৩২
#অভিসারক_ও_অভিসারিণী
লেখা #AbiarMaria
#৩২
খুব সকালে ফারহার ঘুম ভেঙে গেল৷ সে গুটিশুটি মেরে জামানের উদোম বুকের সাথে লেপ্টে আছে। গোসল করে ভেজা চুল খোলা রেখে ঘুমিয়েছিল, তাই সেগুলো এখন মুখের উপর ছড়িয়ে আছে। মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে একমনে জামানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আগে কত পর পর লাগতো, অভিমানে বুক ভার হয়ে থাকত, পালিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে হত, রাগ হতো। আর এখন? ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ সে। যখন প্রেমে পড়েছিল, তখন ফ্যান্টাসি কাজ করত জামানকে নিয়ে, দুষ্টু দুষ্টু চিন্তা মাথায় আসত কেবল। তবে এই ভালোবাসা যখন জেঁকে বসবে, তখন অনুভূতি ঠিক কেমন হবে তা কখনো বোঝা হয়নি। ফারহা চুপ করে জামানের বুকে কান চেপে ওর হার্টবিট শুনতে থাকলো। এই শীতের সকালে উষ্ণ বুকের মাঝে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকার আনন্দটা আর খুব বেশিদিন হয়ত কপালে জুটবে না। আর মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি। তারপর ওর ফ্লাইট। জামানের ওর সাথে যাওয়ার কথা, কিন্তু এখনো টিকিট কিংবা ছুটি ম্যানেজ হয়নি। যদি না হয়? যদি ফারহাকে একা যেতে হয়? যদি জামানের আসতে কয়েক মাস কিংবা বছর পেরিয়ে যায়? ফারহার অদৃশ্য ভবিষ্যৎ কল্পনা করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কান্না করতে পারছে না বলে বুকের ভেতর লুকানো ঝড় উঠছে। দুইহাতে জামানকে শক্ত করে চেপে ধরে বুকে মুখ গুঁজে থাকলো।
ঘুমের মাঝে এমন চেপে ধরায় জামানের মনে হচ্ছে, বুকে উপর কি চেপে বসলো ভাই? চোখ খুলে আবিষ্কার করল ফারহা ওকে শক্ত করে চেপে ধরে বসে আছে। জামান এক হাতে ঘুম ঘুম চোখে অন্ধকারে ফারহার চুলে আঙুল চালিয়ে বলল,
"খারাপ লাগছে তোমার?"
ফারহা মাথা নাড়লো। জামান ওর মুখ উঁচু করে ঘুম ঘুম চোখে বোঝার চেষ্টা করল বৌয়ের চোখে মুখে কি চলে? দুশ্চিন্তা? নাকি খারাপ লাগা? একটা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে আবার ওকে জড়িয়ে ধরল।
"ঘুম হয়েছে?"
"হু"
"ভালো লাগতেছে?"
"হু"
"ক্ষুধা লাগছে?"
"হু"
"উঠবা?"
"হু"
"এত হু হু করতেছ কেন?"
ফারহা চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
"ভাল্লাগতাসে না!"
"এই মাত্র না বললা ভাল লাগতেছে?! এর মাঝেই অনুভূতি চেঞ্জ? মুড সুইং করতেছে কি প্রতি সেকেন্ডে?"
"মজা লাগতেছে তোমার, না?"
জামান উত্তর দিল না। চিৎ হয়ে শুয়ে মাথার নিচে এক হাত দিয়ে আরেক হাতে ফারহাকে ধরে বলল,
"খুব সুন্দর স্বপ্ন দেখলাম বুঝছ!"
"কি স্বপ্ন?"
"আমাদের একটা কিউট বেবি হইছে। ঠিক তোমার মত একটা মেয়ে। আর তোমার মত সাহসী আর দস্যি!"
জামান হাসছে। ফারহা অন্য সময় হলে কেন ওকে দস্যি বলা হয়েছে, তা নিয়ে মাথা খারাপ করে দিত। আজ কিছু বলল না। মাঝে মাঝে জামান বাচ্চার কথা বললে ও অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। মুখ ঘুরিয়ে স্মিত কন্ঠে জবাব দিল,
"স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে তোমার। বাস্তব আর হবে না। এমন এক মেয়েকে বিয়ে করেছ..."
"কে বলেছে? ডাক্তাররা তো শুধু সম্ভাবনার কথা বলে। ছেলে মেয়ে দেয়ার মালিক তো আল্লাহ। উনি কি মানুষের পারমিশন নেয় বাচ্চা দেয়ার জন্য? শোনো, বাংলাদেশে গিয়ে ডাক্তার দেখাও। তারপর ট্রিটমেন্ট হলে সব ঠিক হয়ে যাবে"
"জানি তো, কিছুই হবে না"
জামান ওর থুতনিতে আলতো স্পর্শ করে নিজের দিকে মুখ ঘোরালো
"এত আশাবাদী মেয়েটার কি হলো? সারাক্ষণ এত নিরাশার কথা বললে হবে?"
"জানি না। তোমাকে আমি কখনো পরিপূর্ণ করতে পারব না, এটা ভাবলে..."
ফারহার গলার কাছে কি যেন আটকে গেছে। যতবার এই কথা আসে, ওর মনে হয় একেবারে দুর্বলতার শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। এই একটা কারণে সব ইগো মাটি দিয়ে শেষ বারের মত জামানের কাছে ছুটে এসেছিল যদিও কখনো চায়নি জামানের জান হতে, বৌ হতে। জামান ঠিকই সব জেনে শুনে ওর জামাই হয়ে গেল। আচ্ছা, যদি ও কখনো বদলে যায়? সবাই মিলে যখন বলবে, এই মেয়েটা কখনো তোমাকে বাবা ডাক শোনাতে পারবে না, তখন কি জামানের অনুতাপ হবে না? অনুতাপ হলে কি করবে? ছেড়ে দিবে? ফারহা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। জামান ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
"সেই গতরাত থেকে একটা ইমোশনাল মেয়েকে দেখছি। এই মেয়েটা গতকালও একজনের নাক মুখ ফাটিয়ে দিল! আর এখন শুধু কান্না করে কেন? আচ্ছা শুনো। কখনো যদি আমি এসব নিয়ে তোমাকে কিছু বলি, আরেকটা মেয়ের দিকে আগাই, তুমি সেই মেয়েটার নাক গতকালের মত মেরে মেরে ফাটিয়ে দিবে! ঠিক আছে?"
ফারহা কড়া চোখে জামানের মুখের দিকে তাকালো। জামান হাসছে। ফাএহা কটকট করে বলল,
"আর তোমাকে কি করব?"
"আমাকে আদর করবে! এত বেশি আদর দিবে যে অন্য সবাইকে ভুলে যাবো!"
"না মেরে আদর কেন দিব, তার কারণ দর্শাও আগে!"
"আমাকে মারলে তোমার দেবতা এপোলোর নাক খসে পড়ে যাবে! পরে সবাই বলবে, এই দেবতা নাক কোথায় গেল! তারপর তোমাকে সবাই নাকছোড় এর বউ ডাকবে!"
"নাকছোড়!"
শব্দটা বলে ফারহা হিহি করে হাসতে শুরু করল। জামান ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলল,
"হুম। নাকছোড়!"
"আগে তোমাকে অনেক বদরাগী মনে হতো। এখন মনে হচ্ছে, দিন দিন জোকার হয়ে যাচ্ছো!"
জামান মুখ তুলে ওর চোখের কোণে লেগে থাকা অশ্রু ফোটা মুছতে মুছতে বলল,
"তোমার জন্য জোকার পোকার পাগল ছাগল সব হতে পারব! শুধু কান্নাকাটি করা যাবে না! হাসতে হবে!"
জামানের কপালের উপর সব চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে, ওর চোখ ভরা মাদকতা। ফারহা এই দৃষ্টির সাথে বিয়ের প্রথম রাতে ভয়াবহভাবে পরিচিত হয়েছে। লজ্জায় লাল নীল বাতি জ্বলার আগেই সে জোর করে বিছানা থেকে উঠে আসলো। ফজরের সময় হয়ে গেছে বলে জামানও আটকালো না, মুচকি হেসে স্ত্রীকে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে বালিশে মুখ গুঁজলো। ফারহা আয়নার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো ওর চুল গুলো মাথার উপর কাকের বাসা তৈরি করে রেখেছে। হাত দিয়ে সেগুলো ঠিক করার বৃথা চেষ্টা করল কয়েক সেকেন্ড। আয়নায় নিজে দেখে জামানের উপর আফসোস হচ্ছে। এই ছেলেটা কি দেখে ওকে বিয়ে করেছে? পুরো একটা জংলী দেখা যাচ্ছে। গায়ের টপস এর গলা একপাশে হয়ে একটা কাঁধ উন্মুক্ত হয়ে গেছে, ঢোলা একটা ট্রাউজার পরে আছে, আর চুল গুলো পাগলীর মত।
ওকে আয়নার সামনে দাঁড়াতে দেখে জামান বিছানা থেকে ওর হাত ধরে টান দিল।
"এভাবে কি দেখো আয়নায়? খবরদার, আমার জিনিসে একদম নজর দিবা না!"
ফারহা ফিক করে হেসে ফেলল। জামান এলোমেলো চুল ঠিক করার চেষ্টা চালাতে চালাতে বলল,
"শোনো, টয়লেটে গিয়ে একদম কান্না করবা না। করলে কিন্তু দরজা ভেঙে ঢুকে যাবো। একটা কথা মনে রাখবা সবসময়। আমরা যদি জঙ্গল দিয়ে হেঁটে যাই, তখন শেয়াল, নেকড়ে, হায়েনারা বসে থাকে আমাদের খুবলে খাওয়া জন্য। সুযোগ পেলেই ওরা আঁচড় বসিয়ে দেয়। কিন্তু এজন্য কখনো কেউ মারা যায় শুনেছো? জীবনে যাইই ঘটুক না কেন, বুঝে নিবা, এসব হলো শেয়াল কুকুর, হায়েনা। এসব নিয়ে ভাবলে বেঁচে থাকা যাবে না। এরা আসবে যাবেই, তাই বলে পথচলা কখনো থামবে না! সবসময় এভাবেই প্রতিবাদ করবা। বি ব্রেভ!"
ফারহা এক দৃষ্টিতে জামানকে দেখছে। প্রথম বর্ষে থাকতে যেবার জামান ওকে ভার্সিটিতে মারামারি করতে দেখেছিল, ও ভেবেছিল সব শেষ ওখানেই। জামান কখনো একটা মারকুটে মেয়েকে ভালোবাসবে না। অথচ ওর সব ধারণাকে মানুষটা প্রতিদিন ভুল প্রমাণিত করে আসছে। ফারহা জামানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ল।
"তোমাকে ছাড়া বাংলাদেশে কিভাবে থাকব আমি!"
জামানেত উত্তর দেয়ার আগেই কাবাবের হাড্ডির মত ফারহার ফোন কর্কশ শব্দে বেজে উঠল। যদিও খুব সুন্দর একটা রিংটোন সেট করা, তবুও এই মুহূর্তে সেটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য শব্দ মনে হলো! ফোনটা বালিশের চিপা থেকে বের করে বিরক্ত হয়ে দেখল ওর মা কল করেছে বাংলাদেশ থেকে।
"আশ্চর্য! আম্মু আজীবনই এই ভোর বেলায় কল দিয়ে মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়! সারাদিনে কি আর সময় পায় না?! ধরব না আমি! এই সময় যারা ফোন করে, তাদের কল আমি ধরি না!"
জামান হেসে বলল,
"মাকে বলো, আমি আমার জামাইয়ের বুকে পড়ে আছি! এই সময় ডিস্টার্ব কেন করতেছ!"
"শখ কত! জুতার বাড়ি গুলো তুমি খাবা না, আমি খাব!"
"হা হা হা, এখনো মা তোমাকে জুতা দিয়ে মারে?!"
"তার মারা জিনিসপত্রই তো জুতা, বেল্ট আর খুনতি! এছাড়াও সামনে যা পায় তাইই মারে!"
"হা হা হা! তুমি তখন কি কর?"
"পালাই!"
"মাকে আমার কথা উনি খুশি হবে, মারবে না"
"তা তো অবশ্যই। আম্মু তো তোমার ভক্ত। বিয়ের আগেই..."
কথাটা মুখে আসতেই সে গিলে ফেলল। জামান যেদিন আমেরিকা আসার খবর দেয়ার জন্য ফারহাকে ডেকেছিল, সেদিনই ওর মা ওকে চেপে ধরেছিল। জামানের প্রশংসায় ওর মার মুখ পঞ্চমুখ ছিল। অন্যদিকে মেয়েকে আচ্ছামত বকেছেন যেন জামানের পিছু ছেড়ে দেয়। এখন যদি জামানকে এসব বলে, জামান পরে খোঁটা দিলেও দিতে পারে! ফারহা কথা না শেষ করে উঠতে চাইলে জামান চেপে ধরল।
"বিয়ের আগেই কি?"
"তোমার নাকের ঘি!"
কথা বলে চড়ুই পাখির মত ফুড়ুৎ করে পিছলে বেরিয়ে গেল। ওদিকে জামান হাসছে শুধু। ওদিকে ওর শ্বাশুড়ি কল করেই যাচ্ছে। জামান ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
"শ্বাশুড়ি আম্মা! আর মাত্র কয়েকটা দিন অপেক্ষা করেন! মেয়ে আপনার কাছে তো আসবেই, সাথে মেয়ের জামাইও আসতেছে!"
চলবে...
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top