#অভিসারক_ও_অভিসারিণী
লেখা- #AbiarMaria

#৭

ইরফান হাসছে। কফির কাপ রেখে জ্যাকেট বুকের উপর টেনে চেপে ধরল।
"কিছু কিছু কেইস দেখে প্রচন্ড মাথা ধরে যায়, কিছু কেইস দেখে অনেক কিছু শেখা যায়। তোমার কেইস দেখে মনে হচ্ছে, অনেক দিন পর কোনো কমেডি ড্রামা দেখতে বসেছি!"
"ভুল কিছু বলোনি। তবে কমেডি ড্রামা না বলে যদি কমেডি সার্কাস বলো তাহলে ভুল কিছু হবে না। এই ফারহা হচ্ছে একটা পুরো সার্কাস। এত এম্বারেসিং মেয়েটা! এমন এমন সব কাজ করবে যে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারতাম না, চোখ মিলাতে পারতাম না!"
"কয়েকটা উদাহরণ দাও?"
"এই যেমন কথা বলতে গেলে উল্টাপাল্টা কিছু একটা বলে ফেলত, সিঁড়িতে দেখা হলে চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখত, যেন আমাকে দেখা খুব মজার কোনো বিষয়! সাধারণত নির্লজ্জ ছেলেরা এমন করে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফারহা ঠিক ছেলেদের মত আমাকে দেখত, আর আমার মেয়েদের মত লজ্জা লাগছিল!"
"ভাই, তুমি কি ছেলে? নাকি মেয়ে?"

জামান মাথা চুলকালো।
"ফারহার কাছে আমি একটা মেয়েই। ওর কাছে পুরুষ হয়ে কিছু একটা করা, সো টাফ! ও ভার্সিটিতে মারামারি করত, ছেলে মেয়ে সবাইকে মারত। ছেলেরাও ওর সাথে ঝামেলা এড়িতে চলত। সেই মেয়ে আমাকে নির্লজ্জের মত দেখবে, এ আর এমন কি!"
"তারপর কি হলো?"
"ডিরেক্ট প্রপোজ!"
"এ্যাঁ?! কোনো রাখ ঢাক ছাড়াই?!"
"হ্যাঁ! কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না, উলটো ঘাবড়ে গেলাম"
"আগের রিলেশানের জন্য?"
"হুম। হুট করে ওর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল, ঐ মেয়েটাও আমার দিকে আগে এগিয়ে এসেছিল, ওর আগ্রহ ছিল বেশি। আবার আমার সাথে সেইই বিট্রে করেছে আগে। বারবার পেছনের কথা মনে পড়ে আমি হুট করে পিছিয়ে গেলাম। ওকে তক্ষুনি বললাম, আমার তোমাকে ভালো লাগে না। কিন্তু ফারহা অনড়। আমার ভালো না লাগলেও সে আমাকেই ভালোবাসবে। এই প্রথম আমি কোনো মেয়ের প্রতি কঠিন আচরণ করতে শুরু করলাম। এই প্রথম আমি বারবার ফারহাকে ফিরিয়ে দিতে লাগলাম। কারণ আমার কাছে মনে হচ্ছিল, ফারহা মেয়েটা সস্তা আবেগে ভেসে যাচ্ছে। কয়েকবার বললামও, মানলো না, মানবেই না, পিছে লেগে থাকলো। আমাকে ও প্রায়ই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত, ছাদে গিয়ে বসে থাকত আমার আশায়। আমার ভয় বাড়তে থাকল। আগের বারের মত এবারও কষ্ট পাব ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু ফারহা আমাকে জ্বালানো শেষ করল না। কখনো সেজে, কখনো আম্মুর সাথে কথা বলার ছুতোয় বাসায় এসে বসে থাকত, আমার সামনে ঘুরত। ওর কাজ থেকে মনে হত, আমি ওকে।খেয়াল করছি কিনা, তাতে ওর কোনো আসে যায় না। অথচ ও যে আমার জন্যই এসেছে এবং আমিও সেটা বুঝেছি, সেটা দুজনের কেউ স্বীকার করতাম না। একটা লুকোচুরি খেলা চলত আমাদের মাঝে। একদিনের কথা বলি৷
সেদিন ও আমাদের বাসায় শাড়ি পরে আসলো। এই প্রথমবার আমি ফারহাকে এত সুন্দরী রূপে দেখলাম। আমি জানি ও আমার জন্য সেজেছে, কিন্তু এত সুন্দর করে কেউ সেজেছে আমার জন্য, আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। ফারহা মেয়েটা জানে না, কোনো ছেলের সামনে এমন মাথানষ্ট সাজ দেয়া কত বড় পাপ! তার উপর ওর নির্লজ্জ কাজকর্ম! আরেকটু হলেই..."

ইরফান খুশি খুশি হয়ে প্রশ্ন করল,
"কি? চুমু খেতে?!"
জামান হতাশ গলায় বলল,
"এত বড় কলিজা আছে আমার? যদি ফারহার সাহসের ছিটেফোঁটাও আমার মাঝে থাকত, তাহলে সেদিন ঠিক চুমু খেয়েই ফেলতাম। কিন্তু ঘটনা ঘটালাম উলটা। রাগ দেখালাম যতটা পারলাম। কারণ আমার দুর্বলতা জানিয়ে তখনও প্রশ্রয় দিতে চাইনি। আমার সবসময় ধারণা ছিল, ওর বাচ্চামি আবেগ শেষে আমি আবারও মাটিতে থুবড়ে পড়ব; আর এবার আমি তা কিছুতেই হতে দিতে পারি না!"

ইরফান হতাশা প্রকাশ করল।
"তার মানে সেদিন কিছুই হয় নি?"
"হয়েছে তো। ফারহা চলে যাওয়ার আম্মু বলছিল, ওকে আমার জন্য পছন্দ হয়েছে। আমার কি ওকে ভালো লাগে কিনা!"
"কি বললে!"
"স্ট্রেট মানা করে দিলাম! আমি তো জানি আমার পাশাপাশি আম্মুর মাথাও ও ওয়াশ করা শুরু করে দিয়েছে। আমি কোনোভাবেই এসব দিয়ে নিজেকে কষ্ট দিতে চাইনি। এদিকে কয়েকদিনের মাঝে আমার বন্ধু নাবিলের গায়ে হলুদ ছিল। ঐ সময় আমার কলেজ জীবনে বান্ধবী তন্বীর সাথে কথা হচ্ছিল। ওর সাথে আমার কিছু সমস্যা ছিল, সেগুলো মেটাতে পারছিলাম না। হুট করে ফারহা এসে কোত্থেকে ফোন নিয়ে টানাটানি শুরু করল, তন্বীকে আমার গার্লফ্রেন্ড বলে বলল, ও আমার সাথে বিট্রে করেছে, এই সেই। আমি প্রেম করি, কিন্তু ওকে জানাইনি। এই সেই! আমার মাথা এত গরম ছিল যে ওর অর্ধেক কথাই তখন মগজে ঢুকেনি। রেগে ফোন নেয়ার পর দেখি তন্বী লাইনেই আছে। কানে নেয়ার সাথে সাথে ও আমাকে ইচ্ছামতো গালি দিল। বলল, সবার কাছে আমি ওকে কোন সাহসে গার্লফ্রেন্ড পরিচয় করিয়ে দেই, ওর বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও কি করে এসব করলাম, আমি আগে থেকেই ওর নামে উল্টাপাল্টা কথা বলি, এসব বলতে শুরু করল"

ইরফান হাত তুলে থামালো।
"ওয়েইট! তন্বী কে?"
"আমার এক বান্ধবী যাকে নিয়ে আমার ফ্রেন্ডরা আমাকে সন্দেহ করত। ফারহা আমার পিছে ঘুরে বলে নাবিলের কাছে বলেছিলাম, ওকে আমি পছন্দ করি। আর নাবিলও সেটা ফারহাকে বলেছিল। মেইনলি তন্বীকে আমি দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম এটার বুঝার জন্য, ফারহা কি আমার প্রতি পজেসিভ কিনা!"
"কি বুঝলে?"
"মেয়ে ভয়াবহ রকমের জেলাস। রীতিমতো তন্বীর উপর গবেষণা করে ফেলেছিল। তবে ভুল বোঝার কারণে মাঝখানে ওর সাথে বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে গেল। আমি না পারলাম ফারহার উপর রাগ দেখাতে, না পারলাম তন্বীকে বুঝিয়ে বলতে। তবে ওর জেলাসির মাত্রাটা আরও ভালোভাবে বুঝলাম যখন আমি তার কয়েকদিন পর বান্দরবান ট্যুর থেকে আসি। ব্যাগ নিয়ে উপরে উঠতে না উঠতেই আমার কলার চেপে ধরল, রীতিমতো জেরা করতে শুরু করল। ঐ মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, ফারহা আমার বউ! হা হা হা!"
"ইন্টারেস্টিং! তোমার রিএকশন কি ছিল?"

"সত্যি বলব? ধরে চকলেটের মত খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছিল!"

জামানের কথা শুনে ইরফান হো হো করে হাসছে। জামান মুখ ঢাকার চেষ্টা করছিল লজ্জায়। ইরফান হাসতে হাসতে বলল,
"ইচ্ছা পূরণ করেছ?"
"এতটাও বুদ্ধিহীন না যে আবেগে পড়ে এসব করব! তার উপর যেভাবে কলার ধরে টানছিল, অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! এই মেয়ের গায়ে ভয়াবহ জোর! এজন্য ধরে কোলে করে ছাদে নিয়ে গেলাম। ছাদে গিয়ে বললাম, এখন যদি চুমু খাই? তাহলে কি করবে? ফারহার মুখ পাংশুটে হয়ে গিয়েছিল। সত্যি বলতে এত কাছ থেকে সুন্দরী একটা মেয়েকে দেখে যে কোনো ছেলের মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। আমারও হচ্ছিল"
"আশা করি এখন মনের কথা প্রকাশ করেছ?"

জামান পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে সেটা জ্বালালো। মুখ ভরা ধোঁয়া ছেড়ে ধোঁয়াশা দৃষ্টিতে বলল,
"আমাকে আবারও অতীত চেপে ধরল। মনে পড়ে গেল, শুধু মাত্র টাকার জন্য আমাকে একটা মেয়ে ছেড়ে গেছে। মেয়েদের এক মাত্র প্রয়োজন টাকা। আমি তখন কত বেতন পাই? মোটে মাত্র বিশ হাজারে মত। মাস শেষে নিজেরই টানাটানি শুরু হয়, আরেকজনের খরচ কি করে চালাবো? ভালোবাসা একটা দায়িত্ব, এই দায়িত্ব আবেগে চলে না, চলে বাস্তবতার চাকায়। ফারহার মাথায় ওসব নেই, কিন্তু আমার তো আছে! আমাকে তখন ফারহা বন্ধুত্বের অফার দিল, আমি সেটা গ্রহণ করলাম। আর প্রতিজ্ঞা করলাম, যথেষ্ট টাকা জমিয়ে এরপরে ফারহাকে নিজের কাছে আনব। তার আগে নিজের ভালোবাসা প্রকাশের কোনো অধিকার নেই। আজ দেখেন ভাই, টাকা আছে, সব আছে। শুধু ফারহা আমার হলো না!"

জামানের কন্ঠে হতাশা। একের পর এক ধোঁয়া ছাড়ছে। ইরফান ওকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করছে। ছেলেটা যে নিজের অনুভূতি লুকিয়ে ভুল করেছে, সেই ভুলের মাশুল এত বছরেও গুনছে। জীবন সত্যিই বড্ড বিচিত্র।

চলবে...

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top