২২
#অভিসারক_ও_অভিসারিণী
লেখা #AbiarMaria
#২২
কানে হেডফোন গুঁজে একের পর এক বন্ধুকে জামান কল করছে আর ইরফানের বাসার ঠিকানা দিয়ে আসতে বলছে। কথা বলতে বলতে সে বাঁ হাত স্টেয়ারিং ধরে রেখেছে, আর ডান হাতে ফারহার হাত চেপে ধরে রেখেছে। ফারহা একবার হাত সরিয়ে ফেলেছিল। তাতে জামান রেগে ওর দিকে এমন চোখ গরম করে তাকিয়েছে যে আর দ্বিতীয় বার এই কাজ করার সাহস হয়নি।
ইরফানের বাসায় গিয়ে কলিং বেল টিপতেই ইরফান দরজা খুলে দিল। সালাম দিয়ে ওরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল।
"কনগ্রেজুলেশন মিস্টার জামান! ফাইনালি ভালো কিছু হচ্ছে! সো দিস ইজ আওয়ার ব্রাইড!"
ফারহা মিষ্টি হাসি দিল। ভাগ্যিস এরা কেউ ফারহার দুষ্ট হাসি দেখেনি। পেছনে ইরফানের স্ত্রী মেহেরজান তার ছেলেকে খাওয়াচ্ছিল। ফারহাকে দেখে সে এগিয়ে আসলো।
"নায়া বাহু! চান্দ জেয়সা হ্যায়!"
"চান্দ জেয়সা হ্যায় ক্যায়া? ইয়ে তো চান্দ হ্যায়!"
জামানের কথা শুনে ইরফান টিপ্পনী কাটল।
"খুব বউয়ের প্রশংসা চলছে দেখি!"
"ইরফান ভাই, সংসার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ, হ্যাপি ওয়াইফ, হ্যাপি লাইফ!"
মেহেরজান ফারহাকে টেনে নিয়ে বলল,
"ফারহা কিন্তু আমার কল্পনার চেয়েও সুন্দরী! জামান, তোমাদের দুজনকে সত্যিই খুব মানাবে। মেড ফর ইচ আদার! কিন্তু এত সাদাসিধা কেন? ওকে আরও সাজাতে হবে"
"ভাবী, কিচ্ছু করতে হবে না। ওকে এভাবেই ভালো লাগছে"
ইরফান বাদ সাধলো।
"তোমার তো এখন সব অবস্থায়ই বউকে সুন্দর লাগবে! তাই বলে কি একটু সাজবে না? এটাই তো আসল বিয়ে। সাজলে সমস্যা কি?"
"ভাই, দেরী হয়ে যাবে!"
"এত অধৈর্য হলে চলে নাকি মিয়া! বউ পালাবে না, পাহারা দেয়ার জন্য আমরা আছি তো!"
মেহেরজান ফারহাকে হাত ধরে টেনে টেবিলের কাছে নিয়ে আসলো। উর্দুতে বলল,
"কিছু খেয়ে নাও?"
ফারহাও উর্দুতে উত্তর দিল,
"আমি খেয়েছি"
"সুন্দর উর্দু বলতে পারো দেখছি। এই আমির, ব্রেড শেষ করো। নাহলে পাপা তোমাকে মারবে, আর আমরা তোমাকে বাসায় রেখে যাবো। জলদি খাও!"
ফারহাকে নিয়ে সে ওদের বেডরুমে প্রবেশ করল। ফারহা অবাক হয়ে ওদের ইন্টারিওর দেখছে। জামান বলেছে, ইরফানের নিজের ফ্ল্যাট এটা, সব নিজের ইচ্ছেয় গুছিয়েছে৷ ফারহা ঘরের চারপাশটা মুগ্ধ হয়ে দেখছে। আপন মনে বলল,
"কি সুন্দর ঘর!"
"তোমরাও পাবে। জামান চেষ্টা করছে এখানে স্থায়ী হওয়ার"
ফারহা ঘাড় ঘুরিয়ে মেহেরজানকে দেখলো। পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চির মানুষটা একেবারে ফিট স্বাস্থ্য। এক সন্তানের জননী হলেও তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। উনার চেহারাও মাশাল্লাহ সুন্দর। ফারহার কাছে এসে বললেন,
"এমন কাজল লেপ্টে গেছে কেন? কান্না করেছ?"
"আসলে... আসলে আমি বিয়েতে রাজী না। জামান ভাই এক প্রকার জোর করে"
"কেন রাজী নও! জামান তোমাকে কত ভালোবাসে জানো? এক জীবনে এমন মহব্বত পাওয়ার সুযোগ খুব কম মেয়েরই হয়। তোমার কি জামানকে অপছন্দ কোনো কারণে?"
"নাহ, তেমন কিছু না"
"তাহলে শুধু অমত করো না। এভাবে সৌভাগ্য পায়ে ঠেলতে নেই। এদিকে এসে বসো, তোমাকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে দেই। আরেহ, হাতে দেখি মেহেদী নেই! মেহেদী না দিয়ে বিয়ে হয় নাকি? একটু অপেক্ষা করো, আমি মেহেদী আনছি"
ফারহার হাতে যত্ন সহকারে মেহেদী লাগিয়ে সাজাতে সাজাতে মেহেরজান বলছে,
"আমার এক কাজিন জামানকে খুব পছন্দ করত। বছর খানেক ওর পিছে ঘুরেছিল। ও বাংলাদেশী জানা সত্ত্বেও জামানকে বিয়ে করার জন্য এক পায়ে খাড়া ছিল"
"আর জামান?"
"ও পাত্তাই দেয় নি! দেখা হলে হায় হ্যালো করত, এর বেশি কিছু না। অনেক বার বুঝিয়ে বলার পরও ও ছাড়ছিল না। এই দেখো ওর ছবি"
ফারহা দেখলো মেহেরজানের মোবাইলে অত্যাধিক সুন্দরী এক রমনী৷ এমন মেয়েকে জামান রিজেক্ট করেছে?! অবিশ্বাস্য! মেহেরজান ফোন রেখে আবার ফারহাকে সাজাতে সাজাতে বলল,
"আমরা তো সবাই অবাক। কত বার করে জিজ্ঞাসা করলাম, ও বলল ভালো লাগে না এসব। তুমি এখানে আসার কিছুদিন আগে তোমার ব্যাপারে ও ইরফানকে সব খুলে বলে। তখন বুঝতে পারলাম কেন আমাদের জামান কিছুতেই কারো বাঁধায় পড়ছে না! ওর মন তো আগেই বাঁধা পড়ে আছে তোমার কাছে!"
ফারহা কোনো উত্তর দিচ্ছে না, কেবল শুনে যাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে, ওর প্রতি জামানের অনুভূতির কথা ও ছাড়া আর পুরো পৃথিবীর সবাই জানে। কেবল ও ই এতদিন চোখে পট্টি বেঁধে ছিল। সাজতে সাজতে আবারও ওর কান্না চলে আসছে। মেহেরজান টিসু নিয়ে ওর চোখের পানি ঠিক করে দিল।
"একদম কান্না করা যাবে না! হালকা কান্না হয়ত মেকাপ সামলাবে। বেশি কাঁদলে কিন্তু আমার সব শ্রম মাটিতে মিশে যাবে! কাঁদছ কেন বলো তো?"
"আম্মু আব্বুকে মনে পড়ছে খুব। উনাদের ছাড়া কখনো এতদিন থাকি নি। আজকে আমার বিয়ে, অথচ কেউ নেই! উনারা শুনলে খুব কষ্ট পাবেন। আমি তাদের একমাত্র মেয়ে"
"কিন্তু এখন তো তুমি বাংলাদেশে ফেরত যেতে পারবে না। আবার এখানে থাকলেও তো জামান বিয়ে না করলে কষ্ট পাবে। এসব ভেবো না, আমরা আছি তো! বাবা মায়ের কাছে সময় হলেই যাবে"
ফারহাকে সাজানোর পর যখন ফারহা চোখ খুলে নিজেকে আয়নায় দেখলো, তখন বিশ্বাস করতে পারছিল না। মেহেরজান জোর করে ওর নিজের গয়না পরিয়ে দিয়েছে। মাথায় টিকলি আর ঝাপটা, গলায় নেকলেস, হাত ভর্তি চুড়ি, চেহারাতে মেকাপ, আইলেশ, সব মিলিয়ে ফারহার নিজেকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে। মেহেরজানের হাত ধরে বলল,
"থ্যাঙ্কিউ ভাবি, সাজ অনেক সুন্দর হয়েছে! কিন্তু এই গয়না গুলো..."
"এগুলো আমি তোমাকে উপহার দিলাম। জীবনে বিয়ের একটা স্মৃতি থাকবে আমার পক্ষ থেকে। এগুলো কিছু দিন আগেই বানিয়ে এনেছিলাম, একবারও পরা হয়নি। ভাবিনি এভাবে কাজে লেগে যাবে!"
ফোন বের করে ফটাফট ফারহার কয়েকটা ছবি তুলে নিল। ছবি তোলা শেষে ফারহাকে বলল,
"তুমি বসো, আমি চট করে দেখে আসি ওদিকে ওরা কি করল!"
মেহেরজান চলে যাওয়ার পর বিশাল আয়নায় ফারহা নিজেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। ওর নিজেকেই নিজের খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। ও এত সুন্দরী হলো কবে থেকে! আচ্ছা, জামান ওকে দেখে কি করবে? এই লোক তো গতকাল থেকে অস্থির হয়ে আছে। এই রূপে জামানের সামনে গেলে নিশ্চিত তার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। ফারহার ইচ্ছা হচ্ছে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকতে। কে বলেছিল ওকে এত সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে? এখন তো জামানের পাগলামীর ভয়ে আধামরা হয়ে যাচ্ছে। মুখের উপর দোপাট্টা দিয়ে ঢেকে রাখলো, যদি সেটা না দেয়ার মতই। একটা ব্যাপারে ফারহা নিশ্চিত হয়ে গেছে, ওর ক্রেজিনেস জামানের সামনে কিছুই না। জামান ওর চাইতেও পাগলাটে, শুধু সময় আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকে সে। নিকটবর্তী ভবিষ্যতের কথা ভেবে ও বার বার শিউরে উঠছে।
এদিকে জামানের বন্ধুরা একে একে ইরফানের বাসায় হাজির হয়েছে। সবাই ওকে ইচ্ছামতো খোচাচ্ছে। কয়েকজন বলছে,
"আমরা তো ভেবেছিলাম জামান গে! যাক, ও প্রমাণ করল যে ও গে না!"
সবাই উচ্চস্বরে হাসছে। সবাই চলে আসার পর জামানের দুজন বান্ধবী আর মেহেরজান ফারহার কাছে গিয়ে বসল। ফারহাকে এভাবে দোপাট্টা দিয়ে মুখ ঢেকে থাকতে দেখে মেহেরজান হেসে দোপাট্টা টেনে ভালোভাবে মুখ ঢেকে দিল। কানে কানে বলল,
"বাসর রাতের আগে ঘোমটা তুলতে দিও না যেন!"
ফারহার অস্বস্তি লাগছে, লজ্জা না। এমনিতেই ওর লজ্জা নেই, কিন্তু এখন কিছু বলারও উপায় নেই। বারবার বাবা মায়ের চেহারা চোখের সামনে ভাসছে। একবার যদি দেখতে পেত!
ইরফানের ছোট ভাই এখানকার মসজিদের ইমাম। সেই বিয়ে পড়াচ্ছে। মেহেরজান ফারহার বাবার নাম লিখে নিয়ে গেল। যখন ওকে কবুল পড়াতে আসলো, তখন সবাই চাদর টেনে ধরল। ফারহার বুকের ভেতর কেমন যেন করছে, গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে ঝামেলা পাকাচ্ছে। বারবার শুধু ওর মায়ের কথা মনে পড়ছে। কে জানত এভাবে বিদেশ বিভূঁইয়ে একা পরিবারের কাউকে ছাড়াই জামানের অর্ধাঙ্গিনী হবে ও?
কবুল বলার পর এপাশ থেকে সবাই সমস্বরে আলহামদুলিল্লাহ বলে ওঠল। জামান এই শব্দ শোনার অপেক্ষাতেই ছিল। যাক বাবা, এই মেয়ে কবুল বলতে গিয়ে অন্তত গালাগালি করেনি! ফারহার পরে জামানের কবুল বলার পালা। জামান এক সেকেন্ডও সময় নেয় নি কবুল বলতে। ওর এক বন্ধু বলে ওঠল,
"জামান জন্মের পর থেকে কবুল বলার জন্য এতদিন বসে ছিল!"
জামান জবাব দিল,
"ভাই, নিজে তো বিয়ে শাদী করে পুরোদস্তুর সংসারী হয়ে গেছ, মজা তো এখন নিবাই! তোমাদেরই তো দিন!"
যদিও ওরা বাইরে খাবে ভাবছিল, ইরফান সেটা হতে দেয়নি। সে বাহির থেকে খাবার অর্ডার করে আনিয়েছে। যখন টেবিলে জামানের সাথে ফারহাকে বসাতে বলল, মেহেরজান সাফ মানা করে দিল।
"বউ এখানে আসবে না। তোমরা আর আমরা আলাদাভাবে খেয়ে নিব"
"আমরা মানে?"
"আমি আর ফারহা। আমরা ভেতরে খাবো। বাসরের আগে বর বউকে দেখতে পারবে না!"
জামান যে ভেতরে ভেতরে অসহিষ্ণু হয়ে আছে, তা ইতিমধ্যে সব পুরুষেরা টের পেয়ে গেছে। তারা আনন্দে হৈহৈ করে ওঠল। জামান হাত তুলে বলল,
"না, এসব তো আমি মানব না! ও আমার বিয়ে করা বউ। এখন তো আমার থেকে ওকে দূরে রাখা যাবে না!"
জামান চেয়ার ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করতেই তিন দিক থেকে তিনজন ওকে চেপে ধরল। একজন বলল,
"ভাই, বিয়ে তো হয়েই গেছে, আরেকটু নাহয় সবর করো! আমাদের এক সাথে অন্তত খেতে তো দাও!"
সবাই মিলে চারদিক থেকে জামানকে নিয়ে মজা করছে। মেহেরজান খাবার একটা প্লেটে নিতে নিতে জামানকে বলল,
"দেবরজী! গোস্যা যতই করো, বাসরের আগে বউকে দেখতে দিচ্ছি না। মনে করো, ওটা তোমার ভালোর জন্যই!"
মেহেরজানের চোখ টিপ দেয়া দেখে জামানের আরও অসহ্য লাগছে। ফারহাকে এক নজর দেখার জন্য মন প্রচন্ড ছটফট করছে। অথচ সবাই টের পেয়ে ওর দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে আচ্ছামত!
খাওয়া শেষ করে সবাই আড্ডা দিতে দিতে মাগরিব প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। মুসলিম যারা আছে, সবাই একত্রে জামাতে মাগরিব আদায় করল। জামান হুট করে বলল,
"আমাদের যাওয়া উচিত ইরফান ভাই!"
"মানে? কই যাবা তোমরা? থাকো আজকে এখানে?"
"না ভাই, সম্ভব না। যেতে হবে। এখানে থাকলে আপনাদের সমস্যা হবে"
"আরে নাহ, কিসের সমস্যা! আমরা তো প্ল্যান করেছি তোমাদের জন্য বাসর ঘর সাজাবো। এখন নিজের বাসায় গিয়ে কি করবা?"
"ভাই, হাতে এখনও সময় আছে। দুজনে একটু বাইরে ঘুরব। এখানে থেকে থেকে দম আটকে আসতেছে"
পাশ থেকে ফরিদ নামের বাঙালী বন্ধু বলল,
"ভাই, এখন নতুন ভাবীরে নিয়ের বের হয়েন না! জীনে ধরব!"
"ধুর ফাউল! হুদাই সবাই মিলে জ্বালাইতেছিস আমাকে। ইরফান ভাই, আমার উঠা দরকার"
ইরফান হেসে বলল,
"আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা তো এখন লিগ্যাল লাভবার্ড। তোমাদেরকে আটকে রাখলে আমাদের পাপ হবে! মেহের? আমাদের নতুন বউকে বরের হাতে তুলে দাও!"
মেহেরজান ফারহার হিজাব দিয়ে কায়দা করে ওর চেহারা ঢেকে নিয়ে আসলো।ঘর থেকে বের হওয়ার পর এক ঝলক দেখে জামানও হতাশ। তবুও ধৈর্য ধরে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রাখলো। আগে বউ নিয়ে এখান থেকে সরতে হবে। তারপর দেখা যাবে এত পর্দা হিজাব ঝড়ের তান্ডবে কোথায় যায়!
মোটামুটি সুন্দরভাবে বিদায় নিয়ে ফারহাকে ওরা জামানের গাড়িতে তুলে দিল। মেহেরজান ফারহার কানে কানে অনেক কিছু বলল, আর ফারহা শুধু মাথা ঝাঁকালো। জামান গাড়ি স্টার্ট করে যখন ইরফানের বাসার সীমানা পেরিয়েছে, তখন হাত বাড়ালো ফারহার মুখ থেকে হিজাব সরানোর জন্য। ওর হাতের সীমানায় আসার আগেই ফারহা ফট করে সরে গেল।
"কি হলো, চেহারা দেখাতে সমস্যা কি? মুখ খোলো?"
জামানের কন্ঠে বিরক্তি। ফারহা মাথা নেড়ে বলল,
"সময় হোক।এখন ড্রাইভ করেন আপনি। নাহলে এক্সিডেন্ট হবে"
"ঠিক আছে, তাহলে হাত দাও"
"ফারহার হাত নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরল। নরম হাতে খুব সুন্দর করে মেহেদী দিয়ে নকশা করা। জামান ওর হাত নিয়ে তাতে একটু পর পর চুমু খাচ্ছে, কখনো আঙুলের ফাঁকে আঙুল চালাচ্ছে, কখনো হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করছে। এসব দেখে হিজাবের ভেতর ফারহা মিটিমিটি হাসছে। একই সাথে ভালো লাগার অনুভূতি হাতের প্রতিটা নার্ভ বেয়ে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ফারহা এই অনুভূতির সাথে আগে কখনো পরিচিত ছিল না। আচ্ছা, বিয়ের কারণেই কি এই অনুভূতির জন্ম হয়েছে?
জামান ড্রাইভ করতে করতে রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করল।
"এখানে থামলেন যে? আমরা বাসায় যাবো না?"
"এখনই না। কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করব আমরা। তুমি নেমে দাঁড়াও"
ফারহা ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে আসার পর জামান ওর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটার গতি খুব দ্রুতও নয়, একেবারে ধীরেও নয়। প্রথমবারের পর ও আর হিজাব সরানোর চেষ্টা করেনি। জামান ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় ফেটে পড়লেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলো। কিছু জিনিস নির্দিষ্ট সময়েই ভালো লাগে, আর এজন্য অপেক্ষা করাটা হলো এক মধুর যন্ত্রণা। জামান অপেক্ষা করছে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের।
প্রায় তিন মিনিটের বেশি কিছু সময় হাঁটার পর ওরা একটা ব্রিজে এসে দাঁড়ালো। ফারহা হিজাব একটু সরিয়ে চারপাশ দেখে প্রশ্ন করল,
"কোথায় এখন আমরা?"
"এটা ব্রুকলিন ব্রিজ, আমার প্রিয় যায়গা গুলোর অন্যতম। যখনই মন খারাপ থাকে, তখন এখানে আসি"
"আজ কি মন খারাপ?"
"নাহ, মন খারাপ হবে কেন? আজ তো আমার সবচেয়ে খুশির দিন!"
ফারহার হাত ছেড়ে দুহাতে কোমর জড়িয়ে ধরল। নরম কন্ঠে বলল,
"অনেক তো পরীক্ষা দিলাম। এখন কি আমার প্রেয়সীর সাক্ষাত আমি পেতে পারি? আমি যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না!"
"এটা কি ঠিক সময়? এখানে মুখ খুললে..."
"আমিই তো দেখব। আশেপাশে তেমন কেউ নেই। যারা আছে, তাদের আমাদের নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি চাই, তুমি নিজের হাতে ঘোমটা সরাও"
ফারহা ধীর গতিতে হিজাব সরালো। ফারহাকে দেখে জামানের মনে হলো ২০০ ভোল্টেজের শক খেয়েছে। এজন্যই ভাবী ফারহাকে লুকিয়ে রাখছিল! তানাহলে দেখার সাথে সাথে ওর মাথা ঘুরে যেত। জামান যেন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে। ফারহার অধরে আঙুল ছুইঁয়ে দিতে ও মৃদু কেঁপে উঠল। নেশা জড়ানো কন্ঠে বলল,
"তুমি কি জানো খ্রিস্টানরা বিয়ের পর কেন কিস করে?"
"কেন?"
"আগের যুগে কিস করাকে কন্ট্রাক্ট সিল করা বুঝাতো। আমি আমার ভালোবাসার কন্ট্রাক্টে সিল দিতে চাই"
জামানের মুখ ওর দিকে এগিয়ে আসতেই ফারহা মুখ সরিয়ে অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,
"সবাই দেখবে তো!"
"কে দেখবে? কেউ দেখবে না"
"জামান..."
"শশশশ, আমাকে থামানোর কোনো শক্তিই এখন আর তোমার নেই"
জামানের স্পর্শ পাওয়ার সাথে সাথে ফারহা ভুলে গেল ওকে বাঁধা দিতে। ও ভুলে গেল ওরা এখন খোলা আকাশের নিচে একটা ব্রিজে রাতের শহরের আলোতে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের অজান্তে পরম সুখানুভূতিতে আত্মসমর্পণ করল। এই অনুভূতির কাছে পৃথিবীর কোনো বাঁধা টিকতে পারে না। আচ্ছা, আরও আগে কেন এই মুহূর্ত জীবনে এলো না? ফারহার গালে আর্লি ডিসেম্বরের তীব্র ঠান্ডা হাওয়া আঘাত করছে। অথচ জামানের তীব্র আলিঙ্গন আর ভালোবাসায় ওর বাহ্যিক সমস্ত অনুভূতি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। শরীরের প্রতিটি স্নায়ুকোষ আজ মন দিয়ে অনুভব করছে জামানের ভালোবাসার তীব্রতা।
চলবে...
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top