২৯

#অভিসারক_ও_অভিসারিণী
লেখা #AbiarMaria

#২৯

পরদিন সকাল থেকেই দুজন বেশ ব্যস্ত। চেক আউট টাইম ১১টা হলেও জামান চাচ্ছে আগেভাগেই এলাকা ছাড়তে। কারণ ঝড় থেমে গেলেও আকাশ পরিষ্কার হয়নি। বেশি তুষারপাতের কারণে অনেক সময় রোড ব্লক হয়ে যায়। তখন স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপের জন্য ওদের অপেক্ষা করতে হয়। জামান চাচ্ছে পরিস্থিতি ভালো থাকতেই নিউইয়র্কে ফিরে আসতে। একারণে সকাল থেকেই দুজন সব কাজ শেষ করেছে। ফারহার সব কিছু গোছাতে গোছাতে মনে হচ্ছে, ওর জীবনে ও কোনোদিন এত কাজ করে নি। মাত্র দুই দিন থেকেছে, অথচ পুরো ঘরে কাপড়, খাবার দাবার, এটা ওটা ছড়িয়ে আছে। জামান তো বিড়বিড় করে শুধু বলছিল,
"তুমি একটা সীমাছাড়া অলস!"

ফারহার খুব যে ইগোতে লেগেছে কথাগুলো, এমন না। ওর মায়ের কাছে তো উঠতে বসতে গালি খেত। কাপড় গোছাতে গোছাতে মনে মনে ভাবছে, না জানি সারাজীবন জামান কি করে ওকে সহ্য করবে। আহারে জামান! স্বামীর জন্য খুব আফসোস হচ্ছে। এই প্রেম বিয়ে শাদী না হলে জামান এখন একটা ভালো মেয়ে বিয়ে করতে পারত। আচ্ছা, যদি ওর জ্বালায় বিরক্ত হয়ে আরেকটা বিয়ে করে ফেলে? এই আবেগ তো আর আজীবন থাকবে না! তখন?! ফারহা ঝট করে জামানের মুখের দিকে খেয়াল করল। জামান কপাল কুঁচকে রয়েছে। ফারহা দ্রুত হাতে সব ঠিক করছে। না ভাই, বিয়ে হতে না হতে সতীনের কথা মানা যায় না! এখনো যদি না বদলায়, তাহলে নিশ্চিত জামান আরেকটা বিয়ে করবেই! না না না, এসব হতে পারে না!

নিউইয়র্কে ওরা যখন পৌঁছালো, তখন জামান খেয়াল করল, ফারহা সব কিছু গুছিয়ে ফেলছে। জামান বলার আগেই বিছানা ঝেড়ে এলোমেলো কাপড় গুছিয়ে ফেলল। জামান বেশ অবাক হয়ে ফারহাকে লক্ষ্য করল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। ফ্রিজ থেকে কিছু খাবার বের করে রান্নার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। এক ফাঁকে টয়লেটে গেল। ফিরে এসে দেখল, ফারহা সব কিছু স্লাইস করছে। কিভাবে কি কাটবে, কোনটা কোনটা লাগবে, এসব জিজ্ঞাসা করছে। জামান অবাক হয়ে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে প্রশ্ন করল,
"কি হইছে তোমার?"
"আমার? আমার আবার কি হবে?"
ফারহার মুখে বিস্ময়ের অভিব্যক্তি। জামান একটু ভেবে বলল,
"না মানে, আমি ভাবছিলাম তুমি রেস্ট করবা, আমি রান্নাটা..."
"না না৷ তুমি ছেলে মানুষ, তুমি একা রান্না করবা কেন? আমিও হেল্প করি। সব রান্না জানা পর্যন্ত তোমার সাথে থাকা দরকার তো, নাকি? না থাকলে তো একা একা কাজ করতে তোমারও সমস্যা হবে!"
"বুঝলাম"
"আর হ্যাঁ, তোমার সবগুলো কাপড় কি এখন ওয়াশিং মেশিনে দিব?"
"তুমি কি এখন কাপড়ও ধুবা?! কাল ধোও"
"না, সমস্যা নাই। পরে আবার হজবরল লেগে যাবে। আর তুমি রেগে যাবা! আমি কাজ করে রাখি আর কি"

ফারহা কথাগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই বলছে, কিন্তু জামানের হজম হচ্ছে না। সে নিজের হাতে চিমটি কাটলো। না ভাই, অজ্ঞান তো হয়, সজ্ঞানেই আছে! তাহলে ফারহার এত পরিবর্তন?! এই মেয়ে তো দুই ঠ্যাং দুই দিকে দিয়ে এখনো ঘুমায়, মাঝে মাঝে কাপড়ের স্তুপের মাঝে ঘুমিয়ে থাকে, কয়েকদিনের প্লেট কিচেনে জমিয়ে রাখে, অথচ আজ?! বিয়ের কিছুদিন আগে একবার ওর মনে হয়েছিল, আজ সারাদিন কোনো ডিশ ওয়াশ ও করবে না কয়েকদিন। এই কাজ তো ফারহাকে দিয়েছিল সেই প্রথম দিনেই। জামান তিন দিন অপেক্ষা করে করে দেখল, ওর স্টকের সব প্লেট চামচ ময়লা হয়ে গেছে, অথচ ফারহা সেগুলো সিংকে রীতিমতো স্তুপ করে রেখেছে! জামান এসে যখন ওকে খোঁচা দিল, তখন ফারহা এমন ভাবে প্লেট গুলোর দিকে তাকালো যে, এটা কোনো স্তুপ হলো নাকি? জামানের যদি এত্তগুলো ক্রোকারিজ থাকতো, তাহলে ফারহা বোধহয় সেগুলোও নামিয়ে নামিয়ে নোংরা করত, তবুও কোনো কিছু ধুতো না। আজ কি এমন হলো?!কোনো মিরাকেল হলো নাকি?! নাকি সূর্য আজকে অন্য কোনো দিক থেকে উঠেছে?

এতশত ভাবতে ভাবতে আবার নিজেকে নিজে বুঝ দেয়, ফারহা ঠিক হয়েছে, এটা তো ভালো। এই মেয়ে যদি বদলায়, অসুবিধা কি? মেয়ে মানুষ গোছালো স্বভাবের হওয়াই উচিত। আসলে ছেলে মেয়ে সবারই গোছালো স্বভাবের হওয়া চাই। তবে মেয়েদের যেহেতু ঘরেই থাকতে হবে, তাই তাদের স্বভাব গোছালো হওয়া বেশি দরকার। জামান আপন মনে মাথা নাড়ে আর হাসে, বউটার শুভবুদ্ধির উদয় হলো বলে!

সন্ধ্যার দিকে ফারহা জামানের সাথে গা ঘেঁষে বসল। জামান বিছানায় বসে বসে একটা বই পড়ছিল। পাশে বউ ঘেঁষে আসতেই ভালো লাগাটা সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে সেটা প্রকাশ না করে নষ্ট হওয়া মনোযোগ বসানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে প্রশ্ন করল,
"কি ব্যাপার? এই সময় ঘেঁষাঘেঁষি হচ্ছে কেন?"
"আচ্ছা তুমি কি কি রান্না করতে পার?"
"বিদেশী খাবার রান্না করতে পারি। ঐ বেগুন শুটকি, চিচিঙ্গা দিয়ে মাছ, মাছের মুড়িঘণ্ট, এইসব খাবার দাবার পারি না"
"পিজ্জা পারো?"
"হ্যাঁ। কেন? পিজ্জা খেতে ইচ্ছা হচ্ছে?"
"হুম"
"তাহলে অর্ডার করে দিই"
"না না, চলো আমরা বানাই"
"কিন্তু সবকিছু তো বাসায় নাই। বাইরে যেতে হবে"
"তাহলে নিয়ে আসো। দুজনে মিলে বানাবো। তোমার চিন্তা করতে হবে না, আমি সব কেটে কুটে দিব তোমাকে"

জামান মাথা ঘুরিয়ে ফারহাকে দেখল।
"তোমার কি হইছে বলো তো?"
"আশ্চর্য কথাবার্তা! আমার কি হবে? দুজন মিলে রান্না করা তো একটা রোমান্টিক আর এক্সাইটিং ব্যাপার! তো করলে সমস্যা কি?"
"সেটাও সত্য! ঠিক আছে। আমি স্টোর থেকে সব নিয়ে আসি। এটাই কি তাহলে আমাদের ডিনার?"
ফারহা দাঁত বের করে জোরে জোরে মাথা নাড়ল। জামান বেরিয়ে পড়ে যেসব জিনিস নেই সেসব বের করতে। এর মাঝে ফারহা রান্নাঘরে কিছু কাজ এগিয়ে রাখে। জামান এসে দেখে, ফারহা পেঁয়াজ, ক্যাপসিকাম, টমেটো কেটে রেখেছে। চিকেনও বের করে রেখেছে। টিশার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলল,
"খুব ক্ষুধা লেগেছে মনে হচ্ছে?"
"না, আসলে আমি এক্সাইটেড খুব!"
জামান মুচকি হাসছে। পিজ্জার ডো মাখিয়ে ইস্ট দিয়ে এক কোণায় রেখে দেয়। তারপর পিজ্জা সস বানাতে লেগে যায়। ফারহা শুধু প্রশ্ন করছে। সস বানানোর পরও আরও এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় পিজ্জার ডো পুরোপুরি তৈরি হতে। এরপর জামান সেটা বেলতে শুরু করলে ফারহা বাঁধা দেয়।
"আমি করি?"
"তুমি রুটি বেলছ কখনো?"
"না তো"
"তাহলে এটা কিভাবে পারবা? গোল না হয়ে তো এটা বাংলাদেশের মানচিত্র হয়ে যাবে!"
"হবে না। তুমি দেখিয়ে দাও"
জামানের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি উঁকি দিচ্ছে। ফারহাকে সেটা বুঝতে না দিয়ে কিভাবে বেলতে হবে দেখিয়ে দিল। ফারহা পারছে না এমনটা বলে ওর হাতের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে রুটি বেলতে শুরু করল। ফারহা চমকে উঠল। জামানের মতলবটা কি? জামান ওর পিঠের সাথে লেপ্টে আছে, দুইহাতেও ওকে চেপে ধরছে। ফারহা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করল,
"তুমি কি রুটি বেলতেছ? নাকি আমাকে বেলতেছ?"
"এক ঢিলে দুই পাখি মারতেছি!"
ফারহা চেষ্টা করলেও এখন ছুটতে পারবে না জামানের গ্রিপ থেকে, ভালোমত জানে সে। জামান ওর উঁচু করে বেঁধে রাখা চুলে নাক ডুবিয়ে দিল। একটু পর সে উন্মুক্ত ঘাড়ে নেমে আসলো। ফারহার এই মুহূর্তে সুড়সুড়িতে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
"আমার কিন্তু একদম প্রেম প্রেম পাচ্ছে না, সুড়সুড়ি পাচ্ছে খুব!"
"তাই?! কোথায় সুড়সুড়ি? দেখি!"
"অসভ্য! আমরা কি পিজ্জা বানাবো? নাকি কিচেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেডরুমের কাজ করব?"
"আমরা প্রেমের পিজ্জা বানাবো। তাতে থাকবে ভালোবাসা, প্রেম, আদর, চুমু..."

ফারহা আচমকা 'তেলাপোকা' বলে চেঁচিয়ে উঠল। জামান চমকে ওকে ছেড়ে দিল। ফারহা এই সুযোগে জামানকে সরিয়ে পালিয়ে গেল। জামান আশেপাশে কোথাও তেলাপোকা না দেখে হেসে ফেলল। ওদের বেডরুম থেকে ফারহার হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। জামান জোরে জোরে বলল,
"পিজ্জা বানিয়ে নেই, এরপর রুমে এসে তোমাকে বেলব, দেখো!"
"দেখবো নে!"
ওপাশ থেকে ফারহার সাহসী উত্তর।

এভাবেই চলছে ওদের জীবন। জামান অফিস করে এসে ফারহাকে নিজের জন্য অপেক্ষারত পায়, দুজনে মিলে কখনো কখনো আবার বাইরে চলে যায়। বাংলাদেশের মত এখানে গভীর রাতেও বাইরে থাকলে কোনো সমস্যা হয় না। এখানে সারারাতই ঘোরা যায়। সারাদিনের ক্লান্তি ফারহার হাসি দেখলেই উবে যায়। তবে ওর পাগলামি খুব বেশি কমেনি। এক রাতে রোমান্টিক মুভি দেখতে বসল দুজন। জন যথারীতি গায়েব, তাই পুরো বাসাটা নিজেদের মত করে দুজন উপভোগ করছে। এক গামলা পপকর্ন নিয়ে মুভি দেখতে বসার কিছু পরেই জামান ফারহাকে পেছন থেকে টেনে জড়িয়ে ধরে রাখলো। ফারহা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে মুভি দেখছে। একটু পর জামান কাঁধে হাত দিল, এরপর গলায়, এরপর কোমরে। জামানের হাত কোনোভাবে এক যায়গায় স্থির থাকছে না। ফারহা বিরক্তিতে 'আহ' করে রীতিমতো লাফিয়ে উঠল। এত জোরে লাফিয়ে উঠল যে বোল থেকে পপকর্ন চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। ও দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
"সমস্যা কি?! মুভি দেখার সময় এরকম মোচড়ামুচড়ি করতেছ কেন?! এক কাজে দুই কাজ হয় নাকি? হয় প্রেম করবা, নাইলে মুভি দেখবা! তোমার এই জ্বালা তো আর ভাল্লাগতেছে না!"

জামান জবাব না দিয়ে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়লো,
"তুমি এরকম চিৎকার দিলা কেন এখন?!"
"মেজাজ গরম হলে চিৎকার দিব না তো করব কি? তোমার জ্বালায় শান্তিমত একটা মুভিও দেখতে পারতেছি না!"
"শান্তির মায়েরে বাপ!"
কথাটা বলেই চালের বস্তার মত ফারহাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বেডরুমের দিকে রওনা দিল। এদিকে আচমকা এমন করায় ফারহা ওকে ইচ্ছামতো খামচি দিচ্ছে। জামান কৃত্রিম রাগ প্রকাশ করে বলল,
"সেদিনের কথা ভুলে গেছ?! আমি কিন্তু একেবারে নখ তুলে ফেলব এবার!"

জামানের থ্রেটে কাজ হলো, ফারহা থেমে গেল। জামান ওকে ধপ করে বিছানায় ফেলতেই ফারহা নাক মুখ কুঁচকে ফেলল।
"আগে কি গুন্ডামি করতেন আপনি? কথায় কথায় তুলে নিয়ে আসেন কেন?"
"তোমার মত গুন্ডির সাথে গুন্ডামি করব না তো কি করব? স্বামীর সোহাগ কি জিনিস বুঝো তুমি?"
"না বুঝি না, কচি খুকি আমি!"
"কচি খুকি না, তুমি হচ্ছো একটা পাকনা বেল!"
"কিহ!"
"জ্বী! জীবনে একবার ন্যাড়া হয়ে বেল তলায় গেলাম আর তুমি মাথায় পড়ছ। এখন তো আমাকে জোরজবরদস্তিই করা লাগবে। নাইলে তুমি এই চিৎকার চেঁচামেচি, মারামারি জীবনেও বন্ধ করবা না!"

ফারহা কয়েকবার বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। একজন পুরুষের সাথে গায়ের জোরে কতক্ষণ পারা সম্ভব? ওর ভীষণ রাগ লাগছে। মন চাচ্ছে জামানকে কামড়ে আঁচড়ে জোরাজুরির সাধ মিটিয়ে দিতে।

ওদের ভাগ্য ভালো মারামারি লেগে যাওয়ার আগেই জামানের ফোন বেজে উঠল। জামান বিরক্ত হয়ে ফোন আনতে উঠে গেলে ফারহা দৌড়ে দরজা আটকে দিল। আজকে আর সে দরজা খুলবে না!

এদিকে ইরফান ফোন করে ওদের দুজনকে ডিনারে আসার জন্য ফোর্স করছে। জামানের যদিও বাইরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল না, কিন্তু মেহেরজান ভাবীর হাতের রান্নাও সে মিস করতে চায় না। তার হাতের হায়দারাবাদী বিরিয়ানিটা অনেক সুস্বাদু। জামান রাজী হয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছে আর ফারহা চুপ করে ঘরের ভেতর ঘাপটি মেরে আছে। জামান ওয়ার্নিং দিল,
"এক মিনিটের মাঝে দরজা না খুললে আজকে তোমার একদিন কি আমার সারাদিন! মাইন্ড ইট!"

চলবে...

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top