুমি কি বুঝতে পারছো ঠিক কোথায় এসে গেছো তুমি? একেবারে কোর এলাকা। পৌঁছে গেছো মহাবিশ্বের সবচেয়ে নিষিদ্ধ অঞ্চলে

একটা বড় ঝটকা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকো। কারণ আমি যা বলতে চলেছি, তা শোনার জন্য তোমার হৃদপিণ্ড কতটা মজবুত তা আমার জানা নেই

তুমি এখন এই মহাবিশ্বের মূল মেকানিজম অংশে চলে গেছে, যেখানে ভয়ংকর কোন দুঃস্বপ্নও মানুষকে কোনদিন নিয়ে যেতে পারবেনা এটা সেই জায়গা যেখানে সৃষ্টি জগতের সময়ের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হচ্ছে হাজার কোটি বছর ধরে। যা দিয়ে এই পুরো মহাবিশ্ব চলছে। অর্থাৎ ঘড়ির নীচে যেখানে তার সকল মেশিনগুলি কাজ করছে ঘড়িকে সচল রাখতে। এখানেও মহাবিশ্বের সময় নির্ধারণের কোটি কোটি ব্যারেল ভিন্ন ভিন্ন ক্যালকুলেশন করে সঠিক পরিমাপ করতে করতে এগিয়ে চলছে
ঘড়ি ব্যাটারি দিয়ে নয় ডার্ক এনার্জি দিয়ে চলে। মহাবিশ্বের সময়ের ঘড়ি। সত্যি বলতে, তোমার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ-এর ঘড়ি। সময় স্থানকে স্ফীত করে চলছে তার আপন পরিক্রমায়

বলতে পারবে, সময় জিনিসটা আসলে কি?

দুটি বস্তুর মাঝের অংশকে বলে দূরত্ব বা 'স্পেস' আর দুটি ঘটনা ঘটার মাঝের অংশকে বলে সময়

সবকিছুই বিভ্রান্তি। দূর এবং কাছে বলতে আসলে কিছু নেই। নেই আগে বা পরে বলে কিছু। নেই অতীত বা ভবিষ্যৎ বলে কিছু। সবই বিভ্রান্তি। সবই মায়া। সবই এই বৃহৎ ঘড়ির এক ইলিউশান। এসব বুঝতে হলে মানুষকে পৌছাতে হবে মহাবিশ্বের অপর পৃষ্ঠে। লাগবে আরো শত কোটি বছরের সাধনা

এখানে একটুখানি হেরফের করে দিলে পুরো দুনিয়ার কোথাও না কোথাও সময়ের চরম উলটপালট হয়ে যাবে। যদিও সে ক্ষমতা মানুষকে দেয়া হয়নি। এটা সম্পূর্ণ শীতল স্থান। ঔষধ যেমন শিশুদের নাগালের বাইরে রাখা হয়, মহাবিশ্বের এই বিশালাকার ক্ষেত্র মানুষের আওতার বাইরে

রকেট কিংবা কম্পিউটারের ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়। কিন্তু মহাবিশ্বের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ক্ষমতা কোন মানুষের নেই, তাই স্থান আমাদের দুর্বোধ্য

আমরা হাজার বছর ধরে চেষ্টা করে এই নিষিদ্ধ স্থানে ঢোকার উপায় বের করেছি। এর দরজা উন্মুক্ত করেছি তুমি যে ঘরে ছিলে ঠিক তার মেঝের নীচে যেখান দিয়ে তুমি এসেছ

আমি জানিনা আমার কথাগুলি পড়ার জন্য তুমি বেঁচে আছো কিনা। এসব বলে হয়ত আর লাভ নেই। কি হবে বলে? আমি আর পারছিনা, খুব কষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করছি এতো সহজে মৃত্যুর কাছে ধরা না দিতে। কিন্তু আর লিখতে পারছিনা আমি। যদিও লেখার জন্য আমাকে আসলে চিন্তা করা ছাড়া আর কিছুই করতে হচ্ছেনা। তবু শরীরের যন্ত্রণা আর সইতে পারছিনা। আমার জীবনের শেষ সময়টা আমি এভাবে কাটাতেও চাচ্ছি না, কারণ লেখাগুলি কেউ পড়ছেনা। পড়ার কথা না। তাই না? তবু আমার অনুমান যদি ভুল হয়... তাই লেখা আর কি

আমার একটা কুকুর আছে। ওর নাম লুসি। আমার জীবনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার পাশে ছিল। আমার মৃত্যুর পরেও সে থাকবে। আমার লুসি। আমার সোনা! আমার লাশের পাশে বসে রইবে চোখে পানি নিয়ে। তার মনিবের জন্য কিছু করতে পারবে না বলে..

ও বেঁচে রইবে হাজার বছর ধরে। আমি জানি আমার স্মৃতি সাথে নিয়ে। ও বেঁচে রইবে কারণ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অন্যায় আমি তার সাথেও করেছি। সেই এক্সপেরিমেন্ট। সে আমার চূড়ান্ত ভুলের অপরাধে অপরাধীর সাজা গুনছে। আমার আরো একজন অতি আপনজন আছে। তার নাম আবীর। আমার ছেলে। তার কথা লেখার সময় আমি পাবো কিনা জানিনা।

যাই হোক, তোমাকে বেঁচে থাকতে হলে তোমাকে আগে জানতে হবে তুমি কি অবস্থায় আছো

বিছানার চাদরের উপরের পাশটা যদি হয় আমাদের মহাবিশ্ব, তুমি ঠিক সে চাদরের অপর পাশে আছো। চাদর ঝাড়ার সময় খেয়াল করলেই দেখবে সেখানে ওয়েভ তৈরি হয়, উঁচু নিচু অংশের সৃষ্টি হয়। উঁচু অংশটা যদি পাহাড় হয়, চাদরের অপর পাশে সেটা খাল। অপর পাশ থেকেও পাহাড়ের ভাঁজ হওয়া ছাপটা স্পষ্ট দেখবে। পাহাড়ের গঠনটা দেখবে। সেই একই আকৃতি, পাহাড়ের মত। কিন্তু এর ভিতরে পাহাড়টা নেই। কারণ পাহাড়টা আছে আমাদের মহাবিশ্বে। পাশে। পাশে এটা শুধুই খাল। কিন্তু পাশে তুমি মাটি খুঁড়লেই এখানে পৌছাতে পারবেনা। পৌছাতে হবে 'টুয়েলভথ ডাইমেনশন' ভেদ করে। উপরের ব্যাখ্যাটা শুধুই একটা উপমা। সহজ করে অল্প কথায় বলা

আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। আমি আর বেশিক্ষণ টিকবোনা। আমি তোমায় এখানে কেন এনেছি জানো? কারণ আমি জানি তুমি কে। তুমি ছাড়া এই গেট দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবেনা। এখনো যদি মারা না গিয়ে কেউ আমার লেখাগুলি পড়তে থাকে, তা কেবল আমার সন্তান আবীর। যার হাজারো অনুলিপি একই সাথে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছে

আবীর,
পৃথিবীতে যখন কেউ অপরাধ করে, হত্যা করে, অবিচার করে, তখন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। হত্যা করা অপরাধ। ন্যায়বিচারের জন্য তার সাথেও এই অপরাধমূলক কাজটা করতে হয়। বিচারের জন্য অপরাধীর শরীরের উপর অবিচার করতে হয়

অত্যাচারী শাসককে নির্মূল করতে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়, তার সৈনিকদের পরাস্ত করতে হয়। এও এক ধরণের অত্যাচার

ঠিক তেমন প্রকৃতির একটি বৃহৎ অসামঞ্জস্যতাকে ঠিক করার জন্য আরেকটি অসামঞ্জস্যতার আশ্রয় নিতে প্রকৃতি বাধা দেবেনা বলে আমার ধারণা

আমি জানিনা, আমি আমার ছেলেটাকে কোন বিপদের মাঝে এনে ফেলেছি। আমি দুঃখিত সোনা। আমি সত্যিই দুঃখিত

আবীর? তুমি এখন দেখতে কেমন হয়েছ মানিক? এই বুড়ো পরিশ্রান্ত বাপটাকে ক্ষমা করে দিও সোনা। দেবে তো, বলো?

মূল কথাগুলি আগেই বলে নিয়েছি যাতে শেষ কথাগুলি শান্তিতে বলতে পারি

আমি তোমাকে সব বলবো। আমাদের গল্প, তোমার গল্প, তোমার মায়ের গল্প, আমাদের সব ঘটনা যা ছিল তোমার অজানা, তোমাকে বলবো এই মহাবিশ্বের সব অজানা বিস্ময়কর গল্প, আমাদের লুসির গল্প আর সেই ভয়ংকর 'ইম-মোর্টাল ঘোস্ট ন্যাচারের গল্প'

তুমি শুনতে পাচ্ছো তো আবীর? তুমি শুনছো তো আমার কথা?







g

o

to next page :

Next part>>>
ওমেগা বনাম আবীর

:)

please don't forget
to vote,
thank you ((:

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top