৩৩

#অভিসারক_ও_অভিসারিণী
লেখা #AbiarMaria

#৩৩

ইদানীং জামান আর ফারাহ ওরা দুজনেই সুযোগ পেলে শপিং আর ঘুরাঘুরিতে চলে যায়। এখনো নিউইয়র্কের বহু অংশ ওদের ঘোরা বাকি। জামানের অফিসের কারণে সব সময় বাইরে যাওয়ার এনার্জিও থাকে না। তাই জরুরি শপিং ছাড়া ওরা বাইরে বেরুচ্ছে না। আর মাত্র কয়েকদিন, তারপরই ফারহার ফ্লাইট। জামান চেষ্টা করেও এক সাথে টিকিট পায়নি। এই নিয়ে ফারহা ওর কয়েক দফা চুল টেনে খামচি মেরে কান্নাকাটির ভং ধরে একাকার অবস্থা করে ফেলেছিল। তখন জনও বাসায় ছিল। জামানের ঘর থেকে চেঁচামেচি আর কান্নার শব্দ শুনে মুখ ভেঙচে বলল,
"শালা! কতবার বুঝালাম এশিয়ান মেয়েকে বিয়ে করে জীবন শেষ করবি না। বিয়ে করবি একটা ইউরোপিয়ানকে! ভালো লাগলে থাকবি, না লাগলে কিক! ডিভোর্স দিয়ে দরকার হয় আরেক দিকে চলে যাবি। না, তোর এশিয়ান ডাইনীই লাগবে। খা এখন বউয়ের হাতে মাইর! খা!"

বাংলা শব্দগুলোর মাঝে 'শালা' গালিটা জনের খুব পছন্দ। সে খুব জীভ কিঞ্চিৎ বাঁকা করে শালা বলবে। জামান কিংবা কোনো বাঙালির সাথে জন এই শব্দ ব্যবহার করবে। ফারহা অবশ্য শুনলে জনের গায়ে কিছু একটা ছুড়ে মারত। জন এত লম্বা যে ফারহা ওর সাথে মারামারি করতে ভয় পায়। কিন্তু এই কথা কি স্বীকার করা যায়? ফারহা চৌধুরীর ইজ্জত থাকবে এতে? ও এজন্য জনের উপর রাগ হলেই হাতের কাছে যা পায় তা দূর থেকে ছুড়ে মেরে বাংলাতে গালি দেয়। ইচ্ছে করেই ইংরেজীটা এড়িয়ে যায়, নাহলে জন যদি আবার তুলে আছাড় মারে? এত বড় দৈত্যের সাথে কলিজা নিয়ে লাগতে যায় সেই তো অনেক! জন অবশ্য এসব পাত্তা দেয় না। ওর ভাবটা এমন, চাইলেই সে ফারহাকে এক হাতে পুটুশ করে পিষে ফেলতে পারবে। তাই পাত্তা দিচ্ছে না। ওদেরকে মারামারি করতে দেখলে জামান অবশ্য কিছু বলে না৷ অবশ্য এটাকে মারামারি বলবে নাকি অন্য কিছু, সেটাও একটা প্রশ্ন।

ফারহা এসব ভেবে ভেবে সুযোগ পেলেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। এই বাসা, এই দেশ, পিচ ঢাকা ঝা চকচকে রাস্তা, স্টারবাকস, মেক ডোনাল্ড, হাবিজাবি সব খাবার, সব কিছু ছেড়ে যেতে হবে ভেবে কান্না পাচ্ছে ওর। জামানকে যদিও সবচেয়ে বেশি মিস করবে, তবুও মাত্র দুই মাসে বড় মায়া পড়ে গেছে এই শহরের প্রতি। বাসায় কি হয় কে জানে, এই দেশে আসতে পারবে কিনা, আসলেও কত বছর পর কে জানে? ওর মন চায় জামানের কলার ধরে ধুরুম ধুরুম করে মারতে৷ এত দিন আগে বিয়ে করল, অথচ টিকিট তখন খোঁজা যেত না? আর অফিসের বসে কিসের এত সমস্যা যে সে ছুটি দিচ্ছে না? মানব হত্যা পাপ না হলে ও বোধহয় জামানের বসের গুলি মেরে খুলি উড়িয়ে দিত। আহ ফারহা, আহ! কি হলো তার?

আর তিন দিন পর ফ্লাইট৷ সকাল সকাল ফারহা চিন্তা করল জামানকে একটু চমকে দেয়া যাক। নাস্তার আয়োজন করে এসেছে, একটু পর ওরা খাবে৷ এখনো তাদের ক্ষুধাটা ঠিক চাগিয়ে ওঠে নি৷ ফারহা একটা লাল জর্জেটের শাড়ি বের করল। এটা ও শখ করে নিয়ে এসেছিল স্নো এর মাঝে পরে ছবি তুলবে বলে। অনেক সুন্দর ছবিও তুলেছিল ওদের হানিমুন থেকে আসার দিন বরফের মাঝে। যদিও এত ঠান্ডার মাঝে এত পাতলা শাড়ি পরে থাকতে গিয়ে দাঁতে দাঁত বারি লেগে খটখট শব্দ হচ্ছিল, তবুও সে বেশ কিছু ছবি তুলে ফেলেছে। জামান অবশ্য ছবি তোলার পর সেখানেই প্রেমের অভিসার পাতানোর ওর ওষ্ঠোধর দখল করে বসেছিল। ফারহার মুখে এক দলা উষ্ণ নিঃশ্বাস ছুড়ে ফিসফিস করে বলেছিল,
"আমার মাথা খারাপ করার কি খুব দরকার ছিল এখন? ট্রেন তো চালু করে দিয়েছ, ব্রেক যে কাজ করে না ভালোভাবে, সে খেয়াল আছে?"
ফারহাও ভ্রু নাচিয়ে উত্তর দিয়েছে,
"ট্রেনের ব্রেক এত খারাপ হলে হবে? এখন থেকে সংযম করা শিখতে হবে তো! এ তো মাত্র ট্রেলার!"

ফারহার হানিমুনের কথা মনে পড়ে মনটা আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠল। সে চায়, ওদের যাওয়ার আগে প্রতিটা মুহূর্ত স্মৃতিময় হয়ে থাকুক। লাল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে আয়নাতে নিজেকে দেখে নিল। জামানকে পটানো যাবে তো? শাড়ি পরে বেড রুম থেকে বের হয়ে ওর চোখ গেল বসার ঘরের দিকে। জামান শুধু একটা ট্রাউজার পরে উদোম শরীরে একটা দুই কেজির ডাম্বেল নিয়ে ব্যায়াম করছে। পরিশ্রমের কারণে ওর শরীর বেয়ে ঘাম ফোঁটায় ফোঁটায় শরীরে আটকে আছে। ফারহা জামানকে সিডিউস করবে কি, উলটো জামানের কিলবিলে পেশী দেখে ও নিজেই আটকে গেল। গুটিগুটি পায়ে সেখানে হাজির হতেই জামানের দৃষ্টি তার স্ত্রীর উপর নিবদ্ধ হলো। ফারহা তখনও পলক না ফেলে জামানকে দেখে যাচ্ছে। মনে মনে তখন ওর ব্যাকগ্রাউন্ডে গান বাজছে-
"পড়ে না চোখের পলক
কি তোমার রূপের ঝলক!"

জামান কি বুঝলো কে জানে, সে ডাম্বেলটা সোফায় রেখে একটা টাওয়েল নিয় ঘাম মুছলো। তারপর সেটা কাঁধে ঝুলিয়ে স্ত্রীর দিক অগ্রসর হয়ে এক হাতে কোমর পেচিয়ে ধরল।
"কি? লোভ লাগে?"
ফারহা শাড়ির আঁচল নাকে চেপে বলল,
"উহু, ঘামের গন্ধ লাগে! ওয়াক!"
জামানের মুখের হাসি প্রসস্থ হলো। সে আরেক হাতে জোর করে ওকে জাপটে ধরল। ওদিকে ফারহা সাপের মত মোচড়াচ্ছে জামানের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। জামান ওর গ্রীবায় নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
"তোমার ঘামের গন্ধ লাগলে লাগুক, আমার নাকে তো তোমার পারফিউম সুড়সুড়ি দিচ্ছে! এত সাজগোজ এই সকাল সকাল?"
ফারহা মুখ খোলার সাথে সাথে ওর ফোন তার তিরিক্ষি শব্দে ডাকাডাকি শুরু করল। জামান রিংটোন শুনেও স্ত্রীকে বাহুবন্ধন হতে মুক্ত করল না। বরং ভালোবাসাবাসির খেলার আরও গভীরে ডুব দিতে চেষ্টা করছে। ফারহা কোনোমতে হাত বের করে দেখল, ওর মা! বিড়বিড় করে বলল,
"আমার রোমান্স আম্মুর সহ্য হয় না! খুঁজে খুঁজে ঠিক ঐ সময়টাতেই কল দিবে!"

জামানকে জোর করে কিছুটা সরিয়ে মায়ের ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে কথার ফুলঝুরি ছুটে আসতে শুরু করল। জামান ফারহাকে টেনে নিয়ে সোফায় বসলো। ফারহা যখন ফোনে কথা বলছে, তখনও জামান ওর কাঁধে মুখ রেখে বসে আছে। কথা বলা শেষ হওয়ার পর জামান প্রশ্ন করল,
"শ্বাশুড়ি এত অস্থির কেন বলো তো? চলেই তো যাচ্ছো তার কাছে। কেন শুধু শুধু সময় নষ্ট করছে!"
"উফ, আম্মু কি জানে নাকি? জানলে  তো আর কল..."
কথা শেষ হওয়ার আগেই ফারহাকে জামান দখল করে নিল। জন যদিও ঘুমুচ্ছে, তবুও কখন বেরিয়ে আসে বলা যায়? স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত সময়ে প্রাইভেসি খুব গুরুত্বপূর্ণ। জামান এই অবস্থাতেই ওকে কোলে নিয়ে বেডরুমে গিয়ে দরজা আটকে দিল। ফারহাকে বিছানায় রাখার পর খেয়াল করল, ওর চোখে পানি।দুই হাতে আলতো ভাবে চোখের পানি মুছে বলল,
"এখন কেন এত আবেগী হচ্ছো? আমি তো আসবই। একটু সময় লাগবে..."
"আমার ভাল্লাগতেছে না কিচ্ছু। মনে হচ্ছে প্রতিটা ঘন্টা সেকেন্ডের গতিতে চলে যাচ্ছে৷ আমি জানি না আমি কিভাবে তোমাকে ছাড়া..."
কথা শেষ হতে না হতেই ফারহার গলা কান্নায় বুঁজে এসেছে। জামান কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে কানের কাছে মুখ এনে বলল,
"টিকিট আর ছুটি দুটোই ম্যানেজ হয়ে গেছে!"

ফারহার মনে হলো সে কানে কিছু ভুল শুনেছে৷ অবাক হয়ে জামানের চোখের দিকে চাইতে দেখল, ওর চোখে কোনো মিথ্যা নেই। কি বলবে ভাবতে না ভাবতেই উন্মুক্ত ঘাড়ে খামচি মেরে বসলো। ক্রুদ্ধ কন্ঠে আওয়াজ উঁচিয়ে বলল,
"আগে বলা যাইতো না?! এত নাটক করে বলার কি দরকার ছিল?! আমার কষ্ট লাগে না? দুই সপ্তাহ ধরে টেনশনে ঘুম আসে না আমার! আর তোমার যত নাটক! পরশু রাতেই আমার ফ্লাইট! কেমনে পারলা আমার সাথে এগুলা করতে?! বললে কি হইত?!"

জামান হাসতে হাসতে ফারহাকে বিছানাতে চেপে ধরল।
"বললে তোমার এই বাঘিনী রূপ চোখে পড়ত না তো! আই রিয়েলি মিস দ্যাট ক্রেইজি ফারহা!"
ফারহা কিছু বলার আগে ওর কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জামান এখন ওর খামচির প্রতিশোধ নিবে, ভালোবাসাময় প্রতিশোধ।

দুই ঘন্টা পর ওরা যখন নাস্তা করে নিয়েছে, তখন জামান ওকে নিয়ে লেপটপ নিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর ওর বাবা মাকে ভিডিও কল দিল। ফারহা সেটা দেখে উঠতে চাইলে জামান ওর হাত চেপে ধরল।
"তুমি কি করতেছ!"
"ইটস টাইম টু টেল দ্যা ট্রুথ!"
"আর ইউ ম্যাড?! উনারা কি রিএকশন করবে?! আর এখন কি দরকার? বাংলাদেশে গিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে বললেই তো হয়!"
জামান ওর মাথায় ওড়না টেনে ঘোমটা দিতে দিতে বলল,
"চুপ করে বসো থাকো তুমি। একদম কথা বলবা না!"

সামনে লেপটপের স্ক্রিনে যখন কানেকটিং থেকে স্ক্রিনে বসে থাকা মানুষ গুলো দেখা গেল, তখন ফারহা বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করল, ওখানে ওর বাবা মাকেও দেখা যাচ্ছে! ঝট করে জামানের মুখের দিকে তাকালো। ছেলেটা মুচকি হাসছে। এসব কি প্রিপ্ল্যানড ছিল? কখন জামান এসব করল?! আজকে না জানি ওয়েবক্যাম এর ভেতর থেকে ওর মা সেন্ডেল ছুড়ে মারে! ফারহা মনে মনে জপছে,

আল্লাহ তুমি এই বারের মত বাঁচাও,
আমাকে না, আমার ইজ্জত বাঁচাও!
জামাইয়ের সামনে জুতার বাড়ি দিলে
জামাইও সুযোগ পেলে দিবে ধরে!
আল্লাহ রে আল্লাহ!
আমার ইজ্জত তোমার হাতে!

চলবে...

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top