৩৪

#অভিসারক_ও_অভিসারিণী
লেখা #AbiarMaria

#৩৪

ফারহা বাবা মায়ের সামনে জামানকে নিয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। কয়েক বছর আগের সেই ঠকঠকানি রোগটা আবার দেখা দিল নাকি? মাগগো মা!  এখন কি হবে?! এক সারিতে চারজনের পিছে তন্দ্রাকে উঁকি দিতে দেখা যাচ্ছে। এই মেয়ে কি করছে এখানে? নিশ্চয়ই ভিডিও কলের সব দায়িত্ব ওর ঘাড়েই। জামান কি ওকেও সব বলে দিয়েছে?? ওর বাবা মা কি জানে? জামানের বাবা মা? ফারহার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এমন অবস্থা হবে, তা তো অকল্পনীয় ছিল!

এদিকে ফারহার বাবা মা বেশ অবাক হয়েছিল রুকাইয়া ওদের উপরে ডেকে নেয়ায়। ভেবেছিল কোনো জরুরী কাজ কিনা৷ ভিডিও কলের ওপাশে ছেলে মেয়ে দুটোকে এক সাথে দেখে উনাদের দুজনের মাথায় বিনা আকাশে বজ্রপাত হয়েছে।  তার মেয়ের মতলবটা কি আসলে? সে কি জামানের সাথে যোগাযোগ করতেই আমেরিকা গেছে? ফারহা মায়ের রাগে পায়ের তালু, মাথার তালু, হাতের তালু ফেটে যাচ্ছে। মেয়েকে ইচ্ছে করছে ওয়েবক্যামের ভেতরে ঢুকে চুলে মুঠি ধরে এনে আচ্ছামত ধোলাই করতে। ফারহার বাবারও চেহারায় একই অভিব্যক্তি। মেয়েটা একেবারে গোল্লায় গেছে। কোথাও আর মান ইজ্জত রাখবে না, সব শেষ করে ফেলবে! বউয়ের বান্ধবী বাসার উপরের তলায় এসেছে, এখন তাদের সাথে, তাদের ছেলের সাথে এমন কেলেঙ্কারির পরেও যদি ফারহা এত বছর পর গিয়ে আবার ঐ ছেলের পিছে লাগে, তাহলে স্বামী স্ত্রী দুজনে গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না! মাত্র একটা বাচ্চা দিল আল্লাহ। আর সেটাও ইজ্জতের যা তা করে ছেড়ে দিচ্ছে। এমন বাচ্চা থাকার কি দরকার ছিল? ফারহার বাবা রাগ করে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলেন। মেয়েকে এই মুহূর্তে দেখতে ইচ্ছা করছে না। তবে জামান কেন ওদের এক করল, সেটা নিয়ে কৌতুহল হচ্ছে। উনি যা ভাবছে, তাই কি? কিন্তু...

সবার ভাবনার অবসান করে জামান গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করল,
"আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন কেন এই সময় এখানে ডাকলাম? আর কেন আমরা দুইজন এক সাথে? আম্মুও আমাকে এই নিয়ে অনেক প্রশ্ন করছিল। আসলে আপনাদের একটা সিদ্ধান্ত জানানোর ছিল। আমরা দুজন, মানে ফারহা আর আমি..."

ওর কথা শেষ হওয়ার আগে ফারহার মা উৎকন্ঠা হয়ে প্রশ্ন করলেন,
"কি করছে তোমাকে আমার মেয়ে বাবা? এই মেয়েটা আমার নাক কেটে ছাড়লো! সত্যি করে বলো, ও কি ঐ দেশে গেছে তোমার পেরেশানি করতে? তোমার শান্তির জীবনে অশান্তি আনতে? আমি চিনি তো! আমি জানতাম ও এগুলাই করতে গেছে! যাওয়ার আগে থেকেই আমার মনে কু ডাক ডাকতেছে!"

পাশ থেকে রুকাইয়া তার বান্ধবীর হাত চেপে ধরলেন।
"তুই কিন্তু বেশি বুঝিস! আগে জামানের কথাটা তো শেষ হতে দিবি? ও কি বলতে চায় আগে শুনি?"
পাশ থেকে জামানের বাবাও বললেন,
"আপা, ছেলেমেয়েদের আমরা একটু বলতে দেই? আপনি শান্ত হয়ে বসেন"
ফারহার বাবাও স্ত্রীকে চুপ থাকতে ইশারা করেন। নিজের মেয়ের উপর যত অনাস্থা, জামান ছেলেটার উপর তার তত আস্তা। তার মেয়ের মত উড়নচণ্ডী কিংবা দায়িত্ব-কান্ডজ্ঞানহীন নয়! তিনি জামানের দিকে তাকিয়ে বলেন,
"তুমি বলো বাবা"

জামান এতক্ষণ বেশ কনফিডেন্ট থাকলেও এখন কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়েছে। ফারহা ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে ইশারা করে বলল, পাকনামী করছ না? এখন সবার দৌড়ানি খাও! জামান ঢোঁক গেলে নিজেকে শক্ত করল মনে মনে। ক্যামেরার ওপাশ থেকে পাঁচ জোড়া উৎসুক চোখ ওদের দিকে চেয়ে আছে। জামান সব নার্ভাসনেস সরিয়ে মুখ খুললো।

"আসলে সমস্যাটা সবসময় আমাদের দুজনের মাঝে ছিল। আমার কারণে ফারহাও আসলে রাগ করে বিয়েতে রাজী হয়নি। আমিও ভাবিনি কখনো ও আর রাজীও হবে। কিন্তু বিয়ের জন্য অন্য কাউকেও পছন্দ হচ্ছিল না। এদিকে ফারহারও একই অবস্থা। এখন আসলে... ইয়ে..."

জামানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জামানের মা বললেন,
"ফারহা কি বিয়েতে রাজী হয়েছে?"
জামান ফারহার দিকে একবার চেয়ে উত্তর দিল,
"আমরা দুজন আসলে..."
"আমরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আন্টি। দেশে আসলেই বিয়ে করব। এতদিন যত রাগ সমস্যা ছিল, সব মিটে গেছে। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকেন"

হড়বড় করে ফারহা জামানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে এসব বলল। জামান বিরক্ত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালো। কি দরকার ছিল এসব বলার? জামান চাচ্ছিল বিয়ের ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে। নাহলে এখানে ওরা কিভাবে আছে, ওদের মাঝে কিছু হয়েছে কিনা, গার্জিয়ানদের এসব নিতে চিন্তা হবে। ফারহার কথা শুনে ফারহার মা বললেন,
"তোরা এখন কোথায়?"
জামান উত্তর দিল,
"আমার বাসায়। ঐ, আপনাদের সাথে কথা বলার জন্য আসলো আর কি"

জামানের মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
"সত্যিই মা? তুই রাজী হইছিস? এতদিনে আমার ছেলের দিকে একটু সুনজরে তাকানোর ভাগ্য হলো? আমি সেই কবে থেকে বলতেছি একটু বুঝ, কিন্তু তুই তো তুইই..."

জামানের মা সরল মনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছেন। জামানের সরল বাবার মুখেও প্রশান্তির হাসি। পেছন থেকে তন্দ্রা খুশিতে হাত নাড়ছে। ওদিকে ফারহার বাবা মায়ের মুখ অন্ধকার। ফারহা আগে থেকেই জানত যে ওর বাবা মা খুশি হবে না। জামান সেটা খেয়াল করে বলল,
"আংকেল আন্টি, আপনারা খুশি হননি?"

ফারহার বাবা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
"গাধা পানি খায়। কিন্তু কিভাবে খায় জানো? ঘোলা করে খায়। আমার মেয়ে হলো গাধার চেয়েও খারাপ। বিয়ে ঠিকই তোমাকেই করবে, মাঝখান দিয়ে এতগুলো মানুষের হয়রানি। থাক, আমি আর কিছু বলব না। আমার মেয়ের মন চাইলো তোমাকে মানা করল, আবার মন চাইলো আবার বিদেশ গিয়ে তোমাকে পটিয়ে বিয়ে ঠিক করল। আমি এসবের কিছু জানি না, তোমাদের জীবন, সিদ্ধান্ত তোমাদের"

ফারহা অসহায়ের মত বলল,
"আমি মোটেও পটাতে এখানে আসিনি আব্বু! আমার এরকম কোনো উদ্দেশ্য ছিল না!আমি..."
"থাক, এত বছর তোমার কথা শুনতে শুনতে আমাদের মাথা ধরে গেছে। আর কিছু শুনতে চাচ্ছি না"
জামান ফারহাকে থামিয়ে বলল,
"আংকেল, আসলে এটা আমরা দুজন মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আর এটা মূলত আমারই সিদ্ধান্ত। ফারহা রাজীই ছিল না। এজন্য আমরা বিয়ে করেছি"

সবাই চোখ গোল গোল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। জামান আবার নিজের কথা বদলালো,
"মানে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কি। এইতো, পরশু রাতেই ফ্লাইট। দুজন এক ফ্লাইটেই চলে আসব ইনশাআল্লাহ। আমি যেটা আপনাদের অনুরোধ করব আপনারা সবাইকে জানিয়ে দিবেন, আর যা যা ব্যবস্থা নেয়া যায় নিবেন। কারণ আমার হাতে সময় খুব অল্প। এক মাসের জন্য আসব। বিয়ের কেনাকাটা, অনুষ্ঠান, এসবে দুই মাস লাগালে তো আর হবে না!"

পেছন থেকে তন্দ্রা লাফিয়ে উঠল,
"ভাইয়া! এক মাসের মাঝে এত কিছু কিভাবে করব? বড় ভাইয়ার সময় কিচ্ছু করতে পারিনি। আর এখন তুমি এত তাড়াহুড়ো করলে কিভাবে হবে!"
"তাহলে আজকে থেকেই শুরু কর। কারণ আমি দেরী করলে আমার চাকরি চলে যাবে। তাই আমি ভুলেও সময় বাড়াতে পারব না"
জামানের মা অস্থির হয়ে উঠেছেন।
"তোরা এত আগে কেন জানাসনি এসব! এত অল্প দিনে সবাইকে দাওয়াত দেয়া, কার্ড করা, বাজার করা, কিভাবে কি করব! তোদের বিয়ে নিয়ে শখ আহ্লাদ তো আছেই। এগুলো কি পূরণ করব না?!"
"তোমরা তাহলে আপাতত শুধু বিয়ের ব্যবস্থা করো, অনুষ্ঠান পরে করবে"

ফারহার মা হাত তুলে মানা করলেন।
"না, না। অনুষ্ঠান যা হওয়ার এখনই হবে। তিন চার বছর আগে থেকে তোমরা দুজন মিলে আমাদেরকে ঝুলিয়ে রাখছ। আর কত? এইবারেই সব শেষ হবে। এই রুকাইয়া, তুই সব ব্যবস্থা কর। আমি এই মেয়ে বাসা থেকে যত তাড়াতাড়ি পারি বিদায় দিব। ও জ্বালা আর সহ্য করতে পারব না!"

ফারহার মা ক্যামেরার সামনে থেকে উঠে যান, সাথে ফারহার বাবাও উঠে সরে আসেন। জামানের বাবা মা ব্যস্ত হয়ে বলেন,
"তোর সাথে পরে কথা বলতেছি, আমি তোকে ফোন দিব!"

জামানের বাবা মাও সরে গেলে তন্দ্রা এগিয়ে এসে বলল,
"ভাইয়া! একটা কথা বলি?"
"কি কথা?"
"তোমরা অলরেডি ডেইট করতেছ, তাই না?!"

ফারহা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। জামান দাঁত কেলিয়ে হাসি দিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বলল,
"বিয়ে করেছি এক মাস আগে, সংসার করতেছি অলরেডি!"
তন্দ্রা মুখে দুই হাত চাপা দিয়ে মৃদু শীৎকার দিয়ে উঠল। ফারহা হাত জোড় করে বলল,
"প্লিজ বইন, কাউকে কিচ্ছু বইলো না এখন! আমার বাপ মা আমাকে এমনেই মেরে ফেলবে!"

তারপর হাতের কনুই দিয়ে জামানকে খোঁচা মেরে বলল,
"তোমার তো সহ্য হচ্ছিল না! এখন আমাকে আমার মা খুন করবে! ভাবছিলাম দেশে গিয়ে একটু ঠান্ডা হয়ে তারপর বলব। তার আগেই সে পুরো পরিবেশ গরম করে ফেলল!"
"পারলাম আর কই? তুমিই তো মিথ্যা বললা! এখন ভাববে না তুমি আমি সারাদিন কি করতেছি? হয়ত বা এক সাথে ঘুমাচ্ছি, এইসব? মিথ্যার দরকার কি ছিল?"
"তুমি হঠাৎ করে এত সত্যব্রত হইছ কেন শুনি?"
"আমি সবসময় সত্য বলতাম!"
"ও ও ও! রিয়েলি?! তাহলে আমাকে এত আগে থেকে পছন্দ কর, এসব নিয়ে মিথ্যা কেন বলছ মিথ্যুক? তোমার মিথ্যার জন্যই আমি এত বছর দূরে ছিলাম!"
"আমার মিথ্যা না! ঐটা তোমার ইগো!"

তন্দ্রা আতঙ্কিত হয়ে ওয়েবক্যামের ওপাশে লড়াকু এক দম্পতিকে দেখছে৷ এরা দেশে আসলে তো চিৎকার করে পুরো দেশ উড়িয়ে দিবে! এর মাঝে জামান উত্তর দিল,
"আমি দেশে গিয়ে একদিনও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। এজন্যই বলতে চাইলাম। এতদিনের অভ্যাসে আমার কষ্ট হবে"
"আচ্ছা? কিভাবে আগে থাকতেন আপনি? আর এক মাসে নিশ্চয়ই আমার সব পেপার হবে না। তখন আমেরিকা এসে কিভাবে থাকবেন?"
"তখনেরটা তখন দেখা যাবে। এখন আমি এসব পারব না"
"তোমার বোন সব শুনতেছে! লজ্জাও লাগলো না তোমার?"

জামান তন্দ্রার দিকে চেয়ে ধমকে উঠল।
"এই! তোর লজ্জা লাগতেছে? লজ্জা লাগলে কল কাট! কাট!"
তন্দ্রা তড়িঘড়ি করে কল কাটতে গিয়ে দেখল ফারহার ফোন বাজছে। ও ফোন হাতে নিয়ে বলল,
"চলে আসছে বাংলা সিনেমার রিনা খান। এখন আমাকে যদি গালাগালি করে, তাহলে আমি আজকে তোমার খবর করে ফেলব! পাকনামির আর যায়গা পাও না! জুতার বাড়ি খাওয়ানোর জন্য এগুলো করছ! পাকনা ব্যাটা!"

চলবে...

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top