#৯

#প্রাপ্তি

#৯

রশ্নী চুপচাপ গাড়িতে বসে আছে,বাসার ভেতর যাবে কি যাবে না,সে দ্বিধায় ভুগছে।তারপরও লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ও বাইরে পা রাখে।রহস্যের শেষ যে ওকে দেখতেই হবে!

বিরাট ওঠোন ওয়ালা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কেমন অদ্ভুত লাগল।আশেপাশের বাড়িগুলোর সাথে এর মিল কম।আজকাল চারপাশে বেশির ভাগ নতুন ধাঁচের বাড়ি,তার মাঝে এটি বেশ পুরোনো। জানালায় থাই গ্লাসের বদলে আগের দিনের ছিটকানি লাগানো সিস্টেম। বাড়ির রঙও খসে পড়ছে প্রায়,বিভিন্ন যায়গায় যায়গায় শ্যাওলা ছত্রাক বেড়ে উঠছে।ওঠোনের ডান পাশে বড় বড় তিনটা নারকেল,আম আর বরই গাছ,আরেকদিকে বিশাল বকুল গাছ,লতায় পাতায়,পরগাছায় পরিপূর্ণ।তবে নজর উপর দিক থেকে নিচের দিকে আনলে বেশ বোঝা যাচ্ছে যে আজকের পরিস্থিতি অন্যান্য দিন থেকে আলাদা।সবাই সাদা বসনে নিজেকে আবৃত করে রেখেছে,ভেতর থেকে আগরবাতির ঘ্রাণ,ধোঁয়া,পূজা অর্চনার ঘন্টা আর মন্ত্র,মানুষের উপস্থিতির হালকা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।রশ্নী সাবধানে বাড়ির আঙিনায় ঢুকে পড়ে,মূল উদ্দেশ্য সকলকে দেখা।কে বা কারা এর সাথে জড়িত,কেন এমন নির্মম ঘটনা ঘটল,তা জানতেই হবে।

রশ্নী মাথায় ওড়না চাপিয়ে মুখে হাত দিয়ে মানুষ ঠেলে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে।কেউ ওর দিকে সন্দেহ বা অবাক চোখে দেখছে না,সবার চোখ হাতে ডান দিকের পূজোর ঘরের দিকে।সেখানে দেবতা শ্রীকৃষ্ণের মূর্তির সামনে বসে পন্ডিত মশাই মন্ত্র পাঠ করছেন,সামনে শুধু ধুতি পরিহিত পুরো টাক মাথার এক লোক বসে আছে।দেখে তার বয়স ষাটোর্ধ বলে মনেই হয় না,বরং মনে হয় এই বুঝি পঞ্চাশে পা দিয়েছে।শক্ত বলিষ্ঠ পেটানো দেহ,দেখে বোঝা যায়,সে নিয়মিত ব্যায়াম করে।মুখ একেবারে শক্ত করে রেখেছেন,কাঠিন্যপূর্ণ চেহারায় তার নাকের নিচের পুরু গোঁফ আভিজাত্য ফুটিয়ে তুলেছে।হাতে তার পূজোর সরঞ্জাম,মুঠোয় কি সব ডালপালা নিয়ে মোচড়াচ্ছেন আর পন্ডিতের সাথে সাথে বিড়বিড়িয়ে মন্ত্র পাঠ করছেন।রশ্নী ধারণা করে,এ পূজার বাবা শিমুল মন্ডল।তার আর পন্ডিত মশাইয়ের মাঝে বেদীর সাথে ঠেস দিয়ে একটা মেয়ের সহাস্য ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা,তাতে মালা ঝোলানো।ছবির মেয়েটাকে এক নজরেই চেনা যায়,পূজা মন্ডল।রশ্নী সন্তর্পনে নারীদের সাথে একপাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। একজন মহিলা মুখে কাপড় চাপা দিয়ে এক কোণায় বসে আছে,চোখ মুখ বেশ ফোলা।রশ্নী ধারণা করে,এ-ই হয়ত মৃতার মাতা, পরমিতা মন্ডল।কিছুক্ষণ পরে এক যুবককে দেখে শিমুল মন্ডলের কানে কানে কিছু একটা বলতে।মাথা ভর্তি চুল সমৃদ্ধ ঠিক বাবার মত গোঁফওয়ালা যুবক যে রাজীব মন্ডল,এতে কোন সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।তবে শিখাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না,অথবা রশ্নী ঠিক ধরতে পারছে না কে শিখা। এক কোণায় দাঁড়ানো রশ্নীর অনুসন্ধিতসু চোখ জোড়া পরিবারের বাকি সদস্যদের খুঁজে বেড়ায়।

এখানে আসার আগে মন্ডল পরিবার নিয়ে রশ্নী ভালোভাবে জেনে এসেছে।দুবোন,এক ভাই ওরা,রাজীব,পূজা আর শিখা।বাবা,মা, ঠাকুর মা, আর এক কাকু আছে।ওর কাকুর বিয়ে হয়নি এখনো তাই ওদের সাথেই থাকে,ব্যবসায় সাহায্য করে।ওদের পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই ভারতে থাকে।ওরা প্রতিবছরই পূজা-পার্বনে ভারতে চলে যায়।রশ্নী যখন ওর পারিবারিক ইতিহাস আর সদস্যদের নিয়ে ভাবছে,তখন ওর কানে আসে কথাগুলো।

"শুনেছিস?পূজার মুখাগ্নি তো দাদা করে নাই,রাজীব করছে!"
"করবে না?যেই মেয়ে বেঁচে থাকতেই অমন কান্ড করে বসে,সেই মেয়ে মরে গেলেও বা কি আসে যায়!"
"কি বলিস তুই! পূজাকে দাদা কেমন আদর করত ভুলে গেছিস?পূজাকে শিখার চাইতে বেশি কাছে কাছে রাখত।আর এখন সেই মেয়েকে মুখাগ্নি দিবে না,এ কোন কথা না!"
"বাদ দাও তো!ঐ অলুক্ষুণে মেয়ের জন্মটাই খারাপ ছিল।মনে আছে ওর জন্মের পরে বৌদি কেমন মরণ অসুখে পড়ল?মরণ অসুখ তো হওয়া দরকার ছিল এই মুখপুরীর।ওর হত,ও মরত,তাহলে ওদের আজকের দিন দেখতে হত না!"
"শোন,পূজা এমন ভুল করত না যদি রাজীব ওকে এসবে বাঁধা দিত বা বোঝাত।রাজীবটাই তো ওকে জোর করেছে দুদিন,আমি সাক্ষী! দাদাও তখন কিছু বলেনি।আর এখন একেবারে ঘেন্না উপচে উঠছে,না? তোরা সব এক জাতের!"
"বাব্বাহ,আমায় টানছো কেন গো? যাকগে,অলক্ষী গেছে,বাচ্চাটাও গেছে।ওহ ভগবান,এই বাড়িটাকে বাঁচাও তুমি!"

রশ্নী সব শুনে তীক্ষ্ণ চোখে দুই নারীকে লক্ষ্য করে,এরা নিজেদের মাঝে ফিসফিস করতে ব্যস্ত।এই মহিলাগুলো নিশ্চিত জানে বাচ্চাটার কি হয়েছে,কিন্তু ওদের তো জিজ্ঞাসা করা যাবে না।নাকি একটা চেষ্টা করে দেখবে?ভাবতে ভাবতে ওদের দিকে আরেকটু ঘেঁষে দাঁড়ায় রশ্নী।মুখ খুলতে গিয়েই কাঁধে কারো স্পর্শ পায়।পেছন ঘুরে দেখে একটা মেয়ে ওর দিকে কুঞ্চিত ভ্রু দিয়ে তাকিয়ে আছে।রশ্নীকে ঘুরে তাকাতে দেখে সে বেশ নিচু তবে স্পষ্ট কন্ঠে বলে,

"একটু ওদিকে আসবেন?"

রশ্নীর বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে।মেয়েটা কি টের পেয়ে গেছে যে ও বাইরের কেউ? রশ্নী অবশ্য এ জাতীয় অনেক পরিস্থিতিতে পড়েছে,তাই এটাও জানে কি করে এখান থেকে বের হতে হবে।চেহারা স্বাভাবিক রেখে রশ্নী মেয়েটার পিছু নেয়।ওর বয়স বেশি হবে না,পনের বা ষোল হবে হয়ত।কিন্তু এভাবে ডাকছে কেন?ধৈর্য্য ধরে চুপচাপ পিছু পিছু আসে।রশ্নীকে নিয়ে মেয়েটা বাড়ির দোতলার একটা ঘরে নিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়।বুকের উপর আড়াআড়িভাবে হাত রেখে বলে,
"আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!আপনি দিদির কি হোন?কোত্থেকে এসেছেন?"
রশ্নী বুঝতে পারে এ শিখা।সবার সাথে সাথে ওর ব্যাপারেও সব তথ্য জেনে এসেছে।ওর উত্তরটাও তৈরি ছিল।
"আমি ওর বান্ধবী রুবির বড় বোন।রুবি আসতে পারেনি,তাই আমিই এসেছি।সত্যি বলতে এরকম একটা ঘটনা...খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত... পূজার জন্য আমার খুব খারাপ..."

হাত তুলে ও রশ্নীকে থামায়।
"দিদির এটাই পরিণতি হওয়ার ছিল।দিদিকে নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কিছুই নেই,নিজেই নিজেকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে।এখন এতে কারো দুঃখ প্রকাশে কিছু আসে যায় না"
"ঠিক আছে,কিন্তু তাই বলে আত্মহত্যা কোন সমাধান তো নয়! একটা মানুষ কখনো শখ করে মরতে চায় না,পৃথিবীকে সে অনেক ভালোবাসে।যখন তার পৃথিবী আর তাকে ভালোবাসে না,তখন সে মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেয়।এখন আত্মহত্যাকারী স্বেচ্ছায় মরে না,তাকে আশেপাশের পরিবেশ উদ্বুদ্ধ করে মরে যেতে।তাছাড়া মানসিক অবস্থা বুঝে সাপোর্ট পেলে হয়ত আজ পূজা বেঁচে থাকত,হয়ত ওর বাচ্চাটাও বেঁচে থাকত..."
শিখা জ্বলে ওঠে,
"থামেন!কি করলে কি হত তা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই।আর বাচ্চা কোত্থেকে আসল?যে নেই তার কথা বলে লাভ কি?ও তো পৃথিবীর মুখই দেখেনি!"
"সত্যিই কি দেখেনি?তুমি কি ঠিক বলছ?"

এক চিলতে শিখার মুখের আগুন দপ করে নিভে যায়,মুখের রগগুলো ফর্সা গালে আরও ফুটে উঠেছে।পরমুহূর্তেই বেশ জোর গলায় প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে,
"আপনি তো মিথ্যা বলেছেন আমাকে!"
"কি মিথ্যা??"
"আপনি রুবির বড় বোন না!"
"কি বলছ! তুমি না জেনে এ কথা তো বলতে পার না!"
"পারি,কারণ আমি জানি আমি সত্য।তার প্রমাণ হল,রুবি নামে দিদির কোন বান্ধবী ছিল না।আর আপনার নাম রশ্নী আবরার,ক্রাইম রিপোর্টার।কি,চমকে গেছেন?আমি তো ভুল বলিনি,তাই না?"

শিখার দুচোখে দপদপিয়ে আগুন জ্বলছে,আর রশ্নীর বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে।ও এখন কি করবে?শিখা যদি অন্য সবাইকে বলে দেয়?এই মেয়ে ওর ব্যাপারে জানেও বা কতটুকু???

ভাবনার মোড় ঘোরার আগেই শিখা বলে,
"দিদিকে নিয়ে কোন প্রকার ক্রাইম রিপোর্ট এখানে চলবে না।বাবা আর দাদার হাত অনেক দূর পর্যন্ত,কত দূর পর্যন্ত তা আপনার ধারণাও নেই।আপনার মত এরকম বহু সাংবাদিক তাদের পকেটে থাকে,কেনা বেচা করে।আপনি দয়া করে আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না শুধু নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে! সাবধান হয়ে যান!"

রশ্নী এতটা বিস্মিত যে রেগে যেতে ভুলে যায়।এই বয়সের একটা মেয়ে অথচ কি কথার টোন!পরিবারের সবাই যে কতটা নির্দয়,তা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।রশ্নী দৃঢ় কন্ঠে বলে,
"শোনো মেয়ে,তুমি হচ্ছো আমার হাঁটুর বয়সী।তোমার বাবা বা দাদা কার কি ক্ষমতা তা আমার ভালোই জানা আছে।আর এটাও জেনে রেখো,তোমাদের কারো আমার ব্যাপারে ধারণা নেই।থাকলে কেনার কথা বলতে দশবার ভাবতে!আমাকে কিনেছে এই সাধ্য এই পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরও নেই! আর সেখানে তুমি ভাবছ আমি ক্রাইম রিপোর্ট বানিয়ে লোক খাওয়ানোর ধান্ধায় এখানে এসেছি?? ভুল! আমি সত্য জানতে এসেছি।আর আমি চ্যালেঞ্জ করে গেলাম তোমায়, পূজা আর ওর সন্তান হত্যা রহস্য আমি সমাধান করেই ছাড়ব।পারলে আটকিও!"

কথাগুলো বলে শক্তমুখে রশ্নী স্থান ত্যাগ করে।এই বাসায় ওর আপাতত কিছু দেখার নেই,বলার নেই,বোঝার নেই।তবে সমস্যা হয়ে গেল।রশ্নী না চাইলেও শত্রুপক্ষের মুখোমুখি হয়ে গেছে ও।এখন যা হবে,সরাসরিই হবে!

গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয়।যাবার আগে চোখে পড়ে,দোতলার ব্যালকনিতে শিখা দাঁড়িয়ে আছে,এক দৃষ্টিতে ওকে দেখছে।শত্রু পক্ষ নিশ্চয়ই পরবর্তী পদক্ষেপ খুব দ্রুতই ফেলবে।কি হতে পারে?

চলবে...

লেখনীতে, #AbiarMaria

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top