#অভিসারক_ও_অভিসারিণী
লেখা- #AbiarMaria

#৯

ইরফান আর জামান একটা রেস্টুরেন্টে বসে খেয়ে নিচ্ছে দুপুরের খাবার। মুখের খাবারটুকু চিবিয়ে জামানকে সে প্রশ্ন করল,
"ফারহা কি নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির খরচ সম্পর্কে?"
"জানে। তবে এমন একটা ভাব করছে যেন এসব ওর হাতের মোয়া!"
"ওদের আর্থিক অবস্থা কেমন?"
"এত এক্সপেন্সিভ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার মত না অন্তত"
"তাহলে? তাছাড়া তোমার বাসায় যে উঠবে, আমি জানি তুমি আর জন দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকো। ফারহা কোথায় থাকবে?"
"জন ছুটিতে আছে আপাতত। ও দুই মাস পর আসবে। ততদিনে ফারহার কোনো না কোনো একটা গতি হয়ে যাবে। আমি কি এই মেয়েকে আমার ঘরে রাখব নাকি, হুহ!"
"আন্টি কি এসব জানে?!"
"নাহ! আম্মু শুনলে কি করবে জানি না, কিন্তু আম্মু জানে না। এগুলো হচ্ছে ফারহার প্ল্যান, সে যতদিন না আলাদা বাসা নিতে পারছে, ততদিন থাকবে। আমার কাছে স্পেশাল ফেভার চেয়েছে"
"আর ইউ কম্ফোর্টেবল এবাউট ইট?"
"অফকোর্স নট! আমি এখনো নিজেকে মানসিকভাবে ওর সাথে কি করে চোখে চোখ মিলাবো, সেটাই বুঝতে পারছি না!"
"ভয়াবহ অবস্থা। তোমার জন্য মায়া লাগছে জামান"
"ভাবছি, ফারহাকে পেয়িং গেস্ট হিসেবে রাখব। আমাকে পে করতে হবে ওর। কারণ এই মেয়ে যে রান্নার র ও জানে না, সেটা আমি নিশ্চিত। এসেই আমার উপর খাওয়া শুরু করবে। এই সুযোগে টাকা নিয়ে রেখে দিব!"
জামান দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ইরফান মাথা নাড়ল,
"তুমি পারবা না। পেয়িং গেস্ট বলো আর ফ্রি গেস্ট বলো, পারবা না। এই মেয়ের কাছে তুমি নস্যি জামান"

খানিক সময়ের জন্য জামান চাবানো বন্ধ করে দিল, তারপর আবার খাবারের দিকে মনোযোগ দিল। ফারহাকে নিয়ে ভেবে ভেবে সকালটা গেছে, দুপুরটা নষ্ট করা যাবে না। এই মেয়ে তো কয়েকদিন পর ঠিক মাথা কিনে নেবে যা বোঝা যাচ্ছে। জামান মনে মনে শঙ্কিত। যেভাবে ফারহা ওকে থ্রেট দিয়েছে, ফারহা এখানে আসলে যে পুরোপুরি ডেস্পারেট হয়ে যাবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এরকম পাগলাটে মেয়ের পাল্লায় ওর মত মানুষ পড়বে, সেটা ভাবনাতীত ছিল। যেখানে জামানের মেজাজের সাথে ওর চারপাশের সবাই মানিয়ে চলত, সেখানে এই ফারহা ওর মেজাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলা ফেরা করে। না জানি এখানে আসার পর কিভাবে ওকে নাচায়! অজানা আশঙ্কায় জামানের শরীর কেঁপে ওঠে।

এদিকে বাংলাদেশে বসে ফারহা ওর আব্বু, চৌধুরী সাহেবের সাথে লড়াই করছে ঠিক বাংলা সিনেমার মত। মেয়ের এমন সিদ্ধান্তে তার বাবা শুধু বিরক্ত না, চরম অসন্তুষ্ট। উঠতে বসতে তার গিন্নিকে বকে যাচ্ছেন মেয়ের উচ্ছন্নে যাওয়ার কারণে কেবল নিজের মনের শান্তির জন্য, তাতেও বিশেষ সুবিধা হচ্ছে না। মেয়েকে কয়েকবার বকার চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারেন নি, মেয়ে আমেরিকা যাবেই। বাধ্য হয়ে মেয়ের সাথে সমঝোতায় বসেছেন। ডাইনিং এক মাথায় তিনি, আর আরেক মাথায় ফারহা। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রাগে মাথার তালু ফেটে যাচ্ছে, তবুও মেজাজ ঠান্ডা রাখতে হচ্ছে। শীতল কন্ঠে প্রশ্ন করেন,
"তোমার কি স্কলারশীপ হয়ে গেছে?"
"না, হয় নাই"
"তাহলে কিভাবে যাবা? প্রতি সেমিস্টারে কত টাকা যাবে?"
"দেখি, কাজ করে ওখানে পে করা যাবে। আগে তো সুযোগ পাই"
"সুযোগ না পেয়েই এত লাফালাফি হচ্ছে কেন!"
ফারহা নির্বিকার ভঙ্গিতে খাচ্ছে। আজকাল সে তার বাবাকেও ভয় পাচ্ছে না। প্লেটের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলল,
"আমার আসলে এই দেশ ভালো লাগছে না। ওখানে গিয়ে চেষ্টা করব ভর্তি হওয়ার, না হতে পারলে কাজ করে খাবো। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি না হতে পারলেও কোনো না কোনো ইউনিভার্সিটিতে তো ভর্তি হতেই পারব।  সেখান থেকেই নাহয় পিএইচডি করব"
"মানুষ আগে ইউনিভার্সিটির সাথে যোগাযোগ করে, এরপর সেখানে যায়। তোমার কাজকর্ম দেখছি সব উলটা! তোমার ভাবসাব কিন্তু ভালো ঠেকছে না আমার কাছে"
"আমার বাংলাদেশ অসহ্য লাগছে, এজন্য যাবো, ব্যস। এইটা একটা দেশ হলো? অসহ্য! খালি বিয়ে বিয়ে বিয়ে! খেতে বসলে বিয়ে, ঘুমাতে গেলে বিয়ে, রান্নাঘরে বিয়ে, টয়লেটে বিয়ে, এমনকি খাটের তলাতেও বিয়ে! আমি বিয়ে করব না! আমি আরেক দেশে গিয়ে কামলা খাটব, তাও বিয়ে করব না"

ফারহার বাবা ওদিকে বসে দাঁতে দাঁত পিষছেন। মেয়ের স্পর্ধা দেখে এর মাঝে তার প্রায় টাক হয়ে আসা মাথায় শুয়ে থাকা চুল গুলো দাঁড়িয়ে গেছে। কটকট করে দাঁত দিয়ে শব্দ করতে করতে বলেন,
"বিয়ে করবি না, কিন্তু কামলা দিতে পারবি! এই তোর বুদ্ধি? আমি তো ভাবছিলাম আমার মেয়ের বুদ্ধি আছে! এখন দেখতেছি আল্লাহ আমাকে একটাই বাচ্চা দিছে, সেটাও একটা ষ্টুপিড। এই স্টুপিড তো আমার বংশের মেয়ে হইতে পারে না!"
"স্টুপিড হওয়ার কিচ্ছু হয় নাই আব্বু। আমার কি নিজের কোনো চাওয়া থাকতে পারে না?"
"তোদের নিজের চাওয়া আছে, আর আমাদের? আমরা তোকে জন্ম দিছি, পড়ালেখা করা ছাড়া আর কি করছিস?"
ফারহা নির্লজ্জের মত দাঁত বের করে বলল,
"আজ অব্দি কোনো প্রেম করে কেলেঙ্কারি করিনি!"

পাশ থেকে ওর আম্মু এসে ওর গালে একটা চড় লাগিয়ে বললেন,
"উদ্ধার করছিস আমাদের ইতর! উদ্ধার করছিস! ধন্য হয়ে গেছি আমরা এইজন্য!"
ফারহা গালে হাত দিয়ে ডলছে আর মায়ের দিকে চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ফারহার আব্বু তার স্ত্রীকে থামতে ইশারা করেন,
"তুমি আবার গায়ে হাত তুলতেছ কেন!"
"বেয়াদবি সহ্য করব নাকি? মুখে মুখে উত্তর দেয় সারাক্ষণ! জন্ম দিয়ে ঠেকে গেছি মনে হয় ওর কাছে আমরা!"
ফারহার বাবা তার মেয়ের দিকে মনোযোগ দেন।
"তুই ঐখানে কতদিনের জন্য যাবি?"
"এখনো ঠিক করি নাই"
"এয়ারপোর্টে যখন জিজ্ঞাসা করবে কেন যাচ্ছিস, কি বলবি?"
"বলব ঘুরতে যাইতেছি"
"তুই কি ট্যুরিস্ট ভিসায় যাবি?! তারপর ওখানে লুকায় লুকায় ইনকাম করবি? তারপর জেলে ঢুকে বসে থাকবি?! কোনো আইডিয়া আছে তোর বাইরের দেশ নিয়া?!"
চৌধুরী সাহেব উত্তেজিত হয়ে গেছেন, ফারহা নির্লিপ্ত। আর চৌধুরী সাহেবা কটমট করে বখে যাওয়া মেয়ে কে দেখছেন। ফারহার বাবা রেগে একটা কমলা ছুড়েন মেয়ের দিকে, আর ফারহা দক্ষ বোলারের মত সেট ক্যাচ ধরে ফেলে। বাবার চোখের দিকে চেয়ে বলল,
"তুমি আমাকে লাঠি খুন্তি বা জুতা না মেরে কমলা মারতেছ কেন?! এইটা কি মারার জিনিস? এইটা খাওয়ার জিনিস!"
"তুই আমাকে সত্যি করে বল তোর আমেরিকা যাওয়ার জন্য এত লাফালাফি কেন! আমি কোনো ভণিতা চাই না!"

ফারহা চেহারায় অনেক কষ্টে একটা দুঃখী ভাব ফোটানোর চেষ্টা করল। তারপর মন খারাপ করে বলল,
"বাংলাদেশ আর ভালো লাগছে না আব্বু। আমি একটু আমেরিকা যেতে চাই, প্লিজ! আমি তো জীবনেও তোমাদের পারমিশন ছাড়া একটা পিকনিকেও যাইতে পারি নাই! একটাবার নাহয় আমাকে সুযোগ দাও? মাত্র দুই মাস থাকব, তারপর আমি চলে আসব। আসার পর যা বলবা, তাই শুনবো! প্লিজ!"
খাবার টেবিলে বসে ফারহা কাঁদো কাঁদো হয়ে বাবার কাছে কথাগুলো বলছে। ওর মা এসব দেখে বিরক্ত স্বরে স্বগোতক্তি করলেন,
"নিজের মেয়ে যে এমন পাক্কা অভিনেত্রী হবে, তা কল্পনাও করি নাই! শিখছে শুধু এই ভেল্কিবাজি। এই, তুই কি ভাবছিস? তোর এইসব ভেল্কিবাজি আমরা বিশ্বাস করব?"

ফারহার বলতে ইচ্ছা হচ্ছে,
না করলে নাই,
আমি তোমার পরি, তোমার খাই,
এইজন্যই সব বুঝো,
খালি আমার ইচ্ছাগুলা বুঝো নাই!

মুখে বেচারি ভাব ফুটিয়ে বসে থাকলো। ফারহার বাবা চৌধুরী সাহেব টকটকে লাল চোখ নিয়ে বললেন,
"আমেরিকা যাওয়ার টাকা দিবে কে?"
ফারহা ফড়ফড় করে জবাব দিল,
"আমার চাকরির টাকা আছে না! তাছাড়া ছোট মামা আমাকে অনেক গুলো দিয়েছিল। তুমি শুধু টিকেটের টাকাটা দিলেই..."
শেষের দিকে ফারহার কন্ঠ মিইয়ে আসছিল। কিন্তু ফারহার বাবা কিছুতেই মেয়েকে এতদূর একা ছাড়বেন না। অগত্যা জামানের সাথে উনারা যোগাযোগ করলেন। কিন্তু সেখানেও ওর বাবার আপত্তি। ফারহা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তার বাবাকে রাজী করাতে চেষ্টা করল।

এমনি করে চারদিন লেগে গেল। চৌধুরী নিমরাজি হয়ে মেয়েকে যেতে দিচ্ছেন। আর ঐদিকে তার গিন্নি গজগজ করছেন। মেয়ে তো বোধহয় হাতছাড়া হয়েই গেল!

ফারহা শীতের বিকেলে ওদের ছাদে বসে আছে। দিন এখন ছোট হয়ে আসছে, যেন সূর্যটা সারা বছর রোদ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে বছরের এই সময়ে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। ফারহা ছাদে বসে মিষ্টি রোদ গায়ে মাখছে আর চা খাচ্ছে। বেশ কিছুদিন এই আকাশটা দেখা হবে না, এই বাতাস ছোঁয়া হবে না। সবটা খুব বেশি মিস করবে।

ছাদে কারো পদশব্দ ওর মনোযোগ ভেঙে দেয়। ঘাড় ঘুরিয়ে পাভেলকে সামনের চেয়ারে বসতে ইশারা করে। পাভেল বসতে না বসতেই বলল,
"খুব ভয় করছে রে, কখনো অমন একা একা এত দূরে যাইনি তো। তার উপর জামান ভাইকে তো অনেক আঘাত দিয়ে ফেলেছি। এখন যদি উনি আমাকে সাহায্য না করেন? উনি যদি সাপোর্ট না করেন? আচ্ছা, আমি ভুল করছি না তো?"
পাভেল ফারহার হাতে হাত রাখলো।
"এত ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। একবার ওখানে যা, সাহস কর, তারপর দেখবি আর এত ভাবতে হবে না। এমনিতেই এই সময় তোর এত চিন্তা করা উচিত হচ্ছে না। আমরা তো যা চিন্তা করার, আগেই করেছি। ভাবিস না, সবাইকে এদিকে সামলে নিব"

ফারহা ভরসার দৃষ্টিতে পাভেলকে দেখে। নাহ, এই জার্নিটা ওকে করতেই হবে, যে করেই হোক।

চলবে...

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top