১৪

#অভিসারক_ও_অভিসারিণী
লেখা- #AbiarMaria

#১৪

সকালে জামানের ঘুম ভাঙলো ফারহার মৃদু ছোঁয়ায় আর কফির তাজা ঘ্রাণে। চোখ খুলে দেখলো ফারহা এক মগ কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
"আপনার জন্য বেড কফি। কাল কত কষ্ট করলেন আপনি, এজন্য আজকে আমিও একটু কষ্ট করলাম"
জামান ওর হাত থেকে কফির মগ নিয়ে সামনে টেবিলে রাখলো। সোফাতে খানিকটা সোজা হয়ে বসল সে। এখনো ঘুমে চোখ জড়ানো তার। ফারহা নিজের কফি নিয়ে কার্পেটের উপর বসে পড়ল। জামানের কাছে থাকা রিমোট নিয়ে টিভি অন করল। জামান চুপচাপ শুয়ে আছে। ফারহা আবার তার দিকে ফিরে বলল,
"কফিটা খেয়ে নিন, ঠান্ডা হচ্ছে তো"
"সকাল সকাল এত কষ্টের কি দরকার ছিল? তুমি আমাকে বললে আমিই তো বানিয়ে দিতাম"
"গতকাল থেকে সব আপনিই করছেন। আর কত কষ্ট দিব বলুন? জানেন, জীবনেও কারো গায়ে বমি করিনি। হয়ত ছোটবেলা করেছি, সেটা আলাদা। কিন্তু বুঝ হওয়ার পর কক্ষনো এমন অপকর্ম আমার দ্বারা সাধন হয়নি! ভাবতে পারেন? অনেক ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি আপনাকে আমি!"
"বিয়ে করলে তো আরও কত কি হত! এসব আর এমন কি। মেয়েরা এক আধটু এমন করেই"
"বিয়ে তো আর করিনি! আচ্ছা, আমাকে দেখলেই কি আপনার বিয়ের কথা মনে পড়ে?"

জামান কিছুটা নড়েচড়ে বসল।
"তোমার সাথে আমার কিসের সম্পর্ক বলো তো? আমরা কি বন্ধু? ভাই বোন? কাজিন? কলিগ? কি সম্পর্ক?"
ফারহা এক ঝলক দেখে মুখ ঘুরিয়ে আবার টিভি দেখছে। সে এই প্রশ্নের জবাব দিবে না, জামান জানে। জামান প্রসঙ্গ বদলালো।
"জ্বর আছে নাকি তোমার? শরীর ভালো লাগছে এখন?"
ফারহা ঠোঁট উল্টালো। জামানে নির্দ্বিধায় ওর কপালে, গালে হাত রাখলো,তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে হাত সরিয়ে নিল।
"টেম্পারেচার হালকা আছে। তুমি কি সবসময় এমন? জ্বর হলে উলটপালট আচরণ করো?"
"আমার জ্বর হয় না। শেষ কবে জ্বর এসেছিল জানেন? যেদিন আপনি আমেরিকা চলে আসেন। তার আগে যেবার এসেছিল, তখন আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী। ভয়াবহ জ্বরে পড়ে মরো মরো অবস্থা। আপনি যখন চলে যান, তখন তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল। আমি মনে হচ্ছিল মরে যাচ্ছি! অথচ আমি বারবার নিজেকে ছুঁয়ে প্রমাণ পাচ্ছিলাম, আমি বেঁচে আছি, ভয়াবহ কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি"

ফারহা নির্বিকারভাবে কথাগুলো বলছে। জামান ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করল,
"আমি চলে আসার দিন খুব কষ্ট পেয়েছিলে, তাই না? এজন্য আমাকে আর বিয়েই করলে না"
"হুম"
"বাদ দাও, ওসব পুরাতন কথা ভেবে আর কি হবে? যা হবার তা তো হয়েই গেছে। কষ্ট তো আমারও ছিল, আমি তো তোমার মত করে বলতে পারিনি, পারবও না। যাই হোক, জ্বর আসবে তো এখন আবার। আমি নাস্তা বানাচ্ছি, খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও। আজকে অফিসে একটা জরুরী কাজ পড়ে গেছে, কান্ট এভয়েড। তোমাকে একাই রেখে যেতে হচ্ছে। সমস্যা হবে তোমার?"
ফারহা ঠোঁট উল্টালো।
"কি আর সমস্যা হবে? বেশি হলে বমি করে বমির উপর উলটে পড়ে থাকব। আর কিই বা হবে!"
"আমি কল দিব এক/দুই ঘন্টা পর পর। কোনো সমস্যা হলে জানিও, আমি চলে আসব"

জামান উঠে বসল। কফিতে কয়েক চুমুক দিয়ে বলল,
"বাই দা ওয়ে, কফিটা ভালো বানিয়েছ। আর কিছু বানাতে পারো? রান্নাবান্না কিছু করা হত দেশে?"
"দেশে তো আম্মু আছে। রান্নাঘরে পাও ফেলিনি। মাঝে মাঝে গেলে আম্মু আমাকে অভিশাপ দিয়ে বের করে দিত"
"কেন? সব ধ্বংস করে আসতা?"
"কাইন্ড অফ!"
"শোনো, রান্না হলো একটা বেসিক লিভিং স্কিল। এই দেশে আসার পর সে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। ছেলে মেয়ে সবাইকে সবসময় রান্নার বেসিক জিনিসটা শিখে রাখা উচিত। তুমি যদি জানো, সেটা তোমাকে বাঁচতে সাহায্য করবে। এখানে আসার এক দেড় মাস পর্যন্ত শুধু সিদ্ধ নুডুলস আর ডিম ভাজি খেয়ে দিন পার করতাম। চা কফিও ভালো হত না, ভাত নরম হয়ে যেত। সেই নরম ভাত কোনো মতে গিলতাম। কান্না আসত, কিন্তু চোখ থাকত মরুভূমির মত শুকনো। সারাদিন কষ্ট করেও এইটুকু ভালো খাবারের যে অভাব ছিল, জীবনে মনে কখনো ভাবি নি যে এই খাবারটাই এত বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে! তোমরা তো দেশে ভালোই ছিলে। বাবা আছে, মা আছে, টেবিলে খাবার আছে, আলমারিতে ধোয়া কাপড় আছে। দিন শেষে প্রিয় মুখ গুলো দেখতে পারো, বাংলায় কথা বলার মানুষ থাকে। আর আমি? দিনের পর দিন একাকিত্ব এতটা গ্রাস করেছিল যে মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা হত!"

জামান ঠোঁট বাঁকা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফারহা এখনও টিভির দিকেই তাকিয়ে আছে। জামান উঠে দাঁড়াল। কফির বাকিটুকু শেষ করে বলল,
"নাস্তা আর লাঞ্চ রেডি করে দিয়ে যাচ্ছি, খেয়ে নিও। আনফরচুনেটলি আন্টি নেই, তাই তোমারটা তোমাকেই নিয়ে খেতে হবে। ওষুধও খেয়ে নিও। আর ফোন সাইলেন্ট করবে না"

জামান হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। ফারহা চুপচাপ কফি খাচ্ছে৷ খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে ওর। হুট করে মানুষটার উপর মায়া হচ্ছে, ভয়াবহ রকমের মায়া। এত মায়া ভালোবাসা ফারহা ভয় পায়। আচ্ছা, আবার ও জামানের প্রেমে পড়ে যাবে না তো? আবার আগের মত পাগলামি করবে না তো? কি হত যদি তখন একটু জামানকে বুঝত? আজকে আফসোস হত না। অনেক কষ্টে টিভির দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করে, যদিও সেটা আর সম্ভব না।

জামান নাস্তা আর লাঞ্চ তৈরি করে ফারহাকে নাস্তা খাইয়ে বের হল। যাওয়ার আগে বুঝিয়ে বলল যেন বাসা থেকে বের না হয়। সারা বাসা ঘুরে ঘুরে ফারহার হুট করে একাকিত্বকে আবিষ্কার করল। সত্যিই, বিদেশ বিভূঁইয়ে একটা মানুষ কত অসহায়। সে যদি না খায়, অসুস্থ হয়, গোসল না করে, তাকে নিয়ে ভাবার কেউ নেই, তাকে দেখার কেউ নেই। কিভাবে মানুষ বাঁচে একাকিত্বের রাজ্যে?

এরপরের দুই দিন এভাবেই কেটে গেল। জামান সব রান্না করে দিয়ে যায়, আর ফারহা সারাদিন টিভি দেখে আর খায়। মায়ের কাছে কল দিয়ে আস্তে আস্তে কথা বলে। উনি খুব অবাক হয়েছিলেন সেদিন জামানের কন্ঠ শুনে। ফারহা বুঝালো, জামান ওকে দেখতে এসেছিল শুধু। ফারহার মা জানেও না তার মেয়ে কোথায় আছে। জানলে মনে হয় না তারা সন্তুষ্ট হতেন। যে ছেলে এত অপমান পেয়েছে তার মেয়ের কাছে, সেই ছেলের সামনে যেতেও তো তার মেয়ের লজ্জা পাওয়ার কথা। অথচ কি অকপটে মেয়েটা জামানের আশ্রয়ে আছে! জামানও সব ভুলে ফারহার জন্য সবকিছু করছে। প্রতিদিনের বাজার থেকে রান্না করা, ডিশ ওয়াশ, লন্ড্রি, ফারহার ওষুধ খাওয়ানো, সব করছে। ফারহা কয়েকবার টাকা দিতে চেয়েছিল, জামান মানা করেছে। বলেছে, বাংলাদেশে যাওয়ার আগে ওর কাছ থেকে চেয়ে নেবে।

ফারহা ভাবছে শুধু, জামানের কাছ থেকে এত কেয়ার পাবে, তা ওর চিন্তার বাইরে ছিল। ভেবেছিল, গাইড হিসেবে সাহায্য করবে। এরচেয়ে বেশি কিছু ও আশা করেনি। যে ছেলে তার অসুস্থতা সামলাচ্ছে, তার এত যত্ন করছে, সে কি আজও ভালোবাসে ওকে? ঠিক কয়েক বছর আগের মত? ফারহার ভেতর খচখচ করছে। ওর উত্তর চাই, কিন্তু প্রশ্ন করা যাবে না। জামানের সামনে নিজের আর্গুমেন্ট যতবার উপস্থাপন করতে যায়, ততবার ওকে পিছিয়ে আসতে হয়।

দুই দিন পর ফারহা নিজের কাপড় লন্ড্রি করতে ঘর থেকে বের হলো। তখন দেখল জামানও কতগুলো কাপড় নিয়ে ওয়াশিং মেশিনের সামনে বসে আছে। ফারহার হাতে কাপড় দেখে বলল,
"তুমিও কাপড় ধুবে নাকি? আসো, তোমার গুলোও দিয়ে দিই"
ফারহা মনে মনে আৎকে উঠল। অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,
"ইয়ে মানে, না, থাক, আমার কাপড় আমি ধুবো"
"ঠিক আছে, তোমারটা তুমিই ওয়াশ করবে। এক সাথেই দিয়ে দিই, আমার গুলো আমি বের করে নিব, তোমারটা তুমি নিয়ে নিও। এটা অটো ওয়াশ, একবারে কাপড় ড্রাই হয়ে বের হবে। তাই সমস্যা নেই"
ফারহা আমতা আমতা করতে করতে কাপড় গুলো দিল। জামান সেগুলো মেশিনে দিতে দিতে বলল,
"ডু মি আ ফেভার। টেবিলের প্লেট, গ্লাসগুলো গুছিয়ে সিংকে রেখে দাও৷ আর সম্ভব হলে ধুয়ে ফেলো"

ফারহা টেবিল গুছিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে স্বগতোক্তি করল,
"মনে হচ্ছে যেন সংসার করছি। শুধু এক সাথে থাকাটাই বাকি আছে!"
পেছন ফেরার সাথে সাথে দেখল জামান দাঁড়িয়ে আছে। চুলোয় বাটার চিকেন বসানো, সেটা দেখার জন্যই ওর আসা। ফারহার মন্তব্য কি শুনে ফেলেছে?  জামানের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও শুনে ফেলেছে। জামান ওর কাছে এসে ফারহার এক পাশে ওর কোমরের কাছাকাছি দেয়ালে হাত রাখলো। মুখটা ফারহার বেশ কাছাকাছি আনলো। জামানের চোখের পাতা, ভ্রু, নাক, ঠোঁট জোড়া ফারহা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। জামান একবার ওর চোখ, একবার ঠোঁটের দিকে তাকাচ্ছে। ফারহা নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে। জামানের গরম নিঃশ্বাসটুকুও যেন ওকে গ্রাস করছে। ধীরে ধীরে মানুষটা বলল,
"চলো, সংসারের অপূর্ণতা পূর্ণ করে দেই। দু মাসের একটা সংসার হয়ে যাক আমাদের, লিভ টুগেদার। কি বলো? মাত্র দু মাস। তারপর তুমি তোমার বাসায়, আর আমি আমার বাসায়। দুজনের জীবন, রাস্তা সব আলাদা হয়ে যাবে। আফটারঅল, এত সুন্দরী রমনী দিনের পর দিন আমার সাথে একা বাসায় আছে, তার প্রতি লোভ হওয়াটা স্বাভাবিক না? অত্যন্ত স্বাভাবিক। কি, রাজি তুমি?"

ফারহার মাথা ঘুরাচ্ছে। ও যা শুনছে, তা কি সত্যি? নাকি কল্পনা?

চলবে....

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top