৩য় পর্ব

নিঝুম রিকশায় বসে চারদিক দেখতে দেখতে ভার্সিটিতে যাচ্ছিল। অদীয়ার ফোন পেয়ে মনোযোগটা হারাল ও।

চারদিকটা এখনও হালকা হালকা কুয়াশায় ঢাকা। গরমটা আসলে এখনও ভাল করে জাকিয়ে বসেনি। নিঝুম টিস্যু বের করে নাকের উপরে চেপে ধরল। কেন যেন ফোটায় ফোটায় পানি ঝরছে রাত থেকে। আজব, মনের দুঃখে চোখের বদলে নাক থেকে পানি পড়ে জানা ছিল না.. আনমনেই একটু হাসল নিঝুম। খুব বাজে একটা দিন গেছে কাল। সারারাত হাতের ব্যাথায় ছটফট করেছে ও। সাথে অপমান টাও সেই লেভেলের ছিলো। না.. আর ওই বিশ্রী লোকটাকে নিয়ে ভাববে না নিঝুম। কালকের দিনটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। জীবনে কতকিছুই তে পছন্দ হয়, সবই কি আর পাওয়া যায়? সকালেই মাত্র নিজের কাছে ওয়াদা করেছে ও ব্যাপারটা মুছে ফেলবে মন থেকে।

ক্যাম্পাসে লোকজন সবেমাত্র আসতে শুরু করেছে। নিঝুম রিকশা থেকে নেমে বাংলা ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অদীয়াকে হোস্টেলের গেটের কাছে দেখে হাতের ইশারায় ওকে দাঁড়াতে বলল নিঝুম। অদীয়াকে মনের দুঃখ না বলা পর্যন্ত ওর দুঃখ কমবে না, আর কালকের ঘটনাটা ভোলা ওর জন্য জরুরি। সাত সকালে তাই নাস্তা না করেই বের হয়েছে নিঝুম।

বেলা দশটা পর্যন্ত অদীয়ার সাথে ওর রুমে বসে কাটিয়ে দিল নিঝুম।

সব শুনে অদীয়াও একটু মন খারাপ করল। তারপর নিঝুমকে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে, "দেখ নিঝু, ওই ছেলে তোর জন্য নয়। তা না হলে পাঁচশ মাইল দূর থেকেও ও তোর কাছে ঠিক চলে আসত।"

নিঝুম নিজেও সেটা বিশ্বাস করে। তারপরও মন খারাপটা যাচ্ছে না। অদীয়ার সাড়ে এগারোটায় একটা ক্লাস আছে। নিঝুমেরও, কিন্তু ওর করতে ইচ্ছে করছে না। শাইনিকে ফোন দিলে ওর ছোট বোন ধরল। শাইনি ব্যাস্ত... ওর চাচা এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। অদীয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিউমার্কেটে একাই আসতে হলো নিঝুমকে।

নতুন কিছু রান্নার বই এসেছে। মন খারাপটা কমে গেল নিঝুমের। সুযোগ পেলেই নতুন নতুন রেসিপি দেখে রাঁধতে চেষ্টা করে ও। মার মত অত ভাল হয়না যদিও তবু নিঝুম চেষ্টা করে। ওর বাবা আর আশু খুব আগ্রহ করে সেগুলো খায়, তাতেই ওর আনন্দ।

সাড়ে আটশ টাকা দাম হয়েছে দুটো বই মিলে। নিঝুম ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিতে গিয়ে থমকে গেল। কেউ একজন ওর আগেই  দোকানদারকে টাকা বের করে দিয়েছে, এক হাজার টাকার আস্ত একটা নোট। নিঝুম প্রথমে এক হাজার টাকার নোটটা, নোট থেকে লোকটার হাতটা আর তারপর লোকটার পুরো অবয়বটাকে দেখল। প্রথম কয়েক সেকেন্ড ওর মাথা কাজ করেনি। কিন্তু তারপর লোকটার মুখের মুচকি হাসি দেখে ওর ভেতরটা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। কত্তবড় সাহস এই লোকটার। কালকে একদম চিনতেই পারলনা আর এখন এসেছে দরদ দেখাতে। ওর মনে হচ্ছিল টাকাটা লোকটার মুখে ছুড়ে মারে। কিন্তু না,নিঝুম নিজেকে বোঝাল, তা করব কেন? লোকটাকে অত পাত্তা দেওয়ারই বা কি আছে?

নিঝুম সাথে সাথে ওর মুখের শক্ত হয়ে যাওয়া পেশিগুলোকে শিথিল করল। তারপর দোকানদারের দিকে নিজের সাড়ে আটশ টাকা এগিয়ে দিল।

দোকানদার এবার একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। দুজনেই টাকা বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা একবার নিঝুম আর একবার সামনে দাঁড়ানে লোকটার দিকে তাকাচ্ছে। দোকানি যে উত্তরটা নিঝুমের কাছ থেকেই চাচ্ছে..... সেটা বুঝতে পেরে নিঝুম বলে উঠল," কি হলো টাকাটা নিন। "

কিন্তু দোকানদার নিঝুমের হাত থেকে টাকা নেওয়ার আগেই অসভ্য লোকটা চট করে দোকানদারের কানে কানে ঝুকে কি যেন বলল, এরপর আস্তে করে লোকটার পকেটে টাকাটা গুঁজে দিল।

বইয়ের দোকানদার নিঝুমের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল," ম্যাডাম আবার আসবেন। সামনের সপ্তাহে আরও কয়েকটা রান্নার বই আসবে।"

নিঝুমের চোখদুটো এবার মতো হলো। কি ভাবে এই লোক নিজেকে? সরকারি অফিসার বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে? নায়কের ভাব দেখো... আবার সানগ্লাসও পরেছে। এক নজরে অরন্যের ড্রেসআপটা একটু দেখে নিল নিঝুম। এই লোক পুলিশ কি করে হয়, মাথায় আসছেনা নিঝুমের। কালকেও একটা কালো শার্টে ছিল, আজকেও কালো গেঞ্জি। মনে হয় ডেমন কিং!

নিঝুমের লাল লাল মুখটা দেখে অরণ্যর কি ভীষন লোভ হচ্ছিল গালটা ছুঁয়ে দেখার। কথায় আছে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ... কিন্তু উল্টো পুলিশের মন ছুঁয়ে দিলে তার শাস্তি কি হওয়া উচিত? মুখ টিপে আবারো হেসে ফেলল অরণ্য।

নিঝুম বই দুটো হাতে নিয়ে সোজা নিউমার্কেটের দ্বিতীয় সারিতে ঢুকে পড়ল। মনটা শান্ত করা দরকার। হাটতে হাটতে একটা ইমিটেশনের গয়নার দোকানের পাশে গিয়ে দাঁড়াল ও। অক্সিডাইসডের এক জোড়া ঝুমকো খুব পছন্দ হলো নিঝুমের , কিন্তু ও সেটা দেখেই আবার রেখে দিল। অরণ্য ঠিক ওর পিছে পিছে এসেছে। আবার যদি লোকটা কোন কিছুর দাম দিয়ে দেয় তাহলে খুব বিশ্রী একটা ব্যাপার হবে, কিন্তু নিঝুম তো ওর পিছুও ছাড়াতে পারছেনা।

নিঝুম বুঝতে পারছেনা ওই লোক ওর পিছে পিছে কেন ঘুরছে? মনে হয় এই লোকের কোন প্রেমিকা আছে। আচ্ছা অরণ্যর পরিবার কি ওই মেয়েকে মেনে নিচ্ছে না ? অরণ্য কি নিঝুমের কাছে কোন সাহায্য আশা করছে? মনের ভেতরে ওর হাজারো প্রশ্ন ঘুরতে থাকে।

অরণ্য আসলে ওর কাছে কি চায়? ওকি কোনভাবে নিজেকে দোষী ভাবছে? না, সেটার তো কোনো প্রয়োজন নেই। বিয়ে কি মুখের কথা? আর অরণ্যর ওকে ভালো লাগেনি তাতে কি এমন হয়েছে ? দুনিয়ায় কি ছেলের অভাব?

এদিকে লোকটা ওর পিছে পিছে হাটছে তো হাটছেই... খুব অস্বস্তি লাগে নিঝুমের। ও আর নিজেকে আটকাতো পারেনা। হুট করে দাঁড়িয়ে যায় রাস্তার মাঝেই। কিছু না বললে তো একেবারে চলছেই না।

ওকে থেমে যেতে দেখে পিছন থেকে হেটে পাশে এসে দাঁড়াল অরণ্য।

"কোনো সমস্যা?" অরণ্যর গলায় উৎকন্ঠা। 

নিঝুমের কেমন যে লাগল, শব্দগুলো ঠিক ওর বুকের ভেতরের কোন একটা গোপন কুঠুরিতে গিয়ে আঘাত করল। লোকটা ওর সাথে এমন আচরন কেন করছে?

এই লোক চায় কি? ওকে মেরে ফেলতে? একবার ওকে পাশে দাঁড়িয়ে অভয় দেয়, আবার কিছু সময় পরে সেই লোকই ওকে আস্তাকুঁড়েতে ছুড়ে ফেলে। এ কেমন আচরন? অভিমানে ঠোঁটদুটো এবার একটু ফুলে ওঠে নিঝুমের।

অরণ্যর মনে হচ্ছিল গোলাপি ঠোঁট দুটো আসল তো? গোলাপির সাথে ঈষৎ লাল রঙ জমা হয়েছে ঠোঁটের এক কোনে। আসলে নিঝুম ওর নিচের ঠোঁটের এক প্রান্ত উপরের দুই দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছে। দাঁত দুটো এমন ভঙ্গীতে ঠোঁটদুটোকে চেপে ধরেছে যে, অরণ্যর পাগল পাগল লাগে। কি করবে ও... নিঝুমের ঠোঁটের সৌন্দর্য কোনো অংশেই একটা গোলাপের থেকে কম না।

এরকম হলেতো অরণ্যর জন্য সহ্য করা মুস্কিল। এই মেয়ে কি ওকে এখনই মারতে চায়? বড্ড ভালোবাসতে ইচ্ছে হচ্ছে যে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

"আপনি কি চান বলুন তো? " নিঝুম আর সহ্য করতে পারেনা। এত অপমান করল কাল, তাও মন ভরেনি নাকি? আরও করবে?

নিঝুমের ঝাঁঝাল স্বরে তটস্থ হলো অরণ্য। এই রে এবার বোধহয় ওর আকাশে ঝড় উঠবে। নিঝুমের চোখে কালবৈশাখীর ঘনঘটা দেখতে পাচ্ছে ও স্পষ্ট। কেন যেন মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে বুকটা খামচি দিয়ে উঠল ডাকসাইটে অফিসারের। এই মেয়ে ওকে ঠিক বিপদে ফেলবে.... না না ভুল হলো, অলরেডি বিপদের মধ্যেই আছে ও। এই মেয়ের চোখের টলটল পানিতে হৃদয় হাহাকার হওয়ার অবস্থা হচ্ছে ওর। আবেগ গুলো সব বাঁধন ছাড়া মেঘের মত উন্মাতাল হয়ে যাচ্ছে। কথার উত্তর কি করে দেবে?

এই মুহুর্তে এখানে অসংখ্য লোক। কেউ ওদের দেখছে কি না জানে না নিঝুম। কিন্তু তার পরেও লোকটার সম্মানটা মাটিতে মিশাতে একটু বাঁধল নিঝুমের। তাই নিজেই বলল," আমার কিছু কথা আছে আপনার সাথে।"

অরণ্য যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ও তো ভেবেছিল কে আপনি... কাকে চান বলবে। একেবারেই না চেনার ভান যে করেনি, সেটাই অনেক বড় ব্যাপার ওর জন্য।

"এখানেই বলবে? কোনো রেস্টুরেন্টে বসি?" অরণ্য আস্তে করে বলল। ওর কেন যেন খুব অপরাধী লাগছে নিজেকে। নিঝুমের চোখগুলো কেমন ফোলা ফোলা। কান্নাকাটি করেনি তো? ওর জন্য যদি ঝুমের মন খারাপ হয় তাহলে, নিজেকে একদমই ক্ষমা করতে পারবেনা অরণ্য।

"না না কোনো রেস্টুরেন্টে যাবো না। হাটতে হাটতে বলি," নিঝুম কথাটা বলেই হাটা শুরু করল। অগত্যা অরণ্যকেও ওর পিছু নিতে হল।

খানিকটা সময় উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হাটার পর, নিঝুম মুখ খুলল, " একটা সত্যি কথা বলুন তো, আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন? না মানে আপনি আসলে কি চাচ্ছেন, আপনার হয়ে আপনার মাকে কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে?"

নিঝুমের কথায় অরন্য হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারলনা। বলে কি এই মেয়ে...?

ভালোবাসা.. সেটা নিয়ে খানিকটা দ্বিধা হয়ত ওর এখনও আছে। তবে জীবনসঙ্গী হিসেবে নিঝুমকে ওর চাই। এটা নিয়ে ওর এখন আর কোনো দ্বিধা নেই। ভাল লাগাটা যখন আছে,
ভালোবাসাটা না হয় বিয়ের পরেই হবে। এখন স্রেফ একটু আধটু চেনা জানা হলেই যথেষ্ট।

"আপনি কি আমার প্রশ্নের উত্তরও দিবেন না? " নিঝুমের স্বরে এবার অভিমান টের পেল অরণ্য। ইশশসস... কত বড়ো ভুল যে হয়ে গেছে কালকে। পাগলিটার অনেক অভিমান হয়েছে নিশ্চই। অবশ্য কালকে ওর সাথে যা হয়েছে, তাতে অভিমান না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।

"নিশ্চই দিব, কি জানতে চাও বলো? " অরন্যর কথাগুলোতে কি আছে ওই জানে। নিঝুমের মনটায় আবার এক পশলা বৃষ্টি হলো। অরন্য ওকে আপনি না বলে সরাসরি তুমি বলছে। নিঝুম শুনেও সেটা না শোনার ভান করল। অরন্য এমন ভাবে কথা বলছে যেন ও নিঝুমের খুব কাছের কেউ।

নিঝুমের চোখদুটো আপনা থেকেই ভিজে আসতে চাইছে । কেন যে এত কষ্ট হচ্ছে ওর? মনের হাটের বিকিকিনিতে এত সহজেই ঠকে গেল ও?  রাগটা তাই নিজের উপর সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। কিন্তু ভুলতে তো ওকে হবেই।

"আপনি বোধহয় কাউকে ভালোবাসেন.. তার নামটা কি বলা যাবে? " নিঝুম লক্ষ্য করল লোকটার চোখেমুখে খুশির একটা আভা ফুটে উঠেছে। ইশশ... চোখদুটো কেমন হেসে উঠল। এক সেকেন্ডের জন্য ঈর্ষায় জ্বলে গেল নিঝুম। মেয়েটা কি অনেক বেশি সুন্দরী? পর মুহূর্তে নিজের মনের উপর রাশ টানল ও। ছি! কি সব ভাবছে ও। আসলে কালকে অ্যাকসিডেন্টটা হওয়ার পর থেকে মাথা বিগড়েছে ওর। কারও ব্যাক্তিগত জীবনে নাক গলান খুব খারাপ কথা। মনে মনে নিজেকে বাজে একটা গালি দিল নিঝুম।

"তা তো মনে হয় বাসি, কিন্তু সে বাসে কিনা বুঝতে পারছিনা। "

অরণ্যর এমন স্পষ্ট আর সাবলীল উত্তরে খেই হারিয়ে ফেলল নিঝুম। সে জন্যই তাহলে ওরকম আচরন করেছে কালকে। তা ওরকম না চেনার ভাব না করে ওকে বলে দিলেই তো হতো। ওকি ওকে জোর করে ধরে বিয়ে করত নাকি? এতই ছোটলোক ভাবে ওকে? কিন্তু অরণ্যর উত্তরে তো মনে হয় ওই মেয়ে ওকে ভালোবাসেনা..... তাহলে?

"কেন তাকে জিজ্ঞেস করেন নি? "

অরণ্য এবার সানগ্লাসটা চোখ থেকে নামিয়ে ভাঁজ করে পকেটে ভরল। আজকে কালো শার্টের সাথে ডীপ ব্রাউন কালারের প্যান্ট পরেছে ও। নিঝুম আড়চোখে একবার অরন্যকে দেখে চোখ সরিয়ে নিল। এত রাগ হয় নিজের উপর। এত কিছুর পরও কি করে ওই লোককে চুরি করে দেখতে ইচ্ছে হয় ওর.... দুই গালে দুটো জুতোর বারি পড়া উচিত ওর।

"তুমি অভয় দিলে জিজ্ঞেস করতে পারি... করব?"

অরণ্যর কথায় এবার সব তালগোল পাকিয়ে গেল নিঝুমের। লোকটা কি ইচ্ছে করে এরকম ফাজলামো করছে ওর সাথে। আর এরকম একটা বিষয় নিয়ে কেউ ফাজলামে করে? খুব রাগ হলো নিঝুমের অরণ্যর উপর। হঠাৎ বলেই বসল,"এত প্যাঁচানোর কি দরকার? সোজাসুজি বললেই তো হয় যে, আপনার মনের মানুষ আছে। আর আপনি তাকে অনেক ভালোবাসেন। তাহলে তো আর বাবা - মাকে মানুষের সামনে অপদস্ত হতে হয়না। "

অরণ্য বেশ উপভোগ করছিল নিঝুমের অনুযোগে ভরা কথাগুলো। এহ এটা তো একদম বাপ সোহাগী। এইটুকু কথা বলতে গিয়ে নাক মুখ ফুলিয়ে কি অবস্থা করছে দেখো।

"তুমি বুঝলে কি করে যে আমি তোমাকে ভালবাসি? আমি তো একবারও বলিনি।" অরণ্য নিজের হাতদুটো বুকের কাছে বেঁধে খুব গম্ভীরমুখে জানতে চাইল... যেন নিঝুমের চুরি ওর কাছে ধরা পড়ে গেছে।

নিঝুম উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গেল। কি বলল লোকটা? ও কখন বলল যে ও অরণ্যকে , না মানে ওই লোক ওকে ভালোবাসে। ওতো ভালো করেই জানে যে ওই লোক ওকে কথা বলার মতোও পছন্দও করেনা।

"দেখুন আমি একবারও এই কথা বলিনি, আপনি ভুল শুনেছেন।"

"ভুল আর আমি!.. ইম্পসিবল। আমি পরিষ্কার  শুনেছি যে তুমি বললে, আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন? " অরন্য ভীষন মজা পাচ্ছে এখন। কাঁদুনে বুড়ি রেগে মেগে দেখো কেমন বীটের মতো লাল হচ্ছে।

"হ্যাঁ তা তো করেছি। কিন্তু আপনি আমাকে ভালোবাসেন সে কথা কখন বললাম? আজব মানুষ তো আপনি," প্রায় ফুঁসে উঠে নিঝুম।

লোকটা একদম একটা ইয়ে.... কি বেহায়ার মত কথা এগুলো। ও কখন ওই কথা বলেছে? নিঝুম আবার হাটতে শুরু করল কিন্তু পেছন থেকে হাতে টান পড়তেই থেমে যেতে হলো ওকে। লোকটার কি মাথা খারাপ, এত লোকের মধ্যে ওর হাত ধরে টানছে কোন সাহসে?

"যাচ্ছো যে বড়ো," অরণ্য সত্যি ওর হাতটা টেনে ধরেছে। অনেকক্ষণ ধরেই ধরতে চাচ্ছে। সেই কাল দুপুরের পর থেকে আর একবারও তো ধরার সুযোগ পায়নি। বিয়ের পর একদিন সারাদিন এই পাগলী বৌয়ের হাত ধরে বসে থাকবে অরণ্য।

"তার মানে? " নিঝুম হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নিল জোরের সাথে। এই হাত ধরার অধিকার ওই লোকের নেই, সেটা ওই লোককে বুঝিয়ে দিতে হবে আজ।

"মানে আমার এক রাজকন্যা ভারি পছন্দ হয়েছে। মনে মনে আমিতো তাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি, কিন্তু মেয়েটা একদম ছিচকাঁদুনে টাইপের আর কিছু বলার আগেই রেগে ফুলে ঢোল হয়ে যায়, আর... আর মাথায় বোধহয় বুদ্ধিসুদ্ধি তেমন নেই," অরণ্য মুখ মুছতে মুছতে বলল। এত গরম, বললাম যে কোনো রেস্টুরেন্টে চলো। কিন্তু নাহ এই মেয়ের এই রাস্তাই পছন্দ।

আসলে অরণ্য ভুলেই গিয়েছিল যে এই মেয়ে কালকে ওকে কায়দা করে বাসার ঠিকানা দেয়নি। তোর লাইফ শেষ অরণ্য... দুনিয়ায় আর কেউ তোর নজরে পড়লো না।

"আপনি কি বলুন তো? কাউকে পছন্দ করেন খুব ভাল কথা কিন্তু তাহলে আমার সামনে তার
নামে আবার বদনাম করছেন কেন? বলার সাহস থাকে তো তার কাছে গিয়ে বলুন।"

কষ্ট আর অভিমানে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে নিঝুমের। ওর সামনে এভাবে ওই মেয়ের কথা না বললেই কি হত না? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই কথাগুলো শোনান এতই জরুরি।

"তার সামনেই তো বলছি," অরণ্য আরও সিরিয়াস চেহারা করে বললো। মনে হচ্ছে কোন বিজনেসের ডীলিং হচ্ছে এখানে... আবহাওয়া একদম থমথমে,গুমোট।

নিঝুম টের পেল ওর কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করছে।
এই কথা বলে অরণ্য কি বোঝাতে চাইছে? তার সামনেই বলছে মানে? অরণ্য কি বলতে চাইছে যে, নিঝুমকে ওর পছন্দ! কিন্তু তা কি করে হয়?
লোকটা নিশ্চই কোনো প্যাঁচ কষছে। কিন্তু এই কথার তো ওই মানেই হয়। লোকটা এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত কথা কেন বলছে... একটার পর একটা আজগুবি কথা বলে ওকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে। না আর দাঁড়াবে না নিঝুম। এক্ষুনি বাসায় যাবে। কিন্তু তার আগেই অরণ্য আবার ওর ডান হাতটা ধরে ফেলল।

নিঝুমও আর পারছিলনা,বেশ একটু চেচিয়ে বলে উঠল, "মেয়েদের আপনারা কি মনে করেন বলুন তো? ইচ্ছে হলে কথা বলবেন, ইচ্ছে না হলে বলবেন না? আর আপনি কথায় কথায় আমার হাত ধরছেন কোন সাহসে?"

একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করে হঠাৎ হুশ হল নিঝুমের। আশে পাশের লোকগুলো সব কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

অরণ্যর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলল নিঝুম। কেমন একটা অপ্রস্তুত ভাবে তাকিয়ে আছে অরণ্য ওর দিকে। কিন্তু নিঝুমই বা কি করে....বার বার এই ধরনের কথা বললে সহ্য হয়। ওর কি মান অপমান বলে কিছু থাকতে নেই।

"আই এ্যাম সরি," নিঝুম নিচু স্বরে মাফ চাইলো।

অরণ্য কোনো উত্তর দিল না।

" আমি এখন যাব," বলেই নিঝুম আর দাঁড়াল না। এক নাম্বার গেটের কাছে আসতেই অরণ্যর ডাকে আবার থামতে হল ওকে।

"নিঝুম প্লিজ,দেখো আমাকে দশটা মিনিট একটু সময় দাও।"

অরন্যের কথায় উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল নিঝুম। একটু কেন..... ওতো পুরো জীবনটাই দিতে চেয়েছিল, একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে নিঝুমের বুকের অন্তস্থল থেকে।

"আর একটা অনুরোধ... প্লিজ না করবে না, আমি এই গরমে আর দাঁড়াতে পারছিনা। তোমার পছন্দের কোনো ক্যাফে আাশেপাশে থাকলে চলো। "

অরণ্য এখন এখান থেকে সরে যেতে চাচ্ছে। লোকজন বার বার কৌতুহল নিয়ে তাকাচ্ছে ওদের দিকে, ব্যাপরটা খুবই অস্বস্তিকর।

নিঝুম মাথা নাড়ল,"দেখুন আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। আপনার খুব কষ্ট হলে বড়জোর ওই সামনের চটপটির দোকানে ঢুকতে পারি। এছাড়া অন্য কোথাও আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।"

অরণ্য শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে সামনের দোকানটাতে গিয়েই বসল। নিঝুম কিছু খাবে কিনা জানতে চাইল নিঝুম মাথা নেড়ে না বলল। কিন্তু একটু পরে ওয়েটার ছেলেটা এসে কি খাবে জানতে চাইলে এবার বেশ লজ্জায় পড়ে গেল নিঝুম। চটপটির দোকানের কথা বলার সময় ওর মাথাতেই ছিল না ব্যাপারটা। শেষ পর্যন্ত এক প্লেট চটপটি আর এক গ্লাস লাচ্ছির অর্ডার করল অরণ্য।

"আপনি কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কথাটা প্লিজ তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন। আমি বাসায় যাব।"

নিঝুমের অস্বস্তি হঠাৎ বেড়ে গেল। ও এই লোকের সাথে এই দোকানেই বা কেন আসল? একদম উচিৎ হয়নি। বড় ফুপি জানতে পারলে খুব রাগ হবে, আম্মুও। নিঝুমের মনে হলো কিছু একটা অজুহাত দিয়ে ওর বের হয়ে যাওয়া উচিত এক্ষুনি।

"বলছি.. জাস্ট পাঁচ মিনিট ওয়েট করো। জরুরী একটা ফোন করে নেই," অরণ্য কথাটা বলেই  পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা ফোন করল। ওয়েটার ততক্ষণে চটপটির প্লেটটা নিঝুমের সামনে এনে দিয়েছে। নিঝুম চুপ করে বসে ছিল, খুব ঝামেলায় পড়া গেল তো। অরণ্য নিঝুমের মনোভাব বুঝতে পেরে হাতের ইশারায় ওকে খেতে বলল।

"কি হলো চটপটি পছন্দ নয়? অন্যকিছু দিতে বলব?" অরন্যর কথায় মায়া জড়ান। কালকেও ছিল... কিন্তু শুধু দুপর বেলায়। নিঝুম মাথা নিচু করে মাথা নাড়ল। আবার কষ্ট হচ্ছে। নিঝুমের থেকে থেকে কান্না পাচ্ছে। অরণ্যর সাথে আর কখনও হয়ত দেখা হবে না। কিন্তু এই সময় টুকু নিঝুম ওর স্মৃতিতে যত্ন করে রেখে দেবে। অরণ্যর কাছে হয়ত এটা কিছু না কিন্তু ওর কাছে অনেক কিছু।

নিঝুম যতটা পারে মাথা নিচু করে চটপটির বাটিটা টেনে নিল। মুখে নিয়ে গিলতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে ওর... চটপটিটা বেশ ঝাল। একটাই সুবিধা, চোখের পানিটা, ঝালের কারনে পড়ছে বলে চালিয়ে নিতে পারবে।

"নিঝুম আমি জানি তুমি আমার উপর খুব রেগে আছো," কথাটা বলে একটু বিরতি নিল অরণ্য।নিঝুমের মনোভাবটা ওর সত্যি জানা দরকার। অরণ্য এক কথার মানুষ। একবার নিঝুমকে কথা দিলে নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সেটা রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে ও। কিন্তু নিঝুম কি সত্যি ওর সাথে ঘর বাঁধতে চায়? ওর জীবনে বিপদ হলো নিত্যসঙ্গী। রাত দুপুর নেই বাসার বাইরে পরে থাকতে হয়। এসব সহ্য করতে পারবেতো নিঝুম।

নিঝুম অরণ্যের কথায় খাওয়া ফেলে তাকিয়ে রইল। যদি বুঝতেই পারছে, তাহলে জিজ্ঞেসই বা কেন করছে? কিন্তু সব কথা তো আর সবাইকে বলা যায়না।

"নিঝুম কালকে তোমাদের বাসায় যা হয়েছে, ওটা একদমই আমার হাতে ছিলনা। আমি যদি জানতাম ওটা তুমি, আমি যে করে হোক ওখানে যেতাম বিশ্বাস করো।"

অরণ্যর কথায় নিঝুমের আক্কেলগুড়ুম। বলে কি এই লোক! যেতাম মানে? পাগল নাকি? কালকেই তো ওদের বাসা থেকে খেয়ে বের হলো ওরা সবাই!

নিঝুমের চোখমুখের অভিব্যাক্তি বলে দিচ্ছিল, নিঝুম ওর কথা কিছুই বুঝতে পারছেনা।
অরণ্য নিঝুমকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই নিঝুমের বিস্ফোরিত চোখ বলে দিল, তার হয়তো আর প্রয়োজন হবে না।

নিঝুমের মনে হলো ওর চোখের কোন মেজর প্রবলেম দেখা দিয়েছে, তা না হলে ওর চোখের সামনে দু দুটো অরণ্য হয় কি করে ?

কিন্তু অদ্ভুত হচ্ছে এক চোখ বন্ধ করেও  নিঝুম তাই দেখল!

অদ্ভুত না?

একই সময়ে একটা অরণ্য ওর সামনের চেয়ারে বসে ওকে মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছে আর আরেকটা অরণ্য ওর দিকে সোজা নাক বরাবর হেটে আসছে!

চলবে...........

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top